বাড়ি ফেরার পথে এ ব্যবসায়ীর দুই চোখে গুলি লাগে। এক চোখ পুরোপুরি নষ্ট, অন্যটির ৭০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত। দুইবার অস্ত্রোপচার হয়েছে, এখনও আলো ফেরেনি।
Published : 28 Jul 2024, 12:36 AM
নরসিংদীর বাবুরহাটে কাপড়ের ব্যবসা করতেন তিন সন্তানের জনক তৌহিদ ভুঁইয়া। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতার মধ্যে পড়ে তার জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার।
কোটা আন্দোলনকারীদের গত ১৮ জুলাই কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচিতে বাড়ি ফেরার সময় নরসিংদী শহরে বাস থেকে নামার পরপর পিঠে লাগে ছররা গুলির আঘাত, সেই আঘাতের পর ঘাড় ফেরাতে কয়েকটি গুলি বিদ্ধ হয় তার চোখে মুখে।
এক চোখের জ্যোতি নিভে গেছে পুরোপুরি, আরেকটিও ৭০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত, দুইবার অস্ত্রোপচার করে ছররা গুলিগুলো বের করা হয়েছে, কিন্তু চোখের আলো আর ফেরেনি।
ঢাকার আগারগাঁওয়ের জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ক্ষীণ আশা নিয়ে এখনও তৌহিদ অপেক্ষায়। ৭০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত চোখে যদি কিছুটা হলেও আলো ফেরে, তাহলে তিনটি সন্তান আর স্ত্রীর জীবনটা কোনো রকমে চালিয়ে নিতে পারবেন। দৃষ্টি পুরোপুরি চলে গেলে কী হবে তা ভাবতেই পারছেন না।
ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে এখন তৌহিদের মতো বহু মানুষ চিকিৎসা নিচ্ছেন, যারা কোটা আন্দোলনকে ঘিরে ১৮ থেকে ২১ জুলাইয়ের সংঘাতে আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা এই সংঘাতের সাতে পাঁচে ছিলেন না কিন্তু আহত হয়ে এখন জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তায়।
কীভাবে কী হয়ে গেল তৌহিদের
১৮ জুলাই বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে বাবুরহাটের দোকানে থাকার সময় এই ব্যবসায়ী জানতে পারেন এলাকার অবস্থা ভালো না। তড়িঘড়ি করে দোকান বন্ধ করে নরসিংদী শহরের ভেলানগরের নিজ বাড়িতে যেতে বাসে উঠলেন।
ভেলানগরের জেলখানা মোড়ে বাস থেকে নামা মাত্রই শুনলেন গুলির আওয়াজ, সঙ্গে হইচই। তখন বিকাল প্রায় ৪টা।
সড়কে তার সঙ্গে ছিল আরও চার থেকে পাঁচজন পথিক। ভুল করেই সবাই সংঘর্ষের মাঝামাঝি অবস্থানে চলে এসেছিলেন। কী করবেন বুঝতে না পেরে দিলেন দৌড়।
তৌহিদ বলেন, তখনই ছররা গুলি এসে লাগল তার পিঠে। মুখ ফিরে তাকিয়ে দেখতে গিয়ে অসংখ্য গুলি এসে এবার লাগল চোখে মুখে।
স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যান, সেটি ছিল তালাবদ্ধ। তখন তাকে নেওয়া হয় সদর হাসপাতালে। সেখানে একদিন রেখে চিকিৎসকরা পাঠান চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে।
শুক্রবার রাজধানীর এই আসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে।
ঘটনার আটদিন পর শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম তৌহিদ বলেন, “আমার ডান চোখে ১১ টা ছিটা গুলি (ছররা গুলি) লাগছে, আর বাম চোখে তিনটা। ডাক্তার জানিয়েছে ডান চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। আর বাম চোখ ৭০ ভাগ ড্যামেজ। এখন পর্যন্ত দুইবার অপারেশন হইছে তবুও ভালো হয় নাই।”
৫ জনের পরিবারে তিনি একাই উপার্জন করেন। তার দুটি ছেলে, একটি মেয়ে। বড় ছেলের বয়স ১১ বছর, মেয়ের বয়স ৯ এবং ছোট ছেলের বয়স ৭।
তৌহিদ বলেন, “আমি আন্দোলনের আগে-পরে কোথাও ছিলাম না। শুধু দোকান বন্ধ কইরা বাসায় ফিরতেছিলাম। এর মধ্যে আমার দুই চোখ হারাইলাম।
“আমার ছোট ছোট তিনটা বাচ্চার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমার উপরে। অন্তত একটা চোখ যদি ঠিক না হয় তাদের কী হবে!”
শেষ দেখার সেই দৃশ্যগুলো এখনও পোড়ায় তৌহিদকে। তিনি বলেন, “মানুষ বাঁচার জন্য দৌড়াচ্ছে। একেকজন গুলি খেয়ে খেয়ে রাস্তায় পড়তেছে। আর গুলি ঠিক কোন দিক থেকে আসতেছে সেটাও বোঝার উপায় নেই।”
হাসপাতালে তৌহিদের সঙ্গে থাকছেন তার কয়েকজন প্রতিবেশী। এদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা এই হাসপাতালে আসার পর থেকে দেখতেছি শুধু রোগী আসছে তো আসছেই। প্রায় দেড়শ রোগী আসছে আমার দেখা মতে।”
দুবাই যেতে চেয়েছিল রাকিব, এখন শুধুই কান্না
দুবাই গিয়ে কাজ করবেন বলে চিটাগং রোডে একটি সেলুনে পাঁচ মাস ধরে কাজ শিখছিল ১৬ বছর বয়সী মো. রাকিব। গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি পা হারিয়েছেন।
রাকিবের দাবি, ২০ জুলাই বিকাল ৬টার দিকে বাসায় যেতে সেলুন থেকে বের হয়ে আহসান উল্লাহ সুপার মার্কেটের সামনে সংঘর্ষের মাঝে পড়ে যায় সে। হঠাৎ করে একটি গুলি লোহার পিলারে লেগে বাম পায়ের হাঁটু ফুটা করে বের হয়ে যায়।
রাকিবের বাবা কবির হোসেন বলেন, “ছেলেটাকে প্রথমে আল বারাকা হাসপাতালে নিলে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার কথা বলে। ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার পরে সেখান থেকে বলে হৃদরোগে পাঠাতে। পরে হৃদরোগ ইনস্টিটিউট থেকে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠায়।
“পঙ্গু হাসপাতালের ডাক্তাররা বলে পা নষ্ট হয়ে গেছে, কেটে ফেলতে হবে। পরে সোমবারে পা কেটে ফেলা হয়।
“ছেলেটারে বিদেশ পাঠানোর পরিকল্পনা অনেক দিনের, তাই সেলুনে কাজ শিখাইতেছিলাম যাতে করে সেখানে অন্য কাজ না পাইলেও সেলুনের কাজ অন্তত করতে পারে। কিন্তু বিদেশ যাওয়ার আশা মাটি তো হইলই। সারাজীবনের জন্য আমার ছেলেটা পঙ্গু হয়ে গেল।”
বাবা কথা বলার সময় রাকিবের চোখ দিয়ে টলটল করে পানি পড়ছিল। পরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
খলিলদের জীবন পড়ে গেল অনিশ্চয়তায়
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের (পঙ্গু হাসপাতাল) পরিচালক কাজী শামীমুজ্জামানের তথ্য বলছে, আন্দোলনের সময় থেকে হাসপাতালে রোগী এসেছে ২৬৪ জন। এর মধ্যে অনেকেই চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন। বর্তমানে ভর্তি আছেন ৬৯ জন। এদের একজনের পা কাটতে হয়েছে।
হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের একজন খলিলুর রহমান। পেশায় বাবুর্চি। বিয়েসহ বিভিন্ন আয়োজনে চুক্তিতে রান্না করেন। ১৯ জুলাই শুক্রবার গুলশানের গুদারাঘাটে এক বিয়ের রান্নার উপকরণের তালিকা দিতে যাচ্ছিলেন। তখন দুই পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে যান, হঠাৎ করে তার পায়ে গুলি লাগে।
খলিল বলেন, “সুস্থ মানুষ আমি ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছি। মুহূর্তের মধ্যে হাঁটুর নিচে সামনের দিক দিয়ে গুলি ঢুকে পিছন দিয়ে বের হইছে। ঠিক কে করছে, তা বুঝে উঠতে পারি নাই। এখন ডাক্তার বলছে অপারেশন করতে হবে। কিন্তু পুরোপুরি ঠিক হবে কিনা জানি না।”
তার স্ত্রী হালিমা বেগম বলেন, “আমাদের তিন ছেলে। এক ছেলে বরগুনার আমতলীতে গ্রামের বাড়িতে থাকে। আর বাকি সবাই বাড্ডায় ভাড়া বাসায় থাকি। এখন আমার স্বামীর এই অবস্থায় আমরা ধ্বংসের মুখে পড়ে গেছি। সাজানো সংসার তছনছ হইয়া গেছে।”
ইমরান হোসেন মিরপুরের মনিপুরি পাড়ায় অবস্থিত টপ ওয়ান কোম্পানির ইনচার্জ। ১৯ জুলাই দুপুরের পরে অফিসে যাচ্ছিলেন, তখনই পায়ে গুলি লাগে।
তিনি বলেন, “আমি সকালে উত্তরা গেছি, ধানমন্ডি গেছি। কিন্তু পরিস্থিতি যে এতো খারাপ হবে সেটা কল্পনায়ও ছিল না।
“মিরপুর ১২ নম্বর থেকে একটা পাঠাও বাইক নিলাম। মনিপুরি পাড়া তিন নম্বর গেটে আমার অফিসের সামনে নামাবে। ২০০ টাকা ভাড়া ঠিক করলাম। বাইকার ভাই বলতেছে সব ঠান্ডা হয়ে গেছে। কিন্তু মিরপুর-১০ নম্বর দিয়ে ঢুকে সামনেই দেখা গেল দাও দাও করে আগুন জ্বলছে। পোলাপান ‘হই হই’ করতেছে।”
বাইকারকে বাহনটি ঘুরাতে বলতেই পায়ে গুলি লাগে। সেটি পা ফুটা করে বেরিয়ে যায়।
ইমরানের তথ্য বলছে, তখন বিভিন্ন ভবনের ছাদ থেকে গুলির প্রচণ্ড শব্দ আসছিল।
“আমার পায়ের দুইটা হাড় ভাঙছে, রগ ছিড়ে গেছে। একদিন পরপর পায়ে অপারেশন চলতেছে। এখন পর্যন্ত তিনটা অপারেশন হইছে। পা বাঁচানোর অনেক চেষ্টা চলছে।”
পুলিশ সদস্যের ওপর হামলাকারী কারা
পঙ্গু হাসপাতালে ভাঙা হাত নিয়ে কাতরাতে দেখা যায় ট্রাফিক পুলিশ সদস্য মো. আরফান আলী। গত ১৮ জুলাই বেলা ১১টায় মিরপুর-১০ নম্বরে হামলার শিকার হয়েছেন তিনি।
আরফান বলেন, “হুট করে কিছু মানুষ দা-লাঠি, ইট দিয়ে আমার উপরে হামলা শুরু করে। প্রথমে মাথায় আঘাত করে আমাকে ফেলে দেয়। এরপর তারা খালি আমাকে মারতেছেই। কিছুক্ষণ পর কেউ কেউ বলতেছে, ‘সে মনে হয় মরে গেছে, আর মারিস না’।”
যারা পিটিয়েছিল, তারাই এই পুলিশ সদস্যকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন, আবার আরেক দল
তাকে আরেক দফায় মারধর করে।
স্থানীয় আল হেলাল হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার পর নিউরো সায়েন্স হাসপাতাল হয়ে পঙ্গু হাসপাতালে আসেন তিনি।
আরফান বলেন, “আমাকে যারা মারছে তাদের কাউকে স্টুডেন্ট মনে হয় নাই। কারো কারো মাথায় পাগড়ি ছিল, একজনের মাথায় গামছা বাঁধা। সবাই অনেক সিনিয়র। ওদের সঙ্গে কী এমন শত্রুতা আল্লাহ জানে। আমার শরীরের সবকিছু ইট দিয়ে থেঁতলে দেওয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন, “ডাক্তার বলছে হাতে রড পড়াতে হবে। তবে জীবনে কখনও ভারী কাজ করা যাবে না।”