‘আমরা না কি বঙ্গবন্ধুর কন্যা?’

একাত্তরে পাকস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের শিকার নারীদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজের ‘কন্যা’ বললেও পঁচাত্তরের পর থেকে এখনও তাদের সত্যিকারে সামাজিক স্বীকৃতি মেলেনি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এক নারী মুক্তিযোদ্ধা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Nov 2016, 05:33 PM
Updated : 15 Nov 2016, 05:33 PM

মঙ্গলবার বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রমেশ চন্দ্র মজুমদার মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বর্তমানের দুঃখ-দুর্দশা ও লাঞ্ছনার কথা জানান হনুফা নামের ওই বীরাঙ্গনা।

তিনি বলেন, “‍আমরা নাকি বঙ্গবন্ধুর কন্যা? শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা কেমন আছেন, আর আমরা কেমন আছি? আমাদের খোঁজ তো তারা নেয় না। বোন তো বোনের খোঁজ নেয়। আমরা না খেয়ে থাকলেও কেউ কখনো আমাদের খোঁজ নেয় না।

“আমার নিজের ছেলে আমাকে বলে, ‘তুমি আমার মা না, তোমার পরিচয় দিতে আমার লজ্জা করে’। আমার স্বামী আজ থেকেও নেই। আমার পরিবার এখন ধ্বংসের পথে। আজ থেকে ৪৬ বছর আগের ঘটনা অথচ এখনও ভুলতে পারছি না।”

সামাজিক এই লাঞ্ছনায় যুদ্ধের পর বেঁচে থাকাকেই অভিশাপ হিসেবে ভাবতে শুরু করা এই বীরাঙ্গনা এক একবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন বলেও জানান।

“আমি যদি না বেঁচে একাত্তরে মরে যেতাম তবেই ভালো হত। ইতিহাসের পাতায় আমার নাম লিখে সবাই আজ দরদ দেখাত। আমি আত্মহত্যা করার জন্য গায়ে কেরোসিন ঢেলে ছিলাম।”

সব নারী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চেয়ে প্রধানমন্ত্রীকে সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান জানান হনুফা।

“আমরা ভাতা চাই না, আমরা স্বীকৃতি চাই। প্রধানমন্ত্রী, আমাদের একটু দেখেন।”

একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রায় চার লাখ বাঙালি নারী পাকস্তানি বাহিনী ও তাদের বাংলাদেশি দোসরদের হাতে নির্যাতিত হন। অনেকের মতো এ সংখ্যা প্রায় ছয় লাখ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নির্যাতিত অনেক নারী আশ্রয়হীন হয়ে সামাজিক লাঞ্ছনার মধ্যে আত্মহত্যা করেন।

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যা‌তিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সম্মান জানান।  ওই সময় আশ্রয়হীন বীরাঙ্গনাদের পিতার পরিচয়ের জায়গায় তার নাম ও ঠিকানার পাশে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ঠিকানা লিখে দিতেও বলেছিলেন।

তার নির্দেশনায় বীরাঙ্গনাদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়, যা ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আগ পর্য‌ন্ত চলছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এই প্রক্রিয়াটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি সামরিক শাসকদের মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানি জান্তার সহযোগীদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরইমধ্যে এ বিষয়ে আদালতের নির্দেশনাও আসে। শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর গতবছর ১০ অক্টোবর বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল। গত বছরের ২৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে ওই প্রস্তাব পাস হয়।

এর পর থেকে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এখন পর্যন্ত কয়েকটি ধাপে প্রায় ১০০ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির গেজেট প্রকাশিত হয়েছে।

রমেশ চন্দ্র মজুমদার মিলনায়তনে ‘দ্য স্প্রেকট্রাল ওয়োন্ডেড: সেক্স ভায়োলেন্স, পাবলিক মেমোরিস অ্যাণ্ড বাংলাদেশ ওয়ার অব ১৯৭১’ শিরোনামের অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে আয়োজন করে সামাজিক সহায়তা উদ্যোগ এবং অপরাজেয় বাংলা নামে সংগঠন।

অনুষ্ঠান থেকে আয়োজকদের পক্ষ থেকে নয় জন নারী মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মাননা দেওয়া হয়। তাদের হাতে নগদ পাঁচ হাজার টাকা ও ক্রেস্ট তুলে দেন সংগঠনের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন।

সম্মাননা পাওয়াদের আটজন হলেন- বীরমাতা হনুফা, সাবিহা আহমেদ, সন্ধ্যা রানী ঘোষ, কাননী গোমেজ, রিজিয়া বেগম, রেজিয়া বেগম, নূর জাহান আক্তার ও নূর জাহান বেগম ।

সামাজিক সহায়তা উদ্যোগের পরিচালক এবং অপরাজেয় বাংলার চেয়্যারম্যান অধ্যাপক আবু মো. দেলোয়ার হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরীন আহমাদ, নৃবিজ্ঞান বিভাগের রিডার ও ডারহাম ইউনিভার্সিটি গবেষণা পরিচালক ড. নয়নিকা মুখার্জি এবং যুক্তরাজ্যের ডারহাম ইউনিভার্সিটির গবেষণা পরিচালক ড. সলিমুল্লাহ খান।

অতিথিরি বক্তব্যে অধ্যাপক নাসরীন আহমেদ সরকার প্রকাশিত নারী মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট থেকে যাদের নাম বাদ পড়েছে, তাদের খোঁজ খবর নেওয়ার পাশাপাশি প্রকৃত বীরাঙ্গনাদের মোট সংখ্যা বের তাদের গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান।

অধ্যাপক নাসরীন আহমদ বলেন, “রাষ্ট্রের দায়িত্ব বীরাঙ্গনাদের যথাযথভাবে দেখভাল করা। এরাও মুক্তিযোদ্ধা। এসব বীরাঙ্গনারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তাদের প্রতি রাষ্ট্র ও সকল নাগরিকের সম্মান প্রদর্শন করা উচিত।

“সম্প্রতি বীরাঙ্গনাদের ভাতা প্রদানে সরকারিভাবে একটি গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে।এতে যাদের নাম প্রকাশ করা হয়েছে, তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য।”

অনুষ্ঠানে বীরাঙ্গনাদের ওপর বাংলাদেশ শিল্পকল্পা একাডেমি নির্মিত তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।