“শিশুটির বাবা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে প্রথমে যে নারীকে সন্দেহভাজন হিসেবে দেখিয়েছিলেন, তদন্তে নেমে দেখা গেছে, ওই নারী ঘটনার আগে-পরে অনেকক্ষণ হাসপাতালে ঘুরে বেড়িয়েছেন।”
Published : 11 Jun 2024, 12:07 AM
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চুরি যাওয়া নবজাতক শিশুটি ছয় দিনেও উদ্ধার হয়নি।
শাহবাগ থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, শিশুটির বাবা প্রথমে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে যে নারীকে সন্দেহ করেছিলেন, তিনি এই ঘটনায় যুক্ত নন। শিশুটির বাবা নিজেও কিছুটা বিভ্রান্ত। এ কারণে এখনও চোর শনাক্ত করা যাচ্ছে না। নতুন কৌশল নেওয়া হচ্ছে।
তবে শিশুটির মা সুখী বেগমের মন তো আর এসব যুক্তি মানছে না। তিনি শুধু নিজের হারানো সন্তান ফিরে চাইছেন।
এদিকে শিশুটির বাবা ট্রাক শ্রমিক শরিফুল ইসলাম বলছেন, একদিকে সন্তান হারানোর উদ্বেগ, অন্যদিকে অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য তিনি কাজেও যেতে পারছেন না। ফলে ঋণ করে চলতে হচ্ছে তাকে।
ঢাকার ধামরাইয়ের কালামপুর থেকে গত ৩ জুন সন্তানসম্ভবা স্ত্রী সুখী বেগমকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে আসেন শরিফুল। পরদিন ৪ জুন (মঙ্গলবার) অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জমজ দুটি কন্যা সন্তান হয় সুখী বেগমের। জন্মের কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি সন্তান চুরি হয়ে যায়।
হাসপাতালের গাইনি বিভাগ ও নবজাতক ওয়ার্ড থেকে শিশু চুরির ঘটনা এর আগেও বেশ কয়েকবার আলোচনায় এসেছে; যার সবশেষ শিকার মনে করা হচ্ছে ইটবাহী ট্রাকের শ্রমিক শরিফুল ইসলাম ও তার স্ত্রী সুখী বেগমকে।
শিশু চুরি ঠেকাতে হাসপাতালে সিসি ক্যামেরা, ওয়ার্ড থেকে বের হতে রেজিস্ট্রারে সই, সার্বক্ষণিক আনসার সদস্য থাকছে সেখানে।
নিরাপত্তার এত সব চোখ ফাঁকি দিয়ে দরিদ্র মা সুখী বেগমের কোল খালি করে কীভাবে তার সদ্য নাড়িকাটা একটি সন্তান চুরি হয়ে গেল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে, তার জবাব মিলছে না কিছুতেই।
এ ঘটনায় শিশুটির বাবা শরিফুল ইসলাম শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেছেন।
থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, তারা এখনো শিশু চুরি করে নিয়ে যাওয়া নারীকে শনাক্ত করতে পারেননি।
হাসপাতালে সিসি ক্যামেরায় দৃশ্য ধারণ হওয়ার পরও তদন্ত কোথায় আটকাচ্ছে জানতে চাইলে ওসি বলেন, “শিশুটির বাবা সিসি ক্যামেরার ফুজে দেখে প্রথমে যে নারীকে সন্দেহভাজন হিসেবে দেখিয়েছিলেন, তদন্তে নেমে দেখা গেছে, ওই নারী ঘটনার আগে-পরে অনেকক্ষণ হাসপাতালে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
“আর তার কোলে যে শিশুটি তা কোনোভাবেই কয়েক ঘণ্টা বা একদিন বয়সী নয়, সেই শিশুটি আকারে কিছুটা বড়। শিশুটির বাবা ওই নারীকে নিয়ে নিজেও বিভ্রান্ত। পুলিশ প্রথম থেকে শিশুটির বাবার দেখিয়ে দেওয়া সেই নারীকে শনাক্ত করার চেষ্টায় ছিল। এখন নতুন পন্থা অবলম্বন করতে হচ্ছে, যার জন্য সময় লাগছে।”
চোর শনাক্তে বিভ্রান্ত হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন শিশুটির বাবা শরিফুল ইসলামও।
সোমবার তিনি বলেন, বিপদের সময় ওই নারীর চেহারা ভালো করে খেয়াল করেননি তিনি। যার কারণে ঠিকমত মনে করতে পারছেন না। সন্দেহবশত তিনি এক নারীকে দেখিয়েছিলেন।
এদিকে যতদিন যাচ্ছে, উতলা হয়ে উঠছেন শিশুটির মা সুখী বেগম।
তিনি বলেন, “জমজ আরেকটি মেয়ে এখন বুকের দুধ খাচ্ছে। চিন্তা, মা ছাড়া এইটুকু শিশুর কী করে দিন কাটছে। সে কী খাচ্ছে, কার কাছে আছে।”
বাড়ছে ঋণের বোঝা
শিশুটির বাবা শরিফুল ইসলাম বলেন, দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে ট্রাকে ইট তোলার কাজ করেন তিনি। কাজে না গেলে মজুরি বন্ধ। স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হওয়ার পর তিনি স্থানীয় একটি এনজিও থেকে ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন।
প্রতি মাসে সাড়ে আট হাজার টাকা করে ঋণের কিস্তি দিতে হয়। স্ত্রীকে ঢাকায় আনার পর পরিচিত কয়েকজনের কাছ থেকে সাড়ে ২২ হাজার টাকা ধার করেছেন। সেগুলো দিয়েই চলছেন।
স্ত্রীর সঙ্গে তাকে থাকতে হচ্ছে। মা ও আট বছরের ছেলেটিকেও হাসপাতালে রাখতে হচ্ছে। স্ত্রীর ওষুধ ও খাবার হাসপাতাল থেকেই দেয়। অন্যদের বাইরে থেকে কিনে খেতে হয়। উপর্জনহীন মানুষের জন্য খাবার কিনে খাওয়া বিপুল খরচের হতাশ কণ্ঠে বলেন শরিফুল।
চুরি যাওয়া সন্তানকে ফিরে পেতে কিছু করতে না পারায় অসহায়ত্ব প্রকাশ করে তিনি বলেন, “না জানি আমার মাইয়াটা কেমন আছে, কই আছে। বাচ্চা পাইলেই আমরা বাড়ি যামু গা। টাকা-পয়সার চিন্তা করি না। সব শোধ করতে পারুম, কিন্তু বাচ্চা আমার চাই। আপনারা দোয়া কইরেন।”
শরিফুল বলেন, তার বড় ছেলে জমজ দুই কন্যার একটিকে জান্নাত বলে ডাকে। তার জন্য আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তা কিছু টাকা দিয়েছেন। সেটা দিয়ে জান্নাতের কাপড়-চোপড় কেনা হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল থেকে যেভাবে চুরি হল সুখী বেগমের নাড়িকাটা সন্তান