ছাত্রী নিপীড়নের অভিযোগে যে সংগঠনের নেতাকর্মীদের বহিষ্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের অবরোধে প্রায় চার ঘণ্টা আটকে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান, সেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই তাকে উদ্ধার করেছে আন্দোলনকারীদের পিটিয়ে।
Published : 23 Jan 2018, 03:06 PM
‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থী’ ব্যানারে মঙ্গলবার দুপুরে উপাচার্যের কার্যালয় ঘেরাও করে একদল শিক্ষার্থী, যাদের মধ্যে সক্রিয় ছিলেন বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা।
বিকালে কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইনের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের ২০-২৫ জনের একটি দল উপাচার্যকে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত করতে যায়।
সরকার সমর্থক সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা সময় রড-লাঠি নিয়ে চড়াও হন বিক্ষোভকারীদের উপর; উপাচার্য ভবন থেকে থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরও বিভিন্ন স্থানে কয়েক দফায় হামলা হয় বলে বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ।
এই হামলায় ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী, বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি তুহিন কান্তি দাশ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি ইভা মজুমদার, বিশ্ববিদ্যালয় নেতা প্রগতি বর্মন তমা, ছাত্র ফেডারেশনের বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি উম্মে হাবিব বেনজীর, ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থী’র সমন্বয়ক মাসুদ আল মাহদীসহ অন্তত ২৪ জন আহত হয়েছেন।
হামলার শিকার হন ইংরেজি দৈনিক ইনডিপেনডেন্টের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মীর আরশাদুল হকসহ কয়েকজন আলোকচিত্রী। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোকচিত্র সাংবাদিকের ক্যামেরা কেড়ে নেওয়ারও চেষ্টা হয়েছিল।
এই হামলা করানোর জন্য উপাচার্যকে দায়ী করে এর প্রতিবাদে বুধবার সারাদেশে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্র জোট।
এদিকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বিক্ষোভরতদের উপর হামলার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, অছাত্রদের কবল থেকে উপাচার্যকে উদ্ধারে গিয়েছিলেন তারাসহ সাধারণ ছাত্ররা।
চার মাস আগে উপাচার্যের দায়িত্ব নেওয়া অধ্যাপক আখতারুজ্জামানের এই বিষয়ে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, সহিংস শিক্ষার্থী ও বহিরাগতরা উপাচার্যের প্রতি আক্রমণ করলে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা মানববলয় তৈরি করে তাকে রক্ষা করেন।
এই ঘটনা তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দীনকে প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। তদন্ত কমিটিকে দ্রুত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঢাকার সরকারি সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’ ব্যানারে আন্দোলনকারীদের উপর হামলা থেকে।
গত ১৫ জানুয়ারি উপাচার্যের কার্যালয়ে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’দের উপর চড়াও হলে হামলাকারীদের শাস্তির দাবিতে ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনকারীরা প্রক্টরের কার্যালয়ের ফটকও সম্প্রতি ভাংচুর করে। এতে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
অধিভুক্তি সমস্যার সমাধান ছাড়াও নিপীড়নে জড়িত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বহিষ্কার ও প্রক্টরের অপসারণসহ চার দফা দাবিতে আন্দোলনকারীরা মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় উপাচার্য কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয়।
তারা অন্তত তিনটি ফটক একে একে ভেঙে বেলা দেড়টার দিকে উপাচার্যের দরজার সামনের করিডোরে অবস্থান নেন।
তিন ঘণ্টার বেশি অবরুদ্ধে থাকার পর বিকাল সোয়া ৩টার দিকে বোর্ড অব এডভান্সড স্টাডিজের একটি সভায় অংশ নিতে সিনেট ভবনে যেতে নিজের কার্যালয়ের পেছনের ফটক দিয়ে বের হন উপাচার্য; পথে উপাচার্যের চারপাশ ঘিরে অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা।
এ সময় আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র মাসুদ আল মাহাদী উপাচার্যের কাছে তাদের দাবিগুলো তুলে ধরে তা পূরণের ঘোষণা দিতে আহ্বান জানান।
জবাবে উপাচার্য আখতারুজ্জামান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী নিয়মতান্ত্রিকভাবে একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জবাবে আন্দোলনকারীরা প্রক্টরের পদত্যাগ এবং শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মামলা প্রত্যাহারের দুটি দাবি মেনে নেওয়ার তাৎক্ষণিক ঘোষণা দিয়ে যেতে চাপ দেন।
এর মধ্যেই বেলা পৌনে ৪টার দিকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আবিদ আল হাসানসহ ছাত্রলীগের ২০-২৫ জন নেতাকর্মী ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন।
তারা উপাচার্যকে আন্দোলনকারীদের ঘেরাও থেকে মুক্ত করে তাকে তার কার্যালয়ে নিয়ে যান।
এসময় উপাচার্যের কক্ষের সামনের করিডোরে অবস্থান নেওয়া আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের রড নিয়ে তাড়া করেন ছাত্রলীগের কয়েক কর্মী, মারধরও করা হয় তাদের।
এসময় কিছুক্ষণের জন্য অবরোধকারীদের উপাচার্যের দরজার সামনে রেখে সরে গেলেও বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে বিভিন্ন হল থেকে বিপুল সংখ্যক ছাত্রলীগ নেতাকর্মী এসে লোহার রড ও লাঠিসোঁটা নিয়ে আন্দোলনকারীদের উপর চড়াও হয়।
হামলার পর উপাচার্য কার্যালয় থেকে সিনেট ভবনের দিকে যাওয়ার ফটক দিয়ে চলে যেতে চাইলে সেখানে আরেকদল ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর হামলার শিকার হয় আন্দোলনকারীরা।
এরপর ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে ধাওয়া করে মারধর করা হয় বলে আন্দোলনকারীদের অভিযোগ। এসময় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দীকে বেধড়ক পেটানো হয়।
এই ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মোট ২৪ জন চিকিৎসা নিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান বলে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক সানাউল হক সাজ্জাদ জানিয়েছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এর মধ্যে একজনের মাথায় আঘাত লেগেছে, কয়েকজনের রয়েছে লাঠিসোঁটার আঘাত। বাকিরা কিল-ঘুষিতে জথম হন।”
সন্ধ্যায় হাসপাতালে ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি ও প্রগতিশীল ছাত্র জোটের সমন্বয়ক ইমরান হাবিব রুম্মন এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, “ছাত্রলীগ নির্মমভাবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালিয়েছে। এতে অর্ধশত জন আহত হয়েছে।”
আহতদের মধ্যে লিটন নন্দী, উম্মে হাবিবা, তুহিন, ইভা, তমা, মাহদী ছাড়াও রয়েছেন মোহায়মেন আহমেদ, আবু রায়হান, মেঘলা, তাবাসসুম তাবরিজ, সাদিকুর রহমান, জওহর লাল রায়।
ইমরান বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম আমরা। তিনি কথা না শুনে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালিয়েছেন।”
সারাদেশে বুধবার বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করে তিনি বলেন, এরপর মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করে পরবর্তী কর্মসূচি দেওয়া হবে।
ঢাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে সিপিবি, বাসদ ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা।
এদিকে হামলার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছাত্রলীগ এখানে হস্তক্ষেপ বা মারামারি করতে যায়নি।
“ছাত্রদল এবং জামায়াত-শিবির এবং কিছু বাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে অবরুদ্ধ এবং তার উপর হামলা করেছে শুনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে সেখানে গিয়েছিল ছাত্রলীগ।”
উপাচার্য ও প্রক্টর কার্যালয়ের ফটক ভাংচুরকারী শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারের দাবি জানান ছাত্রলীগ সভাপতি।
ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইন বলেন, “বাইরে থেকে অছাত্র, সন্ত্রাসীদের নিয়ে এসে ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ অস্থিতিশীল করার জন্য উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করার খবর শুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা উপাচার্যকে উদ্ধার করতে গিয়েছিল।”
দিনের ঘটনার বর্ণনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কতিপয় সহিংস শিক্ষার্থী ও বহিরাগত যুবক রড, লোহার পাইপ, ইট, পাথর নিয়ে উপাচার্য ভবনের তিনটি ফটকের তালা ভেঙে উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে অশালীন বক্তব্য দিচ্ছিল। তাদের একটি প্রতিনিধি দলকে উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে বলা হলেও তারা শোনেনি।
উপাচার্য বোর্ড অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজ সভায় যাওয়ার জন্য বের হলে ‘উদ্ধত, উত্তেজিত ও উচ্ছৃঙ্খল আন্দোলনকারীরা’ তার পথ রোধ করে বলে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।
এতে বলা হয়, উপাচার্য তদন্ত সাপেক্ষে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলেও আন্দোলনকারীরা তা প্রত্যাখ্যান করে অশালীন বক্তব্য দিতে থাকে।
“এক পর্যায়ে উপাচার্যের প্রতি বলপ্রয়োগ ও আক্রমণ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্য ও শিক্ষার্থীরা মানব বলয় তৈরি করে উপাচার্য মহোদয়কে তার কার্যালয়ে ফিরিয়ে আনে।”
আন্দোলনকারীদের উপর হামলার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে কিছু বলা হয়নি।
আন্দোলনকারীরা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এই ঘটনা ঘটিয়েছে দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, “আন্দোলনের নামে ধ্বংসাত্মক ও নাশকতামূলক ধারাবাহিক কার্যক্রমের আরও একটি বড় ধরনের অপপ্রয়াস।”
নাশকতামূলক, নিপীড়নমূলক, সন্ত্রাসী কার্যক্রম যারাই চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।