‘বিব্রত, শঙ্কিত’ বিচারপতি সিনহার বিদেশযাত্রা

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে থাকা প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ৩৯ দিনের ছুটিতে অস্ট্রেলিয়ার পথে রওনা হয়েছেন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে নিজের আশঙ্কার কথা জানিয়ে।

সুমন মাহমুদ কামাল তালুকদার, পিয়াস তালুকদার ও গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Oct 2017, 04:08 PM
Updated : 14 Oct 2017, 06:34 AM

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে বিচারপতি সিনহা ছুটিতে গেছেন। কিন্তু শুক্রবার রাতে বিদেশে যাওয়ার সময় তা নাকচ করে তিনি বলেছেন, অসুস্থ নন, ক্ষমতাসীনদের সমালোচনায় তিনি ‘বিব্রত’।

“আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সরকারের একটি মহল আমার রায়কে ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করে পরিবেশন করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার প্রতি অভিমান করেছেন, যা অচিরেই দূরীভূত হবে বলে আমার বিশ্বাস।”

চাপ দিয়ে প্রধান বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠানোর যে অভিযোগ বিএনপি করছিল, তাও নাকচ করেছেন বিচারপতি সিনহা। বলেছেন, বিচার বিভাগ যাতে ‘কলুষিত না হয়’, সেজন্য তিনি নিজেই ‘সাময়িকভাবে’ যাচ্ছেন।

সাড়ে তিন মাস চাকরির মেয়াদ থাকা প্রধান বিচারপতি উচ্চ আদালতে সরকারের হস্তক্ষেপের আশঙ্কার কথাও বলেছেন। রাষ্ট্রের জন্য তা ‘কল্যাণ বয়ে আনবে না’ বলে তিনি সরকারকে সতর্ক করেছেন।

সিঙ্গাপুর এয়ালাইন্সের ফ্লাইট এসকিউ ৪৪৭ এ শুক্রবার রাত ১১টা ৫৭ মিনিটে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়েন প্রধান বিচারপতি। সেখানে তিনি তার মেয়ে সূচনা সিনহার বাসায় উঠবেন বলে সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

শোনা যাচ্ছিল, স্ত্রী সুষমা সিনহাও যাচ্ছেন প্রধান বিচারপতির সঙ্গে; হেয়ার রোডের বাসা থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাওয়ার সময় স্বামীর সঙ্গে গাড়িতেও ছিলেন তিনি।

তবে শেষ পর্যন্ত বিচারপতি সিনহা একাই উড়োজাহাজে ওঠেন। মিসেস সিনহা তাকে তুলে দিতে এসেছিলেন বলে হাই কোর্টের প্রটোকল কর্মকর্তা আবদুল ওয়ারেস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।

সিঙ্গাপুর এয়ালাইন্সের ডিউটি ম্যানেজার মো. জুনায়েদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ফ্লাইট সময়মতই ছেড়ে গেছে। প্রধান বিচারপতি একাই ছিলেন, স্ত্রী সঙ্গে যাননি। সিঙ্গাপুর হয়ে শনিবার অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছাবে ওই ফ্লাইট।

দায়িত্বে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশে আর কোনো প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে প্রকাশ্যে এত আলোচনা-সমালোচনা হয়নি। আর কোনো প্রধান বিচারপতির বিদেশযাত্রা সংবাদমাধ্যমের এতটা মনোযোগও আকর্ষণ করেনি।

বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করে বিচারপতি সিনহার দেওয়া চিঠির বরাতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, প্রধান বিচারপতি চারটি দেশে যেতে চান। 

“অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা এবং ইউনাইটেড কিংডম- এই চারটি দেশে যেতে চান। আগামীকাল ১৩ অক্টোবর দেশ ত্যাগ করতে চান এবং ১০ নভেম্বর দেশে ফিরে আসবেন বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।”

প্রথমে প্রধান বিচারপতির জন্য ৩ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত ৩০ দিনের ছুটি মঞ্জুর করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু বিচারপতি সিনহা যেহেতু আরও বেশি দিন বিদেশে থাকবেন, সেহেতু রাষ্ট্রপতি বৃহস্পতিবার নতুন আদেশ দেন।

আইন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বর্ধিত ছুটিতে প্রধান বিচারপতির বিদেশে অবস্থানের সময়ে, অর্থাৎ ২ নভেম্বর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত, অথবা তিনি ‘দায়িত্বে না ফেরা পর্যন্ত’ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা প্রধান বিচারপতির কার্যভার সম্পাদন করবেন।

শেষ বেলার নাটকীয়তা

# ছুটিতে থাকা প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা যে শুক্রবারই অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছেন, আগের দিনই তা স্পষ্ট করেছিলেন আইনমন্ত্রী।

# শুক্রবার সকাল থেকেই প্রধান বিচারপতির হেয়ার রোডের বাসার সামনে ভিড় করেছিলেন সাংবাদিকরা। দুপুরের পর প্রধান বিচারপতির বোন, বড় ভাইয়ের মেয়ের জামাই ও চাচাতো ভাই বাসায় এসে বিচারপতি সিনহার সঙ্গে দেখা করে যান।

#  সন্ধ্যায় প্রধান বিচারপতির প্রটোকলের ও তার ব্যক্তিগত গাড়ি ওই বাসার ফটকে পৌঁছায়। প্রধান বিচারপতির একান্ত সচিব মো. আনিসুর রহমান বাসায় ঢোকেন সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে।

# হাই কোর্টের প্রটোকল অফিসার মোহাম্মদ আব্দুল ওয়ারেস সন্ধ্যা ৭টায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি স্যারের বাসায় এসেছি। মালামাল নিয়ে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেব।”

# ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা রাশেদা সুলতানা নিশ্চিত করেন, রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে অস্ট্রেলিয়ায় রওনা হচ্ছেন প্রধান বিচারপতি। 

# হাই কোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার সাব্বির ফয়েজ রাত ৯টার দিকে প্রধান বিচারপতির বাসায় ঢোকেন।

# রাত পৌনে ১০টার দিকে প্রধান বিচারপতির গাড়ি যখন বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হল, ওই বাসভবনের ফটকের সামনে তখন শতাধিক সংবাদকর্মীর ভিড়। প্রধান বিচারপতি প্রথমে গাড়ির বাঁ দিকের কাচ নামিয়ে হাত নাড়েন। পাশেই ছিলেন স্ত্রী সুষমা সিনহা।

# সাংবাদিকরা সমস্বরে বলতে থাকেন- ‘স্যার কিছু বলুন, আপনি কেমন আছেন?’ এরপর প্রধান বিচারপতি গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এসে সাম্প্রতিক টানাপড়েন নিয়ে মুখ খোলেন। বাংলাদেশে সাংবাদিকরা বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মুখোমুখি হয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ পেলেও প্রধান বিচারপতির ক্ষেত্রে তা বিরল।   

“আমি অসুস্থ নই। আমি ভালো আছি।

“আমি পালিয়ে যাচ্ছি না, আমি আবার ফিরে আসবো। আমি কিছুটা বিব্রত।

“আমি বিচার বিভাগের অভিভাবক। বিচার বিভাগের স্বার্থে, বিচার বিভাগ যাতে কোনোমতে কলুষিত না হয়, সেজন্য আমি সাময়িকভাবে যাচ্ছি। আমি আবার ফিরে আসব।”

“আমি কারও প্রতি বিরাগ নই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সরকারকে ভুল বোঝানো হয়েছে।”

# সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেওয়ার পর কোটের ডান পকেট থেকে একটি ভাঁজ করা কাগজ গাড়ির সামনে সাংবাদিকদের সামনে উঁচিয়ে ধরে প্রধান বিচারপতি বলেন, তার বক্তব্য সেখানে লেখা আছে।

# এরপর ডান পা বাড়িয়ে গাড়িতে উঠতে গিয়েও আবার পেছনে ফিরে বলেন, “আমি কারো চাপে যাচ্ছি না। আমি নিজেই যাচ্ছি।”

# প্রধান বিচারপতি তার নামফলকওয়ালা গাড়িতে চড়ে রাত ৯ টা ৫৬ মিনিটে বিমানবন্দরের দিকে রওনা হন। পেছনে ছিল তিনটি প্রাইভেট কার, তাতে কয়েকজন বিচারপতিও ছিলেন।

# বিচারপতি সিনহা বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে প্রবেশ করেন ১০টা ৪০ মিনিটে। তার আগেই দুটো মাঝারি আকারের স্যুটকেস ও একটি ছোট কার্টন বেল্টে তুলে দেওয়া হয় বলে প্রটোকলের কর্মকর্তারা জানান।

# রাত ১১টা ৪৯ মিনিটে বিমানে ওঠেন প্রধান বিচারপতি। আট মিনিটের মাথায় সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ঢাকা ছেড়ে যায়।

আড়াই মাসের টানাপড়েন

অগাস্টের শুরুতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর থেকেই ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার মুখে ছিলেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।

সংবিধানের ওই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু রায়ে তা বাতিল করে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনে সুপ্রিম কোর্ট।

সাত বিচারপতির ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেওয়া ৭৯৯ পৃষ্ঠার ওই রায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নিজের পর্যবেক্ষণের অংশে দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করেন।

ওই রায় এবং পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা, এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে বঙ্গবন্ধুকে ‘খাটো করা হয়েছে’ অভিযোগ তুলে বিচারপতি সিনহার পদত্যাগের দাবি তোলেন ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা।

অন্যদিকে সংসদের বাইরে থাকা বিএনপির নেতারা ওই রায়কে স্বাগত জানিয়ে আসছেন। তাদের অভিযোগ, ওই রায়ের কারণেই চাপ দিয়ে প্রধান বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।

ওই অভিযোগ অস্বীকার করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিচারপতি সিনহার স্বাক্ষরে রাষ্ট্রপতিকে পাঠানো ছুটির চিঠি গত ৪ অক্টোবর সাংবাদিকদের দেখান।

ওই চিঠির বক্তব্য ছিল, প্রধান বিচারপতি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এর আগে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন এবং গত বেশ কিছুদিন ধরেও বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। এ কারণে বিশ্রামের জন্য তিনি ছুটিতে যেতে চান।

আইনমন্ত্রী বৃহস্পতিবারও বলেছিলেন, বিচারপতি সিনহা যেভাবে চেয়েছেন, সেভাবেই তার ছুটির প্রজ্ঞাপন হয়েছে ।

সরকার ও বিএনপি নেতাদের এই কথার লড়াইয়ের মধ্যে বিদেশযাত্রার সময় লিখিত বিবৃতিতে নিজের বক্তব্য জানিয়ে গেছেন বিচারপতি সিনহা। 

সেখানে তিনি লিখেছেন- “আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি, কিন্তু ইদানিং একটা রায় নিয়ে রাজনৈতিক মহল, আইনজীবী ও বিশেষভাবে সরকারের মাননীয় কয়েকজন মন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ব্যক্তিগতভাবে যেভাবে সমালোচনা করেছেন, এতে আমি সত্যিই বিব্রত।”

২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পাওয়া বিচারপতি সিনহার চাকরির মেয়াদ রয়েছে আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত।

সুপ্রিম কোর্টের অবকাশ শুরুর আগে গত ২৪ অগাস্ট তিনি শেষ অফিস করেন এবং অবকাশ শেষে ৩ অক্টোবর আদালত খোলার দিন থেকে ছুটিতে আছেন।

তার অবর্তমানে প্রধান বিচারপতির কার্যভার পাওয়া বিচারপতি ওয়াহহাব মিঞা শিগগিরই কিছু প্রশাসনিক পরিবর্তন আনবেন বলে যে তথ্য আইনমন্ত্রী দুদিন আগে সাংবাদিকদের দিয়েছেন, তা নিয়ে বিবৃতিতে উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন বিচারপতি সিনহা। 

“প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিংবা সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোনো রেওয়াজ নেই। তিনি শুধুমাত্র রুটিন মাফিক দৈনন্দিন কাজ করবেন। এটাই হয়ে আসছে।

“প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করলে এটি সহজেই অনুমেয় যে, সরকার উচ্চ আদালতে হস্তক্ষেপ করছে এবং এর দ্বারা বিচার বিভাগ ও সরকারের মধ্যে সম্পর্কের আরও অবনতি হবে।”

সেক্ষেত্রে তা ‘রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না’ বলে সতর্ক করেন তিনি।