জাতীয় সঙ্গীতকে ‘স্বাধীনতার অস্তিত্বের পরিপন্থি’ আখ্যা দিয়ে তা পরিবর্তনের দাবি তোলেন জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী।
Published : 07 Sep 2024, 11:19 PM
মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধানের মূলনীতি ও জাতীয় সঙ্গীতকে কটাক্ষ করার নিন্দা ও প্রতিবাদ করেছেন দেশের বিশিষ্ট ৪৮ নাগরিক।
শনিবার এক বিবৃতিতে তারা বলেছেন, এই অপতৎপরতা বন্ধ না হলে জনপ্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য আরও বৃহৎ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
শত শত শিক্ষার্থী, শিশু, কিশোরী-কিশোর ও জনতার প্রাণ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও গণতন্ত্রের যে বিজয় অর্জিত হল, তাকে সংকীর্ণ দলীয় ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিলের জন্য কোনো সাম্প্রদায়িক অথবা অন্য গোষ্ঠী যাতে ব্যবহার করতে না পারে, সে জন্য সবাইকে সতর্ক, সজাগ ও ঐকবদ্ধ থাকারও আহ্বান রেখেছেন এই ৪৮ নাগরিক।
গত ৩ সেপ্টেম্বর একটি ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে দেশের জাতীয় সঙ্গীতকে ‘স্বাধীনতার অস্তিত্বের পরিপন্থি’ আখ্যা দিয়ে তা পরিবর্তনের দাবি তুলেছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী।
তার বক্তব্যের পর দেশে-বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেকেই প্রতিক্রিয়া দেখান। উদীচীসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন রাস্তায় দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত ও দেশাত্মবোধক গান গেয়েও আজমীর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছে।
এরই ধারাবাহিকতায় শনিবার বিবৃতি দিলেন ৪৮ নাগরিক।
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে কয়েকজন হলেন- ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল, খুশি কবীর, অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ, রাশেদা কে. চৌধুরী, সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আমরা গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ করছি যে, অসৎ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত জনরায়ে প্রতিষ্ঠিত বিষয়সমূহ, এমনকি জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে প্রশ্ন তোলার ধৃষ্টতা দেখাতে পরিকল্পিত প্রচার শুরু করেছে।
"মাত্র কয়েক দিন আগে জামায়াতে ইসলামীর আমির জাতিকে অতীতের সব কিছু ভুলে যাবার পরামর্শ দিয়েছেন। অনুমান করা যায়, অতীত বলতে তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, সেই সময়ে তার দলের ভূমিকা ইত্যাদির কথাই বুঝিয়েছেন। তিনি যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেই বোঝাতে চেয়েছেন, তা আরও পরিস্কার হল গত ৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে সাবেক ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী সংবিধান ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা থেকে। আমরা তার এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সাম্প্রদায়িক ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের নিন্দা ও তীব্র প্রতিবাদ জানাই।"
"একইসাথে তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অর্থ এই নয়, যেখানে সেখানে যা খুশি তাই বলা যায়। যে উদ্দ্যেশ্যে তিনি ৩ সেপ্টেম্বরের সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন, তার বাইরে গিয়ে সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জাতীয় সঙ্গীত ও সংবিধানের মূলনীতির প্রতি কটাক্ষ করে তিনি বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের আবেগের জায়গায় আঘাত করেছেন।"
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, "১৯৭১ সালে তরুণ, ছাত্র, কৃষক-শ্রমিক-সেনা-পুলিশ সদস্যসহ সর্বস্তরের বিভিন্ন ধর্ম-জাতি-বর্ণ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবনপণ লড়াইয়ে নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে চরম আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামের আমাদের এই প্রিয় দেশটিকে স্বাধীন করেছিলেন।
“এর জন্য বর্বর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর জামায়াতসহ বিভিন্ন দলীয় ঘাতক বাহিনীর অবর্ণনীয় বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হয়েছে সাধারণ মানুষ নারী-পুরুষ, ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী-লেখক, শিল্পী, সাংবাদিকসহ সর্বস্তরের অগণিত ব্যক্তি ও পরিবারকে।”
সেই ইতিহাস এই দেশের প্রজন্মের পর প্রজন্মের মানুষ মনে রেখেছে এবং ভবিষ্যতেও মনে রাখবে বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করে বিবৃতিতে বলা হয়, “এই ইতিহাস ভুলে যাবার কথা বলার অধিকার কিংবা দুঃসাহস কারোরই থাকার কথা নয়।"
তাতে বলা হয়েছে, "আর জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়েই মুক্তিযোদ্ধারা জীবনপণ লড়াইয়ের শপথ নিয়েছেন, যুদ্ধ করেছেন। তাদের অনেকে শহীদ হয়েছেন, অনেকে শারীরিক পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছেন। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা যে যুদ্ধ করেছেন, জাতীয় সঙ্গীত ছিল তাদের প্রেরণার সার্বক্ষণিক উৎস। তাই জাতীয় সঙ্গীতটি কার্যত যুদ্ধের মধ্য দিয়েই লক্ষ শহীদের রক্তে নতুনভাবে আমাদের প্রাণের সঙ্গীত হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একে নিয়ে প্রশ্ন তোলা মানে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা। একে কোনোভাবেই এই দেশের মানুষ দলমত নির্বিশেষে ছাত্র-জনতা মেনে নেবে না।"
আমান আযমীর গুমের ঘটনারও বিচার দাবি করে বিবৃতিতে বলা হয়, "সাবেক ওই সেনা কর্মকর্তা গুমের শিকার হয়ে রাষ্ট্রীয় সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত গোপন আটককেন্দ্র ‘আয়নাঘর’-এ দীর্ঘ ৮ বছরে বন্দি ছিলেন। গুমের শিকার ব্যক্তিদের মুক্তিসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন এজেন্সির দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারের দাবিতে আমরা বরাবরই সোচ্চার ছিলাম, এখনও আছি। আমরা চাই সাবেক ওই সেনা কর্মকর্তাসহ যারা ‘আয়নাঘর’-এ আটক ছিলেন, নিপীড়ন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারা সবাই ন্যায়বিচার যেন পান।
“আমরা আশা করবো অন্তর্বতীকালীন সরকার তাদের ন্যায়বিচারের বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিশ্চিত করবেন।"
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, "স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে যে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থান বা বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল জুলাই মাসে, ৫ অগাস্ট তার বিজয়কে আমরা দ্বিতীয় বিজয় বলে অভিহিত করেছি। কিন্তু কোনো মহল যদি এই বিজয়কে ৭১-এর বিজয় দিবস কিংবা মহান মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে দাঁড় করানোর কোনো অপচেষ্টা চালায় তাকে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও তার গৌরবময় বিজয়ের দুশমন বলেই চিহ্নিত করতে হবে।"
বিবৃতিদাতাদের মধ্যে আরও রয়েছেন টিআইবির'র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভীন হাসান, সিনিয়র আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী, ড. মো: হারন-অর-রশিদ, সিনিয়র আইনজীবী তবারক হোসেন, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, শামসুল হুদা, রেহনুমা আহমেদ, ড. শাহনাজ হুদা, অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, ড. খাইরুল ইসলাম চৌধুরী, ঈশানী চক্রবর্তী, অধ্যাপক জোবায়দা নাসরিন, অধ্যাপক মাহা মির্জা, সামিনা লুৎফা, ড. সাদাফ নূর, ড. নূর মোহম্মদ তালুকদার, মাযহারুল ইসলাম বাবলা, এ এস এম কামালউদ্দিন, মফিদুর রহমান লাল্টু, মিনহাজুল হক চৌধুরী, সালেহ আহমেদ, মনিন্দ্র কুমার নাথ, রেজাউল করিম চৌধুরী, ফারহা তানজীম তিতিল, তাসনীম সিরাজ মাহবুব, জাকির হোসেন, সাইদুর রহমান, ব্যারিস্টার আশরাফ আলী, ব্যারিস্টার শাহদাত আলম, আইনজীবী নাজমুল হুদা, এম এম খালেকুজ্জামান, আইনজীবী মো: আজিজুল্লাহ ইমন, প্রিন্স আল মাসুদ, উম্মে কুলসুম, শায়লা শারমীন, তাপসী রাবেয়া, আজমীর হোসেন, দীপায়ন খীসা, বাপ্পী মাশেকুর রহমান, হানা শামস আহমেদ, মুক্তাশ্রী চাকমা।