‘পঁচাত্তরের পর শহীদসন্তান পরিচয় দিতে ভয় লাগত’

পঁচাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পরে শহীদের সন্তান পরিচয় দিতে ভয় পেতেন বলে জানিয়েছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী এস এম এ রাশীদুল হাসানের মেয়ে রোকাইয়া হাসিনা নীলি।

নিজস্ব প্রতিবেদকও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Dec 2017, 07:50 PM
Updated : 14 Dec 2017, 07:56 PM

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি চিরন্তন চত্বরে শীহ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত ‘শহীদদের স্মৃতিচারণ ও প্রদীপ প্রজ্জ্বালন’ কর্মসূচিতে একথা বলেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন এস এম এ রাশীদুল হাসান। স্বাধীনতার প্রাক্কালে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর তাকে হত্যা করে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী।

রোকাইয়া হাসিনা নীলি বলেন, “পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে আমরা ভুলতে বসেছিলাম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কথা, শহীদদের জীবন দেওয়ার কথা। একটা সময় ছিল, শহীদের সন্তান পরিচয় দিতে আমার ভয় লাগত। মনে হত পরিচয় দিলে বোধ হয় আমার ক্ষতি হবে। আমার বড় ভাইয়ের চাকরি হবে না, আমার মাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা থেকে বের করে দেওয়া হবে।

“সেই ইতিহাস আমরা আবার পুনরুদ্ধার করেছি। এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায়, তাই গর্ব করে বলতে পারি আমি শহীদের সন্তান।”

তিনি বলেন, “আজকে আমার কষ্টের দিন, একইসঙ্গে গর্বের দিন। কারণ সমগ্র জাতি আজকে আমার বাবাকে স্মরণ করছে। বাংলাদেশ নামক দেশটি জন্মানোর জন্য আমার বাবা জীবন দিয়েছে। সেই সূর্যসন্তানের সন্তান আমি।”

বাবার স্মৃতিচারণ করে হাসিনা নীলি বলেন, “আমার বাবা একটা কথা বলতেন- দেশ স্বাধীন হবে, দেশের নাম হবে বাংলাদেশ, আমরা বাংলায় কথা বলব, বাঙালি সংস্কৃতি ধারণ করব। 

“আজকে দেশে বিদেশি সংস্কৃতি প্রভাব বিস্তার করছে। আমরা শাড়ি পরতে ভুলে গেছি। আমরা বিদেশি পোশাকে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।”

রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায় জাতি

তরুণ প্রজন্মকে বাঙালি সংস্কৃতি ও চেতনা ধারণ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “আজ শিকড়কে ভুললে চলবে না। আপনারা মনে প্রাণে বাঙালি হোন। তাহলে আমার বাবার জীবন দেওয়া স্বার্থক হবে।”

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, “আমাদের অনুভূতিতে আছে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। বুদ্ধিজীবীরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পথ প্রদর্শক ছিলেন।”

বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় সাজাপ্রাপ্তদের বাংলাদেশে এনে দণ্ড কার্যকরের দাবি জানান তিনি।

“একইসঙ্গে আরও যারা ৩০ লক্ষ মানুষ হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত আছে তাদের বিচার অতি দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে।”

এই অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণা করেন শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের সন্তান জাহিদ সুমন এবং জহির রায়হানের ছেলে অনল রায়হান।

সন্ধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আরেক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে একাত্তরের শহীদ মধুসূদন দে’র নাতনি মধুপ্রতি দে বর্নিল বলেন, একাত্তরের কালরাতে দাদা, দাদী এবং ভাই-ভাবীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে তার বাবা সারাজীবন মানসিক সমস্যায় পার করেছেন।

“আমার বাবা আমৃত্যু ট্রমাটাইজড ছিলেন। তার সাইড ইফেক্টে আমার বাবার স্লিপ এপনিয়া হয়। শুধু যে আমাদের সেই প্রজন্ম দাদু সাফার করেছে তা নয়, আমার বাবাও সাফার করে গেছে মৃত্যু পর্যন্ত। আমরাও সেভাবে সাফার করছি।”

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আলোচনা সভায় শহীদ মধুসূদন দে’র নাতনি মধুপ্রতি দে বর্নিল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের প্রতিষ্ঠাতা মধুসূদন দে’র ছেলে বাবুল চন্দ্র দের মেয়ে এই বর্নিল দে। একাত্তরে মাত্র তিন বছর বয়সে বাবাকে হারানো বাবুল পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন গত ১৪ জুলাই।

পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে স্ত্রী যোগমায়া দে, ছেলে রনজিত কুমার দে ও তার স্ত্রী রীনা রাণী দের সঙ্গে শহীদ হন মধুসূদন দে, তখনকার সময়ে তার পরিচিতি ছিল মধুদা নামে।

বাবার মুখে পরিবারের সদস্যদের নৃশংস খুনের বর্ণনা শোনার কথা অনুষ্ঠানে জানান বর্নিল; নিজে এখন বাবাকে হারিয়ে তার বাবার একা একা বেড়ে ওঠার কষ্ট অনুভব করার কথা তুলে ধরেন তিনি।

বর্ণিল বলেন, “বাবা খুব বলত, তার মাকে খুব ভালোবাসত। বলত, ‘কখনো মাকে ছাড়া থাকতে পারতাম না, কিন্তু চোখের সামনে মাকে ঝাঁজরা করে দিচ্ছে, আমার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। চোখের সামনে নিজের বাবাকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সিঁড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, বাবাও আমার দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে, আমিও তার দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছি কিছু করার নাই।

“আগে শুধু বাবার মুখে শুনতাম তার এই যন্ত্রণাটা। ছোটবেলা থেকে বাবার কী রকম যন্ত্রণাটা হত, ফিল করত বাবা! একা একা বড় হওয়া, বাবা-মা, দাদা-বউদি মাথার উপর কেউ নেই। এখনতো আমারও বাবা নেই।”

১৯৯২ সালে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বাধীন গণআদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার কারণে পরবর্তীতে তার বাবার জামায়াত-শিবিরের হুমকির মুখে পড়ার কথা উল্লেখ করেন তিনি।

“বাবা গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। অনেকে পিছিয়েছে কিন্তু বাবা পিছাননি। তার কারণে জামায়াত-শিবিরের বিরূপ প্রতিক্রিয়া আমাদের সহ্য করতে হয়েছে বিভিন্নভাবে।”

অনুষ্ঠানে শহীদ এনায়েত হোসেনের ছেলে সাখাওয়াত হোসেনের মেয়ে তাহসিনুর মিত্রিতাও তার দাদাকে হত্যার ঘটনা তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, একাত্তরের ২৩ নভেম্বর থেকে শুরু করে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯৯০ জন শিক্ষক, ১৩ জন চিকিৎসক, ৬০ জন আইনজীবী, ১৮ জন লেখক-প্রকৌশলী এবং অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের প্রথমে অমানুষিক অত্যাচার করে যেন তারা মৃত্যুর পথে ঢলে পড়ে।

“কতো সহজেই আমরা সংখ্যাগুলো বলি, তাই না! কিন্তু তাদের শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার হাহাকার আমরা বুঝতে পারি না।”

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি আলী যাকের

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি আলী যাকের অনুষ্ঠানে বলেন, “যেসব বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হল, তারা বেঁচে থাকলে দেশটা অন্যরকম হতে পারত। আমরা আরও শত বছর এগিয়ে থাকতাম। তাদের বেছে বেছে নিয়ে হত্যা করা হল।”

তিনি বলেন, “তখন আমরা ভাবতাম, আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছি কেবল তাদেরকে পাকিস্তানিরা মারবে। যারা রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন না, নির্বিবাদে ছিলেন তাদের কেন মারবে? তখন আমরা বুঝতে পারিনি। তারা বিবেকের শান দেন, মানুষক জাগিয়ে রাখেন।

“কিন্তু শত্রুরা ঠিকই বুঝেছিল। তাদেরকে হত্যা করলে দেশটাকে কতোটা পিছিয়ে দেওয়া যায়, সেটা তারা বুঝেছিল।”

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আরেক ট্রাস্টি সারওয়ার আলী বলেন, “যারা পাকিস্তানি আদর্শের দিকে দেশকে নিয়ে যেতে চায়, তাদের বিষয়ে সতর্ক হওয়ার জন্য শহীদ বুদ্ধিজীবীরা আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক।”

শহীদ পরিবারের সদস্যরা বিগত ৪৬ বছর ধরে সেই যন্ত্রণা বয়ে চলেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “শহীদ সন্তানদের মায়েদের আমি কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। কারণ তারা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে সন্তানদের লালন-পালনের বোঝা টেনে নিয়ে গেছেন।”

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে ওয়েবসাইট

ওই অনুষ্ঠানে একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে ওয়েবসাইট www.intellectualmartyrsbd.com এর উদ্বোধন করা হয়।

এনার্জিপ্যাকের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান G-Gas এর এই উদ্যোগের সার্বিক তত্ত্বাবধান করছে এশিয়াটিক মার্কেটিং কমিউনিকেশনস লিমিটেড। ওয়েবসাইট তৈরিতে সহযোগিতা দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।

ওয়েবসাইট সম্পর্কে এশিয়াটিক মার্কেটিং কমিউনিকেশনসের চেয়ারম্যান আলী যাকের বলেন, “শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিদর্শন, তাদের কর্ম, তাদের আত্মত্যাগ যেন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে পারি, সেজন্য এই উদ্যোগ।”

অন্যদের মধ্যে এনার্জিপ্যাকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন রশীদ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।