একাত্তরে নাটক-কথিকায় ‘উদ্বুদ্ধ হয়েছিল’ মানুষ

একাত্তরে যুদ্ধের দিনগুলোতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে গান, কথিকাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পাশাপাশি অবরুদ্ধ মানুষ আর মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করতে প্রচারিত হয়েছে বহু নাটক।

মাসুম বিল্লাহ কাজী নাফিয়া রহমান ও সাজিয়া আফরিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 March 2018, 11:44 AM
Updated : 27 March 2018, 07:53 PM

‘জল্লাদের দরবার’ ধারাবাহিক নাটকে হাস্যরসের মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তার স্ত্রী ও সাঙ্গপাঙ্গদের আলাপ; আবার ঈদের দিনে একক নাটকে ধরা দিয়েছে তরুণ মুক্তিযোদ্ধার মনে যুদ্ধের পরে বিজয়ীর বেশে ঈদ উদযাপনের আকাঙ্ক্ষা।

তবে বিক্ষুব্ধ সেই দিনগুলোতে মান ধরে রাখার চাইতে নাটক-কথিকা-রম্যরচনার মাধ্যমে সবাইকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করার দিকে বেশি নজর ছিল নির্মাতাদের।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নাটক ও কথিকা বিভাগের প্রধান সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, “আমাদের প্রখ্যাত নাট্যকার যারা ছিলেন, তারা ওখানে গিয়েছিলেন, তারা ওই সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে খুব একটা কনট্রিবিউট করতে পারেননি। কারণ, তারা উপলব্ধি করতে চাইছিলেন, একটা ভাল গল্প, কালজয়ী গল্প, কালজয়ী উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা তারা করছিলেন।

“কিন্তু প্রচারটা তো অন্য জিনিস। প্রতিদিন ছ’ঘণ্টা করে আমরা অনুষ্ঠান করছি। সেই ছ’ঘণ্টা চালাতে হবে এবং তার জন্য যা পাওয়া যায়, তাই নিয়ে চালাতে হবে। বসে থাকলে হবে না যে, এটার মান কেমন ওটার মান কেমন।”

সেক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষায় রচিত এম আর আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’ কথিকার ভাষা এখন শালীন মনে না হলেও সময়ের বিবেচনায় সেটাই জরুরি ছিল বলে মনে করেন চলচ্চিত্র নির্মাতা হাসান ইমাম।

স্বাধীনতার ৪৭তম বার্ষিকীতে এক সাক্ষাৎকারে নাটক ও কথিকার বিষয়বস্তু নিয়ে এমন বক্তব্যের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা বেতার ও যুদ্ধদিনে কলকাতায় সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নানা স্মৃতিচারণ করেন এই শব্দসৈনিক।

একাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনে সাড়া দিয়ে গঠিত বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের আহ্বায়ক ছিলেন হাসান ইমাম।পরে ১৯৭১ সালের মে মাসে কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে চালু হওয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন।

ওই বেতারের প্রথম সংবাদ বুলেটিন তিনি পাঠ করেছিলেন সালেহ আহমেদ ছদ্মনামে। পরবর্তীতে সেখানে তিনি দায়িত্ব নেন নাটক ও কথিকা বিভাগের প্রধান হিসেবে। তার তত্ত্বাবধানে ধারাবাহিক নাটক ‘জল্লাদের দরবার’, ‘চরমপত্র’ কথিকাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচারিত নাটকের বিষয়বস্তু নিয়ে হাসান ইমাম বলেন, “রেডিও নাটক, আধ ঘণ্টার নাটক করতাম। ৩৫ মিনিট, ৪০ মিনিটের নাটক করতাম। বিভিন্ন অনুষ্ঠানভিত্তিক নাটকও করেছি, আবার বিভিন্নভাবে আমরা নাটকও লিখেছি। নাটক, কথিকা এবং রম্য রচনা এসব করে আমরা সেসময়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছি। তার ফলে আমরা সারাদেশের মানুষের সমর্থনও পেয়েছি।”

ঈদের আগের রাতে প্রচার হওয়া একটি নাটকের পটভূমি তুলে ধরে বলেন, “মামুনুর রশিদের লেখা একটা নাটক, আমি প্রযোজনা করেছিলাম। সেই নাটকে, একটি ছেলে ঈদের দিনে মায়ের কাছে বার্তা পাঠাচ্ছে সেখানে- ‘মা তুমি চিন্তা করো না, আমরা জয়যুক্ত হয়ে ফিরব’।

“সেই সময়ে অবরুদ্ধ বাংলায় যাদের ছেলেমেয়েরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে তারা হাউমাউ করে কেঁদেছে ঈদের আগের রাতে সেই নাটক প্রচারিত হওয়ায়।”

‘চরমপত্র’ খ্যাত এম আর আখতার মুকুলের জনপ্রিয়তার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “চরমপত্রে যেসব শব্দ ব্যবহার করেছে, আজকের দিনে হয়তো সেগুলো শালীন নয়, এমন ধরনের শব্দ ব্যবহার করেছে, এমন কথা বলা হয়েছে, যেগুলো হয়তো সাহিত্যে-সংস্কৃতিতে ইতোপূর্বে ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু যুদ্ধের সময়ে এগুলোই মানুষকে নাড়া দিয়েছে।

“ইয়াহিয়া খানের বিভৎস যে চেহারা, সেটাকে হাস্যকর করে তুলেছে এম আর আখতার মুকুলের কথিকা।”

নাট্যকার কল্যাণ মিত্রের ‘জল্লাদের দরবার’-এ ইয়াহিয়া খানকে মানুষের কাছে হাস্যকর করে তোলা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “মানুষের ভয় কাটিয়ে দিয়েছে যে, ইয়াহিয়া খানকেও জয় করা যায়। যে আতঙ্ক ছিল সেই আতঙ্ককে কাটিয়ে দিয়ে তাদেরকে ছোট করে দেওয়া। এটা একটা ক্ষুদ্র জিনিস.. ইয়াহিয়া খানকে পরাজিত করা কোনো ব্যাপার না।”

শুরুর দিকে কেবল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সবার জন্য ছদ্মনাম দেওয়া হয়েছিল বলে জানান হাসান ইমাম। তবে বেতার কার্যক্রমের বাইরে তাদের নিজ নামই বহাল থাকত।

“আমি যখন খবর পড়ছি সালেহ আহমেদ নামে, আমাদের ছদ্মনাম দেওয়া হয়েছিল সরকার থেকে। তাজউদ্দিন আহমেদ, মান্নান সাহেব, আহমদ রফিক, আলমগীর কবির- সবার একটা করে ছদ্মনাম দেওয়া হয়েছিল, প্রথম যারা গিয়েছিলাম। কলকাতায় আমরা যারা প্রকাশ্যে কাজ করেছিলাম, সেখানে নিজের নামে কাজ করছিলাম।”

ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে সচেতনতা তৈরির জন্য সংস্কৃতিকর্মীদের মাধ্যমে একটি কমিটি করা হয়েছিল, যারা বিভিন্ন মুসলিম অধ্যূষিত অঞ্চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সভা-সমাবেশ করতেন।

সে সময় চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িতদের নিয়ে গঠন করা হয়েছিল বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলী সমিতি। চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান ছিলেন সেটার সভাপতি আর হাসান ইমাম সাধারণ সম্পাদক।

“আমরা এখান থেকে চলচ্চিত্রের যেই ১৩৩টা পরিবার ভারতে যেয়ে আশ্রয় নিয়েছিল, যুদ্ধের সময়ে তারা যাতে চলতে পারে, টাকা যোগাড় করে করে প্রতিমাসে একটা ভাতা দিতাম। এই সময়ে ভারতের একটি সংগঠন ইন্ডিয়ান মোশান পিকচারস অ্যাসোসিয়েশন থেকে অনুদান নিয়ে স্টপ জেনোসাইড ছবি বানালাম। পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করা, তারা কীভাবে গণহত্যা করছে।”

প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সংস্কৃতিকর্মীদের কথাও হাসান ইমাম স্মরণ করেছেন সশ্রদ্ধচিত্তে।

“বাংলাদেশের শিল্পীদের একটা বিরাট গৌরবের সময় একাত্তর। শিল্পীরা প্রাণ দিয়েছে। অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছে। আবার সঙ্গীত, নাটক ইত্যাদি মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, যুদ্ধের পক্ষে মানুষকে নিয়ে এসেছে। এটা মনে করলেই গা শিহরিত হয়।”

এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধে সুরকার আলতাফ মাহমুদের অবদানের কথা তুলে ধরে জানান, তাকে স্বাধীন বাংলা বেতারে যোগ দিতে বলা হলেও তিনি রণাঙ্গনকেই বেছে নিয়েছিলেন।

নিজের গাড়িতে করে গেরিলা যোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র পৌঁছানোর কাজ করে ধরা পড়েন আলতাফ মাহমুদ। তার বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় অস্ত্রশস্ত্র। পরে তার ওপর নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন। তার নখগুলো উঠিয়ে নেওয়া হয়েছিল, আঙুলগুলোয় ঘা হয়ে গিয়েছিল।

হাসান ইমাম বলেন, “যারা তাকে সর্বশেষ দেখেছে, একেবারে বিভৎস অবস্থা- হামাগুড়ি দিয়ে কোনোমতে একটু একটু যেতে পারত। এই রকম অত্যাচারের মধ্যেও তার সঙ্গী কারা ছিল, একজনেরও নাম প্রকাশ করেননি আলতাফ মাহমুদ।”

 

১৯৭১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তাকে রমনা থানা থেকে চোখ বেঁধে অজ্ঞাতস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।

মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকার কথা স্মরণ করে হাসান ইমাম বলেন, “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অসাধারণ অবদান, সেসময় অবরুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়েছে। তারা স্বাধীনতার চেতনায় স্থির থেকেছে এবং তারা বিশ্বাস করেছে যে আমরা জয়ী হব। নিজেদের ছেলেদের সন্তানদের পাঠিয়ে দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে।”

স্বাধীন বাংলা বেতার শোনার জন্য পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকাররা অনেককে হত্যা পর্যন্ত করেছিল বলে জানান এই সংগঠক।

“গোপনে শীতের মধ্যে লেপের ভেতরে একজন শুনত, আস্তে আস্তে, আরেকজনকে বলত এই হয়েছে, সেই হয়েছে। এভাবে আমরা মানুষের মনোবলকে ঠিক রেখেছিলাম।”

একাত্তরে যেই চার মূলনীতি ও স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল সেটা বাস্তবায়ন করতে অনেক দূর যেতে হবে মনে করেন হাসান ইমাম।

“গণতন্ত্র মোটামুটি পেয়েছি। এখনো বিরোধী দল গঠনমূলকভাবে যদি কাজ করে, তাহলে গণতন্ত্র আস্তে আস্তে প্রতিষ্ঠিত হবে।

“অসাম্প্রদায়িকতায় অনেকদূর এগোতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে জাতীয় আয় বাড়লেও সমাজতন্ত্র না থাকায় নিচের দিকের মানুষের মধ্যে বৈষম্য থেকেই যাচ্ছে। ব্যবসায়ী ও ধণিক শ্রেণি গড়ে ওঠায় পাকিস্তান ও ইংরেজ আমলের ধারা রয়ে গেছে। জাতীয় আয়কে সবার মাঝে যদি বন্টন করতে পারতাম, তবে দেশ আরো এগিয়ে যেত।”