যেভাবে জন্ম বিজয়ের গানের

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর। বেলা গড়িয়ে ঘড়ির কাঁটা ১২টা পেরিয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতরের দুঃসাহসী শব্দসৈনিকরা তখনও জানতেন না, বিজয় তাদের দ্বারপ্রান্তে।

মাসুম বিল্লাহ কাজী নাফিয়া রহমান, সাজিয়া আফরিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 March 2018, 11:17 AM
Updated : 26 March 2018, 06:46 PM

বেলা সাড়ে ১২টার দিকে কেন্দ্রের সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক সুজেয় শ্যামকে বলা হল, বিজয়ের গান করতে। সঙ্গে সঙ্গে পুরো বেতার কেন্দ্রেই ছড়িয়ে পড়ে এক ধরনের উত্তেজনা।

এরপরের সোয়া এক ঘণ্টা ইতিহাস। নয় মাস তুমুল জন্মযন্ত্রণার পর যে দেশের আবির্ভাব, তার বিজয়ের গানটির জন্ম হয়েছিল ওই সময়।

বিজয়ের ঘোষণা প্রচারের পরপরই স্বাধীন বাংলা বেতারে বাজানো হয় বিজয়ের গান ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই/ খুশির হাওয়ায় উড়ছে/ উড়ছে উড়ছে উড়ছে/ বাংলার ঘরে ঘরে’

এ গানটিই ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শেষ আর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গান। গানটি ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর দিনভর বাজানো হয়েছিল।

সেদিন শহীদুল ইসলামের লেখা গানটিতে সুর করেছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গীত পরিচালক ও সুরকার সুজেয় শ্যাম। মাত্র ১৫ মিনিট লেগেছিল গানটি লেখা ও সুর করতে; এরপর রেকর্ডিং। আর পুরো গানটার জন্ম হয়েছিল মাত্র এক ঘণ্টায়।

স্বাধীনতার ৪৭তম বার্ষিকীতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই স্মরণীয় মুহূর্তের স্মৃতিচারণ করেন।

“আমি সেদিন অন্য একটা গানের রিহার্সেল করছিলাম। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে আশফাক ভাই আমাকে বললেন- এই গান হবে না। বিজয়ের গান গাইতে হবে। তখন শহীদুল ইসলাম গানের কথা লিখে দিল। আমি সুর করলাম।”

 

আশফাকুর রহমান খান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রোগ্রাম অর্গানাইজার ছিলেন। আর শহীদুল ইসলাম ছিলেন গীতিকার।

“ওই দিন অফিসটায় এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করছিল। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না কেন। ২৫ জন শিল্পীকে নিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে গানটির রেকর্ডিং হয়েছিল। আমিও ছিলাম তাদের মধ্যে। অজিত রায় গানটা লিড দিয়েছিল।”

দেশকে স্বাধীন করার তাড়নায়ই তারা দিনরাত বিভিন্ন সংগ্রামী গান গেয়ে যেতেন বলে জানান তিনি।

“ভারতে তো আমাদের কোনো ভয় ছিল না। কিন্তু ভয় ছিল কোনটা? ভারত তো আমার দেশ না। যত তাড়াতাড়ি আমরা দেশটা স্বাধীন করতে পারি। সংগ্রামী গান, নাটক, কথিকা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করতে পারি, উদ্বুদ্ধ করতে পারি।”

বিজয়ের গানটি স্বাধীন বাংলাদেশে দীর্ঘ ২১ বছর বাজানো হয়নি- এ নিয়ে আক্ষেপও ঝরল সুজেয় শ্যামের কণ্টে।

তিনি বলেন, “৭৫ এর পর থেকে ২১ বছর এদেশে ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ গানটি বাজেনি, ‘জয় বাংলা’ বাজেনি। স্বাধীনতার কোনো গান বাজেনি। স্বাধীনতার গান দোষটা কী করেছে? বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়া যায়নি এদেশে।”

ছবি: নয়ন কুমার

আলাপচারিতায় একাত্তরের সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে শুরু করে যুদ্ধদিনের কথাও বললেন।

বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ তাকে উজ্জীবিত করেছিল জানিয়ে সুজেয় শ্যাম বলেন, “রেসকোর্স ময়দানে আমি সেদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে যাই। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটা কিন্তু লিখিত না, এভাবে কোনো মানুষ বলতে পারে, কোনো মানুষ দেশকে এভাবে ভালবাসতে পারে- তা আমার অনুভূতিতে ছিল না। ওইদিন থেকেই আমার মনে হয়েছে যে, আমরা আলাদা একটা জাতি; আমাদের আলাদা একটা সত্তা আছে।”

সুজেয় শ্যাম জানান, ২৫ মার্চ কালরাতে তিনি ছিলেন সিলেট শহরে। সেদিন রাতে একটা রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা দেওয়ার সময় আওয়ামী লীগের একজন নেতার মাধ্যমে জানতে পারেন ঢাকার অবস্থা ভাল না। ইপিআর ক্যাম্পসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা করেছে পাকিস্তানিরা। সারা দেশে তারা বর্বরতা চালিয়ে হত্যা করেছে নিরীহ বাঙালিদের। এরপর ৭৬ ঘন্টা কার্ফ্যু শেষে ২৮ মার্চ সিলেট শহরে বেরিয়ে দেখেন গণহত্যার বিভৎসতা।

“যখন বের হলাম চারপাশে মানুষ মরা গন্ধ। মানুষের লাশ পড়ে আছে। মনে হল এটা একটা কবরস্থান।”

২৬ মার্চ বেলাল মোহাম্মদ এবং আবুল কাশেম সন্দীপসহ তৎকালীন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কয়েকজন কর্মী সিদ্ধান্ত নেন, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনগণকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে তারা বেতারের মাধ্যমে কিছু প্রচার করবেন।

তারা চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের নতুন নাম দেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’। তবে নিরাপত্তার কারণে তারা চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রকে কাজে না লাগিয়ে শহর থেকে কিছুটা দূরে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রকে ব্যবহার করেন।

২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে প্রথম উচ্চারিত হয় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি’। সে সময়েই আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন। প্রায় এক ঘণ্টা অনুষ্ঠান করার পর তারা পরদিন সকাল ৭টায় পরবর্তী অনুষ্ঠান প্রচারের ঘোষণা দিয়ে সেদিনের পর্ব শেষ করেন।

২৭ মার্চ রাত ৮টায় মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। এর পরদিন ২৮ মার্চ মেজর জিয়ার অনুরোধে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ নামটি থেকে ‘বিপ্লবী’ অংশটি বাদ দেওয়া হয়।

৩০ মার্চ দুপুরের অধিবেশন শেষ হওয়ার পর প্রায় ২টা ১০ মিনিটের দিকে পাকিস্তানি বিমান হামলায় বেতার কেন্দ্রটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।

এ হামলায় কেউ হতাহত না হলেও কেন্দ্র এবং সম্প্রচারযন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৩১ মার্চ সকালে কয়েকজন বেতারকর্মী একটি এক কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সম্প্রচারযন্ত্র নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যান।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের পর মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে ৫০ কিলোওয়াটের একটি ট্রান্সমিটার দেয়। ২৫ মে কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ৫৭/৮ নম্বর দোতলা ভবনের একটি কক্ষে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কার‌্যক্রম শুরু হয়।

জুন মাসের ৮ তারিখে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন সঙ্গীত পরিচালক ও সুরকার সুজেয় শ্যাম।

তিনি বলেন, “বালিগঞ্জের দোতলা বাড়িটার একটা রুমে ‍সংবাদ, নাটক, কথিকা, সংগ্রামী গান- সবকিছু রেকর্ডিং হত। ছোট্ট একটা স্টুডিও ছিল, একটা পর্দা দেওয়া। ভাঙা একটা টেপ রেকর্ডার আর দুটি মাইক্রোফোন দিয়ে আমরা ২৫/৩০ জন গান করতাম।”

ছবি: নয়ন কুমার

প্রথমে শুধু তবলা আর হারমোনিয়াম দিয়েই গান করতেন তারা। পরে কিছু বাদ্যযন্ত্র কেনা হয়।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে থাকার সময়ে মোট নয়টি গানে সুর করেছিলেন সুজেয় শ্যাম। যেগুলো একাত্তরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গাওয়া হয়েছিল।

এসব গানের মধ্যে ‘আয়রে চাষী মজুর কুলী’ এ গানটি ছিল স্বাধীন বংলা বেতারে তার প্রথম গান। এছাড়াও ছিল- ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’, ‘ওরে শোনরে তোরা শোন’, ‘মুক্তির একই পথ সংগ্রাম’ ‘রক্ত চাই রক্ত চাই’, ‘আজ রণ সাজে বাজিয়ে বিষাণ’, ‘আহা ধন্য আমার’, ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’।

বেতার কেন্দ্রের শিল্পীরা প্রতিটি পরিবেশনাই খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে রেকর্ডিং করত জানিয়ে তিনি বলেন, “দেশ তো আমার মা। মাকে দ্রুত স্বাধীন করতে আমরা সাধ্যমতো কাজ করে গেছি। সারাদিন হয়তো কারও খাওয়া হয়নি, ঘুমানোর জন্য একটা বালিশও নাই। কিন্তু হাসিমুখে কাজ করে গেছে সবাই।”

সুজেয় শ্যাম জানান, মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ প্রায়ই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যেতেন। আশ্বাস শোনাতেন, দ্রুত দেশে ফিরে যাওয়ার।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৮ মার্চ দেশে ফেরেন সুজেয় শ্যামসহ কয়েকজন শব্দসৈনিক।

সে সময় দেশের মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হয়েছিলেন জানিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারের সর্বাধিক গানের এই সুরকার বলেন, “আমরা আসলে কী করেছি জানি না, কিন্তু সীমান্ত পার হওয়ার পর এদেশের মানুষ আমাদের জন্য যা করেছে, তা কখনও ভোলার না। কে কি খাওয়াবে, কি করবে- ব্যস্ত হয়ে গেছে। এতোটা সম্মান পাব, ভাবিনি।”  

মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকারের সহযোগিতার কথা স্মরণ করে এ কন্ঠযোদ্ধা বলেন, “ভারত আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছে। আমরা যখন প্রথম গেলাম, তখন হাজার হাজার মানুষ। তখন বিদেশ থেকেও তেমন সহযোগিতা আসেনি। ভারত সরকারই কিন্তু জায়গা, খাওয়া- সব দিয়েছে। আসামও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার স্কুল-কলেজ মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বন্ধ ছিল। কলকাতা, আসাম, ত্রিপুরা এখানকার জনগণের ঋণ আমরা শোধ করতে পারব না।”

সবকিছুর বিনিময়ে তিনি সেই সময়টাকে ফিরে পেতে চান।

ছবি: নয়ন কুমার

“এ দেশের আপামর জনগণের লড়াই সংগ্রামেই আমরা স্বাধীন হয়েছি। ওই নয়মাস আমরা মনে-প্রাণে বাঙালি ছিলাম। এক আত্মা এক মন ছিল। কে হিন্দু কে মুসলমান চিন্তা করি নাই। একসাথে খেয়েছি, ঘুমিয়েছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা শুরু হয়ে গেল। পাঁচাত্তরের পর সব ওলটপালট হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধুকে স্বীকার করেনি অনেক মুক্তিযোদ্ধা।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দলমত নির্বিশেষে সম্মান করারও অনুরোধ জানান তিনি।

“বঙ্গবন্ধু কিন্তু আওয়ামী লীগের না। যেদিন থেকে উনি বঙ্গবন্ধু হয়েছেন, সেদিন থেকে উনি সারা পৃথিবীর বাঙালিদের বঙ্গবন্ধু।”

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “পাকিস্তানে আমরা বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে পেরেছি। কিন্তু স্বাধীন দেশে তার নাম মুখে আনতে পারিনি। স্বাধীনতাকে আমরা মূল্যায়ন করতে পারিনি।”

দেশের সব মানুষ একত্রিত থাকলে ৪৭ বছরে দেশটা সত্যিকারের সোনার বাংলা হয়ে যেত বলে করেন তিনি।

“এই দেশ স্বাধীন হয়েছিল, কারণ আমরা একত্রিত ছিলাম। আর পঁচাত্তরের পরে আমরা ভাগ ভাগ হয়ে গেলাম। রাজাকাররা কিন্তু ভাগ হয়নি। আমরা ভাগ হয়ে গেছি। এই ৪৭ বছরে দেশ সোনার বাংলা ঠিকই হত।”

তরুণ প্রজন্মকে কারও কথা না শুনে সঠিক ইতিহাস জানার আহ্বান জানান তিনি।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানগুলো গেয়ে তরুণ প্রজন্ম তা বাঁচিয়ে রাখবে বলেও আশা তার।

[সুজেয় শ্যাম ১৯৪৬ সালের ১৪ মার্চ সিলেট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। দশ ভাইবোনের মধ্যে সুজেয় ষষ্ঠ। মা-বাবাও ছিলেন নজরুল সঙ্গীত শিল্পী। ছোট বোন, ভাইও বেতারে গাইতেন।

সুজেয় শ্যাম গিটার বাদক ও শিশুতোষ গানের পরিচালক হিসেবে ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান চট্টগ্রাম বেতারে যোগ দেন। পরে বড়দের অনুষ্ঠান পরিচালনা শুরু করলেও ১৯৬৮ সালে ঢাকা বেতারে চলে আসেন। স্বাধীন দেশে কাজ করেছেন বাংলাদেশ বেতারে। ২০০১ সালে বাংলাদেশ বেতার থেকে প্রধান সঙ্গীত প্রযোজক হিসেবে অবসরে যান।

কাজ করেছেন চলচ্চিত্র সঙ্গীত পরিচালক হিসেবেও। একবিংশ শতকের প্রথমে ‘হাছন রাজা’ চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরচালনা তাকে এনে দেয় প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সঙ্গীত পরিচালনা ছাড়াও এই চলচ্চিত্রের একটি গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন। পরবর্তীতে ‘জয়যাত্রা’ ও ‘অবুঝ বউ’ চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করে ২০০৪ ও ২০১০ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।

সঙ্গীতে শিল্পকলা পদক পান ২০১৫ সালে, একই বছর পান স্বাধীনতা সম্মাননা ও ভারত গৌরব সম্মাননা। ২০১৮ সালে পান একুশে পদক।]