রাজধানীর সীমানা ঠিক হয়নি চার দশকেও

আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার সীমানা নির্ধারণের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকলেও স্বাধীনতার চার দশকেও তা হয়নি।

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Oct 2015, 04:00 AM
Updated : 23 Oct 2015, 09:41 AM

একদিকে আইনটি হয়নি। অন্যদিকে পুলিশ, সিটি করপোরেশনসহ রাজধানীকেন্দ্রিক বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠান নিজেদের সুবিধামতো সীমানা ঠিক করে রেখেছে।

ফলে তালগোলের মধ্যেই চলছে সব কাজ। এতে আয়তন, জনসংখ্যা, শিক্ষার হার কিংবা নারী-পুরুষের হারসহ অন্যান্য তথ্য সঠিকভাবে নির্ণয় করা যাচ্ছে না বলে নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন।

পাশাপাশি সেবা দিতে গিয়েও বিভিন্ন সংস্থা সীমানা জটিলতায় পড়ছেন বলে অভিযোগ উঠছে।   

সীমানা নির্ধারণের আইন না থাকার বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গেলে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ বিষয়ে আমি অবগত নই। কেউ আমাকে কখনও কিছু জানায়ওনি। বিষয়টি নিয়ে আমি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে দেখব।”

রাজধানীর সীমানা নিয়ে সংবিধানের পঞ্চম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ১. প্রজাতন্ত্রের রাজধানী ঢাকা। ২. রাজধানীর সীমানা আইনের দ্বারা নির্ধারিত হবে।

খোঁজ নিতে গিয়ে ঢাকা বিভাগ, ঢাকা জেলা, ঢাকা মহানগর, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ- কারও কাছে সীমানার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য মেলেনি।

রাজউক তাদের প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যে সীমানা ঠিক করেছে তা সিটি করপোরেশন, এমনকি ঢাকা জেলার সীমানাকেও ছাপিয়ে গেছে।

সংস্থাটির অন্যতম পরিকল্পনাবিদ আশরাফ আলী আখন্দ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উত্তরে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের দক্ষিণ সীমানা, দক্ষিণে ধলেশ্বরী নদী, পূর্বে রূপগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী এবং পশ্চিমে ধলেশ্বরী ও বংশী নদী হচ্ছে রাজউকের প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত সীমানা।”

প্রজ্ঞাপন জারি করেই রাজউক তাদের এই সীমানা ঠিক করেছে বলে জানান তিনি।

ডিএমপি, ওয়াসা, ডেসা, সিটি করপোরেশনসহ বেশ কিছু সংস্থা নিজেদের কাজের সুবিধার্থে সীমানা নির্ধারণ করে কাজ করছে জানিয়ে আশরাফ আখনন্দ বলেন, “একক নির্দিষ্ট সীমানা এখানে মুখ্য নয়।”

‘ঢাকা সিটি করপোরেশন’ নামে দীর্ঘকাল অবিভক্ত একটি কাঠামো থাকলেও ২০১১ সালে সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে তা দুই ভাগ করা হয়।

তবে অবিভক্ত সিটি করপোরেশনই যে রাজধানী, আইনে কোথাও স্পষ্ট করে তখনও বলা হয়নি।

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) যে সীমানা, তা জনসংখ্যার হার অনুযায়ী ঠিক হয়েছে বলে কর্মকর্তারা বলছেন।

ডিএমপির সম্পদ শাখার সহকারী পরিচালক তাওহীদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিভিন্ন এলাকার জনসংখ্যার বিবেচনায় ডিএমপি তাদের থানার সীমানা নির্ধারণ করে থাকে। সিটি করপোরেশনের বাইরেও ডিএমপির থানাগুলোর সীমানা রয়েছে।”

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর, ডেমরা, কদমতলী, যাত্রাবাড়ী, বাড্ডাসহ ডিএমপির আরও কিছু থানার সীমানা সিটি করপোরেশনের সীমানাকে ছাড়িয়ে গেছে।

রাজধানী হিসাবে ঢাকার সীমানা নির্ধারিত থাকা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন ঢাকার সাবেক জেলা প্রশাসক আবদুল মোবারক।

বর্তমানে নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্বে থাকা সাবেক এই কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিভাগ, জেলা, সিটি করপোরেশনসহ আরও কয়েকটি শাখায় ঢাকার সীমানা রয়েছে। তবে রাজধানী হিসাবে ঢাকার কোনো সীমানা দীর্ঘদিনেও নির্ধারিত হয়নি, এনিয়ে কোনো আইনও হয়নি। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আলোচনা হওয়া উচিত।”

সম্প্রতি এক আলোচনায় অংশ নিয়ে রাজধানী ঢাকার সুনির্দিষ্ট সীমারেখা নির্ধারণের দাবি তোলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনও।

নগর গবেষণা কেন্দ্রের সভাপতি নগর পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলাম মনে করেন, সরকারকেই রাজধানীর সীমানার বিষয়টি স্পষ্ট করতে হবে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বর্তমানে ঢাকাকে কেন্দ্রে করে রাজউক, ডিএমপি ও দুই সিটি করপেরেশন রয়েছে। সরকার চাইলে এর কোনো একটির সীমানাকে রাজধানীর সীমানা বলে ঘোষণা করতে পারে। আবার এই তিন প্রতিষ্ঠানের বাইরে গিয়েও রাজধানীর সীমানা নির্ধারণ করতে পারে।”

এই নগর পরিকল্পনাবিদ এক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা ও পাকিস্তানের ইসলামাবাদসহ কয়েকটি দেশের রাজধানীর উদাহরণ টেনে বলেন, “পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজধানী কেবল রাজধানী শহর হিসাবেই পরিচালিত। সেখানে অন্য কোনো অথরিটি নেই।”

রাজধানীর সীমানা নির্ধারণে নগর পরিকল্পনাবিদ ও ভূতত্ত্ববিদদের সঙ্গে সরকারি নীতি নির্ধারকদের আলোচনার পরামর্শ দেন নজরুল।

ইতিহাসবিদরা বলেন, চারশ’ বছরের পুরোনো শহর ঢাকা। এই স্থানটিকে বার বার প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে বেছে নিয়েছে শাসকরা।

বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা ও তুরাগ নদীর তীরে গড়ে উঠা এই প্রাচীন জনপদকে ১৬১০ সালে মুঘল সুবেদার ইসলাম খাঁ সর্বপ্রথম বাংলার রাজধানী ঘোষণা করেন। অবশ্য তখন সীমানার প্রচলন ছিল না।

ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে দুই বাংলাকে পৃথক করার পরও ঢাকাকেই পূর্ব বাংলার রাজধানী হিসাবে বেছে নেওয়া হয়।

পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী ও স্বাধীন বাংলাদেশেও রাজধানী হিসাবে ঢাকা বহাল থাকে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর গৃহীত সংবিধানে ঢাকাকে রাজধানী উল্লেখ করে সীমানা নির্ধারণে আইন প্রণয়নের বিধান রাখা হয়।