“সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে জনবিরোধী শর্ত আরোপ করে জনগণের মৌলিক অধিকারকে সীমাবদ্ধ করেছে; অধিকারসমূহের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করেছে,” বলেন জিএম কাদের।
Published : 28 Nov 2024, 07:01 PM
সংবিধান সংস্কারে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান পুনরায় চালুর প্রস্তাব করেছে জাতীয় পার্টি।
সেইসঙ্গে দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ না রাখা, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য স্থাপন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন এবং দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে সংসদ সদস্যদের ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়ারও প্রস্তাব করা হয়েছে দলটির পক্ষ থেকে।
বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর বনানীতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে সংবিধান সংস্কারের ক্ষেত্রে ১৯টি প্রস্তাব তুলে ধরেন দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের।
তিনি বলেন, “আমরা পরামর্শ দিতে চাই যে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করা উচিত। পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হলে নির্বাচন পরিচালনার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিধানগুলো পুনরায় চালু করা হবে।
“এই সংশোধনীতে কিছু বিধান প্রবর্তন করা হয়েছিল, যা উপযুক্ত বলে মনে হয়নি; যেমন চলমান সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। তা ছাড়া এ সংশোধনী জনবিরোধী শর্ত আরোপ করে জনগণের মৌলিক অধিকারকে সীমাবদ্ধ করেছে। অধিকারসমূহের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করেছে।”
পঞ্চদশ সংশোধনী সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশকে অপরিবর্তনীয় করে তুলেছে মন্তব্য করে বিষয়টিকে ‘অযৌক্তিক’ আখ্যা দেন জিএম কাদের।
তার ভাষ্য, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা বিচার বিভাগ থেকে না হওয়াই ভালো। কারণ এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। তা ছাড়া এর মাধ্যমে রাজনীতি ও নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের একটি মিশ্রণের অনাকাঙ্ক্ষিত উদাহরণ সৃষ্টি হতে পারে।”
গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস গত ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণে রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের লক্ষ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশনসহ ছয়টি কমিশন গঠনের কথা বলেন।
অধ্যাপক আলী রিয়াজের নেতৃত্বে সংবিধান সংস্কারে কাজ শুরু করেছে ৯ সদস্যের কমিশন। সংবিধান সংস্কারে দলগুলোর সুপারিশ নিচ্ছে এ কমিশন।
বিএনপি মঙ্গলবার কমিশনে গিয়ে লিখিত প্রস্তাব দিয়েছে। সেখানে তারা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রবর্তন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরানো, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনাসহ সংবিধানের একগুচ্ছ সংস্কারের প্রস্তাব করে। এর দুদিন পর দলের প্রস্তাব তুলে ধরলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান।
২০০৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বা সমঝোতা করে জাতীয় পার্টি মোট চারটি নির্বাচন করেছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অতীতের এই সিদ্ধান্তের কারণে এখন তারা চাপে আছে।
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রস্তাবের বিষয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, ”আমাদের প্রস্তাব হল সরকারি দলের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি না হওয়ার ব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজিত করা।
“সরকারি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী যদি দুজন ভিন্ন ব্যক্তি হতেন, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সংসদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে কিছুটা হলেও ভারসাম্য থাকত। ঐতিহ্যগতভাবে এটি কখনও হয়নি। এখন পর্যন্ত যখনই সুযোগ আসে, দলীয় প্রধানই প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন।”
সর্বোচ্চ দুইবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগের প্রস্তাবে ব্যাপারে তিনি বলেন, “ইতিহাসের অভিজ্ঞতা দেখায়, যদি একজন ব্যক্তি যথেষ্ট দীর্ঘ সময়ের জন্য সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থাকেন, তবে সেই ব্যক্তি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার প্রবণতা দেখান এবং স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন।
“এইভাবে বিশ্বের অনেক দেশের সংবিধানে যেকোনো ব্যক্তির সর্বোচ্চ দুইবার শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা বাংলাদেশের জন্যও একই পরামর্শ দিতে চাই। এই বিধান আমাদের সংশোধিত সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।”
সংসদ সদস্যদের দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোটদানের সুযোগ দেওয়ার বিধান সংশোধিত সংবিধানে রাখার প্রস্তাব করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, “তবে তারা সেটা করতে পারবে, যখন দলীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে একটা সুস্পষ্ট বিভাজন দেখা যাবে এবং কমপক্ষে দলীয় সংসদ সদস্যদের এক-তৃতীয়াংশ দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদকে সেভাবে পরিবর্তন করার প্রস্তাব করছি।”
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রস্তাব তুলে ধরে তিনি বলেন, “রাষ্ট্রপতির নিয়োগ সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নয়, বরং সংসদ সদস্যদের তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোটে হওয়া উচিত।
“এর ফলে রাষ্ট্রপতি মোটামুটি সর্বসম্মত প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। রাষ্ট্রপতি নিয়োগের জন্য তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট অন্তর্ভুক্ত করার জন্য অনুচ্ছেদ ৪৮(ক) সংশোধন করতে হবে। সংসদে তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত হয়ে প্রস্তাবিত রাষ্ট্রপতি, সর্বসম্মত প্রার্থী বিবেচিত হতে পারেন। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্ব দিতে পারেন। পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করার পরে সংবিধানের ‘অনুচ্ছেদ ৫৮ (খ)’-তে সে অনুযায়ী পরিবর্তন আনা যেতে পারে।”
এগুলো ছাড়াও রাষ্ট্রপতির অভিশংসনের বিধান, দুইজন ডেপুটি স্পিকার রাখার বিধানসহ মোট ১৯টি প্রস্তাব প্রস্তাব করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান।
সংবিধান সংস্কারে লিখিত প্রস্তাব দিল বিএনপি
সংবিধান 'সংস্কার': নাগরিকদের মতামত জানতে চালু হচ্ছে ওয়েবসাইট
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত
শিক্ষার্থী প্রতিনিধি মাহফুজ আলমসহ ৯ সদস্যের সংবিধান সংস্কার কমিশন