পাহাড়ের সুরক্ষায় ‘মালিকানা’ নির্ধারণের প্রস্তাব

প্রতিটি পাহাড়ের ‘মালিকানা’ নির্ধারণ করে তাদের হাতে পাহাড়ের নিরাপত্তার দায়িত্ব হস্তান্তরের সুপারিশ করেছে জাতীয় কমিটি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকশহীদুল ইসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Feb 2018, 04:23 PM
Updated : 19 Feb 2018, 04:39 PM

এছাড়া পাহাড় রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি পাহাড় রক্ষায় একটি কমিটি গঠন, নীতিমালা প্রণয়ন, ব্যক্তি মালিকানাধীন (ইজারায় থাকা) পাহাড়গুলোকে সরকারের কব্জায় নিয়ে নেওয়াসহ ৩৫টি ‍পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ করেছে পাহাড় ধসের বিপর্যয় রোধে ‘কারণ চিহ্নিত ও করণীয় নির্ধারণ’ কমিটি।

এই কমিটির প্রধান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সত্যব্রত সাহা সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সুপারিশসহ পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিবের কাছে জমা দিয়েছেন।

“কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের, সুপারিশগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে সরকার সেই সিদ্ধান্ত নেবে।”

পাহাড় ধসের কারণ অনুসন্ধান ও করণীয় নির্ধারণে জাতীয় কমিটির প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি হাতে পেয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

গত বছরের ১১ থেকে ১৩ জুনের ভারি বর্ষণে চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি ও মৌলভীবাজার জেলায় ১৬৮ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে রাঙ্গামাটিতেই মৃত্যু হয় ১২০ জনের। ওই সময় পাহাড়ি বন্যা ও পাহাড় ধসের কবল থেকে দুই হাজার ৩০০ জনকে উদ্ধার করা হয়।

ভূতাত্ত্বিক ও ভৌগলিক পরিবেশের কারণে ভূমিধস হয়ে থাকে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন দেশে পাহাড় ও ভূমি ধসের বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে।

“বাংলাদেশের পাহাড়ের মাটির ধরন চাষাবাদ উপযোগী। অন্যান্য দেশের পাহাড়গুলো পাথুরে মাটির হওয়ায় ওই সব পাহাড়ে চাষাবাদ সম্ভব হয় না।”

বাংলাদেশে ঘনবসতির জন্য জনগণের খাদ্য উৎপাদন, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও জীবিকা নির্বাহের জন্য পর্যাপ্ত জমি না থাকায় পাহাড়ি জমির উপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে বলে অনুসন্ধানে পেয়েছে জাতীয় কমিটি।

পার্বত্য এলাকায় গত বর্ষায় পাহাড় ধস

রাঙ্গামাটি জেলা শহরের পার্শ্ববর্তী পাহাড়গুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই শহরের নিকটবর্তী কাপ্তাই, ঘাগড়া, বড়ইছড়ি, রাজস্থলী, নানিয়ারচর এলাকায় সবচেয়ে বেশি মানুষ বাস করে।

“এসব এলাকাকে যুক্ত করে রাঙ্গামাটি-কাপ্তাই, রাঙ্গামাটি-ঘাগড়া-চট্টগ্রাম, ঘাগড়া-বড়িইছড়ি, ঘাগড়া-কাউখালী, রাঙ্গামাটি-মানিকছড়ি-খাগড়াছড়ি, বগাছড়ি-নানিয়ারচর সড়কগুলো তৈরি হয়েছে।

“এতে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বসবাস, তাদের ঘরবাড়ি ও অন্যান্য অবকাঠামো তৈরি এবং চাষাবাদ, জ্বালানি আহরণজনিত কারণে এসব এলাকার পাহাড়গুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর এ কারণেই একই পরিমাণ বৃষ্টিপাতের পরেও অন্য জেলার থেকে রাঙ্গামাটিতে পাহাড় ধসের পরিমাণ বেশি।”

পাহাড়ের উপর দিয়ে রাস্তাঘাট, দালানকোঠাসহ বিভিন্ন স্থাপনা তৈরির সময় নদী শাসনের মতো পাহাড় শাসনে তেমন কোনো কার্যক্রম নেওয়া হয় না বলেও কমিটির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।

“পাহাড় কেটে যে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে তার নিচের মাটি এবং পাশে দাঁড়ানো পাহাড়ের অংশ বিশেষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য প্রকৌশল ও প্রযুক্তিগত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে প্রতি বছরই হয় পিচঢালা রাস্তাগুলো ধসে পড়ছে অথবা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়গুলো রাস্তার উপর ধসে পড়ছে।”

পাহাড় ধসের জন্য আটটি কারণ চিহ্নিত করেছে জাতীয় কমিটি।

# দুর্বল মাটির গঠন

# অতি বৃষ্টিপাত

# চাষাবাদ

# অবৈধ বসতি স্থাপন ও অপরিকল্পিত অবকাঠামো

# বৃক্ষ নিধন

# উন্নত প্রযুক্তি ও প্রকৌশল ব্যবহার করে পাহাড় শাসন না করা

# অবৈধভাবে পাহাড় কর্তন

# ভূমিকম্প

অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতকে পাহাড়ের মাটি ধসের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে কমিটি বলছে, অপরিকল্পিত ভূমি ব্যবহার রাঙ্গামাটি জেলার মাটির ধারণ ক্ষমতা হ্রাস করায় সামান্য বৃষ্টিপাতেই মাটি ধসে পড়ার ঘটনা ঘটছে।

সুপারিশ

গভর্নেন্স সংক্রান্ত তিনটি, ভূমি ব্যবহারের উপর ১৩টি, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস সংক্রান্ত ১৫টি এবং দারিদ্র্য বিমোচন সংক্রান্ত চারটি পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ দিয়েছে কমিটি।

>> পাহাড়ি এলাকায় পাহাড়ের মালিকানা নির্ধারণ করে প্রতিটি পাহাড়ের নিরাপত্তার দায়িত্ব তৎসংলগ্ন মালিকের নিকট হস্তান্তর করা যেতে পারে। এর সাথে পাহাড়ের যে কোনো ঘটনা বা পরিস্থিতিতে সে মালিক দায়বদ্ধ থাকবেন। অর্থাৎ, পাহাড় রক্ষাকারী কমিটি গঠন করা বিশেষ প্রয়োজন।

>> প্রাকৃতিক ও মানুষ্য সৃষ্ট কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশের ভারসাম্য ব্যাহত হচ্ছে বিধায় পার্বত্য জেলাগুলোতে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয় স্থাপন করা দরকার। সমাজভিত্তিক পাহাড়, বনায়ন এবং পরিবেশ রক্ষা কর্মসূচি চালু করা প্রয়োজন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় দপ্তরের প্রতিনিধি এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি সমন্বয়ে মনিটরিংসহ কাজ ও দায়-দায়িত্বের সুনির্দিষ্ট কার্যপরিধি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা যেতে পারে।

>> দেশের বিভিন্ন স্থানের পাহাড়গুলোর অবস্থা, অবস্থান, প্রকৃতি, প্রেক্ষাপট, পাহাড়ের ভূমি ব্যবহার ভিন্ন বিধায় সব পাহাড় রক্ষাকল্পে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। উক্ত নীতিমালার আলোকে দুর্যোগ সহনশীল এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

>> পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমিধস ও পাহাড়ি ঢলের ফলে সৃষ্ট ধ্বংসলীলার জন্য সেখানকার ভূমির অপরিকল্পিত ব্যবহারকে একটি অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে জাতীয় কমিটি।

>> পাহাড়ের ধারণ ক্ষমতা ও আবাসের সক্ষমতা অনুসারে পাহাড়ের শ্রেণি বিভাগ করে শিগগিরই একটি ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা প্রণয়নের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

>> ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড়ের শ্রেণি পরিবর্তনের সব আবেদন খারিজ করা এবং পরবর্তী জরিপের সময় যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদানের মাধ্যমে এসব ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড়গুলো সরকারের এক নম্বর খাস খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করা।

>> এক নম্বর খাস খতিয়ানের অন্তর্ভুক্ত পাহাড়, টিলা শ্রেণির ভূমিতে ইতোপূর্বে স্থাপিত আশ্রায়ন, গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প স্থানান্তর ছাড়াও সব বন্দোবস্ত চিহ্নিত করে বাতিল করা।

>> পাহাড় থেকে মাটি কাটা বন্ধ করতে ইটভাটা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা।

>> অবৈধ পাহাড় কাটা বন্ধ করা। দুর্যোগের ফলে পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানি নিষ্কাশনে এবং পার্বত্য এলাকার সার্বিক পানির নিষ্কাশনে পাহাড় উপযোগী নতুন পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা নির্মাণ।

>> পাহাড় ও পাহাড়ের ঢালে পরিবেশবান্ধব ও পাহাড় রক্ষাকারী গাছ লাগানো।

>> সুষ্ঠু পাহাড় ব্যবস্থাপনার জন্য পার্শ্ববর্তী ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড চীনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে জাতীয় পাহাড় ব্যবস্থাপনা নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে।

>> সব ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের তালিকা তৈরি করা। সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ের রাস্তার পাশে আগামী বর্ষার আগেই জরুরি ভিত্তিতে বনায়ন করা।

>> পাহাড়ি এলাকা থেকে সব ইটভাটা সরিয়ে নিয়ে বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে।

>> পার্বত্য চট্টগ্রামে দারিদ্র্যের হার ৩১ দশমিক ৫০ শতাংশ, অতিদারিদ্র্যের হার ১৭ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ফলে অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর পাহাড় ধসের মত দুর্যোগকালীন সময়ে দরিদ্র জনজীবনে দারিদ্র্য আরও চরম ও জটিল আকার ধারণ করে।

>> পার্বত্য চট্টগ্রামে আবাদ হওয়া ফল, সবজি, ফসলসহ অন্যান্য আবাদের যথেষ্ট ফলন হয়। এসব ফল-ফসলের প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পার্বত্য এলাকায় লাভজনক উপার্জনের উপায় সৃষ্টি করা যেতে পারে। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের অন্তর্ভুক্ত করে দায়িত্বশীল কৃষি ভ্যালু চেইন গড়ে তোলা।

>> ভূমি ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের বিশেষ করে অতি দরিদ্র অসহায় নারীদের অবস্থার উন্নতির জন্য হাস-মুরগি, গরু-ছাগল-শুকর পালনে ও লাভজনক কৃষি কার্যক্রমে সুদমুক্ত বা সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা দেওয়া।

এছাড়া ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে নিয়োজিত দরিদ্র নারী-পুরুষদের পুনর্বাসনে প্রয়োজনীয় ঋণ সহায়তা দেওয়া যেতে পারে।

>> দুর্যোগের পর কৃষি পুনর্বাসনে কার্যক্রম জোরদার এবং সমাজভিত্তিক পর্যটন কার্যক্রম গড়ে তোলা এবং এজন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও পুঁজি সহায়তা দেওয়া যেতে পারে।

>> দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য পার্বত্য জেলাগুলোকে একটি পূর্ণাঙ্গ জনপদ হিসেবে টিকিয়ে রাখতে একটি সুপরিকল্পিত মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং এ পরিকল্পনা নিয়ে যথাযথ অর্থায়ন নিশ্চিত করে কাজ শুরু করতে হবে।

>> পাহাড়ি এলাকায় সমতল উঁচু ভূমি তৈরি করে পর্যটকদের আকৃষ্ট করে এমন কয়েকটি স্যাটেলাইট টাউন তৈরি করা যেতে পারে, যার চারদিকে সুরক্ষা দানকারী দেয়াল বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও রাস্তাঘাটের ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রাকৃতিক কারণের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক, ভূমি ব্যবহার, আইনের শাসনসহ নানা কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোর দুর্যোগ ঝুঁকি বেড়েছে বলে পর্যবেক্ষণ কমিটির।

পাহাড় ধসে দুর্যোগের পর গত বছরের ১৫ জুন অতিরিক্ত সচিব সত্যব্রত সাহাকে প্রধান করে উচ্চ পর্যায়ের ২৭ সদস্যের জাতীয় কমিটি গঠন করে সরকার। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে একাধিক সভা করে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে কমিটি।

এর আগে চট্টগ্রাম নগরীতে ২০০৭ সালের ভূমিধসে ১২৭ জনের মৃত্যুর পর গঠিত একটি কমিটি পাহাড়ের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে আবাসিক প্রকল্প গড়ে না তোলা, পাহাড়ে জরুরি ভিত্তিতে বনায়ন, ঢালু পাহাড়ে গাইডওয়াল নির্মাণ, নিষ্কাশন ড্রেন ও মজবুত সীমানা প্রাচীর নির্মাণের সুপারিশ করেছিল।

এছাড়া পাহাড়ের পানি ও বালি অপসারণের ব্যবস্থা করা, যত্রতত্র পাহাড়ি বালি উত্তোলন নিষিদ্ধ করা, পাহাড়ি এলাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা নিষিদ্ধ করা, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপন বন্ধ করা, পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থাসহ তিন ডজন সুপারিশ ছিল ওই কমিটির প্রতিবেদনে।