বিবিসি লিখেছে, ভারতে শেখ হাসিনার অবস্থান দীর্ঘায়িত হওয়ার বিষয়টি ঢাকার নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে দিল্লির শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।
Published : 03 Sep 2024, 11:35 PM
প্রবল আন্দোলনে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে শেখ হাসিনার দেশত্যাগ এবং দিল্লির কাছের একটি সামরিক ঘাঁটিতে পৌঁছানোর পর প্রায় এক মাস হতে চলেছে। দীর্ঘদিনের এই মিত্রকে নিয়ে এখন উভয়সঙ্কটে রয়েছে নরেন্দ্র মোদীর ভারত সরকার।
ছাত্রদের নেতৃত্বে এক মাস ধরে চলা আন্দোলন দেশজুড়ে সহিংস রূপ পাওয়ার পর ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনার ১৫ বছরের সরকারের নাটকীয় অবসান ঘটে। তাকে নিয়ে ভারত সরকারের অস্বস্তির বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি।
শেখ হাসিনা প্রাথমিকভাবে অল্প সময়ের জন্য ভারতে অবস্থান করবেন বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে তার আশ্রয় পাওয়ার চেষ্টা এখন পর্যন্ত সফল হয়নি বলে বিভিন্ন খবরে বলা হয়েছে।
বিবিসি লিখেছে, ভারতে শেখ হাসিনার অবস্থান দীর্ঘায়িত হওয়ার বিষয়টি ঢাকার নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে দিল্লির শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।
ভারতের কাছে বাংলাদেশ কেবলই প্রতিবেশী নয়। গত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশ ছিল ভারতের কৌশলগত অংশীদার, সেই সঙ্গে ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা, বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সুরক্ষার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ছিল ঘনিষ্ঠ মিত্রের ভূমিকায়।
দুই দেশের মধ্যে ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার (২,৫৪৫ মাইল) দীর্ঘ অরক্ষিত সীমান্ত রয়েছে, যার ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য থেকে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সহজেই বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ সরকার এমন কয়েকটি ভারতীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সীমান্ত থেকে সরিয়ে দেয়। শেখ হাসিনার সময়ে ভারতের সঙ্গে বেশ কয়েকটি সীমান্ত বিরোধ বন্ধুত্বপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি করেছে দুই দেশ।
বিবিসি লিখেছে, এই সম্পর্কের মূলে সীমান্ত সুরক্ষা থাকলেও আর্থিক দিকও আছে। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও কানেক্টিভিটি বিকশিত হয়েছে।
ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে সড়ক, নদী ও রেলপথ ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে।
২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশের অবকাঠামো ও উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ হিসেবে ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থায়ন করেছে ভারত।
বিবিসি লিখেছে, শেখ হাসিনার আকস্মিক ক্ষমতাচ্যুতির কারণে এই অর্জনগুলো যাতে হাতছাড়া না হয়, সেজন্য দিল্লিকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে।
ঢাকায় ভারতের সাবেক হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, “আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে যে কোনো ধরনের অশান্তি সবসময়ই অনাকাঙ্ক্ষিত।”
তবে সাবেক এই কূটনীতিক জোর দিয়ে বলেন, ঢাকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে দিল্লি কাজ করবে। কারণ তাছাড়া উপায় নেই এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণভাবে কী করবে তা ভারত নির্ধারণ করে দিতে পারে না।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সময় নষ্ট করেননি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ সেরেছেন।
তবে দেড় দশক ধরে শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দেওয়ায় বাংলাদেশে ভারতের প্রতি ক্ষোভ প্রশমিত হতে দিল্লির কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।
বিবিসি লিখেছে, ব্যাপক ভোট কারচুপির অভিযোগ ওঠা তিনটি নির্বাচনে জয়ী শেখ হাসিনার দলকে দিল্লি দ্রুত সমর্থন দেওয়ায় ভারতের প্রতি ক্ষোভ বেড়েছে বলে মনে করেন অনেক বাংলাদেশি।
শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে দিল্লির 'প্রতিবেশী প্রথম' নীতিও আরেকবার হোঁচট খেয়েছে, ভারতের আধিপত্য বিস্তারের যে কোনো প্রচেষ্টা প্রতিহতে মালদ্বীপ ও নেপালের সঙ্গী হয়েছে বাংলাদেশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দিল্লি যদি আঞ্চলিক পরাশক্তির তকমা রক্ষা করতে চায়, তাহলে প্রতিবেশী আরো এক দেশে নিজেদের প্রভাব হারানোর ঝুঁকি দিল্লি নেবে না। কারণ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনও এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রকাশ্য ভারতবিরোধী অবস্থান নিয়ে গত বছর মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন মোহাম্মদ মুইজ্জু।
ঢাকার সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বিবিসিকে বলেন, আঞ্চলিক নীতি নিয়ে ভারতের অন্তর্বীক্ষণ করার সময় এসেছে।
“দিল্লিকে দেখতে হবে তারা আঞ্চলিক অংশীদারদের দৃষ্টিভঙ্গি যথাযথভাবে বুঝতে পারছে কি না।“
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরতে শ্বেতপত্র প্রণয়নের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, "আমি কেবল বাংলাদেশ সম্পর্কে বলছি না, এই অঞ্চলের প্রায় সব দেশের কথাই বলছি।”
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে উদাহরণ দিতে গিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের একের পর এক সরকার বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো, বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে ব্যর্থ হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান বিবিসিকে বলেন, “ভারত একরকম ধরেই নিয়েছিল যে বাংলাদেশের ভেতরে আওয়ামী লীগ এবং তাদের সরকারই কেবল ভারতের মিত্র। এটা একটা কৌশলগত ভুল।"
আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি নেতারা জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। সেটি দিল্লির জন্য কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে মন্তব্য করে বিবিসি লিখেছে, দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকা খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন বিএনপি ও ভারতের মধ্যে ‘আস্থার ঘাটতি’ রয়েছে।
২০১৮ সাল থেকে বেশিরভাগ সময় বন্দি জীবন কাটানো খালেদা জিয়া বরাবরই তার বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। সেই সঙ্গে তিনি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ তুলেছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসন এখন মুক্তি পেয়েছেন এবং তার শারীরিক অসুস্থতার উন্নতি হয়েছে।
বিবিসি লিখেছে, আগামী দিনে দিল্লি ও বিএনপি নেতাদের মতপার্থক্য দূর করে কাজ করার পথ খুঁজে বের করতে হবে।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে ঢাকার বিরুদ্ধে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ উঠলে দিল্লির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
সে সময় বাংলাদেশের হিন্দু নেতারা বলেছিলেন, তাদের সম্প্রদায়ের ওপর হত্যা, লুটপাট ও ধর্ষণের মত ঘটনায় ‘ইসলামপন্থি দলগুলো ও বিএনপি’ জড়িত।
তবে বিএনপি ভারতবিরোধী বিদ্রোহীদের আশ্রয় দেওয়া এবং ২০০১ সালে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর হামলা চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
মঈন খানসহ বিএনপি নেতারা বলছেন, ভারত তাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে এগিয়ে আসছে না। দিল্লির এই নীতি এখন বদলে ফেলার সময় এসেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খান জোর দিয়ে বলেছেন, ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যা, ভৌগোলিক আকার এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি বিবেচনা করে কোনো ভারতবিরোধী বিদ্রোহীকে আশ্রয় দেওয়ার মত ভুল করতে যাবে না বিএনপির মত কোনো রাজনৈতিক দল।
বিবিসি লিখেছে, ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভের পেছনে অন্য কারণও রয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অভিন্ন ৫৪টি নদী আছে, ন্যায্যতার ভিত্তিতে সেগুলোর পানি ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধ বহু পুরনো।
ভুল তথ্য কীভাবে দুই দেশের মধ্যকার সন্দেহকে উসকে দিতে পারে, তার একটি উদাহরণ ভারি বৃষ্টিপাতে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের সাম্প্রতিক বন্যা।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে হঠাৎ ভারি বৃষ্টি ঝরার পর ‘অতিরিক্ত পানি’ দুই দেশের মধ্যে প্রবাহিত গোমতী নদীতে দিয়ে তীব্র বেগে বয়ে যায় ভাটির দেশ বাংলাদেশের দিকে। তাতে ত্রিপুরার ভেতরে এবং বাংলাদেশের ভাটিতে প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
তাতে লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; অনেকে তাদের ঘরবাড়ি, জিনিসপত্র ও কৃষিজমি হারিয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামের অনেক বাসিন্দা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা অভিযোগ করেছেন, রাতেরবেলা ড্যাম থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে পানি ছেড়ে দিয়েছে ভারত।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়, যাতে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়- ভারি বৃষ্টির কারণে গোমতী অববাহিকায় বন্যা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশে ভারতবিদ্বেষী মনোভাবের পেছনে চীনকেও একটি কারণ হিসেবে দেখিয়েছে বিবিসি। সংবাদমাধ্যমটি লিখেছে, ভারতের সঙ্গে আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে বাংলাদেশে নিজেদের অবস্থান বাড়াতে আগ্রহী বেইজিং।
মালদ্বীপের নির্বাচনে জয় পাওয়ার পর প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরের জন্য চীনকে বেছে নেওয়া মুইজ্জুকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দিয়েছিল বেইজিং।
বিবিসি লিখেছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা এড়াতে চাইবে দিল্লি। আর সেক্ষেত্রে ভারতীয় পণ্য ও বাণিজ্যের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতার কারণে কূটনৈতিক কৌশল ঠিক করতে এবং ভারতবিদ্বেষী মনোভাব পরিবর্তনে দিল্লি কিছুটা সময় পাবে বলে আশা করছে।
সেই কারণে ভারতে শেখ হাসিনার অবস্থান নিয়ে দিল্লিকে সতর্কতার সঙ্গে পা ফেলতে হবে, বিশেষ করে নতুন সরকার (অন্তর্বর্তী) যদি প্রত্যর্পণের জন্য আনুষ্ঠানিক অনুরোধ করে।
গত মাসে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় যে বিবৃতি দিয়েছেন, তা এরইমধ্যে বাংলাদেশে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
কিন্তু শেখ হাসিনার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বলে মনে হলে এবং সাবেক এই মিত্রকে ঝুঁকিতে ফেলা হবে মনে করলে ভারত তাকে চলে যেতে বলবে না।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “ভারত তাকে (শেখ হাসিনা) কীভাবে আতিথেয়তা করছে তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু সেখানে থেকে তিনি কীভাবে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন তা বাংলাদেশিদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যদি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাহলে তা বৈরিতা হিসেবে মনে করা হবে।”
আর দিল্লির কূটনীতিকরা আশা করছেন, ভারতের দিকে না তাকিয়ে শেখ হাসিনা নিজেই নিজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।