একাত্তরের মে মাসে সাভার থেকে কুমিল্লা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলায় যান লায়লা হাসান। সেখান থেকে কলকাতায় গিয়ে যোগ দেন স্বাধীন বাংলা বেতারে। নাটকে অভিনয়, গান গাওয়ার পাশাপাশি আবৃত্তি করতেন তিনি। আশ্রয় শিবিরে গিয়ে প্রচারণামূলক সাংস্কৃতিক পরিবেশনায়ও ছিল তার অংশগ্রহণ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সন্তান নিয়ে দেশ ছাড়া এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও কলকাতায় সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নিজের সম্পৃক্ততার নানাদিক শুনিয়েছেন লায়লা হাসান।
“পঁচিশে মার্চে যখন ক্র্যাকডাউন হল, গণহত্যা আরম্ভ হল, কারফিউ চলছিল- বহু কষ্ট করে ঢাকা থেকে বাড়ির দিকে গেলাম। একান্নবর্তী পরিবার ছিল আমাদের। শাশুড়ি, জা, ভাসুর আর একটি ছোট কন্যা সন্তান আমার।”
“জনপ্রিয় মুখ হওয়ায় পথে পাকিস্তানি আর্মিদের চোখ ফাঁকি দেওয়া ছিল আরেক দুঃসাধ্য কাজ। আমরা গাড়ির ভেতর মাথা নিচু করে, ছাতা দিয়ে মাথা ঢেকে...অনেকবার তাও থামিয়েছে আমাদের। করুণাময়ের কৃপায় আমরা পার হয়ে আসতে পেরেছি।”
পাকিস্তানিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার বাসনায় আগেই সাভার থেকে কলকাতা যেতে পেরেছিলেন হাসান ইমাম। যুদ্ধের প্রশিক্ষণ আর অস্ত্র আনার পরিবর্তে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রমে জড়িয়ে যান তিনি।
এরপর একাত্তরে মে মাসের শেষের দিকে স্ত্রী আর মেয়েকে কলকাতায় নিজের কাছে নিতে প্রয়াত সাংস্কৃতিক সংগঠক ওয়াহিদুল হককে সাভারে পাঠিয়েছিলেন।
স্মৃতিচারণ করে লায়লা হাসান বলেন, “হঠাৎ করে সাভারে ওয়াহিদ ভাই এসে হাজির। একদম অন্য পোশাক, কেডস, লুঙ্গি পড়া, চুলের স্টাইল আলাদা- তাকে চেনা যাচ্ছিল না। দুপুরে এসে বললেন, ‘তোকে নিতে এসেছি। যাব আমরা কালকে’।”
কলকাতা যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে লায়লা হাসান, সন্জীদা খাতুন ও তার বড় মেয়ের জন্য কেনা হয় বোরখা।
“ওয়াহিদ ভাই আমাদের নিউ মার্কেট নিয়ে গেলেন বোরকা কিনতে। আমাকে আর সন্জীদা আপাকে সবাই চেনে। খুব সাবধানে পথে চলতে হবে।”
বোরকা কেনার পরদিন সকাল থেকে শুরু হয় তাদের অনিশ্চিত যাত্রা। কখনো রিকশায়, কখনো ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে হেঁটে, কখনো বা নৌকায় করে পাক হানাদারদের চোখ এড়িয়ে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে গেছেন তারা। হাতে ছিল কেবল ছোট একটি পুঁটলি, তাতে মেয়ের দুইটা কাপড়, দুধের বোতল আর নিজের দুই-একটা শাড়ি।
প্রথম রাতে কুমিল্লার চান্দিনায় একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন তারা। পরদিন আবার দীর্ঘযাত্রা শুরুর কথা বলতে গিয়ে চোখ ধরে আসে লায়লা হাসানের।
“হাঁটছি। পাশ দিয়ে ট্রাক যাচ্ছে, আর্মিরা যাচ্ছে। ভয়ে ধান ক্ষেতে লুকাচ্ছি আবার যাচ্ছি। ছোট বাচ্চাটা আমার...মনে হলে খুব কষ্ট হয়।”
নানা বাধা পেরিয়ে অবশেষে আগরতলায় পৌঁছান তার। প্রথমে তাদের আশ্রয় নিতে হল একটি স্কুলের শরণার্থী শিবিরে। সেখানে ঘুমের সময় বালিশ চায় ছোট্ট সঙ্গীতা। কিন্তু সেই আবদার পূরণ করতে না পারার কথা মনে করে অঝোরে কেঁদে ফেলেন লায়লা হাসান।
কলকাতা পৌঁছানোর পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে মে মাসের শেষে যুক্ত হন তিনি। সেখানে আবৃত্তি, গান, নাটক করতেন মেয়েকে সঙ্গে নিয়েই।
বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের স্বাধীন বাংলা বেতারে ছোট পরিসরে কাজ করার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন, “রেকর্ডিংয়ে ছোট একটা ঘর, ঘেমে-নেয়ে...আমার মনে আছে মোস্তফা আনোয়ার কবি, আমরা তার প্রযোজনায়-সহযোগিতায় আবৃত্তি করতাম। উনি ঘেমে যাচ্ছেন, বাইরে গিয়ে গেঞ্জিটা চিপে ঘাম ঝরিয়ে সেটা গায়ে দিয়ে আবার এসে রেকর্ডিং করতেন।”
কলকাতায় সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে ‘মুক্তিকামী সংগ্রামী দল’ নামের একটি সাংস্কৃতিক দল গঠিত হয়েছিল বলে জানান লায়লা হাসান। ওই দলে তার সঙ্গে ছিলেন ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুন, সৈয়দ হাসান ইমাম, মুস্তফা মনোয়ারসহ অনেকে। সাংস্কৃতিক দলটি পুরো পশ্চিমবঙ্গ ও দিল্লি ঘুরেছে। জনমত তৈরি করতে রেখেছে ভূমিকা।
“আমরা শিবিরে শিবিরে গিয়ে গান গেয়ে, আবৃত্তি করে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতাম।”
একাত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে মাস্টার্সের ছাত্রী ছিলেন লায়লা হাসান। বয়স কম হলেও সেই সময়ের প্রয়োজনে বিভিন্ন নাটকে মায়ের চরিত্রে অভিনয়ের কথা জানান তিনি।
“তখনতো আর বয়স দেখে বা অন্য কিছু দেখে নাই। যখন যাকে সামনে পেয়েছে তাকে দিয়ে চরিত্র করিয়েছে।”
বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘রুমঝুম’ অনুষ্ঠানের শিক্ষক হিসাবে অতি পরিচিত লায়লা হাসানের জন্ম ১৯৪৬ সালে। মঞ্চনাটক, টেলিভিশন নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করা এই শব্দসৈনিক স্বাধীনতার পরও যুক্ত আছেন বাংলাদেশের নানা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে।
১৯৯০ সালে নাচের দল ‘নটরাজ’-এর প্রতিষ্ঠা করেন লায়লা হাসান। তার অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- ঘরে বাইরে, এই তো প্রেম প্রভৃতি।
একাত্তরে লায়লা হাসানের আড়াই বছরের সন্তান সঙ্গীতা ইমাম এখন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সহ-সাধারণ সম্পাদক ও ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষক। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠকও তিনি।