‘নায়েবে আমির’ গ্রেপ্তার; শারক্বীয়া নিয়ে র‌্যাব-সিটির দুই রকম তথ্য

র‌্যাব বলছে, নতুন জঙ্গিদলটির নামকরণ তিন বছর আগে; সিটিটিসি বলছে গত বছর।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Feb 2023, 12:50 PM
Updated : 22 Feb 2023, 12:50 PM

জামায়াতুল আনসার ফির হিন্দাল শারক্বীয়ার ‘নায়েবে আমির’কে গ্রেপ্তার করে পুলিশের সিটিটিসি বলছে, নতুন নামে এই জঙ্গি দলটির গঠন এক বছর আগে; যদিও র‌্যাব বলে আসছে, তিন বছর আগেই দলটির নামকরণ হয়েছে।

শারক্বীয়ার ‘নায়েবে আমির’ মো. মহিবুল্লাহ ওরফে ভোলার শায়েখকে (৪৮) গ্রেপ্তারের পর বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।

মহিবুল্লাহকে ঢাকার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানানো হয়েছে। তার কাছ থেকে একটি ল্যাপটপ উদ্ধারের কথাও জানিয়েছে সিটিটিসি।

নায়েবে আমির হচ্ছে সংগঠনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ। সর্বোচ্চ পদ আমির। তবে শারক্বীয়ার আমিরের খোঁজ এখনও পাওয়া যায়নি।

গ্রেপ্তার মহিবুল্লাহকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের জন্য হেফাজতে চেয়ে আদালতে পাঠায় সিটিটিসি।

শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম মোহাম্মদ জসিম চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

সিটিটিসির অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, গত বছর জানুয়ারিতে এই জঙ্গি সংগঠনের নেতারা বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ে বম পার্টির (কেএনএফ) ছত্রছায়ায় প্রশিক্ষণ নিতে যান। সেখানেই আনুষ্ঠানিকভাবে এই জঙ্গি দলটির নামকরণ হয় জামায়াতুল আনসার ফির হিন্দাল শারক্বীয়া।

সম্প্রতি ঘরছাড়া কয়েকজন তরুণ-যুবকের খোঁজে নেমে নতুন জঙ্গি দলটির খোঁজ পায় র‌্যাব; এই দলটির সঙ্গে পাহাড়ি সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের যোগসাজশও বেরিয়ে আসে।

সংবাদ সম্মেলনে সিটিটিসি প্রধান বলেন, গত বছরের জানুয়ারিতে চিকিৎসক শাকির বিন ওয়ালী, শামিন মাহফুজসহ মহিবুল্লাহ বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির দুর্গম পাহাড়ে জঙ্গি সংগঠনটির প্রশিক্ষণ শিবিরে যান।

তিনি বলেন, পাহাড়ে বম পার্টি বা কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ চলত। সেখানে তাদের সঙ্গে কেএনএফ নেতা নাথান বমসহ সংগঠনটির অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। সেখানেই তারা আনুষ্ঠানিকভাবে সংগঠনটির নামকরণ করে ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ এবং মহিবুল্লাহকে নায়েবে আমির নির্বাচিত করা হয়।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে শাকিরকে গ্রেপ্তার করে সিটিসিটি, শামিন মাহফুজ এখনও পলাতক।

গত অক্টোবরে গ্রেপ্তার হওয়া আরেক জঙ্গি সদস্যের ভাষ্য দিয়ে র‌্যাব বলেছিল, ২০১৯ সালের আগেই এই জঙ্গি দলটির নামকরণ সম্পন্ন হয়।

গত বছরের অক্টোবরে পটুয়াখালীর মাদ্রাসা শিক্ষক হোসাইন আহম্মদ (৩৩)সহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

গ্রেপ্তার হোসেনের বরাত দিয়ে গত ৬ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছিলেন, “নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবি, আনসার আল ইসলাম এবং হুজির সাবেক কিছু সদস্য ২০১৭ সালে নতুন জঙ্গি সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু করেন। পরবর্তীকালে ২০১৯ সালে সংগঠনটি ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ (হিন্দুস্থানের পূর্বাঞ্চলীয় জামাতুল আনসার) নাম নেয়।”

এরপর গত ২১ অক্টোবর র‌্যাবের আরেক সংবাদ সম্মেলনে আল মঈন বলেন, নতুন এ জঙ্গি সংগঠনের আমিরের সঙ্গে কেএনএফের প্রতিষ্ঠাতা নাথান বমের সমঝোতা হয় ২০২১ সালে। পার্বত্য অঞ্চলে কেএনএফ’র ছত্রছায়ায় জামাতুল আনসার সদস্যদের ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য তাদের মধ্যে চুক্তিও হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে তিন লাখ টাকা দেওয়ার পাশাপাশি কেএনএফ সদস্যদের খাবার খরচ বহন করে জামাতুল আনসার।

Also Read: র‌্যাবের জালে নতুন জঙ্গি দল, কারা এরা?

Also Read: নতুন জঙ্গি দলের ‘পাহাড়ি যোগ’ পেয়েছে র‌্যাব

Also Read: বম পার্টির সঙ্গে নতুন জঙ্গি দলের ‘মাসিক চুক্তির’ খবর দিল র‌্যাব

২০১৭ থেকে সংগঠনের পরিকল্পনা

এর আগে র‌্যাব জানায়, ২০১৭ সাল থেকেই কিছু জঙ্গি সদস্য নতুন সংগঠন গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিল। সিটিসিসিও বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে একই রকম তথ্য দিয়েছে।

সিটিটিসর সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তেব্যে বলা হয়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার মহিবুল্লাহ জানিয়েছেন, তিনি চট্টগ্রামের হাটহাজারীর ‘আল জামেয়াতুল আহেলিয়া দারুল উলুম মইনুল ইসলাম’ মাদ্রাসার ছাত্র থাকার সময়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি-বি) এর সঙ্গে যুক্ত হন এবং কথিত জিহাদি প্রশিক্ষণ নেন। তখন হুজির অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে মহিবুল্লাহ যুক্ত ছিলেন।

পড়াশোনা শেষে মহিবুল্লাহ ভোলায় বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। প্রশাসনের নজরদারির কারণে হুজি-বি’র কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে পড়ায় মহিবুল্লাহসহ তখনকার হুজি সদস্যরা নতুন একটি প্লাটফর্মে জঙ্গি কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা করেন বলে সিটিটিসির ভাষ্য।

আসাদুজ্জামান বলেন, সেই লক্ষ্যে হুজির আরেক নেতা মাইনুল ইসলাম রক্সি তার সঙ্গে ২০১৭ সালে ভোলায় গিয়ে দেখা করেন। এ সময় হুজির অন্য নেতারাও তাদের সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর থেকেই রক্সি ও মহিবুল্লাহর মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ শুরু হয়। ২০২১ সালে রক্সি গ্রেপ্তারের পর হুজির আরেকজন সদস্য রাকিবের সঙ্গে মহিবুল্লাহর যোগাযোগ তৈরি হয়। এরমধ্যেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনার কাজে সদস্য সংগ্রহ ও দাওয়াতি কার্যক্রম চালাতে থাকে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত সেপ্টেম্বরে চিকিৎসক শাকের গ্রেপ্তার হওয়ার পর মহিবুল্লাহ তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ও সিম কার্ড নষ্ট করে ফেলেন। এরপর তাকে তথ্য প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে গ্রেপ্তার করা হয়।

দল প্রধান পলাতক

রংপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে বহিষ্কৃত ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাবেক কর্মী শামিন মাহফুজ গোড়া থেকেই শারক্বীয়ার প্রধান বলে গত ২৭ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান।

সেদিন তিনি বলেছিলেন, জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে এর আগে তিনবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন শামিন, তবে এখন তিনি পলাতক।

বুধবার এই সংগঠনের নেতৃত্ব নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আসাদুজ্জামান বলেন, এই জঙ্গি সংগঠনের প্রধান ব্যক্তি শামিন মাহফুজের নির্দেশে একটি কমিটি হয়। এই কমিটির প্রথম আমির ছিলেন রক্সি। শূরা কমিটিতে ছিলেন ছয়জন। রক্সি গ্রেপ্তারের পর শূরা কমিটির সদস্য আনিসুল ইসলাম ওরফে তমালকে আমির ও মহিবুল্লাহকে নায়েবে আমির নিযুক্ত করা হয়।

সিটিটিসি কর্মকর্তা বলেন, “ভোলার শায়খ হিসেবে পরিচিত মহিবুল্লাহ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের প্রশিক্ষণরত সদস্যদের দারস বা বয়ান দিতেন। আর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পসহ জঙ্গি সংগঠনটির সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন শামিন মাহফুজ।”