নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সঙ্গে পাইলটের কথোপকথনের একটি অডিও ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য এসেছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ও ত্রিভুবন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।
ঢাকা থেকে ৭১ জন আরোহী নিয়ে কাঠমান্ডুতে নামার সময় ইউএস-বাংলার ড্যাশ-৮ কিউ৪০০ মডেলের উড়োজাহাজটি সোমবার দুপুরে বিধ্বস্ত হয়। ওই ফ্লাইটের আরোহীদের মধ্যে অন্তত ৪৯ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নেপালের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ডিজি সঞ্জীব গৌতম নেপালের সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, উড়োজাহাজটি ত্রিভুবনে নামার কথা ছিল রানওয়ের দক্ষিণ দিক দিয়ে। কিন্ত সেটি নামার চেষ্টা করে উত্তর দিক দিয়ে। এই অস্বাভাবিক অবতরণের কারণ এখনও তারা জানেন না।
অন্যদিকে ইউএস-বাংলার সিইও ইমরান আশিফ ঢাকায় এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে অভিযোগ করেন, নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ‘বিভ্রান্তিকর বার্তার’ কারণে ইউএস বাংলার বিমান দুর্ঘটনায় পড়েছে বলে তারা সন্দেহ করছেন।
“গাফিলতিটা আমাদের পাইলটের দিক থেকে না। এটা এটিসি টাওয়ারের দিক থেকে। আমরা এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে এটা বলছি না। তবে আমরা সন্দেহ করছি।”
নেপালি কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে বিএস ২১১ এর ব্ল্যাকবক্স উদ্ধার করেছে। দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে সেখানে তদন্ত কমিটি হলেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জেল হোসেন চৌধুরী মায়া সন্ধ্যায় ইউএস বাংলার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “নেপালের টাওয়ার নাকি বাংলাদেশের কারও কারণে দুর্ঘটনা ঘটল, তা তদন্ত করতে বিমান মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করব।”
আর বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এম নাঈম হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে দেশে দুর্ঘটনা ঘটে, সাধারণত সেদেশের সিভিল এভিয়েশনই দুর্ঘটনার কারণ খুঁজে বের করে। ইউএস বাংলার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, এখানে আমাদের কোনো সহায়তার দরকার হলে আমরা করব।”
কথোপকথন
বিএস ২১১ এর ককপিটে শেষ মুহূর্তে কী ঘটেছিল- নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ও পাইলটের কথোপকথন থেকে তা বোঝার চেষ্টা করেছেন নেপালের সাংবাদিক কনক মনি দিক্ষিত।
নেপাল টাইমসে এক প্রতিবেদনে তিনি লিখেছেন, ওই চার মিনিটের কথা শুনলে মনে হয়, কোন দিক দিয়ে রানওয়েতে নামতে হবে তা নিয়ে পাইলটের মধ্যে হয়ত বিভ্রান্তি কাজ করছিল।
ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে দক্ষিণ অংশের নাম রানওয়ে ০২; আর উত্তর অংশকে বলা হয় রানওয়ে ২০।
“বমবার্ডিয়ার উড়োজাহাজটি যখন এগিয়ে যাচ্ছিল, অন্য উড়োজাহাজের নেপালি পাইলটরা শুনতে পান, এটিসি থেকে ইউএস বাংলার পাইলটকে হুঁশিয়ার করা হচ্ছে যে, তাকে কিছুটা বিভ্রান্ত মনে হচ্ছে এবং তার উচিত রাডার অনুসরণ করা। ”
কনক মনি দিক্ষিত লিখেছেন, দুর্ঘটনার মিনিট চারেক আগে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে ওই অডিওতে বলতে শোনা যায়, সে যেন রানওয়ে ২০ এর দিকে না যায়। পরে তাকে বলা হয়, সে যেন অবতরণ না করে, কারণ আরেকটি উড়োজাহাজ নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বিএস ২১১ ডান দিকে ঘুরতে শুরু করলে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ পাইলটের কাছে জানতে চায়, তিনি কোন দিক দিয়ে নামতে চান- রানওয়ে ০২, না রানওয়ে ২০।
নিয়ন্ত্রণ কক্ষ এরপর জানতে চায়, পাইলট রানওয়ে ঠিকমত দেখতে পাচ্ছেন কি না। তিনি ‘নেগেটিভ’ বললে তাকে ডান দিকে ঘোরার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পাইলট বলেন- ‘অ্যাফারমেটিভ’, অর্থাৎ তিনি রানওয়ে দেখতে পাচ্ছেন।
কনক মনি দিক্ষিত লিখেছেন, ওই সময়ে পাইলট বলে ওঠেন তিনি রানওয়ে ০২ এ নামতে যাচ্ছেন, যদিও এর আগে তিনি উল্টো দিকে নামার অনুমতি চেয়ে আসছিলেন।
নিয়ন্ত্রণ কক্ষ এরপর তাকে রানওয়ে ০২ এ নামার অনুমতি দেয়। একই সময়ে দশ কিলোমিটার দূরে থাকা একটি সামরিক বিমানকে এটিসি থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশি উড়োজাহাজটি রানওয়ে ২০ এ নামতে যাচ্ছে।
ওই রেকর্ডে ইউএস-বাংলার পাইলটের শেষ বাক্য ছিল- “আমরা কি নামার অনুমতি পেয়েছি?”
কিছু সময় নীরবতার পর নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে উদ্বিগ্ন চিৎকার শোনা যায়- ‘আমি আবার বলছি, ঘোরাও…।
কনক মনি দিক্ষিত লিখেছেন, এরপর আরও কিছুক্ষণ নীরবতা পেরিয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে অগ্নি সংকেত বাজতে শুরু করে। এর মানে হল, উড়োজাহাজটি দুর্ঘটনায় পড়েছে এবং বিমানবন্দরের অগ্নি নির্বাপণী সংকেত চালু হয়েছে।
এরপর একজন নেপালি পাইলট জানতে চান, রানওয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে কি না। নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানায়, রানওয়ে বন্ধ।
তদন্ত করছে ইউএস-বাংলা
ইউএস-বাংলার সিইও ইমরান আশিফ সন্ধ্যায় কোম্পানির কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “ওই কথপোকথন শুনলেই বুঝবেন… এটিসির পক্ষ থেকে একটা ভুল বার্তা দেওয়ার বা গাফিলতি হওয়ার একটা টেনডেনসি দেখা যাচ্ছে। আমরা এটা ইনভেস্টিগেশন করছি।”
তিনি বলেন, তারা অভিযোগ করছেন না, তবে এটা তাদের সন্দেহ যে এটিসির গাফিলতি ছিল।
“গাফিলতিটা আমাদের পাইলটের দিক থেকে না। এটা টাওয়ারের দিক থেকে। আমরা এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে এটা বলছি না। তবে আমরা সন্দেহ করছি।”
ইউএস-বাংলার সিইও দাবি করেন, কানাডার বমবার্ডিয়ার কোম্পানির তৈরি ওই উড়োজাহাজের বয়স ১৬ বছর।
“বিমানে কোনা যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল না। আমাদের ৪টা এয়ার ক্রাফট রয়েছে। চারটাই ফ্লাই করে। ”
তিনি বলেন, ওই ফ্লাইটের পাইলট ছিলেন ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান, যিনি বিমান বাহিনীর একজন সাবেক পাইলট এবং তিনি ক্যারিয়ারে পাঁচ হাজারের বেশি ঘণ্টা উড়েছেন। যে উড়োজাহাজটি দুর্ঘটনায় পড়েছে, সেটি নিয়েই তিনি ১৭ শ’ ঘণ্টার বেশি ফ্লাই করেছেন।
ওই উড়োজাহাজের প্রধান বৈমানিক আবিদ সুলতান বেঁচে গেলেও আরেক বৈমানিক পৃথুলা রশিদ মারা গেছেন বলে কাঠমান্ডু মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে দেওয়া তথ্যে জানা গেছে।