দুর্নীতির ধারণা সূচকে এক ধাপ নামল বাংলাদেশ

এই সূচকে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে বাজে অবস্থা কেবল আফগানিস্তানের।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Jan 2023, 08:25 AM
Updated : 31 Jan 2023, 08:25 AM

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বিচারে গত এক বছরে বাংলাদেশে দুর্নীতি পরিস্থিতির সামান্য অবনতি হয়েছে, তাতে তাদের বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের এক ধাপ অবনমন ঘটেছে।

তাদের প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচকের (সিপিআই) ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী (ভাল থেকে খারাপ) বিশ্বের ১৮০টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এবার ১৪৭ নম্বরে। ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী গতবারও এ তালিকায় বাংলাদেশ ১৪৭ নম্বরে ছিল।

আবার অধঃক্রম অনুযায়ী (খারাপ থেকে ভালো) বিবেচনা করলে বাংলাদেশ অবস্থান এবার ১৮০ দেশের মধ্যে দ্বাদশ, যেখানে গতবছর ছিল ত্রয়োদশ অবস্থানে।

১০০ ভিত্তিতে এই সূচকে বাংলাদেশের স্কোর তিন বছর পর ১ কমে ২৫ হয়েছে। এই স্কেলে শূন্য স্কোরকে দুর্নীতির ব্যাপকতার ধারণায় সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ১০০ স্কোরকে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত বা সর্বোচ্চ সুশাসনের দেশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

বিশ্বের ১৮০টি দেশ ও অঞ্চলের ২০২২ সালের দুর্নীতির পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বার্লিনভিত্তিক সংস্থা টিআই মঙ্গলবার তাদের এই বার্ষিক সূচক প্রকাশ করে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে টিআইবি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এবারের প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক এবং বাংলাদেশের দুর্নীতির পরস্থিতি তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, “সূচকে বাংলাদেশের নিম্ন স্কোর ও অবস্থান সার্বিক কোনো অগ্রগতি যেমন নির্দেশ করে না, তেমনি দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণেও অস্বস্তিকর স্থবিরতার প্রমাণ দেয়। এটি আরও প্রমাণ করে যে, 'জিরো টলারেন্সের' অঙ্গীকারসহ সরকারের দুর্নীতিবিরোধী বিভিন্ন পর্যায়ের ঘোষণা সত্ত্বেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও কাঠামোগত দুর্বলতায় বাংলাদেশের স্কোর ও অবস্থানের কোনো উন্নতি হচ্ছে না।"

এই সূচকে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় এবারও দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে বাজে অবস্থা কেবল আফগানিস্তানের। ২৪ স্কোর নিয়ে আফগানিস্তান ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী (ভাল থেকে খারাপ) রয়েছে তালিকার ১৫০ নম্বরে।

দেখা যাচ্ছে, তালেবান শাসনে থাকা আফগানিস্তানের স্কোর গতবারের চেয়ে ৮ বেড়েছে। আর তালিকার ঊর্ধ্বক্রমে ১৭৪তম অবস্থান থেকে ২৪ ধাপ উন্নতি হয়েছে।

গতবারের মতই দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে ভুটান। ৬৮ স্কোর নিয়ে ভুটানের অবস্থান সূচকের ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী ২৫ নম্বরে। এরপর ভারত ও মালদ্বীপ ৮৫ (স্কোর ৪০), শ্রীলঙ্কা ১০১ (স্কোর ৩৬), নেপাল ১১০ (স্কোর ৩৪), পাকিস্তান ১৪০তম (স্কোর ২৭) ।

২৫ স্কোরে বাংলাদেশের সঙ্গে সূচকের একই অবস্থানের রয়েছে গিনি ও ইরান।

সূচক বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের এবারের স্কোর ২০১৪ ও ২০১৫ সালের অনুরূপ এবং অবস্থান ২০১০ ও ২০২০ সালের অনুরূপ: অর্থাৎ দুর্নীতি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। সর্বশেষ এগারো বছরে বাংলাদেশের স্কোর ঘুরেফিরে ২৫ থেকে ২৮ এর মধ্যেই রয়েছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, "গত এক দশকে দুর্নীতির অবস্থানে বাংলাদেশের কোনো উন্নতি ঘটেনি, বরং খারাপ হয়েছে। ২০১৩ থেকে ২০১৭ ও পরে ২০২২ পর্যন্ত আমাদের অবস্থান স্থবির জায়গায় আছে। এটা হতাশাব্যাঞ্জক বলেই আমরা মনে করি। ১২২টি দেশের সাথে আমাদের অবস্থান, যাদের স্কোর ৫০ এর নিচে। দুর্নীতির অবস্থা যেটা সেটা গুরুতর। আমাদের অবস্থান আরও নিচে৷ আরও গভীরতর উদ্বেগের মাঝে আমরা আছি।"

দক্ষিণ এশিয়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, "আমাদের স্কোর এ বছর এক পয়েন্ট কমেছে, আফগানিস্তানের আট পয়েন্ট বেড়েছে। এটা অব্যাহত থাকলে আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের চেয়েও নিচে চলে গিয়ে প্রথম স্থানে চলে আসার সম্ভাবনা আছে। যা খুবই উদ্বেগজনক।"

প্রতিবেদনের সারমর্মে বাংলাদেশের অবনমনের পেছনে কিছু কারণ তুলে ধরা হয়। ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিকে শুধুই 'রাজনৈতিক বক্তব্যে' সীমাবদ্ধ রাখা, মহামারীকালে সরকারি খাতে সুরক্ষাসামগ্রী থেকে শুরু করে সাধারণের কাছে বিভিন্ন সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম, অর্থ পাচারের রিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া, রাজনীতি ও ব্যবসায়ীক পরিমণ্ডলে প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিয়ত সরকারি ও আমলাতান্ত্রিক বলয়ের মধ্যে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে সেখানে। 

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “যারা দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করে, তাদের গলা চেপে ধরা হচ্ছে। গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ এখন ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মতো বিষয়গুলোর জন্য এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারছে না।

"দুর্নীতির তালিকায় উন্নতি করতে হলে আমাদের স্বচ্ছতা, নিশ্চিত করতে হবে, জবাবদিহি বাড়াতে হবে, যারা দুর্নীতি নিয়ে কথা বলে প্রতিবাদ করে তাদেরকে স্বাধীনতা দিতে হবে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি দরকার হবে সেটি হচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে।"

টিআই এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এবারের সূচকে ১৮০টি দেশের গড় স্কোর গতবারের মতই ৪৩। তালিকায় এবার সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে আফ্রিকার দেশ সোমালিয়া; তাদের স্কোর ১২।

এরপরে রয়েছে যথাক্রমে সিরিয়া, সাউথ সুদান, ভেনেজুয়েলা, ইয়েমেন, লিবিয়া, উত্তর কেরিয়া, হাইতি, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি ও বুরুন্ডি।

অন্যদিকে সর্বোচ্চ ৯০ স্কোর নিয়ে গতবারের মতই তালিকায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ডেনমার্ক। এর পরে রয়েছে ফিনল্যান্ড, নিউ জিল্যান্ড, নরওয়ে, সিঙ্গাপুর, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি ও আয়ারল্যান্ড।

সিপিআই-২০২২ এর তথ্যের উৎস ছিল ১৩টি আন্তর্জাতিক জরিপ, তিন বছরের চলমান তথ্য এই সূচকে ব্যবহৃত হয়েছে।

আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আটটি সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলো হল- ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম এক্সিকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে, ইকোনোমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কান্ট্রি রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট, ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট রুল অব ল ইনডেক্স, পলিটিক্যাল রিস্ক ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি রিস্ক গাইড, বার্টেলসম্যান ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স, গ্লোবাল ইনসাইট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস, বিশ্ব ব্যাংকের কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্ট, ভেরাইটিজ অব ডেমোক্রেসিজ প্রজেক্ট।

নির্বাচনের আগে দুর্নীতির ধারণ সূচক প্রকাশ নিয়ে এক প্রশ্নে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, "এর পেছনে অন্য কিছু নেই। সারাবিশ্বে একই সময়ে এই প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে।

"ক্ষমতায় থাকলে দুর্নীতির প্রতিবেদন সবার কাছেই অগ্রহণযোগ্য আর ক্ষমতার বাইরে থাকলে গ্রহণযোগ্য। আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিবেশটাই এমন হয়ে গেছে।"

টিআইবির উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক (আউটরিচ কমিউনিকেশন) শেখ মঞ্জুর-ই আলম এসময় উপস্থিত ছিলেন।

সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সিপিআই অনুযায়ী, পুরো বিশ্বের সার্বিক দুর্নীতি পরিস্থিতি ২০২২ সালে অবনতির দিকে ছিল।

তুলনা করলে দেখা যায়, ২০২১ সালে যেখানে ৬৫টি দেশ তাদের অবস্থানের উন্নতি ঘটাতে পেরেছে, এবছর তা পেরেছে ৪৯টি দেশ। ২০২১ সালে ৬৬ টি দেশের স্কোরে অবনমন ঘটেছিল, ২০২২ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৭৩টি। এবারের জরিপে ৪৮টি দেশের অবস্থানে কোনো নড়চড় আসেনি, ২০২১ সালে এরকম দেশ ছিল ৫৮টি।

এবারের সূচকে ১৮০টি দেশের গড় স্কোর গতবারের মতই ৪৩। সেই গড় স্কোর অর্জন করতে পারেনি ১০৪টি দেশ। গুরুতর দুর্নীতি আছে এমন দেশের তালিকায় আছে ১২৩ টি দেশ, যাদের স্কোর ৫০ এর নিচে। যেখানে বড় দুই নাম রাশিয়া ও চীন।

স্কোরে অবনমন ঘটা দেশের তালিকায় ফিনল্যান্ড, নিউ জিল্যান্ড, নরওয়ে, জার্মানির মত আরও কিছু বড় নাম রয়েছে, যারা হারিয়েছে এক পয়েন্ট করে। দুই পয়েন্ট হারিয়েছে সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও সিঙ্গাপুর। আর লুক্সেমবুর্গ ও যুক্তরাজ্য হারিয়েছে যথাক্রমে চার ও পাঁচ পয়েন্ট।

দুর্নীতির সূচকে ১০ ধাপ বা তারও বেশি ধাপ নেমেছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সাইপ্রাস, হাঙ্গেরি, কাতার, সিরিয়া এবং তুরস্ক। ১০ বা তারও বেশি ধাপ উন্নতি হয়েছে আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, এঙ্গোলা, এস্তোনিয়া, গ্রিস, লাউস ও ভিয়েতনামের।