প্রধান বিচারপতির দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান হবে: আইনমন্ত্রী

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে যেসব দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে, তার অনুসন্ধান হবে এবং তা দুদকের মাধ্যমে করা হবে বলে ইংগিত দিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Oct 2017, 06:42 AM
Updated : 18 Oct 2017, 11:34 AM

রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, “যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোই এন্টি করাপশন কমিশনের আওতায়। তাহলে আপনারা বুঝতেই পারছেন কে এটার অনুসন্ধান করবে, কে এটা তদন্ত করবে।”

বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিরল এক বিবৃতি আসার পর নানামুখী আলোচনার মধ্যে এই সংবাদ সম্মেলনে আসেন আইনমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “এই যে অ্যালিগেশনগুলো, এগুলোর অনুসন্ধান হতে হবে। যদি অনুসন্ধান হয়, তার যদি সত্যতা পাওয়া যায়, তাহলে এটার মামলা হবে। মামলা হলে ইনভেস্টিগেশন হবে। ইনভেস্টিগেশন হওয়ার পরে প্রশ্ন আসবে যে প্রধান বিচারপতির ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়।”

আইনে ‘যেভাবে বলা আছে’, সেভাবেই সব হবে বলে মন্তব্য করেন আইনমন্ত্রী।

শুক্রবার বিদেশ যাওয়ার আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বিচারপতি এস কে সিনহা

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে থাকা প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ছুটি নিয়ে শুক্রবার রাতে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন।

অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে তিনি ছুটি নিয়েছেন বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও রওনা হওয়ার আগে এক লিখিত বিবৃতিতে বিচারপতি সিনহা বলে গেছেন, তিনি অসুস্থ নন, ক্ষমতাসীনদের সমালোচনায় ‘বিব্রত’।

তার বিশ্বাস, সরকারের একটি মহল ‘রায় নিয়ে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়ায়’ প্রধানমন্ত্রী অভিমান করেছেন, যা অচিরেই ‘দূরীভূত হবে’ বলে তিনি মনে করেন।

প্রধান বিচারপতি দেশ ছাড়ার পরদিনই সুপ্রিম কোর্টের বিরল এক বিবৃতিতে বলা হয়, বিচারপতির সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, আর্থিক অনিয়ম, অর্থ পাচার ও নৈতিক স্খলনসহ ১১টি সুনির্দিষ্ট গুরুতর অভিযোগ জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। সহকর্মীরা এর ব্যাখ্যা চাইলে গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা বিচারপতি সিনহা দিতে পারেননি। এ কারণে তারা অভিযোগের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত একই বেঞ্চে বসতে রাজি নন।

সংবাদ সম্মেলনে আনিসুল হক বলেন, “এলিগেশন যেহেতু উঠেছে … যেভাবে এটার অনুসন্ধান করতে হয়, সেটা হবে, অনুসন্ধান করার পরে যদি এটার সত্যতা পাওয়া যায়, তাহলে নিশ্চয়ই তার পরবর্তী পদক্ষেপ যেটা- সেগুলো গ্রহণ করা হবে। এখানে পরিষ্কারভাবে আমি বলতে চাই, কেউ কিন্তু আইনের ঊর্ধ্বে নয়। সেহেতু আইনে যা বলা আছে সকলের ব্যাপারেই সেটা পালন করা হবে।”

সরকারের তরফ থেকে ওই অভিযোগ দুদকে পাঠানো হবে কি না- এমন প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, “দুদকে পাঠানোর আইন আছে, নিয়ম আছে এবং দুদক নিজেও করতে পারে সেটাও আইনে বলা আছে। দুদকে পাঠানোর ব্যাপারে বিবেচনা করব।”

প্রধান বিচারপতি দেশে থাকা অবস্থায় ওইসব অভিযোগ সরকারের হাতে এলেও তাকে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হল কেন- এমন প্রশ্ন করেন এক সাংবাদিক।

জবাবে আনিসুল হক বলেন, আইন অনুযায়ী বিচারপতি সিনহা এখনও প্রধান বিচারপতি।

“প্রধান বিচারপতি পদটি একটি প্রতিষ্ঠান ও সাংবিধানিক পদ। ফলে তার বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো বা খামখেয়ালি করে কিছু করা সমীচীন হবে না।”

বিচারপতি সিনহা দেশ ছাড়ার পরে কেন সুপ্রিম কোর্ট বিবৃতি দিল- এমন প্রশ্নে আনিসুল হক বলেন, “সেটা তো আমার নিয়ন্ত্রণে নয়। সুপ্রিম কোর্ট এই বিবৃতি দিয়েছে, তার ব্যাপারে আমি বিশেষ কথা বলতে চাই না।”

এ বিষয়ে আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “সুপ্রিম কোর্টকে নিয়ে বা যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে যদি বিতর্ক সৃষ্টি হয়, তাহলে আইন বলে, সেই প্রতিষ্ঠান একটা জবাব দিতে পারে।”

আইনমন্ত্রী বলেন, প্রধান বিচারপতি ছুটি নিয়ে ব্যক্তিগত সফরে বিদেশে গেছেন। রাষ্ট্রপতি তার অনুপস্থিতিতে সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতির কার্যভার দিয়েছেন। এ নিয়ে বিতর্কের কোনো ‘অবকাশ নেই’।

“একটি রাজনৈতিক মহল কোনো ইস্যু না পেয়ে খড়কুটো দিয়ে বিতর্ক তৈরির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। যারা এ নিয়ে বিতর্ক করছে, তাদের একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। সেটা হাসিল হয়নি বলেই তাদের এই মায়াকান্না।”

অস্ট্রেলিয়ায় রওনা হওয়ার আগে দেওয়া বিবৃতিতে বিচারপতি সিনহা নিজেকে ‘সম্পূর্ণ সুস্থ’ বলেন। তিনি বলেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনায় তিনি ‘বিব্রত’। বিচার বিভাগ যাতে ‘কলুষিত না হয়’, সেজন্য তিনি নিজেই ‘সাময়িকভাবে’ যাচ্ছেন এবং আবার ফিরে আসবেন।

প্রধান বিচারপতির ওই বক্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করে আইনমন্ত্রী বলেন, “যখন প্রধান বিচারপতি তার বাসস্থান ত্যাগ করেন, তখন কাউকে অ্যাড্রেস না করা একটা লিখিত জিনিসে বলেছেন, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। আমি তার এই বক্তব্যে নিশ্চয়ই হতভম্ব।”

বিচারপতি সিনহা অসুস্থতার কথা জানিয়ে ছুটি চেয়ে যে চিঠি রাষ্ট্রপতিকে পাঠিয়েছিলেন, পরে বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করে যে চিঠি দিয়েছিলেন এবং ওই দুটি চিঠির প্রেক্ষিতে আইন সচিবকে পাঠানো সুপ্রিম কোর্টের ফরোয়াডিং লেটারগুলো সংবাদ সম্মেলনে পড়ে শোনান আইনমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “আমি আপনাদেরকে চিঠি পড়ে শোনালাম, পরিষ্কার করে দিলাম, একজন প্রধান বিচারপতির নিজ হস্তে সই করা চিঠি… এবং সেটা অন্য কাউকে লেখা নয়, সেটা মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে লেখা চিঠি,  তিনি বলেছেন, তিনি অসুস্থ। তাহলে আমি আইনমন্ত্রী হিসেবে অন্য কোনো কথা বলতে পারি না।”

প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ প্রমাণিত হলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে হবে কি না- সেই প্রশ্ন সংবাদ সম্মেলনে করেন একজন সাংবাদিক।

জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে পুনঃস্থাপিত করা হয়েছে। সরকার ওই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

“সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আছে কি না সেটা সম্পর্কেও যে দ্বিমত আছে সেটা আপনারা জানেন।… যেহেতু রিভিউ করব, সে কারণে এটা (বিচারপতি অপসারণ) সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ব্যাপার বলে আমার মনে হয় না।… এখানে একটা ভ্যাকুয়াম আছে। কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতির কিছু ইনহারেন্ট পাওয়ার আছে, সেটা তিনি ব্যবহার করতে পারেন।”

এ প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, প্রধান বিচারপতির বিষয়ে যেসব অভিযোগ দেওয়া হয়েছে সেগুলো নিয়ে তিনি কোনো কথা বলবেন না, কেননা তিনি ‘নিরপেক্ষ থাকতে চান’।