“(মফস্বল) এলাকার থানায় যত কাজই থাকুক, কিছুই মনে হয়নি। ঢাকায় এসে মাত্রাতিরিক্ত কাজের চাপের সঙ্গে যোগ হয়েছে দীর্ঘসময় ধরে ডিউটি। অল্প কয়েকদিনেই মনে হচ্ছে- আর পারব না,” বলেন এক পুলিশ সদস্য।
Published : 02 Nov 2024, 01:30 AM
ঢাকার মোহাম্মদপুর থানায় ২২ অক্টোবর দুপুরে একদল যুবক এসে জানালেন, বেড়িবাঁধ এলাকায় গন্ডগোল হয়েছে। স্থানীয় যুবকদের সঙ্গে কথা কাটাকাটির জেরে ঘটনার সূত্রপাত, পুলিশের সহায়তা চাইছেন তারা। কিন্তু থানার দায়িত্বরতরা ঠাওর করতে পারছিলেন না ঘটনাস্থল তাদের থানায় পড়েছে কি না।
খোদ ওসি বুঝতে না পেরে আশপাশের থানায় যোগাযোগ করলেন। বিভিন্ন জনের সঙ্গে আলাপ করে তিনি নিশ্চিত হলেন, ওই এলাকা তার থানার আওতাধীন। কিন্তু ওই এলাকার ফাঁড়ি কার্যকর না থাকায় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারছিলেন না।
ফোর্স সংকটের পাশাপাশি বাইরে থেকে বদলি হয়ে আসা সদস্যদের নিয়ে অনেক ঝামেলাতেই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে না পারার কথা স্বীকার করেন ওসি আলী ইফতেখার হাসান। ঢাকার বাস্তবতা বুঝতে আর অলিগলি চিনতে যে বেগ পেতে হচ্ছে, তা স্বীকার করেছেন ঢাকায় আসা নতুনরাও।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চুরি-ছিনতাই, ডাকাতি কিংবা খুনের জন্য সবচেয়ে বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকা। ফাঁকা সড়কে কখনও সকালে, কখনও সন্ধ্যা বা রাতে এমনকি ভর দুপুরেও ছিনতাইয়ের ঘটনায় অতিষ্ঠ ওই এলাকার লোকজন।
গেল দুই মাসে গুলি, ধারালো অস্ত্রের কোপ আর পিটুনিতে মোহাম্মদপুর এলাকায় অন্তত ১০ জনের প্রাণহানির পাশাপাশি অর্ধশতাধিক আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। চুরি-ছিনতাই, কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য কিংবা আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এমন ঘটনা ঘটছে প্রায়ই।
২৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুরের চাঁনমিয়া হাউজিং এলাকায় ছিনতাইকারীদের হামলার মুখে পড়েন ‘পাঠাও ফুড’ কর্মী সোহেল তানভীর। হাউজিংয়ের ১ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় যাওয়ার পথে আচমকা অটোরিকশা থেকে নেমে চাপাতিসহ ঘিরে ধরে ৪-৫ জন।
ছিনতাইকারীরা সোহেলের কাছ থেকে অফিসের এক লাখ ১৫ হাজার ১৫১ টাকা, ব্যক্তিগত ৬ হাজার টাকা এবং তার মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে চলে যায়। ২৬ অক্টোবর থানায় গিয়ে মামলা করতে চাইলেও তিনি করতে পারেননি।
টাকা-মোবাইল ছিনতাইকে ‘হারিয়ে গেছে’ হিসেবে বর্ণনা করে সোহেলকে জিডি করতে বাধ্য করে পুলিশ।
সোহেল বলেন, “থানায় মামলা করতে গিয়েছিলাম। পুলিশ বললো জিডি করলেও তদন্ত করে সিসিটিভি ক্যামেরা ভিডিও দেখে ছিনতাইকারীদের ধরতে পারবে। এ কারণে মামলা না করে জিডিই করে আসছি।”
জিডির তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার এসআই রাজু আহমেদ বলেন, “ছিনতাইকারীরা সিএনজিতে এসে টাকা-মোবাইল নিয়ে আবার সিএনজিতে করেই চলে গেছে। অভিযোগকারী কাউকে চিনতে পারেননি, সবাই মাস্ক পরা ছিল।
“আবার সিএনজিতে চলে যাওয়ায় আশপাশের সিসিটিভি ক্যামেরাতেও কাভার করেনি। এজন্য ঘটনাটিকে অভিযোগ আকারে নেওয়া হয়েছে। তদন্তে কাউকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হলে এটা এমনিতেই মামলায় রূপান্তর হয়ে যাবে।”
রোজকার চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির ঘটনায় অতিষ্ঠ হয়ে মোহাম্মদপুরে একদল মানুষ ২৬ অক্টোবর বিকালে থানায় গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশকে ৭২ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়। এর মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে থানায় অবস্থানের ঘোষণাও দেওয়া হয়।
এরপর সেনাবাহিনীর তরফ থেকে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে অভিযান জোরদার এবং থানা পুলিশের তরফে তৎপরতা বাড়ানোর কথা বলা হয়। যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের তিন দিনে (২৬ অক্টোবর থেকে) গ্রেপ্তার হয় শতাধিক।
মোহাম্মদপুর এলাকায় ‘অরাজক’ পরিস্থিতির জন্য পুলিশ স্বল্পতাকে দায় দিচ্ছেন তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ জিয়াউল হক।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের ফাঁড়িগুলোতে এখন পর্যাপ্ত ফোর্স নেই।”
আগের তুলনায় অর্ধেকেরও কম জনবল নিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে হচ্ছে জানিয়ে জিয়াউল বলেন, যানবাহন সংকটে ব্যাহত হচ্ছে টহল কার্যক্রম।
অপরাধ বাড়ছেই
মোহাম্মদপুর ছাড়াও চুরি-ছিনতাই বাড়ছে ধানমন্ডি, উত্তরা ও ডেমরা এলাকাতেও। ক্ষমতার পালাবদলে ‘একযোগে’ সিংহভাগ পুলিশ সদস্যের বদলির পর এখনও ‘পূর্ণ জনবল’ বুঝে পায়নি ঢাকার থানাগুলো। সর্বস্তরে যাদেরকে বদলি করে আনা হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই ঢাকায় একেবারে নতুন।
একদিকে কম জনবল, অন্যদিকে ঢাকার বাস্তবতায় ‘অনভিজ্ঞ’ পুলিশ সদস্যদের দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে। তাতে মহানগরীতে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
তবে ‘একযোগে’ সকল পুলিশ সদস্যকে বদলি করার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশন্স) ইসরাইল হাওলাদার।
মানসিকভাবে ‘বুস্টআপ’ করার জন্য বদলিটা ‘জরুরি ছিল’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “প্রতিদিনই নতুন সদস্যরা এসে যোগদান করছেন। প্রায় ৩২ হাজার ফোর্সের একটা ইউনিটের সবাইকে তো আর একবারে পাল্টে ফেলা হয়নি, আস্তে আস্তে করা হচ্ছে। এজন্য আমাদের বড় কোনো সমস্যা হচ্ছে না।”
ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ মাসে ঢাকার বিভিন্ন থানায় খুনের মামলা হয়েছে ৪০২টি, এর মধ্যে সেপ্টেম্বরেই হয়েছে সর্বোচ্চ ১৪৮টি। এছাড়া অগাস্টে ১১৯টি, জুলাইয়ে ৫৯টি, জুনে ১৩, মে মাসে ১৬, এপ্রিলে ১৪, মার্চে ১৮, ফেব্রুয়ারিতে ৪ আর জানুয়ারিতে হত্যা মামলা হয়েছে ১১টি।
এছাড়া গত ৯ মাসে দস্যুতার ১৬২টি, ডাকাতির ২৪টি, অপহরণের ৭২টি এবং চুরির ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪৬১টি। এর মধ্যে অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে দস্যুতার মামলা ১৮টি, ডাকাতি ৯টি, অপহরণের ৩৩টি এবং চুরির মামলা হয়েছে ৪৮টি।
তবে পুলিশি ঝামেলা এড়াতে চুরি-ছিনতাইয়ের মত ঘটনায় পুলিশের কাছে যান না অনেকেই। এ কারণে অপরাধের সঠিক চিত্র মামলার এই পরিসংখ্যানে উঠে আসে না।
ডিএমপির এক কর্মকর্তা বলেন, “মাসভিত্তিক খুনের মামলার পরিসংখ্যানের হিসাবে অগাস্টে ও সেপ্টেম্বরে অনেক বেশি মামলা হয়েছে। ওই দুই মাসে খুনের মামলা হয়েছে মানেই ওই মাসগুলোতেই খুনের ঘটনা ঘটেছে এমন নয়।
“আগের ঘটনাতেও এ সময়টায় মামলা হয়েছে। খুনের মামলা বাদে বাকি মামলাগুলো ওই সংশ্লিষ্ট মাসের ঘটনাতেই করা হয়েছে।”
‘খেই হারাচ্ছেন’ নতুনরা
৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিনই হামলা চালানো হয় থানাসহ পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায়। লুটপাট-ভাংচুর করে আগুন দেওয়া হয়। হামলা হওয়া থানাগুলোতে ধ্বংস হয়ে যায় মামলার নথি, আলামতসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সবকিছু।
এরপর পুলিশি ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে সংস্কারের উদ্যোগের মধ্যে ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুতি করাসহ শুরু হয় ঢালাও বদলি। বিশেষ করে ঢাকার শীর্ষ পদ থেকে শুরু করে একেবারে কনস্টেবল সদস্যদের বদলির উদ্যোগ নেওয়া হয়। মানসিকভাবে ভেঙে পড়া পুলিশ সদস্যদের মনোবল ফিরিয়ে আনতেই এ বদলির উদ্যোগ নেওয়া হয় বলে দাবি ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের।
এক কর্মকর্তা বলেন, “৫ অগাস্টের পর পুলিশ স্বাভাবিকভাবে কাজে ফিরতে কিছুটা সময় লেগেছে। একজন পুলিশ অফিসার হয়ত দীর্ঘদিন একইস্থানে কাজ করছিলেন, এলাকার অনেকেই তাকে চেনে।
“এই আতঙ্ক থেকে সে স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারছিল না। এ অবস্থায় পুলিশকে স্বাভাবিকভাবে কাজে ফেরাতে তাকে বদলি করা ছাড়া উপায়ও ছিল না।”
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঢাকার সব পুলিশ সদস্যকে বদলি করে যেমন বাইরে পাঠানো হয়েছে, তেমনই বিভিন্ন জেলা থেকে পুলিশ আনা হয়েছে ঢাকায়।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকায় এখন যোগ দেওয়া সদস্যদের বেশির ভাগই রাজধানীতে একেবারে নতুন। অত্যাধিক কাজের চাপের সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খাওয়ার পাশাপাশি রাস্তাঘাটসহ নিজের নির্ধারিত এলাকা চিনতে তাদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জ থেকে পল্লবী থানায় বদলি হয়ে আসা এক এসআই বলেন, “এলাকার থানায় যত কাজই থাকুক, কিছুই মনে হয়নি। ঢাকায় এসে মাত্রাতিরিক্ত কাজের চাপের সঙ্গে যোগ হয়েছে দীর্ঘসময় ধরে ডিউটি।
“অল্প কয়েকদিনেই মনে হচ্ছে- আর পারব না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলে আবার বদলি নিয়ে চলে যাব।”
গাজীপুর থেকে আদাবর থানায় বদলি হয়ে আসা কনস্টেবল হামিদা বলেন, “ঢাকায় এসেছি এক সপ্তাহ হল, এখনও থাকার জায়গা ঠিক হয়নি।
“তেজগাঁওয়ে এক আত্মীয়র বাসায় থেকে ডিউটি করছি। এখন একটু খারাপ লাগছে। নতুন এসেছি, সেট হতে একটু সময় তো লাগবেই।”
রংপুর থেকে বদলি হয়ে আসা একই থানার এসআই আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “অল্প কয়েকজন ছাড়া আমাদের থানার সবাই নতুন। যে কয়েকজন আছে, তারাও চলে যাবে।
“ঢাকায় অনেক গ্যাদারিং, এখানে অপরাধের ধরনও আলাদা। সবকিছু মিলিয়ে আমরা স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।”
বদলিজনিত কারণে থানায় পুলিশ সংকট দেখা দিয়েছে জানিয়ে খিলগাঁও থানার ওসি দাউদ হোসেন বলেন, “আমাদের কিছুটা ফোর্স সংকট আছে। বদলিজনিত কারণে এখনও অনেক ফোর্স বদলি হওয়া কর্মস্থলে যোগ দেননি।
“অনেকেই আসছেন, যোগ দিচ্ছেন। আশা করছি, সবাই যোগ দিলে দ্রুতই এই সংকট কেটে যাবে।”
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা রোববার বলেন, “নতুনদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে তারা এলাকা চেনে না, রাস্তাঘাট চেনে না। ঢাকায় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতেই তাদের বেগ পেতে হচ্ছে। আমার টিমে একজন মুন্সি ছিল এএসআই পদের।
“দীর্ঘদিন ধরে সে অফিসিয়াল কাজ করায় কিছু না বললেও কোন মামলায় কী কী ডকুমেন্টস লাগবে, কোনটা কীভাবে সাজাতে হবে বুঝতো। আজ বদলি হয়ে সেও চলে গেছে। এখন হয়তো আমাদের নিজেদেরই বা কোনো এলসি (লিটারেট কনস্টেবল) দিয়ে কোনোরকম কাজ চালিয়ে নিতে হবে।”
তিনি বলেন, “যারা বদলি হয়ে নতুন আসছেন, তাদের সবকিছু বুঝে নিয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে একটু সময় লাগবেই। আর পুরাতনদের মধ্যে যে কয়েকজন আছেন, বদলির আদেশ হয়ে যাওয়ায় তারাও স্বাভাবিক কার্যক্রমে মনযোগ দিতে পারছেন না।
“সে নতুন কোন জায়গায় যাবে, কোথায় পোস্টিং হবে, সেখানে পরিবারসহ সবকিছু গোছানোর চিন্তায় ব্যস্ত। বর্তমানে গোয়েন্দা পুলিশের স্বাভাবিক নিয়মিত অপারেশনাল কার্যক্রম চলছে না বলেই চলে।”
সংকট ‘সোর্স’ নিয়েও
অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নিজস্ব সোর্সের উপর অনেকটাই নির্ভর করে থাকে পুলিশ। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় দু-একজন সদস্য বদলি হয়ে গেলেও বাকিরা পুরাতন থাকায় তেমন কোনো সমস্যা হত না।
কিন্তু থানা পর্যায়ে এখন সব সদস্যই নতুন হওয়ায় সোর্স নিয়ে সংকট দেখা দিয়েছে। কোনো এলাকায় কিছু ঘটলে বা আগাম তথ্য পাওয়া পুলিশ সদস্যদের কাছে এখন কঠিন ঠেকছে।
জয়পুরহাট জেলা পুলিশ থেকে মোহাম্মদপুর থানায় বদলি হয়ে আসা এসআই রাজু আহমেদ বলেন, “জেলা পুলিশ থেকে ঢাকায় তাও আবার মোহাম্মদপুরের মতো জায়গায় এসেছি। এখানে লোক বেশি, ক্রাইম বেশি।
“এদিকে থানায় আবার ফোর্স কম, অফিসার কম। টানা ৩৬ ঘণ্টাও ডিউটি করেছি আমি এখানে এসে। টানা ডিউটি করেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।”
রাজুর ভাষ্য, “আমাদের কাজের প্রধান অনুসঙ্গই তো সোর্স। কিন্তু এখন লোকাল পর্যায়ে আমাদের কোনো সোর্স নাই। আমরা তো এখনও রাস্তাঘাটই ঠিকমত চিনে উঠতে পারছি না। এর মধ্যে মানুষের সঙ্গে মিশব, তারপর তো সোর্স।”
তবে মাস দুয়েকের মধ্যে এ ধরনের সংকট কেটে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
পূরণ হয়নি কর্মকর্তাও
কর্মকর্তা সংকট এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি ডিএমপির বেশির ভাগ ইউনিট। ডিবি পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশের আটটি বিভাগের সবকটিতে উপ-কমিশনার পদায়ন করা সম্ভব হয়নি। প্রতি দুইটি বিভাগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন একজন উপ-কমিশনার।
ডিবি রমনা বিভাগের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী একজন উপকমিশনার, তিনজন অতিরিক্ত উপকমিশনার ও দুইজন সহকারী কমিশনার থাকার কথা। রদবদলের প্রায় তিনমাস হতে চললেও এতোদিনে সেখানে পদায়ন হয়েছে একজন অতিরিক্ত উপকমিশনার ও একজন সহকারী কমিশনারকে। আর রমনা ও মতিঝিল বিভাগ মিলিয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন একজন উপকমিশনার।
ডিবির রমনা বিভাগের একজন বলেন, “ঢাকায় সব অফিসার থাকার পরেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বেগ পেতে হয়।
“সেখানে এখন অর্ধেক বা তারও কম অফিসার ও ফোর্স নিয়ে স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে নেওয়া একটু চ্যালেঞ্জিং।”
সড়কেও অনভিজ্ঞতার ছাপ
ঢাকার গাড়ির চাপ সামলাতে দীর্ঘ বছরের অভিজ্ঞ ট্রাফিক সদস্যদের ধারাবাহিক বদলির প্রভাব পড়েছে সড়কে। এর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সময়ে সময়ে বিভিন্ন সড়ক বন্ধ করে নানা আন্দোলনও ভোগান্তি তৈরি করছে।
ঢাকার উত্তরা থেকে বনানীতে নিয়মিত অফিস করেন মঞ্জুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, সরকার পরিবর্তনের মাসখানেক আগেই বিমানবন্দর সড়কে ট্রাফিক পুলিশের বাড়তি তৎপরতায় যানজট কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছিল।
“মহাখালী থেকে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত গাড়িগুলো নির্ধারিত জায়গায় থামানোর চেষ্টা হচ্ছিল। নানা উদ্যোগে কিছুটা উন্নতি হলেও সরকার পরিবর্তনের পর আবার যাচ্ছেতাই অবস্থা।”
তিনি বলেন, “সড়কে এখন অনেক ট্রাফিক পুলিশেই নতুন চকচকে ইউনিফর্মে দেখা যায়। রাস্তায় তাদের মুভমেন্ট দেখলেই মনে হয় নতুন। এমনও মনে হয় মাঝে মধ্যে কোন সিগনাল কতোক্ষণ আটকে রাখা লাগবে, কোনটাকে গুরুত্ব দিতে হবে- বিষয়টা নিয়ে তাদের পরিষ্কার ধারণা নেই।
“নতুনদের মাধ্যমেও তো যানজট নিয়ন্ত্রণে আগের ভালো উদ্যোগগুলো কাজে লাগানো যায়। কে দায়িত্বে আসলো- আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ না, আমরা যানজটের দুর্ভোগ থেকে মুক্তি চাই।”
মহাখালী আমতলী মোড়ে কাজ করা ট্রাফিক কনস্টেবল শহীদুলের মুন্সীগঞ্জে বদলি আদেশ হয়ে গেছে।
নতুন কর্মস্থলে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা এই ট্রাফিক পুলিশ বলেন, “নতুন নতুন ট্রাফিক আনতেছে বিভিন্ন জেলা থেকে। জেলা শহরের রাস্তা সামলানো আর ঢাকার রাস্তা সামলানো তো এক জিনিস না।
“তারা কাজই করতে পারতেছে না, যানজট লেগে যাইতেছে। অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ার কারণে বদলি হওয়ার পরেও আমাদের ছাড়তেছে না। ছাড়বে হয়তো কিছুদিন পরে।”
ডিএমপি ট্রাফিক তেজগাঁও বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, "ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা আর বাইরের যে কোনো জায়গার ব্যবস্থাপনার বিষয়টি এক না। এখানে মাত্রাতিরিক্ত গাড়ির চাপের সঙ্গে বাড়তি কর্মঘণ্টার চাপ রয়েছে।
“এমনও অনেক সিগন্যাল রয়েছে, যেখানে ট্রাফিক সদস্যরা খানিকটা বসার সময়ও পান না। নতুন একটা সদস্য এসে জায়গাই চিনতেছে না।"
তার বিভাগে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করা প্রায় অর্ধেক সদস্যকে বদলি করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আবার অনেকের বদলির আদেশ হয়েছে, যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। ঢাকায় যাদের আনা হচ্ছে, তারা বিভিন্ন জেলায় ট্রাফিক সামলেছেন।
“তাদেরকে নিয়ে কাজ করাতে বেগ পেতে হচ্ছে, আবার পুরাতনদের মধ্যে যাদের বদলি হয়ে গেছে- তাদেরও কাজে মন নেই। তার পরেও সবকিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার চেষ্টা চলছে।”
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ১০ অগাস্ট থেকে স্বল্প পরিসরে ঢাকার সড়কে কাজ শুরু করে ট্রাফিক পুলিশ। শুরুতে মাসখানেক অল্প সদস্যের উপস্থিতি দেখা গেলেও শক্ত অবস্থানে যেতে দেখা যায়নি কাউকেই। মামলার কার্যক্রম শুরু হয় আরও পরে।
সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে এসে মামলা কার্যক্রম শুরুর পর ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত ২১ হাজার ৪৪৭টি মামলা এবং প্রায় আট কোটি ৬১ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেছে ট্রাফিক বিভাগ। এ সময়ে ৫৮ হাজার ১৯৬টি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাসহ ডাম্পিং করা হয়েছে ২ হাজার ৫২৯ টি যানবাহন।
ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার তালেবুর রহমান বলেন, “ঢাকার দুই কোটির বেশি জনসাধারণের জন্য আমাদের চার হাজার ট্রাফিক পুলিশ কাজ করছে। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট থেকে শুরু করে আমরা সব জায়গায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি।
“রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার যে প্রচেষ্টা- সেটি অব্যাহত রয়েছে। এজন্য ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি আমরা নগরবাসীর সচেতনতা প্রত্যাশা করি।”
‘ঢালাও’ বদলি নিয়ে প্রশ্ন
জঙ্গি দমনে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) নামে ডিএমপির বিশেষায়িত ইউনিট রয়েছে। এ ইউনিটের বম ডিসপোজাল, সাইবার টিমসহ অনেক সদস্যই দেশে-বিদেশে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। কিন্তু ‘সব পাল্টে ফেলার’ হুজুগে সেখানকার কর্মকর্তাদেরও বদলি করা হচ্ছে।
এক কর্মকর্তা বলেন, “যে ছেলেটাকে এক বা একাধিক দেশে প্রশিক্ষণ দিয়ে একটা বিষয়ে প্রস্তুত করা হল; তার জায়গায় জেলা পুলিশ থেকে একজন অফিসার এসে কী করবে?
“আবার যে অফিসারটাকে প্রস্তুত করতে সরকারের এত টাকা ব্যয় হলো, সে অন্য জেলায় গিয়ে তার দক্ষতা কাজেই লাগাতে পারবে না।”সিল হবে না
পুলিশের এই বদলিকে ‘নিয়মিত কার্যক্রম’ হিসেবে বর্ণনা করা হলেও এখন পর্যন্ত কত সংখ্যক সদস্যকে বদলি করা হয়েছে তা জানাতে পারেননি ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার তালেবুর রহমান।
তিনি বলেন, “খন কাউকে অন্য কোনো ইউনিটে বদলি করা হয়, এটা আমাদের নিয়মিত কার্যক্রম, এটা অব্যাহত আছে।”
বদলি ও ফোর্স সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) ইসরাইল হাওলাদার বলেন, “সংকট হলে একটু সমস্যা হয়। তবে কিছু কিছু রিপ্লেস হয়েছে, যা দিয়ে চালানো যাচ্ছে। খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না।”
একযোগে বদলির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা বলেন, “অনেক সময় বদলির বিষয়ে স্ট্রিক্টলি প্রফেশনাল আচরণ দেখানো যায় না, অনেকসময় বদলি করতে হয়।
“কিন্তু বদলি করতে গিয়ে যদি অসুবিধা হয়- তাহলে তারা বলবে, যদি কেউ কিছু না বলে ধরে নিতে হবে অসুবিধা হচ্ছে না।”