স্বাধীন বাংলা বেতারে ‘জুতো সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ’

কাগজের অভাবে সংবাদপত্রের খালি জায়গায় লেখা হতো খবর; তবলা নেই- টেবিল চাপড়ে সুর তোলা হতো গানের; যিনি সংবাদ বুলেটিন তৈরি করেন, তাকে আবার সংবাদ পরিবেশনও করতে হতো।

মাসুম বিল্লাহ কাজী নাফিয়া রহমান ও সাজিয়া আফরিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 March 2018, 06:19 PM
Updated : 20 June 2020, 06:54 AM

সীমিত জনবল আর সামর্থ্যের মধ্যে এভাবেই একাত্তরে যুদ্ধের দিনগুলোতে টানা সম্প্রচার চালু রেখেছিলেন স্বাধীন বেতারের শব্দসৈনিকেরা। যুদ্ধের ময়দানে না থাকলেও তারা জড়িয়ে ছিলেন স্বাধীনতার লড়াইয়ে- শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। উত্তাল সেই দিনগুলোতে তাদের কারো কণ্ঠ, কারো কলমই হয়ে উঠেছিল অস্ত্র। কেউবা ছিলেন নেপথ্যের যোদ্ধা। 

দেশ স্বাধীনের মন্ত্রে উজ্জীবিত এই কর্মীরা সব অভাবকে জয় করেছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক কামাল লোহানীর ভাষায়, তাদের কার্যক্রম ছিল ‘জুতো সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠের’ মতো।

স্বাধীনতার ৪৭তম বার্ষিকীতে স্বাধীন বাংলা বেতারের বার্তা বিভাগের এই প্রধান বলেন, “আমরা আনন্দ নিয়ে কাজ করেছি। কাজের মধ্যে আমাদের কোনো রকমের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, এটা করব না, ওটা করব- এমন ছিল না। যাকে যে কাজটা দেওয়া হোক না কেন, একেবারে ‘জুতো সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ’ সবই কিন্তু একেকজনকে করতে হয়েছে।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্বাধীন বাংলা বেতারের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে তাদের নানা কার্যক্রম, স্মরণীয় মুহূর্ত নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন সাংবাদিক কামাল লোহানী।

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যা শুরু হয় আর পরদিনই চট্টগ্রামে চালু হয়েছিল ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের’ কার্যক্রম, সেটি চট্টগ্রাম বেতারে। এরপর কালুরঘাটের প্রক্ষেপণ কেন্দ্রে স্থানান্তরিত বেতার কেন্দ্র আক্রান্ত হলে সেখানকার ট্রান্সমিটারটি সীমান্ত পার করে নিয়ে যান অসীম সাহসী কয়েকজন বেতারকর্মী।

এরপর ভারত সরকারের কাছ থেকে পাওয়া ৫০ কিলোওয়াট ক্ষমতার একটি ট্রান্সমিটার নিয়ে একাত্তরের ২৫ মে কলকাতার বালিগঞ্জ রোডে কার্যক্রম শুরু হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের; সেসময় আগের নাম থেকে বাদ পড়ে ‘বিপ্লবী’ শব্দটি। সীমান্তের এমন একটি গোপন স্থানে ট্রান্সমিটারটি বসানো হয়েছিল, যা বেতারের কর্মীরাও জানতেন না।

স্বাধীন বাংলা বেতার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কর্মী, সাংবাদিক, শিল্পী, সুরকার, নাট্যকর্মী, সংস্কৃতিকর্মী, লেখকসহ অনেকের সঙ্গে সেখানে যোগ দেন কামাল লোহানী।

স্বাধীন বাংলা বেতারের কার্যক্রমের বর্ণনা দিয়ে কামাল লোহানী বলেন, “প্রথমে আমরা সকালে এবং সন্ধ্যাবেলা দুটো অধিবেশন করতাম। এ দুটো অধিবেশনেই বাংলা এবং ইংরেজি সংবাদ প্রচার করা হত।

“গান থাকত, কোরান তেলাওয়াত থাকত, ইসলামের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ থাকত, বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার অংশ নিয়ে ‘বজ্রকণ্ঠ’ নামে একটা চাঙ্ক ছিল- দেড় দু’ মিনিটের। এই অনুষ্ঠানের মাঝে মাঝে আমরা কিছু স্লোগান দিতাম।”

‘ওরা মানুষ হত্যা করছে, আসুন আমরা পশু হত্যা করি’ স্লোগানটি সবচেয়ে অসাধারণ ছিল বলে স্মরণ করেন তিনি।

পাকিস্তান রেডিও চট্টগ্রামের প্রযোজক মোস্তফা আনোয়ারের একটি লেখার শেষাংশ ‘হানাদার পশুরা মানুষ হত্যা করছে, আসুন আমরা পশু হত্যা করি’ থেকে এই স্লোগান নেওয়া হয়েছিল বলে জানান।

কিছুদিন পর স্বাধীন বাংলা বেতারে আরেকটি অধিবেশন চালু করা হয় বলে জানান কামাল লোহানী; যাতে মুক্তিযুদ্ধের গান ও কথিকা, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, চরমপত্র, জল্লাদের দরবার, অগ্নিশিখা, পিণ্ডির প্রলাপ পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে, নাটক ও জীবন্তিকাসহ নানা আয়োজন ছিল।

“এম আর আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’ সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল। বিভিন্ন ভাষায় এগুলো লিখতেন। তার বাবা পুলিশ বিভাগে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থাকায় তিনি ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন এলাকায় বেড়ে উঠেছেন। সেগুলোর উচ্চারণও করতেন একটু বিকৃতভাবে।

“জল্লাদের দরবার লিখতেন কুষ্টিয়ার কল্যাণ মিত্র নামে একজন। সেখানে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে, ভুট্টোকে নিয়ে, কী করছে না করছে তার বিবরণ এবং পারিবারিকভাবে তার ভেতরে কী ঘটনা ঘটছে, তার স্ত্রীর সঙ্গে কি কথাবার্তা হচ্ছে তা নিয়ে সে ধারাবাহিকভাবে জল্লাদের দরবার লিখে যেত।”

রণাঙ্গন ফেরত অনেকের কাছ তথ্য সংগ্রহ করে কিংবা অন্যান্য রেডিও থেকে ধার করে স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ বুলেটিন তৈরি করা হত।

কামাল লোহানী বলেন, “সংবাদ লেখার জন্য আমাদের কাগজ-কলম কিছুই ছিল না। আমরা কোনো রকম করে কাগজ জোগাড় করে নিজেদের পকেট থেকে বের করে যেটুকু পেয়েছি, খবরের কাগজের পাশে যেই জায়গটা থাকে, সেই জায়গার মধ্যে প্রথম সংবাদগুলো লেখা হয়েছে এবং সেখান থেকে পাঠ করা হয়েছে।”

তিনি জানান, বাংলা, ইংরেজি ও উর্দুতে সংবাদ বুলেটিন ছিল। শব্দসৈনিকদের মধ্যে জালালউদ্দিন আহমদ, মৃণালকৃষ্ণ সেন, রণজিত্ পাল চৌধুরী, সুব্রত বড়ুয়া, এ মাসুম, আলমগীর কবীর, আলী যাকের, পারভিন হোসেন, নাসরীন আহমাদ (শীলা), সৈয়দ হাসান ইমাম, আলী রেজা চৌধুরী, নূরুল ইসলাম সরকার, বাবুল আখতার নিয়মিত বাংলা ও ইংরেজি বুলেটিন তৈরি ও পাঠ করতেন।

ময়মনসিংহের জাহিদ সিদ্দিকীর মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে উর্দু সার্ভিস চালু করা হয়েছিল। পারভিন হোসেন উর্দু বুলেটিনও পাঠ করতেন।

প্রথম দিকে নানা সঙ্কটের মধ্যে কাজ চালাতে হয়েছিল উল্লেখ করে কামাল লোহানী বলেন, “কিছুদিন পর আমাদের হারমোনিয়াম আসল, কিন্তু তবলা ছিল না- টেবিলে টোকা দিয়ে গান রেকর্ড করা হতো। এরপর আমরা তবলা পেলাম, বাঁশি পেলাম। আস্তে আস্তে বিভিন্ন জিনিস পেলাম।”

এক পর্যায়ে একটি থেকে দুটি স্টুডিও তৈরি করা হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি।

“আমরা কাজ করতাম কেমন করে- আমাদের তিনটা অধিবেশন। সকাল থেকে কাজ শুরু হত, দুপুরের অধিবেশন শেষ করে তিনটা-চারটা পর্যন্ত সন্ধ্যার অধিবেশন শেষ করে খেতে যেতাম। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাসায়ই খেতাম, সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা ছিল।”

সরকার বেতন দেওয়া শুরু করার পর খাবার নিজেদের কিনে খেতে হত উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তখন আমরা ওই টাকায় হোটেলে গিয়ে খেতাম। সবাই একসঙ্গে গিয়ে খেতাম। হোটেলের লোকজন জানত, এরা বাংলাদেশের মানুষ, মুক্তিযুদ্ধ করছে। আমরা যখন যেতাম তখন পর্যন্ত আমদের জন্য খাবার রেখে দিত।”

বিজয়ের সংবাদ পাওয়া এবং সেই সংবাদ প্রচার করার সময়টা সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ছিল বলে মন্তব্য করেন কামাল লোহানী।

তিনি জানান, স্বাধীন বাংলা বেতারের দুইটা ট্রানজিস্টার ঘুরিয়ে বিভিন্ন রেডিও মনিটর করে নানা দিকের খবর সংগ্রহ করা হত। আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্তের আগে একটি ট্রানজিস্টারে ধরা পড়ল মিত্রবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং পাকিস্তান বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান একে নিয়াজির কথোপকথন।

১৬ ডিসেম্বর বিকালে আত্মসমর্পণ হবে, সেটা মাথায় রেখেই দুই থেকে আড়াই মিনিটের সংবাদ বুলেটিন তৈরির কাজ চলে, যেটি লিখেছিলেন বার্তা বিভাগের প্রধান কামাল লোহানী।

সংবাদ পাঠক হিসেবে ওই দিনের ডিউটি রোস্টারে নাম ছিল বাবুল আখতারের। কিন্তু কঠিন কঠিন শব্দ ও সময়কে ধারণ করে সেই সংবাদ পড়তে পারছিলেন না তিনি। ফলে বিজয় ও আত্মসমর্পণের সেই সংবাদ কামাল লোহানীকেই পড়তে হয়েছিল।

সেই স্মৃতি হাতড়ে বললেন, “দীর্ঘ তেইশ বছর পর… বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর পৈশাচিক হামলার পর… হার্মাদ বাহিনী, হায়েনার দল, দস্যু দল বলে গালাগাল করা হয়েছিল। আমার মনে আছে, তিন লাইনের মতো ছিল শুধু গালাগাল। এরপরে ছিল আমাদের বিজয় অর্জনের কথা, পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের কথা।”

বুলেটিন প্রকাশের পর জয়বাংলা স্লোগানে স্বাধীন বাংলা বেতারের সব সহকর্মীরা আনন্দে ফেটে পড়েছিল বলে জানান কামাল লোহানী।

তিনি জানান, বুলেটিন লেখা ও পাঠের সময়ই অন্য একটি কক্ষে ব্যস্ততা ছিল ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’ গান লেখা ও সুর করা নিয়ে।

 

সংবাদ ও স্লোগানের পরপর গীতিকার-সাংবাদিক শহীদুল ইসলামের লেখা, সুজেয় শ্যামের সুর করা গানটি গণসঙ্গীত শিল্পী অজিত রায়ের নেতৃত্বে কোরাসে পরিবেশন করা হয়েছিল।

(কামাল লোহানীর জন্ম ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থানার খান সনতলা গ্রামে। তার পারিবারিক নাম আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী।

পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক বার্তাসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। দুই দফায় সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্ম-সম্পাদক ছাড়াও ছিলেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি।

দীর্ঘদিন গণশিল্পী সংস্থা ও উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা।)