“একই কাজ করছে একজন নারী ও পুরুষ, কিন্তু তাদেরকে সমমজুরি দেওয়া হচ্ছে না। এটাও এক ধরনের নির্যাতন,” বলেন শাশ্বতী বিপ্লব।
Published : 15 Mar 2025, 08:33 AM
দেশে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও বিভিন্নভাবে তারা এখনও হয়রানি বা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলে মনে করেন অধিকার কর্মী শাশ্বতী বিপ্লব ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক শাহনাজ পারভীন।
তারা বলছেন, নারীর কর্মক্ষেত্র বলতে শুধু শিক্ষিত পেশাজীবীদের কাজের জায়গা নয়, শ্রমজীবী নারীরা আরও বেশি ভুগছেন। যৌন হয়রানির বাইরেও বিভিন্ন মানসিক নির্যাতনের শিকার নারীরা। এমনকি মজুরি বৈষম্যও তাদের জন্য এক প্রকারের ‘নির্যাতন’, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে নারীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আইন করার পাশাপাশি বিদ্যমান আইন সম্পর্কে প্রচার বাড়ানো, অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা, সচেতনতা গড়ে তোলা এবং নারীদের নেতৃত্বে আসার সুযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রচারিত প্রথম পর্বে আলোচনায় অংশ নেন শাশ্বতী বিপ্লব ও শাহনাজ পারভীন।
নুভিস্তা ফার্মা নিবেদিত ‘অধিকার সমতা ক্ষমতায়ন’ শীর্ষ এই পডকাস্টে শাশ্বতী বিপ্লব বলেন, “গত ২০ থেকে ৩০ বছরে বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। কিন্তু এ সময়ে হ্যারাসমেন্টও বেড়েছে। বিভিন্ন রকমের নির্যাতন। নট নেসেসারিলি সবসময় সেক্সুয়াল অ্যাবিউসই হয়। পাশাপাশি ভার্বাল অ্যাবিউস, ইন্টিমিডিটেশন, থ্রেট করা, ব্ল্যাকমেইল করা, প্রোপার পলিসি অ্যান্ড প্র্যাকটিসে না থাকার মত বিভিন্ন কারণ।
“আপনারা এটাও জানান ‘ইকুয়্যাল ওয়েজ’ (সমমজুরি) না দেওয়া। একই কাজ করছে একজন নারী ও পুরুষ, কিন্তু তাদেরকে সমমজুরি দেওয়া হচ্ছে না। এটাও এক ধরনের নির্যাতন। বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন কিন্তু নারীদের সঙ্গে চলছে এবং সেটার হার খুবই বেশি বাংলাদেশে।”
শাহনাজ পারভীন বলেন, “আমি সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে আছি, প্যাথলজি বিভাগের প্রধান। অন্যান্য কর্মক্ষেত্রের তুলনায় যেগুলো অনেক উন্নত, এটি তাদের মধ্যে একটি। এখানে আমার যারা সহকর্মী, নারী সহকর্মী বা পুরুষ সহকর্মী, সবাই অনেকটা যোগ্যতা অর্জন করে তারপর এখানে আসতে পেরেছেন।
“আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই, আমার লেভেলের শারীরিক নির্যাতন না থাকলেও মানসিক নির্যাতন ওটাতো থাকে। একই যোগ্যতা সম্পন্ন আমিও আছি, আমার পুরুষ সহকর্মী আছেন। কিন্তু কোনো একটা মিটিং হল বা কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এল, তখন এমন হতে পারে আমার উপস্থিতিটাকে অগ্রাহ্য করা হল বা আমার কোনো মতামত নেওয়া হল না। এটা একটা দিক হতে পারে। তাতে করে আমি অসম্মানিত বোধ করছি বা নিজেকে তুচ্ছ, উপেক্ষিত মনে করছি।”
তিনি বলেন, “আরেকটা হতে পারে যে, হয় কখনও কখনও, আমার পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গে আমরা সবাই গল্প করছি। তখন এমন হতে পারে আমার ওই সহকর্মী ইচ্ছে করেই এমন একটি কথার অবতারণা করল বা একটা জোকস বলল, সেটার ভেতরে হয়ত ঠিক সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট ওইভাবে না, কিন্তু এমনভাবে বলা হল যে তাতে আমি অসম্মানিত বোধ করলাম। এগুলো দুটোই মানসিকভাবে টর্চার।”
‘বেশি ভোগেন’ শ্রমজীবী নারীরা
শিক্ষিত নারীদের বাইরে শ্রমজীবী নারীরাও কর্মক্ষেত্রে বেশি হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন বলে মনে করেন অধিকারকর্মী শাশ্বতী।
“আমরা আসলে নারীর কর্মক্ষেত্র বলতে সহজে ভেবে নেই শিক্ষিত নারী কোথায় কাজ করছে। কিন্তু একদম গৃহকর্মী থেকে শুরু করে, গার্মেন্টস ওয়ার্কার থেকে শুরু করে, করপোরেট মিল-ফ্যাক্টরিজ থেকে শুরু করে, ইভেন কন্সট্রাকশনে যারা কাজ করেন সেখান থেকে শুরু করে ব্যাংক, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা…মানে মানচিত্রটা অনেক বড়। সব জায়গাতেই বিভিন্ন ধরনের ডিসক্রিমেনেশন (বৈষম্য) আছে।”
তিনি বলেন, “একটা আছে, যারা আমরা লেখাপড়া করেছি, খুব ফরমাল সেক্টরে কাজ করি সেটা একরকম। যে নারীরা ইনফরমাল সেক্টরে কাজ করে অন্যরকমভাবে আরও বেশি ভায়োলেটেড হয় তাদের রাইটসগুলো। তাদের সঙ্গে যে ভায়োলেন্সগুলো হয়, সেটার মাত্রাটাও অনেক বিচিত্র ও অনেক বেশি গভীর। আমরা তো তাও বলতে পারছি, উনাদের কিন্তু বলারও জায়গা থাকে না।”
করণীয় কী
কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে আইন করার ওপর জোর দিয়ে শাশ্বতী বিপ্লব বলেন, “ফরমাল সেক্টরের জন্য হাই কোর্টের একটা নির্দেশনা আছে, ২০০৮ এ উনারা সেটা দিয়েছিলেন যে প্রত্যেকটি ওয়ার্ক প্লেসে ও এডুকেশনাল ইনস্টিটিউশনে একটি করে কমিটি করার কথা। যারা কিনা কোনোরকম ভায়োলেন্সের শিকার হবেন বা হ্যারাসমেন্টের শিকার হবেন, তারা সেখানে অভিযোগ করতে পারবেন। সেটা খুব কম জায়গাতে হয়েছে বা হয়নি। এটা অনুযায়ী একটা প্রোপার ডেফিনেশন করার কথা ও একটা অ্যাক্ট করার কথা।
“অ্যাক্ট না থাকলে কিন্তু এনফোর্সমেন্ট পাওয়ার আসে না। কীসের ওপর ভিত্তি করে ইনস্টিটিউশনগুলো এনফোর্স করবে, ওই অ্যাক্টটাও কিন্তু আমাদের হয় নাই। প্রত্যেকটা ইনস্টিটিউশনের যারা কাজ করেন, তাদের কিছু পলিসি করা দরকার যেগুলো এ বিষয়গুলো অ্যাড্রেস করবে।”
সহিংসতার শিকার নারীর পক্ষে সহকর্মীদের কথা বলার সুযোগ দেওয়া সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। নারীর প্রতি সহিংসতাকে সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায় নিয়ে আসারও কথা বলেন তিনি।
নারী নেতৃত্ব
সহিংসতা বন্ধে নারীদের নেতৃত্বের জায়গায় যাওয়ার কথা বলেন শাশ্বতী বিপ্লব। তিনি বলেন, “বাংলাদেশে করপোরেট, ডেভেলপমেন্ট সেক্টর এমনকি রাজনীতিতেও নেতৃত্বের জায়গায় নারীর সংখ্যা খুবই কম। নারীকে নেতৃত্বের জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। যেহেতু লিডারশিপ পজিশনগুলোতে নারীর সংখ্যা কম, তাই নারীর জন্য কথা বলার মানুষ কম।
“একজন ভুক্তভোগী কোনো নিপীড়নের ঘটনা যেভাবে জানেন বা বুঝেন আরেকজন হয়ত অনুমান করে বলেন। তিনি তারা আসল বিষয়টি বুঝতে পারেন না। এটাও একটা চ্যালেঞ্জের জায়গা।”
অনানুষ্ঠানিক সেক্টরে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে নজরদারি বাড়ানোর কথা তুলে ধরে এ নারী অধিকারকর্মী।
“গৃহস্থালি কাজে সহায়তাকারীদের ওপর সহিংসতা বন্ধে আমাদের একটি আইন হয়েছে। কিন্তু এটার প্রয়োগ হচ্ছে কি না তা কেউ জানে না। অনেক সময় আমরা বলি আমাদের কোনো ল নাই পলিসি নাই, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে আছেও। কিন্তু প্রয়োগ নাই।”
আইনের প্রচার ও সচেতনতা জরুরি
নারীর প্রতি সহিংসতা ঠেকাতে বিদ্যমান আইনগুলো সম্পর্কে প্রচার বাড়ানোর কথা বলেন চিকিৎসক শাহনাজ পারভীন।
তিনি বলেন, “নারীর প্রতি সহিংসতা ঠেকাতে আইনের প্রচারণা নেই। সবাই জানে না। আর মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো মনে করে মেয়ে হয়রানির শিকার হয়েছে, এটা যতখানি চেপে রাখা যায় ভালো, কারণ সবাই আমাদের অসম্মানের চোখে দেখবে আইনের রাস্তায় যেতে গেলে কোনো মেয়েকে যদি হাজারো সমস্যায় পড়তে হয়, তাহলে তো তারা সেটা চেপেই রাখবে।”
নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে সংবাদমাধ্যমগুলোর ভূমিকা নিয়ে কথা বলেন এই চিকিৎসক। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও চিকিসকদেরও বিষয়টিতে সংবেদনশীল হওয়ার কথা বলেন তিনি।
“কোনো রেপ সার্ভাইভারের আইনি সহায়তা পেতে কিছু মেডিকেল রিপোর্ট লাগে। তাই চিকিৎসকদেরও সংবেদনশীল হতে হবে। আগে ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ ছিল, ওইটা বাতিল করেছে সরকার। কিন্তু অনেকে বিশ্বাস করেন ওইটা লাগবেই। একদিকে পলিসি বা ‘ল’ হচ্ছে, অন্যদিকে ওইটার প্রয়োগ হচ্ছে না।
“ধর্ষণের খবর প্রচারে সাংবাদিকদেরও সচেতন হতে হবে। অনেক সময় মিডিয়া কর্মীরা ধর্ষণের শিকার হওয়া ছোট্ট মেয়েটির ছবি ছেপে দেন, তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার চেষ্টা করেন। তাই সবাইকে সচেতন করতে হবে, আর তার জন্য দরকার প্রচার ও প্রসার।”
নারীদের প্রতি সহিংসতার ব্যাপারে অভিযোগ দিতে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কমিটি গঠনের ওপর জোর দিয়েছেন শাহনাজ পারভীন। তিনি বলেন, “এ কমিটি থাকলে পুরুষ কর্মীরা একটু হলেও সচেতন হবেন। কারণ এ ধরনের ঘটনার জন্য তাকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে। আর কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ওই কমিটি থাকলে শিক্ষার্থীরাও সচেতন হবেন।”