পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, নিহতদের একজন নারী, অন্যজন পুরুষ। দুজনেরই বয়স ত্রিশের কোঠায়। তবে তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
নিহত দুজন ‘নব্য জেএমবির’ সদস্য এবং ওই বাড়িতে অবস্থান নিয়ে তারা ‘নাশকতার পরিকল্পনা’ করছিল বলে এই পুলিশ কর্মকর্তার ধারণা।
ভগীরথপুরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দুইশ মিটারের মধ্যে পাঁচতলা ওই বাড়ির পাশাপাশি মাধবদীতে সাত তলা একটি বাড়ি ঘিরে সোমবার রাত ৯টার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই অভিযান শুরু হয়।
সব প্রস্তুতি শেষে মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ভগীরথপুরের ‘জঙ্গি আস্তানায়’ শুরু হয় সোয়াটের চূড়ান্ত অভিযান ‘অপারেশন গর্ডিয়ান নট’।
বেশ কিছু সময় গোলাগুলির পর বিকাল ৪টার পর মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের সামনে এসে দুইজনের লাশ পাওয়ার কথা জানান।
পাঁচ তলা ওই ভবনের পঞ্চম তলায় অভিযান শেষে একটি আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া গেছে এবং চারটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে বলে জানান মনিরুল।
তিনি বলেন, “ওখানে তারা চারটি বোমা তৈরি করে রেখেছিল। তো থেকেই আমরা বুঝতে পারি যে তাদের কোনো পরিকল্পনা ছিল। কোনো বড় ধরনের নাশকতার প্রস্তুতি তাদের ছিল।"
ভগীরথপুরের এ বাড়ি থেকে মোটামুটি দুই কিলোমিটার দূরত্বে মাধবদীর ছোট গদাইরচরের যে বাড়িটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘিরে রেখেছে, সেখানেও ‘একাধিক জঙ্গি’ থাকার তথ্য রয়েছে পুলিশের কাছে।
সেখানে সোয়াট অভিযান চালাবে কি না জানতে চাইলে মনিরুল বলেন, “আমরা তাদেরকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানাব। যদি আত্মসমর্পণ করে তাহলে অভিযান চালানোর প্রয়োজন হবে না। আর অভিযান কখন চালানো হবে সে বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। "
ভগীরথপুর ও মাধবদীর দুই বাড়ির ‘জঙ্গিদের’ মধ্যে ‘সংশ্লিষ্টতা’ আছে বলেও তথ্য পাওয়ার কথা জানান কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান।
মাধবদী পৌরসভার ছোট গদাইরচরের সাত তলা নিলুফা ভিলার মালিক হাজী মো. আফজাল হোসেন নামের এক ব্যক্তি। ভবনটির প্রথম থেকে তৃতীয় তলা পর্যন্ত রয়েছে মিফতাহুল জান্নাহ মহিলা মাদ্রাসা। ওই ভবনের পঞ্চম তলার একটি ফ্ল্যাটে জঙ্গিরা অবস্থান করছে বলে পুলিশের ধারণা।
আর মেহেরপাড়া ইউনিয়নের ভগীরথপুরে পাঁচ তলা বাড়িটির মালিক বিল্লাল হোসেন নামের এক কাপড় ব্যবসায়ী। ওই ভবনে অভিযান শেষে পঞ্চম তলায় ফ্ল্যাট থেকে সন্দেহভাজন দুই জঙ্গির লাশ পাওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ।
দুটি বাসাই এ মাসের ৭ তারিখে ভাড়া নেওয়া হয়েছে বলে বাড়ির মালিকদের পক্ষ থেকে পুলিশকে জানানো হয়েছে।
নরসিংদীর পুলিশ সুপার সাইফুল্লাহ আল মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, জঙ্গিদের অবস্থানের খবর পেয়ে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট ও পুলিশ সদরদপ্তরের ল ফুল ইন্টারসেপশন সেলের (এলআইসি) সদস্যরা সোমবার রাত ৯টার দিকে ওই দুই বাড়ি ঘিরে ফেলে।
পরে র্যাব তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। মঙ্গলবার ভোরে সোয়াট সদস্যরা নরসিংদীতে পৌঁছান। সকালে আসেন বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের সদস্যরা। ভগীরথপুরে শুরু হয় অভিযানের প্রস্তুতি।
সকালে দুই বাড়ির গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি এনে রাখা হয় দুই বাড়ির কাছাকাছি। একদল চিকিৎসককেও ভগীরথপুরের বাড়ির কাছে রাখা হয়।
সকাল সাড়ে ৯টার পরে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি আবদুল্লাহ আল মামুন এবং কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান মনিরুল ইসলাম ঘটনাস্থলে আসেন।
মনিরুল সে সময় সাংবাদিকদের বলেন, ভগীরথপুরের ওই বাড়িতে একাধিক জঙ্গি আছে বলে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। তাদের কাছে কী ধরনের অস্ত্র বা বিস্ফোরক থাকতে পারে সে বিষয়েও ধারণা পেয়েছেন। সোয়াট অভিযান শুরুর আগে তারা ‘জঙ্গিদের’ সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন, যাতে তারা আত্মসমর্পণ করে।
সন্দেহভাজন জঙ্গিরা পুলিশের আহ্বানে ‘সাড়া না দেওয়ায়’ সোয়াট সদস্যরা অভিযান শুরুর প্রস্তুতি নেন। এরপর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ওই বাড়ির দিক থেকে থেমে থেমে গুলির শব্দ আসতে থাকে।
এই অভিযানের মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হন পুলিশ মহাপরিদর্শক জাবেদ পাটোয়ারী। তিনি জানান, সোয়াটের এই জঙ্গিবিরোধী অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন গর্ডিয়ান নট’।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, "ভেতরে একাধিক লোক অবস্থান করছে। আমাদের সদস্যরা তাদেরকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু তারা সাড়া দেয়নি। নানাভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু এ ভবনের জঙ্গিরা আমাদের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। যে কারণে এই অভিযানটা একটু কঠিন হচ্ছে। আমাদের সদস্যদের লক্ষ্য করে জঙ্গিরা গুলি চালিয়েছে। পুলিশও গুলি চালিয়েছে। এখানে অভিযান শেষ হলে মাধবদীর ওই বাড়িতে অভিযানের প্রস্তুতি নেওয়া হবে।"
বক্তব্য শেষে বেলা আড়াইটার দিকে ঢাকায় ফিরে যান আইজিপি। বিকাল ৪টার পর কাউন্টার টেরোরিজমের মনিরুল ভগীরথপুরের অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
এর আগে গত ৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক লাগোয়া এক বাড়িতে র্যাবের অভিযানে গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের পর দুই জনের ছিন্নভিন্ন লাশ পাওয়া যায়।
প্রায় আট ঘণ্টার ওই অভিযান শেষে সেখান থেকে তিনটি পিস্তল, একটি একে-২২ রাইফেল ও বোমা ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।