স্ক্যানিং ছাড়াই বন্দর থেকে খালাস হয় মদভর্তি কন্টেইনার: র‌্যাব

সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে গ্রেপ্তারের পর কাস্টমস কর্মকর্তাদের যোগসাজশের বিষয়টি পরিষ্কার হবে, বলছে র‌্যাব।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 July 2022, 03:43 PM
Updated : 24 July 2022, 03:43 PM

সুতা ও মেশিনারিজ ঘোষণায় আনা যে দুই কন্টেইনার থেকে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ জব্দ করা হয়েছে, সেই কন্টেইনার দুটি স্ক্যানিং ছাড়াই চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস করা হয়েছিল বলে জানিয়েছে র‌্যাব।

রোববার বিকেলে ঢাকার কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান সংস্থার আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

কন্টেইনার দুটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার পথে শনিবার ভোরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থেকে আটক করা হয়।

সেখান থেকে মোট ৩৬ হাজার ৮১৬ বোতল মদ উদ্ধার করে র‌্যাব বলছে, ঢাকার কিছু হোটেল, বার ও ক্লাব এসব মদের ক্রেতা। গার্মেন্ট পণ্যের মিথ্যা ঘোষণায় এই মদ আমদানির পেছনে রয়েছে মুন্সীগঞ্জকেন্দ্রিক একটি চক্র, যাদের নেটওয়ার্ক দুবাই পর্যন্ত বিস্তৃত। চলতি বছরেই তারা আরও তিনটি চালানে মিথ্যা ঘোষণায় প্রায় ৪৮ হাজার বোতল বিদেশি মদ এনেছে।

এই মদ আমদানির হোতা আজিজুল ইসলাম ও তার বড় ছেলে মিজানুর রহমান আশিক শনিবারই দুবাই পালিয়েছেন। আজিজুলের ছোট ছেলে আহাদকে রোববার সকালে বিমানবন্দর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর দুবাই বসে চক্রের কলকাঠি নাড়ছেন নাসিরউদ্দীন নামে এক ব্যক্তি। তার বাড়িও মুন্সীগঞ্জে। দুবাই থেকেই এই মদগুলো আনা হচ্ছিল।

র‌্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, যেহেতু সিল করা আমদানি পণ্যের কন্টেইনার, তাই তারা নিয়মমাফিক কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ও শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষকে খবর দিয়ে ঘটনাস্থলে নিয়ে আসে। এরপর সব সংস্থার উপস্থিতিতে শনিবার রাত ১টা থেকে মদের বোতল গণনা শুরু হয়। রোববার ভোর ৪টায় গণনা শেষ হয়।

“উদ্ধারকৃত মদের সরকার নির্ধারিত মূল্য ৩১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, ভ্যাটসহ এর দাম পড়ে ৩৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। র‌্যাবের ইতিহাসে এটা বিদেশি মদের চালান উদ্ধারের বৃহত্তম ঘটনা।“

Also Read: সুতা মেশিনারিজের নামে আনা হল মদ

ঈশ্বরদী ইপিজেডের বিএইচকে টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড ও কুমিল্লা ইপিজেডের হাসি টাইগার কোম্পানি লিমিটেডের নামে দুই কন্টেইনার সুতা ও মেশিনারিজ পণ্য আমদানির ঘোষণা দিয়ে শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যের কন্টেইনার দুটি চট্টগ্রাম বন্দরের এক নম্বর গেইট দিয়ে বের করা হয়।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক বলেন, “ঈশ্বরদী ও কুমিল্লা ইপিজেডে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব নেই। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে এই বিপুল পরিমাণ মদ আমদানির পেছনের মূল ব্যক্তিটি হলেন আজিজুল ইসলাম।”

আজিজুল ইসলাম মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও শ্রীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা। তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ধর্ম বিষয়ক উপকমিটির সদস্য।

মদ উদ্ধারের সময় গ্রেপ্তার মুন্সীগঞ্জের নাজমুল মোল্লা ও সাইফুল ইসলামও ওই চক্রের সদস্য জানিয়ে মঈন বলেন, “গ্রেপ্তার হওয়া পর নাজমুল ও সাইফুলের কাছ থেকে জানা যায়, মালামালগুলো আজিজুল ইসলামের কাছে যাওয়ার কথা ছিল। আজিজুলের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের ষোলঘর ইউনিয়নে।

“তার ছেলে গ্রেপ্তার হওয়া আহাদ এই চালানটির চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম ও নিরাপত্তা কার্যক্রম সামলেছেন। আহাদ ও তার বড়ভাই আশিক এই মালামালগুলো মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে তাদের নিজস্ব ওয়্যারহাউজে নিচ্ছিলেন।”

র‌্যাব জানায়, মুন্সীগঞ্জে তাদের ওয়্যারহাউজ ও বাড়িতে গিয়ে তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি। পরে জানা যায়, ঢাকার ওয়ারীতে তাদের একটি ১২তলা ভবন রয়েছে। সেখানে গিয়েও কাউকে পাওয়া যায়নি। ওই বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি মুদ্রা পাওয়া যায়, যার মধ্যে রয়েছে ৯৮ লাখ টাকা, ৪ হাজার ইউরো, ১১ হাজার ইউয়ানসহ কয়েক কোটি টাকা মূল্যের ভারতীয়, নেপালি, সিঙ্গাপুরী ও মালয়েশীয় মুদ্রা।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক বলেন, “আজিজুল ইসলামের ছেলে আশিক সম্প্রতি ১০-১২ বার দুবাই গিয়েছে। আহাদও সম্প্রতি ৪-৫ বার দুবাই গেছে। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, অবৈধ এই মদ দুবাই থেকে এসেছে।“

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আহাদ টিভি ও ইলেকট্রনিক্স আমদানির ব্যবসা করেন। পরে বাবার সঙ্গে অবৈধ ঘোষণায় মদ আমদানিতে জড়িয়ে পড়েন।

এটি তাদের চতুর্থ চালান জানিয়ে র‌্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, এর আগে তারা জানুয়ারি, মার্চ ও মে মাসে তিনটি চালান আনে। আগের চালানগুলোতে তারা গড়ে ১৪ হাজার করে বোতল এনেছিল তারা। এর আগের চালানগুলো তারা শ্রীনগরের ওয়্যারহাউজে রেখেছিল।

“বংশাল ও ওয়ারীতেও তাদের ছোট আকারের ওয়্যারহাউজ আছে। তাদের আগের চালানগুলো একদিনের মধ্যেই হোটেল, বার ও ক্লাবগুলো থেকে লোকেরা এসে নিয়ে গেছে। আর রাতের বেলায় কন্টেইনার ঢাকায় ঢুকলে রাস্তার মাঝ থেকে ক্লাব বা হোটেলের লোকেরা এসে কন্টেইনার খুলে মদ নিয়ে গেছে।”

মদের এই চালান দুবাই থেকে আনা হচ্ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “গ্রেপ্তার হওয়া আহাদ তাদের বলেছেন, দুবাইয়ে একটি হোটেলে অবস্থানরত নাসির উদ্দীন এই চালানগুলো ঢাকায় পাঠাচ্ছেন। ঢাকার ক্রেতাদের সঙ্গে দাম-দরও তিনি সেরে রাখেন।

“তারা ঢাকায় আনার পর নিজস্ব শ্রমিক ও গাড়িচালক দিয়ে সেগুলো ওয়্যারহাউজে নেন। সেখান থেকে ক্রেতারা এসে নিয়ে যান। বন্দরে তাদের সহায়তা করেছে একটি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট।”

র‌্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, “সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট জাফর, শামীম ও রায়হান মালামাল খালাসের কার্যক্রম চালিয়েছে। বিভিন্ন অসৎ উপায়ে এই মদের বোতল বের করে ঢাকায় পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা করছিল তারা।

চালানটি কিভাবে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বের হলো, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, তারা বিভিন্ন উপায়ে স্ক্যানিং এড়িয়ে কন্টেইনার খালাস করতে সক্ষম হয়েছেন। কাস্টমসের যারা তদন্ত করছেন তারা বিষয়টি বলতে পারবেন, কিভাবে স্ক্যানিং ছাড়া এই বিপুল পরিমাণ মালামাল ঢাকায় চলে এলো। তদন্তে নিশ্চই বের হয়ে আসবে। আর যদি স্ক্যানিং হয়, তাহলে এই বিপুল পরিমাণ মদ কী করে গার্মেন্টস পণ্য ঘোষণায় ঢাকার পথে এলো?”

মঈন বলেন, “আমরা যখন প্রথম কন্টেইনারটি সনাক্ত করি। তখন নাজমুল ও সাইফুল বলে, বিদেশি সিগারেট আছে। পরে তারা জানায়, এখানে বিদেশি মদ রয়েছে। বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে, অসৎ উপায়ে এর আগের তিনটি চালান তারা ঢাকায় পৌঁছেছে।”

এ মদ খালাসের সঙ্গে কাস্টমস কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে গ্রেপ্তারের পর কাস্টমস কর্মকর্তাদের যোগসাজশের বিষয়টি পরিষ্কার হবে।

গ্রেপ্তার বক্তিরা কী তাদের সহায়তাকারী হিসেবে কাস্টমসের কোনো কর্মকর্তার নাম বলেছে, এ প্রশ্নের উত্তরে র‌্যাব কর্মকর্তা আল মঈন বলেন, “তারা বলেছে তাদের যে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট রয়েছে, তারা এই মাল বন্দর থেকে বের করতে সহায়তা করেছে। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে গ্রেপ্তার করতে পারলে বিষয়টি জানা যাবে।”