সরকারকে চাপে ফেলার জন্য ‘বাংলাদেশে বিদেশিদের স্বার্থ নিরাপদ নয়’ বোঝাতে ‘কোনো একজন শ্বেতাঙ্গকে’ হত্যার পরিকল্পনা থেকেই গুলশানের কূটনৈতিক এলাকায় ইতালির নাগরিক চেজারে তাভেল্লাকে খুন করা হয় বলে দাবি করেছে পুলিশ।
Published : 26 Oct 2015, 04:20 PM
গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, তাভেল্লার ‘তিন হত্যাকারী’সহ চারজনকে গ্রেপ্তারের পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ‘বিদেশি হত্যার এই ষড়যন্ত্রের’ বিষয়ে তারা নিশ্চিত হয়েছেন।
রাসেল চৌধুরী ওরফে চাকতি রাসেল, মিনহাজুল আরেফিন রাসেল ওরফে ভাগ্নে রাসেল ওরফে কালা রাসেল, তামজিদ আহম্মেদ রুবেল ওরফে শুটার রুবেল এবং শাখাওয়াত হোসেন ওরফে শরীফ নামের এই চারজনকে রোববার ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সোমবার তাদের হাজির করা হয় পুলিশের গণমাধ্যম কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে।
ঢাকার পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া এ সময় বলেন, কথিত এক বড় ভাইয়ের নির্দেশে ‘নির্দিষ্ট টাকার চুক্তিতে’ দুই রাসেল ও রুবেল এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়। এ কাজে তারা শরীফের মোটরসাইকেল ব্যবহার করে।
“চেজারে তাভেল্লা টার্গেট ছিলেন না। নৈরাজ্য তৈরি করে আন্তর্জাতিকভাবে সরকারকে চাপে ফেলার অপকৌশল হিসেবে এই হত্যার ঘটনা ঘটানো হয়েছে।”
কথিত সেই বড় ভাইয়ের কোনো ‘রাজনৈতিক পরিচয়’ পুলিশ কমিশনার জানাননি। তবে বিএনপি-জামায়াত জোটের দিকে ইংগিত করে তিনি বলেছেন, বছরের শুরুতে যারা ‘মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করেছে’, তারা এ ঘটনায় যুক্ত কি না- পুলিশ তা খতিয়ে দেখছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতারাও এতোদিন এ ধরনের ইংগিত দিয়ে আসছিলেন।
চেজারে তাভেল্লা, ফাইল ছবি
গত ২৮ সেপ্টেম্বর গুলশানের সড়কে তাভেল্লাকে গুলি চালিয়ে হত্যা করা পালিয়ে যায় মোটর সাইকেল আরোহী দুর্বৃত্তরা। আইসিসিও কো-অপারেশন নামে একটি সংস্থার প্রুফ (প্রফিটেবল অপরচ্যুনিটিজ ফর ফুড সিকিউরিটি) কর্মসূচির প্রকল্প ব্যবস্থাপক ছিলেন ইতালির এই নাগরিক, ঢাকায় তিনি একাই থাকতেন।
ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে বেশ কয়েকজনকে আটকের খবর এর আগে গণমাধ্যমে এলেও পুলিশের পক্ষ থেকে বিষয়টি কখনোই স্বীকার করা হয়নি।
হত্যাকাণ্ডের দিন সন্ধ্যায় গুলি শব্দের পর তিনজনকে অস্ত্র হাতে পালিয়ে যেতে দেখেছেন বলে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছিলেন। পুলিশের সরবরাহ করা সিসিটিভির ছবি প্রকাশ করে গত ২১ অক্টোবর বিভিন্ন সংবাদপত্রের খবরে বলা হয়, ওই ছবিতে থাকা তিনজনকে পুলিশ তাভেল্লার হত্যাকারী সন্দেহে খুঁজছে।
এরপর সোমবার সকালে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মুনিরুল ইসলাম ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে চারজনকে গ্রেপ্তারের খবর দেন। তিনি জানান, রোববার এই অভিযানে তাভেল্লা হত্যায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটিও জব্দ করা হয়।
পরে ঢাকার মহানগর পুলিশ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া। যুগ্ম কমিশনার মুনিরুলও এসময় উপস্থিত ছিলেন।
আছাদুজ্জামান জানান, পুলিশ গুলশান থেকে ‘চাকতি’ রাসেল, বাড্ডার সাতারকুল এলাকা থেকে ‘ভাগ্নে’ রাসেল এবং মধ্যবাড্ডা থেকে রুবেলকে গ্রেপ্তার করে। আর ‘ভাগ্নে’ রাসেলের দেওয়া তথ্যে মধ্যবাড্ডার একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় মোটরসাইকেলের মালিক শরীফকে।
“একজন কথিত বড় ভাইয়ের পরিকল্পনায় তারা ইতালীয় নাগরিককে টাকার বিনিময়ে হত্যা করে। তাদের টার্গেট ছিল সাদা চামড়ার কোনো একজন বিদেশি নাগরিক। তাভেল্লাকে তারা আগে থেকে চিনত না। ওই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই তাভেল্লাকে হত্যা করা হয়।”
কত টাকায় তারা চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল জানতে চাইলে পুলিশ কমিশনার বলেন, গ্রেপ্তাররা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে একেক জন একেক রকম অংক বলেছে। তারা বলছে, অর্ধেক টাকা আগে দেওয়া হলেও হত্যাকাণ্ডের পর তাদের বাকি টাকা দেওয়া হয়নি। বিষয়টি পুলিশ খতিয়ে দেখছে।
ওইদিন সকালে শরীফের কাছ থেকে মোটরসাইকেল ধার নিয়ে রাতে আবার তা ফেরত দেওয়া হয় বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, “তারা নেশায় আসক্ত, বিভিন্ন মামলায় তারা কারাভোগ করেছে। রুবেল ওরফে শুটার রুবেল ঠাণ্ডা মাথার খুনি। আর শরীফ ইয়াবা ও অস্ত্র বিক্রির সঙ্গে জড়িত বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।”
তিনি বলেন, পুলিশ ওই কথিত বড়ভাইকে খুঁজছে এবং হত্যার ঘটনায় ব্যবহার হওয়া অস্ত্রটি উদ্ধারের চেষ্টা করছে।
পুলিশ রাসেল চৌধুরীকে আগেই গ্রেপ্তার করেছে বলে পরিবারের অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, “হত্যার ঘটনায় জড়িয়ে থাকার পর তারা পলাতক থাকতে পারে, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে পারে, গোপন আস্তানায় পালিয়ে থাকতে পারে। তবে পুলিশ রোববারই তাদের গ্রেপ্তার করেছে।”
গ্রেপ্তারদের মধ্যে দুই রাসেল ও শরীফকে সোমবারই আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আট দিনের রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ। আর রুবেল ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে পুলিশের অপরাধ তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের সহকারী কমিশনার মিরাশ উদ্দিন জানিয়েছেন।
সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের ওয়েবসাইটে আইএসের বিবৃতি
ঢাকার পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া সংবাদ সম্মেলনে বলেন, চেজারে তাভেল্লা হত্যায় জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার ন্যূনতম আলামত তারা পাননি।
তিনি বলেন, “প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করতেই আইএস নাটক সাজানো হয়েছিল।”
হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ‘সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ’ নামে একটি জঙ্গি তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইএস-এর ‘দায় স্বীকারের’ খবর দিলেও তার কোনো ‘ভিত্তি নেই’ বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালও পরে বলেন, আইএসের নামে যে টুইট করা হয়েছে তা এসেছে বাংলাদেশ থেকেই।
যুগ্ম কমিশনার মুনিরুল ব্রিফিংয়ে বলেন, তাভেল্লা হত্যার বিষয়ে কোনো তথ্য আইএসের ওয়েবসাইটে নেই। ‘এসব বার্তা’ তারা কখনো গোপনেও দেয় না।
“এ বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে সাইট ইন্টিলিজেন্সের পরিচালক রিটা কাতজের সঙ্গে মেইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা কোনো উত্তর আমরা পাইনি।”
গুলশানের এই স্থানেই গুলি করা হয় চেজারে তাভেল্লাকে
পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান জানান, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে পুরো রাজধানীর নিরাপত্তা ব্যবস্থাই ঢেলে সাজানো হচ্ছে।
“বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ দৃশ্যমান রয়েছে। চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। গুলশান, বারিধারা ও বনানীতে এমনভাবে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে- কোনো ঘটনা ঘটলে দুই মিনেটে পুরো এলাকা ব্লক করে দেওয়া সম্ভব। এছাড়া শহরের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ সর্বস্তরের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছে।”
এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ কমিশনার বলেন, তাভেল্লা হত্যার সঙ্গে অন্য ঘটনাগুলোর কোনো সম্পর্ক তারা পাননি।
তবে গাবতলীতে তল্লাশি চৌকিতে পুলিশ হত্যা ও আশুরার তাজিয়া মিছিলে প্রস্তুতির সময় পুরান ঢাকার হোসাইনী দালানে বোমা হামলার ঘটনায় একই দলের হাত থাকার ‘বস্তুগত প্রমাণ’ পাওয়া গেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি হত্যার সঙ্গে তাভেল্লা হত্যার কোনো সম্পৃক্ততা আছে কিনা জানতে চাইলে আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, “ওই বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি না। তাই এই নিয়ে কিছু বলতে পারব না।”