গোবিন্দগঞ্জে চিনিকলের বিরোধপূর্ণ জমি থেকে উচ্ছেদের সময় গুলির ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠনের আদেশে সাঁওতালদের ‘বাঙ্গালী দুষ্কৃতিকারী’ বলায় গাইবান্ধার জেলা প্রশাসককে তলব করেছে হাই কোর্ট।
Published : 06 Dec 2016, 04:04 PM
গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক মো. আব্দুস সামাদকে আগামী ১২ ডিসেম্বর হাই কোর্টে হাজির হয়ে তার ব্যাখ্যা দিতে হবে।
ওই উচ্ছেদের ঘটনায় দায়ের করা দুটি রিট আবেদনে দেওয়া রুলের শুনানিতে মঙ্গলবার গাইবান্ধার জেলা প্রশাসকের দেওয়া একটি প্রতিবেদন পর্যালোচনার পর বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের হাই কোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেয়।
আদালত বলেছে, ‘বাঙ্গালী দুষ্কৃতিকারী’ একটি উন্নাসিক শব্দ। এ ধরনের শব্দ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা ব্যবহার করত। জেলা প্রশাসক ‘আইন অমান্যকারী’ বা অন্য কোনো শব্দ ব্যবহার করতে পারতেন। তা না করে কেন তিনি ‘বাঙ্গালী দুস্কৃতিকারী’ লিখেছেন, তার ব্যাখ্যা জানা প্রয়োজন।
সাঁওতালদের পক্ষে করা প্রথম মামলার বাদী স্বপন মরমুকেও ১২ ডিসেম্বর আদালতে হাজির করতে গাইবান্ধার পুলিশ সুপার ও গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।
সাঁওতালদের ভূমি উদ্ধার আন্দোলন ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার আন্দোলনের নেতাদের অভিযোগ, ওই মামলা ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে করা হয়নি। অন্যদিকে পরিবার বলছে, স্বপনের কোনো খোঁজ তারা পাচ্ছেন না।
সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রামের ১ হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি ১৯৬২ সালে অধিগ্রহণ করে রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ চাষের জন্য সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার গড়ে তুলেছিল। সেই জমি ইজারা দিয়ে ধান ও তামাক চাষ করে অধিগ্রহণের চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ তুলে তার দখল ফিরে পেতে আন্দোলনে নামে সাঁওতালরা।
এরপর সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মে বিরোধপূর্ণ চিনিকলের জন্য অধিগ্রহণ করা ওই জমিতে কয়েকশ ঘর তুলে সাঁওতালরা বসবাস শুরু করেন। গত ৬ নভেম্বর চিনিকল কর্তৃপক্ষ জমি উদ্ধার করতে গেলে সংঘর্ষ বাঁধে। সংঘর্ষের সময় সাঁওতালদের বাড়িঘরে লুটপাট হয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায়। ওই ঘটনায় নিহত হন তিন সাঁওতাল, আহত হন অনেকে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ওই জমি সাঁওতালদের ছিল না। ‘ভূমিদস্যুরা’ সাঁওতালদেরকে ‘ব্যবহার করেছে’। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সাঁওতালদের দিয়ে ‘দখল করিয়ে পরে নিজেদের দখলে নেওয়া’। অন্যদিকে সাঁওতাল পল্লীর বাসিন্দারা বলছেন, তারা ‘বাপ-দাদার জমিতে’ থাকার অধিকার চান।
গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালদের জানমাল রক্ষা, নিরাপত্তা, ক্ষতিপূরণ, স্বাধীনভাবে চলা-ফেরার সুযোগ দিতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), ব্রতী সমাজ কল্যাণ সংস্থা গত ১৬ নভেম্বর হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করে।
পরদিন এ বিষয়ে শুনানি করে সাঁওতালদের ধান কাটার সুযোগ দিতে অথবা ধান কেটে তাদের বুঝিয়ে দিতে চিনিকল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেয় আদালত। সাঁওতালদের সম্পত্তি ও জানমাল রক্ষায় ‘প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না’- তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করা হয়।
পাশাপাশি উচ্ছেদ হওয়া সাঁওতালদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং বাইরে চলাচলের ক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা দিতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেয় আদালত। তাদের নিরাপত্তার জন্য কী কী আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং উচ্ছেদের সময় ভাংচুর-লুটপাটের ঘটনায় কয়টি মামলা হয়েছে সে বিষয়ে গাইবান্ধার পুলিশ সুপার ও গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসিকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
সে অনুযায়ী জেলা প্রশাসক ও পুলিশ কর্তৃপক্ষ আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে, যেখানে তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়ে জেলা প্রশাসকের ওই আদেশের অনুলিপিও ছিল।
পরদিন এ বিষয়ে শুনানি করে রুল দেয় আদালত। সাঁওতালদের উচ্ছেদের নামে তাদের মারধর, লুটপাট, গুলি ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং উচ্ছেদের নামে ওইসব কর্মকাণ্ড কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।
আসকের রিট আবেদনে দেওয়া রুলের শুনানিতে মঙ্গলবার আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী এম আমিনউদ্দিন আদালতকে বলেন, সাঁওতালদের নামে করা প্রথম মামলার বাদী স্বপন মুরমু আদৌ সাঁওতাল নন, তিনি মাহালি সম্প্রদায়ের। পিবিআইয়ের মাধ্যমে গোবিন্দগঞ্জের ঘটনার তদন্ত চান এই আইনজীবী।
অন্য রিট আবেদনে দেওয়া রুলের শুনানিতে জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের আদেশ চান।
এ সময় বিচারক বলেন, “এটা আমরা পরে দেখব। আগে আদেশ দেই।”
এরপর “বাঙ্গালী দুস্কৃতিকারী’ শব্দ চয়নের ব্যাখ্যা চেয়ে জেলা প্রশাসককে তলবের আদেশ দেয় হাই কোর্ট।