স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সংঘাতে এলাকাবাসীর পাশাপাশি বয়সে তরুণ কিছু ‘অছাত্র’ ছিল। তাদের মনোভাব ছিল বেপরোয়া; এরা স্থানীয় নয়।
Published : 29 Jul 2024, 01:33 AM
সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে আন্দোলনে বড় আকারের সংঘাতের আগেই উত্তপ্ত হয়ে উঠে ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকা, সংঘাতপূর্ণ অন্যান্য এলাকা শান্ত হতে থাকলেও অনেক বেশি সময় লেগেছে ওই এলাকা নিয়ন্ত্রণে আসতে।
কারফিউয়ের মধ্যেও সব মিলিয়ে সংঘাত চলেছে পাঁচ দিন। যাত্রাবাড়ী থেকে প্রতিদিনই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছে মরদেহ, শেষ পর্যন্ত সংখ্যাটি কত দাঁড়াল, সেই হিসাব অবশ্য মেলেনি।
স্থানীয় বাসিন্দা একজন গণমাধ্যমকর্মী জানিয়েছেন, সংঘাতে বয়সে তরুণ অনেকেই ছিলেন, যারা ছিলেন বেপরোয়া। স্থানীয় এক প্রবীণ বলেছেন, গত কয়েক বছর গড়ে উঠেছে– এমন অনেক বাড়ির মালিকদের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তারা সংঘাতে জড়িতদের জন্য ‘দুয়ার খুলে রেখেছিলেন’।
আবার এমন ভাষ্যও পাওয়া গেছে যে, সংঘাতে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ছিল স্থানীয় শ্রমজীবী, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য।
একজন পুলিশ সদস্যকে হত্যার পর মরদেহ ঝুলিয়ে রাখার ঘটনাটি ইঙ্গিতপূর্ণ বলে মনে করেন অনেকেই। তাদের ভাষ্য, ‘সাধারণ’ কোনো বিক্ষোভকারীর এমন কাজ করার কথা নয়।
স্থানীয় একজন সংসদ সদস্য বলছেন, পুলিশের সঙ্গে যারা সংঘাতে জড়িয়েছেন, তাদের অনেককেই ‘প্রশিক্ষিত’ মনে হয়েছে। একজন বাড়ির মালিক বলেছেন, ‘উৎসবের মত করে’ একজোট হয়ে লড়াই হয়েছে। কেউ আহত বা নিহত হলেও ভয় না পেয়ে পাল্টা আক্রমণে গেছে বিক্ষোভকারীরা।
স্থানীয় এক সাংবাদিক পুলিশের কাঁদুনে গ্যাস ও গুলির মধ্যেও যাত্রাবাড়ী থানায় হামলার পরিকল্পনার বিষয়টি তাদের মুখ থেকেই শুনতে পেয়েছেন।
কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির আগেই উত্তাপ
১৮ জুলাই রাজধানীর বাড্ডা ও উত্তরা এলাকায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের আগের দিনই উত্তপ্ত হয়ে উঠে যাত্রাবাড়ী। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, সেই আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও যায়নি ভয়ে।
পুলিশ সেই রাতে আর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি, বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। ঢাকা-চট্টগ্রাম আর ঢাকা সিলেট তো বটেই, ঢাকার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জে যাতায়াতও অসম্ভব হয়ে পড়ে।
পরদিন ওই সংঘাত যাত্রাবাড়ী থেকে সাইনবোর্ড হয়ে ছড়িয়ে যায় চিটাগাং রোডের দিকে। আরেক সড়কে ডেমরা রোড ধরে ডেমরা, স্টাফ কোয়ার্টার এলাকাতেও ছড়ায় সংঘাত।
তবে যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে দক্ষিণে জুরাইনসহ ঢাকা-মাওয়া সড়কের আশপাশের এলাকাগুলো একদমই শান্ত ছিল। যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে পশ্চিমের অংশে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, জনপথ মোড়, দয়াগঞ্জ, রাজধানী মার্কেট এলাকাতেও জনজীবন স্বাভাবিক ছিল।
সংঘাতে যারা
রাজধানীর উপকণ্ঠ এই এলাকাটি শ্রমজীবী মানুষদের বসবাসের জন্য পরিচিত। সেখানে আছে বহু কওমি মাদ্রাসা। এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, এই সংঘাতে তারা ‘অচেনা’ মানুষদের দেখেছেন, একই কথা বলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও।
স্থানীয়রা বলছেন, ১৭ ও ১৮ জুলাই সংঘাতে স্থানীয় কিছু তরুণকে দেখা গেছে যারা ছাত্র নন, সেটা ‘দেখেই বোঝা যায়’। আশপাশের কওমি মাদ্রাসার ছেলেরাও সেখানে ছিল। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা রাতে বাড়ি ফিরে গেলেও ‘অছাত্ররা’ রাতেও সংঘাত চালিয়ে গেছে।
গত ১৯ ও ২০ জুলাই ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে দেখা গেছে হতাহতদের বেশিরভাগই নিম্ন আয়ের। তাদের মধ্যে আছে ফুটপাথের ব্যবসায়ী, মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, অটো চালক, কারখানা কর্মী, রিকশা চালক বা দোকান কর্মী। স্কুল- কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংখ্যা কমই দেখা গেছে এই দুই দিনের পর্যবেক্ষণে।
সংঘাত থামলেও এলাকার মানুষদের মধ্যে এখনও সেই পাঁচ দিন নিয়ে আলোচনা থামেনি। শনিবার আর কুতুবখালী, রসুলবাগ, মাতুয়াইল মেডিকেল এলাকা ঘুরে স্থানীয়দের নানা বক্তব্য জেনেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
একজন চা দোকানির ভাষ্য, “এলাকার বাড়িতে বাড়িতে গিয়া খোঁজ নেন, প্রত্যেক বাড়ি থিকা কেউ না কেউ রাস্তায় নামছে। বেশিরভাগই নামছে হুজুগে। পরে যখন গুলি মারা শুরু করছে তহন মাইনষে জিদ্দে এমন করছে।”
অটো গ্যারেজের এর পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলন, “স্থানীয় ফুটপাথের ব্যবসায়ী, খাবার বিক্রেতা, অটো চালক, মাছের আড়তের কর্মীদের অনেকে ওই সংঘাতে অংশ নেয়। মাদ্রাসার ছেলেরাও ছিল।”
কিছু উচ্ছৃঙ্খল কিশোরকে কেউ রাস্তায় নামিয়েছে বলেও তিনি মনে করছেন। তিনি বলেন, “এরা যেসব লাঠিসোঁটা ও অন্য কিছু নিয়ে মারামারি করতে গেছে, সেগুলোও তাদের কেউ জোগান দিয়েছে বলে মনে হয়।”
পুলিশের ওয়ারী বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলছেন, “যাত্রাবাড়ী থেকে কদমতলী এলাকায় প্রচুর মাদ্রাসা থাকার বিষয়টা সবসময় আমাদের হিসাবের মধ্যে থাকে। সংঘাতে মাদ্রাসা ছাত্ররা অংশ নিয়েছিল, পাশাপাশি আরও কিছু লোকজন ছিল যারা ছিল ভীষণ বেপরোয়া।”
১৮ জুলাই ঘটনাস্থল ঘুরে আসা সাংবাদিক শেখ আবু তালেব বলছেন, “সেখানে ছাত্ররা ছিল, মাদ্রাসা ছাত্ররাও ছিল। আর ছিল কিছু কিশোর-তরুণ যারা ভীষণ বেপরোয়া। তাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলেই তেড়ে আসে।
“গুলি-গ্যাসের মুখেও মাঠ ছাড়ছিল না তারা। তাদের কথাবার্তায় শোনা গেছে যাত্রাবাড়ী থানায় আগুন দেওয়ার উদ্দেশ্যের কথা।”
আবু তালেবের ভাষ্য, “যে কোনো জায়গা থেকে একটা পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে এই কিশোররা, যার কারণে তারা অনেক বেপরোয়া ছিল।”
আন্দোলন কাছ থেকে দেখেছেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, বুধবার থেকে বৃহস্পতিবার আন্দোলনে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ছিল। তবে রাতের বেলায় তারা বাড়ি ফিরে যেতেন। রাতভর কিছু কিশোর-তরুণ ‘রীতিমত উৎসব করে’ সংঘাতে চালিয়ে গেছে।
নতুন বাড়ির মালিকদের ‘সন্দেহজনক’ ভূমিকার তথ্য
১৯ জুলাই সেখানে রীতিমতো ‘যুদ্ধ’ চলেছে বলে মন্তব্য করলেন মাতুয়াইলের বাদশা মিয়া রোডের একজন পুরনো বাসিন্দা। তখন পুলিশ সরাসরি গুলি চালানো শুরু করে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই ব্যক্তি বলছেন, “মাতুয়াইল এবং রায়েরবাগ এলাকাটি ১৫-২০ বছর আগেও নিচু, জলাভূমি ছিল। এখানে মাদ্রাসা ও কিছু স্কুল-কলেজকে কেন্দ্র করে বসতি গড়ে উঠে। আমি এই এলাকায় থাকি প্রায় ৪০ বছর যাবৎ।
“এখানে প্রায় ৯০ শতাংশ লোক নতুন বাড়ি করেছে। এদের অনেকেই জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে যুক্ত বলে এলাকায় প্রচার রয়েছে। কিন্তু আপনি জিজ্ঞাসা করলে বলবে ‘আমরা কোনো দল করি না’।”
তিনি বলেন, “যখন আন্দোলনটি সহিংসতায় রূপ নেয়, তখন যাত্রাবাড়ী থেকে শুরু করে রায়েরবাগ পর্যন্ত এলাকায় অনেক বাড়ির ভাড়াটে, আশপাশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, এমনকি অনেক বাসার দারোয়ানরাও মাঠে নেমে পড়ে।
“যখন পুলিশ অস্ত্র নিয়ে সামনে আসে তখন সবারই তো নিজের বাড়ি-ঘরে তারা ফিরে আসে। যার কারণে তারা ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকতে পেরেছে। আবার বাইরে থেকে এসে যারা এখানে মারামারি করেছে তারা কে বা কারা তার কোন হিসেব নেই, কিন্তু ধাওয়া খেয়ে দৌড় দিয়ে তারা আশপাশের বাড়িগুলোতে লুকিয়ে যেতে পেরেছে, বাড়ির মালিকরা সেটা অ্যালাউ করেছেন। যে দুয়েকটি বাড়ির মালিক বাধা দিয়েছে, তারাও শেষ পর্যন্ত বিপদে পড়ে দরজা খুলতে বাধ্য হয়েছে।”
বাদশা মিয়া রোডের বাসিন্দা মোতাহার আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সহিংসতার মধ্যে ঘর থেকে বের হতে পারিনি, বাসার নিচে নামতে গেলেই বিপদ, হয় আন্দোলনকারীরা আক্রমণ করবে না হয় পুলিশ।
“জানালা দিয়ে সব দেখেছি। মাঝে মাঝে ছাদে উঠি কিন্তু হেলিকপ্টার দিয়ে মারা হচ্ছে কাঁদুনে গ্যাস আর সাউন্ড গ্রেনেড, তখন আরও বিপদ। যা দেখছি তা বর্ণনা করার মত না। বলতে গেলে বন্দি জীবন কাটাতে হয়েছে।”
চোখে দেখা সহিংসতার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “প্রত্যেক বাড়ি থেকে দল বেঁধে লোকজন বের হয়ে যাচ্ছে রাস্তায়, কারও হাতে ইট কারও হাতে রড, কারও হাতে লাঠি, অনেকের হাতে দা বঁটি। বলতে গেলে কোনো না কোনো অস্ত্র তাদের সবার হাতেই ছিল।”
মোতাহার আলী বলেন, “একজন গুলিবিদ্ধ হচ্ছে আর অন্যরা আরও বেশি চিৎকার দিয়ে বলছে, ‘আমাদের একজন মেরে ফেলছে, সবাই আসেন’। তখন আবার পুলিশের উপর আক্রমণ। বলতে গেলে আমার কাছে আন্দোলন মনে হয়নি, তারা ‘উৎসবের মত’ করে অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় গেছে।
“কত লোক মারা গেছে সেটা নিয়ে কারও চিন্তা নেই, কেউ মারা গেলে বা আহত হলে লোকজন আরও বেশি উৎসাহিত হয়ে রাস্তায় যাচ্ছে, মনে হচ্ছে যুদ্ধ লেগেছে আর কারও ঘরে থাকার সময় নেই।”
হত্যার পর লাশ ঝুলিয়ে উল্লাস
১৭ জুলাই সকালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমর্থনে যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের ঢালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেছিল আশপাশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। দুপুরের পরেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় কিছু লোকজন যোগ দেয়। সন্ধ্যার পর পুলিশের সঙ্গে শুরু হয় সংঘাত।
রাতব্যাপী পুলিশের সঙ্গে সংঘাত হয় দাঙ্গাকারীদের। পুড়িয়ে দেওয়া হয় ফ্লাইওভারের টোল প্লাজা। সংঘাত ছড়ায় মহল্লাগুলোর অলি-গলিতেও। ছররা গুলির ক্ষত নিয়ে দুই বছরের শিশুসহ বেশ কয়েকজন ঢাকা মেডিকেলে আসে ওই রাতেই।
শেষ রাতের দিকে সংঘাত থেমে যায়। ১৮ জুলাই সকালে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীরা আবার রাস্তায় নামে। তাদের সঙ্গে ছিল ‘অন্যরা’ও। তারা একটি কন্টেইনারবাহী লরি আড়াআড়ি করে রেখে ফ্লাইওভারের ঢালে বাধা তৈরি করে।
সেদিন বাড্ডা ও উত্তরায় সংঘর্ষে বেশ কয়েকজনের প্রাণ ঝরারে। একই অবস্থা হয় যাত্রাবাড়ীতেও।
যেখানে আন্দোলনকারীরা ইট-পাটকেল ছুঁড়েছে পুলিশকে লক্ষ্য করে, তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ ছুড়েছে রাবার বুলেট, ছররা গুলি এবং প্রচুর কাঁদুনে গ্যাস। দুপুরে সেখানে অবস্থান নেয় বিজিবি সদস্যরাও।
বৃহস্পতিবার বেলা ৩টার দিকে দাঙ্গাকারীরা এগোতে এগোতে মাছের আড়তের কাছে চলে আসে, তার দেড়-দুইশ ফুট দূরেই যাত্রাবাড়ী থানা।
দাঙ্গাকারীদের ধাওয়ায় পুলিশ অবস্থান নেয় থানায়। সেখান থেকে তারা কাঁদুনে গ্যাস মারতে থাকে। গুলিও ছোঁড়া হয় বলে জানাচ্ছেন অনেকে।
তাতে দাঙ্গাকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে কিছুটা পিছিয়ে যায়। পরে তারা গুলির মুখে মাছের আড়তের প্লাস্টিকের চৌবাচ্চা, ছোট ছোট ড্রাম আর ট্রাফিক পুলিশের চওড়া রোড ব্যারিকেডগুলো ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে।
এভাবে তারা কিছুটা সামনে এগিয়ে আসে, পুলিশের গুলি-গ্যাসের মুখে আবার পিছিয়ে যায়। আবার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়তি সদস্য এসে তাদের ধাওয়া দিলে তারা মহল্লার ভেতর অলি-গলিতে ঢুকে পড়ে।
২০ জুলাই সকাল থেকে কারফিউ শুরুর পর যাত্রাবাড়ী থেকে শনির আখড়া পর্যন্ত পুলিশ নিয়ন্ত্রণে নেয়। দাঙ্গাকারীরা সরে যায় ডেমরা রোডের দিকে। তখন ‘যুদ্ধটাও’ সরে যায় সেদিকে।
সেদিন সকালে রায়েরবাগ এলাকায় এমন একটি ঘটনা ঘটে, যা ছিল বীভৎস। ট্যুরিস্ট পুলিশের এএসআই মোহাম্মদ মোক্তাদির মাতুয়াইলের বাসা থেকে অফিস ধরতে পল্টনের পথে বের হন। পথে তার পরিচয়পত্র দেখার পর একদল মানুষ তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। এরপর মরদেহ রায়েরবাগ ফুটব্রিজে ঝুলিয়ে রাখে কয়েক ঘণ্টা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ দাবি করেছেন, এই ঘটনায় জড়িতদের নাম পরিচয় পেয়েছেন তারা।
২১ জুলাই পর্যন্ত রায়েরবাগ, মাতুয়াইল, সাইনবোর্ড, চিটাগাং রোড, ডেমরা, স্টাফ কোয়ার্টার এসব এলাকায় থেমে থেমে সংঘাত চলে। পুলিশের পাশাপাশি র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর অবস্থান ছিল সেখানে। আকাশে অনেকটা নিচু দিয়ে হেলিকপ্টার চক্কর দিতে দেখেছেন স্থানীয়রা।
পুলিশ কর্মকর্তার ভাষ্য
ওই এলাকায় টানা তিনদিন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাস্তায় ছিলেন কদমতলী থানার উপ পুলিশ পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বৃহস্পতিবার সারা দিন তারা রাস্তা দখল করে রেখেছে। সন্ধ্যার দিকে যাত্রাবাড়ী থানায় উপর থেকে (ফ্লাইওভারে) ককটেল নিক্ষেপ করে। পরে কদমতলী থানায় আক্রমণ করে। এরপর থেকে আমদের কাছে থানা ও আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ আসে।”
সাইফুল বলেন, “তবে শুক্রবার (১৯ জুলাই) জুমার নামাজের পর অন্তত ১৫/২০ হাজার লোক কাচপুরের দিক থেকে এসে শনিআখড়া ও রায়েরবাগ এলাকায় রাস্তায় অবস্থান নেয়। তারা বার বার ঢাকার দিকে প্রবেশ করার চেষ্টায় থাকে।
“শুক্রবার সারা দিন সারা রাত এবং শনিবার দুপুর পর্যন্ত রাস্তায় ছিল তারা, পরে রাস্তা ছাড়তে বাধ্য হয়। যতক্ষণ তারা রাস্তায় অবস্থান নিয়ে ছিল ততক্ষণ বার বার পুলিশের উপর হামলা চালানোর চেষ্টা করে, এদের হামলায় আমাদের পুলিশও মারা গেছেন।”
সংঘাত ৫ দিনে গড়ালো কীভাবে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “লোকজন বেশি থাকায় এবং অস্ত্রধারী হওয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল।”
ওরা ছিল প্রশিক্ষিত: সংসদ সদস্য
যাত্রাবাড়ী, মাতুয়াইল ও রায়েরবাগ এলাকা (ঢাকা-৫ আসন) থেকে স্বতস্ত্র প্রার্থী হয়ে গত সংসদ নির্বাচনে জয় পেয়েছেন মশিউর রহমান মোল্লা সজল, তবে তিনি আওয়ামী লীগেরই নেতা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যারা যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া এলাকায় তাণ্ডব চালিয়েছে, এরা পরাপুরি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জামায়াত-শিবির কর্মী, একদম ‘জঙ্গি’।
“আমাদের লোকজন যতটুকু নামছে তা কিন্তু কম না। আরও বেশি নামলেও কোনো লাভ হত না, কারণ এরা সশস্ত্র ‘জঙ্গি’। আমাদের হাতে তো অস্ত্র ছিল না। এখানে তাদের কয়েকশ জন আমাদের হাজার হাজার লোককে মোকাবেলা করার মত শক্তি নিয়ে আসছে।”
মশিউর বলেন, “তারা পুলিশের গুলির সামনে দাঁড়িয়ে ‘যুদ্ধ’ করেছে। এদেরকে থামাতে হেলিকপ্টার থেকে কাঁদুনে গ্যাস ছোড়া হয়েছে, তবুও তারা নিবৃত্ত হয়নি। এরা সাধারণ কোনো রাজনৈতিক দলের না। এই বিষয়গুলো আমরা কেন্দ্রকে জানিয়েছি।”
এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতা ছিল- এ বিষয়টিও মেনে নেন ক্ষমতাসীন দলের এই নেতা। বলেন, “আমাদের মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না, এটা সত্য। সব নেতাকর্মী মাঠে নামেনি।”
যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদ মুন্না বলেন, “নির্বাচনের পরে আমাদের এখানে একটা বিভাজন ছিল, স্বতন্ত্র প্রার্থী এমপি হয়েছে। সেক্ষেত্রে উনার সঙ্গে কারা ছিল আপনি খবর নিলে বলতে পারবেন।
“আর আমাদের আওয়ামী লীগের লোকজন নিয়ে আমি দিন রাত মাঠে ছিলাম। কিন্তু যারা আক্রমণ করেছে, সহিংসতা করেছে তারা তো ট্রেইনিংপ্রাপ্ত। তাদের সঙ্গে মোকাবিলা লোকবল দিয়ে সম্ভব নয়। তাদের মোকাবিলা করতে সশস্ত্র হতে হবে, সেটা আমরা করতে পারিনি। ট্রেইনিং নিয়ে আসা লোকজনকে পাল্টা আক্রমণ করা কঠিন।”