৩ নারী জঙ্গি মানারাতের, ঢাকা মেডিকেলের একজন

ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির চার সদস্যকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করেছে, যারা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলের ছাত্রী।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 August 2016, 10:32 AM
Updated : 16 August 2016, 12:44 PM

এরা হলেন- মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের ছাত্রী আকলিমা রহমান, মৌ ও মেঘনা এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষানবিশ চিকিৎসক ঐশী।

র‌্যাব-৪ এর সিপিসি ১ এর অধিনায়ক মেজর সাইদ বলছেন, আটকদের মধ্যে আকলিমা জেএমবির নারী বিভাগের উপদেষ্টা, অন্যরা তার সহযোগী।

গত ২১ জুলাই জেএমবির ‘দক্ষিণাঞ্চলীয় আমীর’ মো. মাহমুদুল হাসান ওরফে হাসানকে (২৭) টঙ্গী থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছ থেকে কয়্জেন নারীর এ দলে যুক্ত থাকার তথ্য পাওয়া যায় বলে র‌্যাব কর্তকর্তারা জানান।

র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি লুৎফুল কবির মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, হাসানের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধানে তারা জানতে পারেন, আকলিমা রহমান নামে জেএমবির এক নারী সদস্য রমজান মাসে ১২ হাজার টাকার তহবিল সংগ্রহ করে দিয়েছেন। এরপর তাকে গোয়েন্দা নজরদারিতে নেওয়া হয়।

“বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি আকলিমা আরবি শিক্ষার কথা বলে বিভিন্ন এলাকায় জনসংযোগ করতেন। তার সঙ্গে অনেকেই সাক্ষাত করতেন। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে গাজীপুরের সাইনবোর্ড এলাকা থেকে সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।”

আকলিমার মোবাইল ফোন থেকে জঙ্গি কর্মকাণ্ডের ‘অনেক তথ্য’ পাওয়া গেছে বলেও র‌্যাবের ভাষ্য।

লুৎফুল কবির বলেন, “আকলিমা প্রায় দেড় বছর ধরে কথিত ওই জিহাদী দলটির সঙ্গে সম্পৃক্ত। কথিত ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য দলকে বড় করা এবং সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তিনি তহবিল সংগ্রহ করে মাহমুদুল হাসানকে পৌঁছে দিতেন।”

আকলিমা রহমান

প্রাথমিক শিক্ষা ঢাকার রেনেসাঁ প্রি-ক্যাডেট হাই স্কুল ও সাইনবোর্ড এলাকার হাজী আহাম্মদ আলী পাবলিক স্কুলে।

উত্তরা হাই স্কুল থেকে ২০১০ সালে এসএসসি এবং হলি চাইল্ড কলেজ থেকে ২০১২ সালে এইচএসসি পাশ করেন। ২০১৩ সালে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া এই তরুণী পড়ছিলেন ফার্মাসি বিভাগের চতুর্থ বর্ষে।

ঐশি

চিকিৎসক বাবা মায়ের সন্তান ঐশী ২০১০ সালে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। চলতি বছর জানুয়ারিতে এমবিবিএস শেষ করে জুন মাসে তিনি ইন্টার্নশিপ শুরু করেন।

ঐশীর বাবা ডা. বিশ্বাস আক্তার হোসেন (৫৮) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক। আর মা ডা. নাসিমা সুলতানা (৪৮) আছেন সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগে।

মৌ

মিরপুর-২ এর ইসলামীয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালে এসএসসি ও মিরপুর চিড়িয়াখানা রোডের বিসিআইসি কলেজ থেকে ২০১২ সালে এইচএসসি পাস করেন মৌ। মেডিকেল ও ইউনিভার্সিটি ভর্তির জন্য তিনি ইউসিসির ফার্মগেইট শাখায় কোচিং করেন। পরে ২০১৩ সালে ভর্তি হন মানারত ইউনিভার্সিটির ফার্মাসি বিভাগে।

মেঘনা

ঢাকার আহম্মদনগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১১ সালে এসএসসি ও ঢাকা ক্যামব্রিয়ান কলেজ থেকে ২০১৩ সালে এইচএসসি পাস করেন মেঘনা। ওই বছরই পারিবারিকভাবে তার বিয়ে হয়। মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী তিনি।

জিজ্ঞাসাবাদে আকলিমা র‌্যাবকে জানান, তার যোগানো ১২ হাজার টাকার মধ্যে আট হাজার টাকা দিয়েছেন ঐশী, যিনি প্রায় তিন বছর ধরে প্রত্যক্ষভাবে এ দলে জড়িত।

ওই তথ্যের ভিত্তিতে সোমবার রাতে মগবাজার এলাকা থেকে ঐশীকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তার ল্যাপটপে ‘উগ্র মতবাদ সংক্রান্ত বিভিন্ন ফাইল, ম্যাগাজিন, লেকচার ও ভিডিও’ পাওয়া যায় বলে র‌্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, আকলিমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তারা মৌয়ের নাম জানতে পারেন, যিনি সাত মাস ধরে এ দলে যুক্ত। মৌকে আটক করা হয় মিরপুর-১ এর জনতা হাউজিং থেকে।

এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে র‌্যাব জানায়, মৌয়ের বাসায় অভিযান চালানোর সময় তিনি তার মোবাইল ফোনের মেমোরি কার্ড ‘ধ্বংস’ করে ফেলেন। তার ল্যাপটপে ‘জিহাদি কর্মকাণ্ডের দলিল’ পাওয়া যায়; বাসায় পাওয়া যায় উগ্র মতবাদের বই।

পরে মৌয়ের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জনতা হাউজিংয়ের একটি মেস থেকে মেঘনাকে আটক করা হয় বলে জানানো হয় ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।

এর আগে গত জুলাই মাসে সিরাজগঞ্জ এবং টাঙ্গাইল থেকে জেএমবির সাত নারী সদস্যকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল অস্ত্র, বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জাম এবং উগ্র মতবাদের বই।

টাঙ্গাইলে গ্রেপ্তার তিনজন জেএমবির আত্মঘাতী দলের সদস্য বলেও সে সময় পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল।

গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলাসহ বাংলাদেশে সাম্প্রতিক উগ্রপন্থিদের বিভিন্ন নাশকতার ঘটনায় জেএমবিকেই দায়ী করে আসছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। ওই দুই ঘটনা এবং কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় নিহত জঙ্গিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলেন বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, যারা বাড়ি পালিয়ে জঙ্গিবাদে জড়ান বলে পরে তথ্য বেরিয়ে আসে।    

গত কয়েক মাস ধরে নিখোঁজদের তালিকায় যারা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নারীও রয়েছেন। তবে কোনো বিশ্ববিদ‌্যালয় ছাত্রীর জঙ্গিবাদে জড়ানোর তথ‌্য এল এই প্রথম।

মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

গ্রেপ্তার চার তরুণীর তিনজন যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, সেই মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গোড়াপত্তন হয়েছিল ১৯৭৯ সালে, মানারাত ট্রাস্টের অধীনে গুলশানে মানারাত ঢাকা নামে ইসলামী ভাবধারার কিন্ডার গার্টেন স্কুল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।

যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা মানারাত ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা সচিব ছিলেন বলেন ট্রাব্যুনালে প্রসিকিউশনের উপস্থাপনে বলা হয়।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্ট্রির চেয়ারম্যান জামায়াতঘনিষ্ঠ সাবেক আমলা শাহ আবদুল হান্নান। সদস্য হিসেবে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. চৌধুরী মাহমুদ হাসান, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যও।

সদস্যদের মধ্যে আরও আছেন ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবু নাসের মোহাম্মদ আব্দুজ জাহের, যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম এলাকায় আল বদর বাহিনীর নেতা ছিলেন বলে ইসলামী ঐক্যজোট নেতাদের অভিযোগ।

তিনি ইবনে সিনা ট্রাস্টের সদস্য এবং ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মানারাত কিন্ডার গার্টেন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও ছিলেন।

ওই স্কুলটিই পড়ে ১৯৮৫ সালে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল কলেজ এবং সব শেষ ১৯৯১ সালে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে রূপ নেয়।