ইউএস-বাংলার পাইলট ছিলেন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, বেপরোয়া: কাঠমান্ডু পোস্ট

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের পাইলট আবিদ সুলতান ‘ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে মারাত্মক মানসিক চাপ ও উদ্বেগের’ মধ্যে ছিলেন এবং ওই অবস্থায় তিনি একের পর এক যেসব ‘ভুল সিদ্ধান্ত’ নিয়েছেন, তার পথ ধরেই গত মার্চে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট বিএস-২১১ বিধ্বস্ত হয় বলে এক তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসার কথা জানিয়েছে নেপালের ইংরেজি দৈনিক কাঠমান্ডু পোস্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 August 2018, 06:28 AM
Updated : 27 August 2018, 03:34 PM

ওই দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে নেপাল সরকারের গঠিত তদন্ত কমিশনের ওই প্রতিবেদনের অনুলিপি হাতে পাওয়ার কথা জানিয়ে কাঠমান্ডু পোস্ট লিখেছে, পাইলট আবিদ সুলতান ত্রিভুবনে নামার প্রস্তুতির সময় বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ‘অসত্য’ তথ্য দিয়েছিলেন; এক ঘণ্টার ওই পুরো ফ্লাইটে তিনি ককপিটে বসেই ধূমপান করছিলেন।  

ঢাকা থেকে ৬৭ জন যাত্রী ও চারজন ক্রু নিয়ে রওনা হয়ে গত ১২ মার্চ দুপুরে কাঠমান্ডুতে নামার সময় দুর্ঘটনায় পড়ে ইউএস-বাংলার ফ্লাইট বিএস-২১১।  আরোহীদের মধ্যে ৫১ জনের মৃত্যু হয়, যাদের ২৭ জন ছিলেন বাংলাদেশি।

কাঠমান্ডু পোস্ট লিখেছে, ফ্লাইটের পুরো সময়টায় প্রধান বৈমানিক আবিদের আচরণ তার স্বাভাবিক চরিত্রের সঙ্গে ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না’, এ বিষয়টি আগেই নজরে আনা উচিৎ ছিল বলে নেপালি তদন্তকারীদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।  

তবে ওই তদন্ত দলে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে থাকা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) ফ্লাইট অপারেশন কনসালটেন্ট সালাউদ্দিন এম রহমতউল্লাহ কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদনটি ‘ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।

কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদনটি দেখেছেন জানিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এটা সম্পূর্ণ ভূয়া ও মিথ্যা তথ্য। এমন কোনো কিছুই এখনো তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসেনি।”

ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান (ফেইসবুক থেকে নেওয়া ছবি)

আর ইউএস বাংলার মার্কেটিং সাপোর্ট অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের জিএম মো. কামরুল ইসলামের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদনে ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান সম্পর্কে কিছু ‘মনগড়া তথ্য দেওয়া হয়েছে যা ভিত্তিহীন’ বলে মনে করে এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ।

“আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী যে কোনো দুর্ঘটনা পরবর্তী পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার আগ পর্যন্ত এ ধরনের অসমর্থিত মতামত প্রকাশ কোনো গণমাধ্যমের কাছেই কাম্য নয়।” 

তদন্ত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে নেপালি পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, অবতরণের সময়ের ছয় মিনিট আগে পাইলট আবিদ সুলতান ত্রিভুবনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষকে তার উড়োজাহাজের ল্যান্ডিং গিয়ার নামানো ও লক করার কথা জানিয়ে বলেন- “গিয়ারস ডাউন, থ্রি গ্রিনস।”

কিন্তু ওই ফ্লাইটের কো-পাইলট পৃথুলা রশিদ যখন অবতরণের আগে শেষবারের মত সব প্রস্তুতি মিলিয়ে দেখেন, তখন দেখা যায় ল্যান্ডিং গিয়ার তখনও নামানো হয়নি। এর কয়েক মিনিটের মাথায় ড্যাশ-৮ কিউ৪০০ মডেলের উড়োজাহাজটি রানওয়ের একপাশে বিধ্বস্ত হয় এবং অগ্নিকূণ্ডে পরিণত হয়।   

শতাধিকবার ত্রিভুবন বিমানবন্দরে অবতরণের অভিজ্ঞতা যার রয়েছে, সেই আবিদ সুলতানের পরিচালনায় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজটি কীভাবে বিধ্বস্ত হল, সে প্রশ্ন উঠেছিল আগেই।

ওই দুর্ঘটনার এক মাসের মাথায় নেপালি তদন্ত কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হওয়ার আগে পাইলটের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের (এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল) যোগাযোগ ‘স্বাভাবিক ছিল না’।

সেদিন সকাল থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে একাধিক ফ্লাইট পরিচালনা করার পর আবিদ সুলতান যখন দুপুরে নেপালে গেলেন, তখন তিনি ক্লান্ত বা অবসাদগ্রস্ত ছিলেন কি না- সে প্রশ্ন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সে সময় আলোচনা হয়।

আবিদ অন্য চাকরি পেয়ে ইউএস-বাংলা থেকে অব্যাহতি চেয়েছিলেন এবং কাঠমান্ডুতে যেতে না চাইলেও তাকে মতের বিরুদ্ধে পাঠানো হয়েছিল- এমন কথাও সে সময় আসে।

তবে বেসরকারি বিমান পরিবহন সংস্থা ইউএস-বাংলার পক্ষ থেকে সে সময় দাবি করা হয়,পাইলট আবিদ সুলতান ‘অবসাদগ্রস্ত’ ছিলেন না। তিনি চাকরি থেকে অব্যাহতি চাননি এবং মতের বিরুদ্ধেও তাকে পাঠানো হয়নি। 

বরং দুর্ঘটনার আগে নেপালের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল থেকে পাইলটকে ‘বিভ্রান্তিকর নির্দেশ’ দেওয়া হয়েছিল বলেও অভিযোগ করেছিলেন ইউএস বাংলার কর্মকর্তার।

ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র আবিদ এক সময় বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ছিলেন। বাহিনীতে তিনি একজন ‘ব্রাইট অফিসার’ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন বলে পরিচিতজনদের ভাষ্য।

ইউএস বাংলার কর্মকর্তারা বলে আসছেন, আবিদ সুলতানের সাড়ে ৫ হাজার ঘণ্টা ফ্লাইট চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল এবং তিনি ড্যাশ ৮-কিউ৪০০ চালিয়েছেন ১৭০০ ঘণ্টার বেশি। ওই দুর্ঘটনায় পাইলটের কোনো দায় ছিল না বলেই তাদের বিশ্বাস।

কাঠমান্ডু পোস্ট লিখেছে, দুর্ঘটনার দিন ঢাকা-কাঠমাণ্ডু ফ্লাইটের ককপিট বসে বার বার ধূমপান করেন আবিদ। কিন্তু তিনি কখনো ধূমপানের অভ্যাসের কথা ইউএস বাংলা কর্তৃপক্ষের কাছে বলেননি। এ থেকে তদন্তকারীরা ধারণা করছেন, ককপিটে বড় ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে ছিলেন পাইলট।       

“ককপিটের ভয়েস রেকর্ডার পরীক্ষা করার পর আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে, ক্যাপ্টেন বড় ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে ছিলেন। ঘুমের অভাবে তিনি ক্লান্ত ও অবসাদগ্রস্ত ছিলেন বলেও মনে হয়েছে।”   

নেপালের পত্রিকাটি লিখেছে, প্রায় এক ঘণ্টার ওই ভয়েস রেকর্ডে কো-পাইলট পৃথুলার সঙ্গে কথোপকথনে পাইলট আবিদের মানসিক অস্থিরতা এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে তার অসতর্কতার বেশ কিছু নমুনা পাওয়া গেছে।

“এছাড়া তিনি এক নারী সহকর্মীর বিষয়েও বেশ কিছু ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য করেন, যিনি ইউএস-বাংলাতেই কো পাইলট হিসেবে কাজ করেন। ওই নারী সহকর্মী ইনসট্রাক্টর হিসেবে আবিদের সুনাম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাদের মধ্যে সম্পর্ক কেমন ছিল, সেই আলোচনা ছিল ফ্লাইটের সময়ের একটি বড় অংশ জুড়ে। ওই ফ্লাইটের কো পাইলট পৃথুলা ছিলেন আবিদের গল্পের একজন নীরব শ্রোতা।”       

আবিদ সুলতান (বাঁয়ে); ছবিটি ফেইসবুক থেকে নেওয়া

প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই আলোচনার এক পর্যায়ে আবিদ অনেকটাই ভেঙে পড়েন এবং বলেন, সেই নারী সহকর্মীর আচরণে তিনি খুবই আহত হয়েছেন এবং কেবল তার কারণেই তিনি কোম্পানি ছেড়ে দিচ্ছেন। 

নেপাল এয়ারলাইন্সের একজন বৈমানিককে উদ্ধৃত করে পত্রিকাটি লিখেছে, ফ্লাইট উড্ডয়ন বা অবতরণের প্রস্তুতির সময় ককপিটে সহকর্মীদের মধ্যে ব্যক্তিগত আলোচনা পুরোপুরি নিষিদ্ধ। ওই সময় পাইলটের পুরো মনোযোগ উড়োজাহাজ চালনায় নিবদ্ধ করার নিয়ম।   

তদন্ত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে কাঠমান্ডু পোস্ট লিখেছে, ক্যাপ্টেন আবিদকে চাকরি দেওয়ার সময় ইউএস-বাংলা তার আগের মেডিকেল হিস্ট্রি পর্যালোচনা করেনি। আর ২০০২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে কোনো মেডিকেল পরীক্ষায় তার হতাশা বা অবসাদে ভোগার কোনো তথ্য কখনও আসেনি। 

তবে আবিদের মেডিকেল পরীক্ষার প্রতিবেদনে তার ধূমপানের অভ্যাস নিয়ে ‘অসঙ্গতি’ রয়েছে বলে তথ্য দিয়েছে কাঠমান্ডু পোস্ট।

তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মেডিকেল পরীক্ষার সময় পূরণ করা ফরমে আবিদ বলেছেন, তিনি কখনোই ধূমপান করেননি। ২০১৫ সালে লিখেছেন, তিনি একসময় ধূমপান করলেও ২০১০ সালে ছেড়ে দিয়েছেন। আবার ২০১৬ ও ২০১৭ সালে লিখেছেন, তিনি কখনোই ধূমপান করেননি।