আদালতের দোহাই সকালে বস্তিবাসী দিলেও তা শোনেননি গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা, দুপুরে হাই কোর্টের নিষেধাজ্ঞা আসার পর অভিযান বন্ধ হয়, তবে ততক্ষণে কল্যাণপুর পোড়া বস্তির এক-চতুর্থাংশ উচ্ছেদ হয়ে গেছে।
Published : 21 Jan 2016, 09:48 PM
ঢাকার কল্যাণপুরে হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বেদখল জমি উদ্ধারে নতুন বাজারসহ এই বস্তি উচ্ছেদে বৃহস্পতিবার অভিযান চালায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদপ্তর। এসময় বস্তিবাসীর সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয় পুলিশের।
দুপুরে উচ্ছেদ অভিযানে আদালতের নিষেধাজ্ঞার খবর চাউর হওয়ার পরও গণপূর্ত বিভাগের তিনটি বুলডোজার সচল ছিল।
বেলা ২টায় সেখানে থাকা গণপূর্ত বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেট নূর আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এখনও অফিসিয়ালি কিছু পাইনি। উচ্ছেদ অভিযান চলছে।”
তার কিছুক্ষণ পরই এই নির্বাহী হাকিম এলাকা ছড়লে অভিযান স্তিমিত হয়ে আসে। গুটিয়ে ফেলা হয় উচ্ছেদ অভিযানের সরঞ্জাম। তারপর চলে যায় অভিযানে সহায়তাকারী পুলিশ সদস্যরাও।
মিরপুর থানার উপ-পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,“বিকাল সাড়ে ৪টার পর পুলিশ পোড়া বস্তি এলাকা থেকে নিজ নিজ বিভাগে ফিরে আসে।”
হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ৫০ একর এই জমিতে তিনটি বহুতল ভবন রয়েছে। তার চারপাশ ঘিরে ১৫ একর জমিতে অবৈধ বস্তি ও মার্কেট গড়ে ওঠে বলে গণপূর্ত বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেট নূর আলম জানান।
সকাল সাড়ে ৯টায় অভিযান শুরুর সময় তিনি বলেন, “এখানে ৫০ একর জায়গা, প্রায় ১৫ একর জায়গা অবৈধভাবে দখল হয়ে আছে। এই জায়গা দখলমুক্ত করার জন্যই আজকের উচ্ছেদ অভিযান।”
মিরপুর থানার ওসি ভূঁইয়া মাহাববু হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা গণপূর্তের জায়গা। আগে থেকে নোটিস দিয়ে উচ্ছেদ চালানো হচ্ছে। আমারা সহযোগিতা করতে এসেছি।”
অন্যদিকে বস্তিবাসীর কথা, এই জমির দখল নিয়ে মামলা চলছে এবং তাদের পক্ষে আদালতের আদেশও রয়েছে। তারপরও কর্তৃপক্ষ ‘অন্যায়ভাবে’ ২০ হাজার মানুষকে উচ্ছেদ করতে এসেছে।
পুলিশ ও গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা বস্তিবাসীদের দুই ঘণ্টা সময় দিলে বাসিন্দাদের একটি অংশ আতঙ্কে মালপত্র সরিয়ে নিতে শুরু করলেও আরেকটি অংশ লাঠি হাতে বিক্ষোভ শুরু করে।
তারা বস্তির প্রবেশ পথসহ ভেতরে বিভিন্ন স্থানে পথের ওপর আগুন জ্বালিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করেন। তখন পুলিশ ও বস্তিবাসীর মুখোমুখি অবস্থানে সৃষ্টি হয় উত্তেজনা।
এক পর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয় এবং বিক্ষোভকারীরা পুলিশের দিকে ইট ছুড়তে থাকে। তখন পুলিশ তাদের দিকে কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে।
তবে ডিএমপির মিরপুর বিভাগের অতিরিক্ত উপ কমিশনার মাসুদ আহমেদ বলেন, “অভিযান চলাকালে তিন নির্মাণ শ্রমিক কিছুটা আহত হন। তাকে উদ্ধার করতে স্থানীয়রা ছুটে যায়। কোনো ধরনের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়নি।”
এর মধ্যে বেলা ১২টার দিকে পুলিশের সহযোগিতায় বস্তির এক দিকে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেন গণপূর্তের ম্যাজিস্ট্রেট। বুলডোজার মার্কেট গুঁড়িয়ে দেওয়ার সময় অন্য অংশে খোলা জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করছিল বস্তিবাসী।
এর মধ্যেই এই বস্তি উচ্ছেদ কার্যক্রমে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা আসে আদালতের। ‘যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া ওই বস্তির বাসিন্দাদের উচ্ছেদ ও হয়রানি না করতে নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক আবেদনে বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর বেঞ্চ এই আদেশ দেয়।
আদালতে যখন এ বিষয়ে শুনানি চলছে, তখনও উচ্ছেদ অভিযান চলছিল। নিষেধাজ্ঞার খবর আসার পর উচ্ছেদ অভিযান চলতে থাকলেও সোয়া ২টার দিকে একটি সাদা গাড়িতে উঠে চলে যান ম্যাজিস্ট্রেট নূর আলম।
এরপর উচ্ছেদ নিয়ে কথা বলতে তার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
আদালতের নিষেধাজ্ঞার কয়েক ঘণ্টা পরও ঘটনাস্থলে অবস্থান করছিল পুলিশ। ডিএমপি মিরপুর বিভাগের উপ কমিশনার মো. কাইয়ুমউজ্জামান খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “আমরা এখনও ম্যাজিস্ট্রেট থেকে কোনো নির্দেশনা পাইনি। এ কারণে ঘটনাস্থলে অবস্থান করছি।”
সাড়ে ৪টার দিকে পুলিশ চলে যাওয়ার সময় বুলডোজারগুলো নিয়ে গণপূর্তের কর্মীরাও চলে যান।
অভিযানে কী পরিমাণ জমি উদ্ধার হয়েছিল- জানার জন্য কোনো গণপূর্তের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি। একটি বুলডোজারের চালক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রায় ২০০ ঘর ভাঙা হয়েছে।”
‘এই শীতে কই যামু’
উচ্ছেদ অভিযান স্তিমিত হয়ে যাওয়ার পর বিকালে ঘটনাস্থলে ঘুরে দেখা যায়, ঘর হারিয়ে রাস্তায় বসে থাকা মানুষগুলোর চোখে-মুখে হতাশা। তবে উচ্ছেদ বন্ধ হওয়ায় কিছুটা খুশিও ছিলেন তারা।
২১ বছর ধরে বস্তিতে বসবাসকারী অটোরিকশাচালক আলী উচ্ছেদের সময় ছলছল চোখে বলেছিলেন, “ঘর থেকে কিছুই বাইর করতে পারি নাই। দুই বাচ্চা আর বউ নিয়া এখন কোথায় যামু, কী করমু?”
তিন বছর আগে মারা যাওয়া পাপিয়া বেগমের ছেলে সুমন মায়ের স্মৃতি ধরে রাখতে এই বস্তিতে ২০ হাজার টাকায় একটি টিনের ঘর কিনে বসবাস করা শুরু করেন বলে জানান।
“প্রতি মাসে বস্তিতে পানির বিল দিতাম ১০০ টাকা, বিদ্যুৎ বিল দিতাম ৩০০ টাকা। কিন্তু তারপরও কেন গরিব মানুষগুলোর বসবাসের জায়গা কেড়ে নিতে হবে?”
বৃদ্ধ গৃহকর্মী সুফিয়া বেগম বলেন, “বাবা, সকালে উচ্ছেদে আমাগো সব হারায়ে ফেলছি। এখন রাতে এই শীতে কই যামু, তাও জানি না।”
উচ্ছেদ অভিযানে নিষেধাজ্ঞার পর বিকালে হাসি দেখা গেল অটোরিকশাচালক আলীর মুখে।
“আল্লাহ আমাগো রক্ষা করছে। তয় বাড়িঘর তো সব ভাইঙ্গা গেছে। এখন আমরা কেমনে সেগুলান মেরামত করুম। কিছুই মাথায় ঢুকতাছে না।”
অভিযান চলার সময় বস্তি ছাড়তে বাসিন্দাদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা গেলেও ম্যাজিস্ট্রেট চলে যাওয়ার পর শিথিলতা এলে বাসিন্দারা আবার ফিরে আসতে থাকেন। তবে পুলিশ যতক্ষণ ছিল, ততক্ষণ কাউকে বস্তিতে ঢুকতে দেখা যায়নি।
পুলিশ যখন চলে যাচ্ছিল তখন ওই বস্তির বাসিন্দা চা বিক্রেতা সুমন সাংবাদিক পরিচয় জেনে বললেন, “ভাই, উচ্ছেদ নাকি বন্ধ হইছে। আমাদের কি সরকার পুনর্বাসন করবো।”
আদালতে শুনানি-আদেশ
দুপুরে অভিযান চলার মধ্যে এই বস্তি উচ্ছেদ কার্যক্রমে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা আসে আদালতের। যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া ওই বস্তির বাসিন্দাদের উচ্ছেদ ও হয়রানি না করতে নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক আবেদনে বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর বেঞ্চ এই আদেশ দেয়।
এই উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনায় সহযোগিতা চেয়ে পুলিশ কর্তৃপক্ষকে দেওয়া গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের চিঠির অনুলিপি নিয়ে আদালতে যায় আসক।
উচ্ছেদ অভিযানে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে করা ওই আবেদনের পক্ষে আদালতে শুনানি করেন ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, আবু ওবায়দুর রহমান ও অবন্তী নুরুল।
২০০৩ সালে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কল্যাণপুরের ওই জমি থেকে বস্তি উচ্ছেদের উদ্যোগ নিলে আসক, একটি বেসরকারি সংস্থা এবং দুই বস্তিবাসী হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন।
তাদের আবেদনে ওই বছর ২৮ ডিসেম্বর অবকালশকালীন আদালত স্থিতাবস্থার নির্দেশ দিয়ে রুল জারি করে। পরের বছর ৫ জানুয়ারি হাই কোর্টের নিয়মিত বেঞ্চেও একই আদেশ আসে।
২০০৬ সালে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় আবারও উচ্ছেদ চালানোর জন্য চিঠি দিলে আসক ফের আদালতে যায়। ওই বছর ২৫ জুন আদালত উচ্ছেদ কার্যক্রম স্থগিতের নির্দেশ দেয়।
বিভিন্ন সময়ে এই মেয়াদ বৃদ্ধির পর ২০০৭ সালের ১৭ জানুয়ারি হাই কোর্ট রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিতাদেশের মেয়াদ বৃদ্ধি করে।
এরপরও চলতি বছর ১০ জানুয়ারি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব ওই জমিতে উচ্ছেদ চালাতে পুলিশ চেয়ে চিঠি দেয়। এই প্রেক্ষাপটে রিট আবেদনকারীরা হাই কোর্টে সম্পূরক আবেদন নিয়ে এলে বৃহস্পতিবার নিষেধাজ্ঞার আদেশ আসে।
আদেশের পর সারা হোসেন বলেন, “আদালত মন্ত্রণালয়, আইজিপি, হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও ঢাকার মহানগর হাকিমকে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বলেছেন।”