পড়ায় গতি বাড়াতে প্রতিযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে; তবে এতে যে শিক্ষার্থীদের চাপে পড়তে হয়, তাও বললেন কেউ কেউ।
Published : 30 Dec 2022, 06:02 PM
শিক্ষার্থীদের সরকারি মেধা বৃত্তি দিতে এ বছর আবার আলাদা করে পরীক্ষা নিয়েছে সরকার; ১৩ বছর পর এই পরীক্ষার ‘ফিরে আসা’ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মধ্যে।
পরীক্ষা শেষে অধিকাংশ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকই বলছেন, পড়ায় গতি বাড়াতে প্রতিযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। তবে এতে যে শিক্ষার্থীদের চাপে পড়তে হয়, তাও বলেছেন কেউ কেউ।
মিরপুর ১০ নম্বরের গ্রিনফিল্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ৯১টি স্কুলের ১৭৪৬ জন শিক্ষার্থী এবার পরীক্ষায় বসেছিল।
এই কেন্দ্রে পরীক্ষা দেওয়া মিরপুর ১২ নম্বরের হলি ক্রিসেন্ট আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষার্থী আমেনা খাতুন সীমা প্রথমে ভয় পেলেও পরীক্ষার পর তার ভীতি কেটে গেছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সীমা বলছিল, “এভাবে তো পরীক্ষা দিইনি। কিন্তু পরীক্ষা শুরুর পরে আর ভয় লাগেনি। অনেক স্কুলের ছেলেমেয়েরা পরীক্ষা দিয়েছে। অনেকের সাথে কথা হয়েছে, ভালো লেগেছে।”
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনেকে এই পরীক্ষাকে ইতিবাচক হিসেবেও দেখছেন। পল্লবীর লিটল ফ্লাওয়ারস প্রিপারেটরি স্কুলের ছাত্রী জান্নাতুল আরা মিমের বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন তেমনই একজন। তিনি মনে করেন, শিক্ষার্থীদের নিজেদের প্রমাণ করার জন্য প্রতিযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে।
সেজন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, “করোনাভাইরাসের মধ্যে বাচ্চাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। তারা স্কুলে যেতে পারেনি, পড়াশুনা করতে পারেনি ঠিকমত। এখন এই ধরনের একটা পরীক্ষা হওয়ার কথা শুনে তারা অনেক আগ্রহ দেখিয়েছে। বার্ষিক পরীক্ষার পরও নিয়মিত পড়াশুনা করেছে।”
এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নতুন পরিবেশে পরীক্ষা দেওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে জানিয়ে জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, “স্কুলে খাতা একভাবে মূল্যায়ন হয়, এখানে আরও ভালো হবে আশা করি। আর ফরমালি একটা ভিন্ন পরিবেশে পরীক্ষা দেওয়া তাদের সাহস বাড়াবে।”
তবে হঠাৎ করেই আসা পরীক্ষার সিদ্ধান্ত শিশুদের চাপে ফেলেছে বলে মনে করেন অনেকে। শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক জীবনেও পরীক্ষার প্রভাব পড়ার কথা এল অনেকের বক্তব্যে।
মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের রুপনগর শাখার শিক্ষার্থী জাহিন ইসলামের বাবা আতিকুল ইসলাম মনে করেন, এ পরীক্ষার মাধ্যমে সরকার ছোট শিশুদের ‘অহেতুক চাপে ফেলেছে’।
প্রাথমিকে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা
এক যুগ পর প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষায় বসল শিক্ষার্থীরা
“উনারাই বলেন, পরীক্ষা কমাবেন। আমরা তো ভাবছিলাম পিইসি বন্ধ করেছে, ভালো হয়েছে। এখন আবার আরেকটা পরীক্ষা বাড়ানো হল। বৃত্তি দিতে চাইলে তো বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমেই দিতে পারে।”
এর মাধ্যমে সরকার গতানুগতিক পথেই হেঁটেছে বলে মনে করেন এই অভিভাবক।
তিনি বলেন, “অনেক অভিভাবকই বলছেন, পরীক্ষা নেওয়ায় নাকি পড়াশোনা ভালো হয়েছে। সরকারও হয়ত এভাবে ভাবছে। কিন্তু এতে বাচ্চাদের ওপর যে চাপ যাচ্ছে সেটা কি তারা বোঝেন? এই মুখস্ত পড়া যে জীবনের জন্য খুব জরুরি না, সেটা আমাদের বুঝতে হবে।”
সবশেষ ২০০৮ সালে প্রাথমিকে বৃত্তি পরীক্ষা নিয়েছিল সরকার; ২০০৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা (পিইসি) শুরু হয়। তখন বৃত্তি পরীক্ষা বন্ধ করে সমাপনী পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতেই শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়া হত।
পঞ্চম শ্রেণীতেই শিক্ষার্থীদের ‘পাবলিক পরীক্ষায়’ বসিয়ে দেওয়া নিয়ে বিতর্কও ছিল অনেক। পিইসি বন্ধ করতে রাস্তায় মানববন্ধনও করেছিলেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। বিতর্কিত ওই পরীক্ষা সরকারের ওপর চাপ তৈরি করলেও তা চলে টানা ১১ বছর।
মহামারীর কারণে গত দুই বছর সমাপনী পরীক্ষা নিতে পারেনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়; এর মধ্যেই শিক্ষাক্রমের নতুন রূপরেখায় পিইসি পরীক্ষা বাদ দেওয়া হয়।
এ পরিস্থিতিতে মেধা যাচাইয়ের বিকল্প হিসেবে এবার বৃত্তি পরীক্ষার সেই পুরনো পদ্ধতিই বেছে নেয় গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২৮ নভেম্বর তা গণবিজ্ঞপ্তিতে জানিয়ে দেওয়া হয়।
নতুন শিক্ষাক্রমে যখন পরীক্ষা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বারবার বলা হচ্ছে, সেখানে বৃত্তি পরীক্ষা ফিরিয়ে আনা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে শিক্ষাবিদদের মধ্যেও। সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারে গণমাধ্যমে বিশিষ্ট নাগরিকদের থেকে বিবৃতিও এসেছে।
এর মধ্যেই শুক্রবার দেশজুড়ে বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে ১০০ নম্বরের পরীক্ষা দিয়েছে পঞ্চম শ্রেণির ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী, যারা নিজেদের স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলে মেধা তালিকার উপরের দিকে ছিল।
পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ট্যালেন্টপুলে ৩৩ হাজার এবং সাধারণে ৪৯ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থী বৃত্তি পাবে এবার। ট্যালেন্টপুলে ৩০০ টাকা ও সাধারণে ২২৫ টাকা করে প্রতি মাসে তারা পাবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত।
মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী জোবায়ের আহমেদের মা তানিয়া আহমেদ বলেন, এ পরীক্ষা বাচ্চাদের পড়ালেখায় উৎসাহ বাড়াবে।
“এই পরীক্ষায় ভালো করলে ওরা বৃত্তি পাবে, এটা জানার পর থেকে আমার ছেলে খুবই আগ্রহী। পড়ালেখায় মনোযোগও বেড়েছে। আমরা অভিভাবকরা তো এটাই চাই, যেন বাচ্চারা আগ্রহী হয়।”
মনিপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাফিসা ইসলাম আফরার মা বর্ষিতা জামান বলেন, “বৃত্তি পরীক্ষাটা বাচ্চাদের জন্য খারাপ হবে না। তবে এবার হঠাৎ করে পরীক্ষা হওয়ায় বাচ্চারা কিছুটা চাপে পড়েছে।”
প্রগতি সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থী আফরিন জাহান জুই জানালো, ৭ ডিসেম্বর তার বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে, ফলাফল দিয়েছে ১৮ ডিসেম্বর। বার্ষিক পরীক্ষার শেষ দিকে বৃত্তির কথা জানতে পেরেছে সে।
“আরও আগে থেকে জানলে ভালো প্রস্তুতি নেওয়া যেত। তারপরও পরীক্ষা দিতে পেরেছি এতেই আমি অনেক খুশি। প্রশ্নও অনেক সহজ হয়েছে।”
এই শিক্ষার্থীর মা মাহফুজা বেগম বলেন, বার্ষিক পরীক্ষার পর গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও বৃত্তি পরীক্ষার কারণে যেতে পারেনি তার মেয়ে।
“বৃত্তি পাক কিংবা না পাক, এই পরীক্ষায় অংশ নিতে পেরেই ও খুব খুশি। ওর দাদার বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু পরীক্ষার কারণে গেল না। ও অনেক আগ্রহ দেখাচ্ছে, তাই আমিও ওকে উৎসাহ দিয়েছি।”
কেন্দ্র থেকে বের হয়েই পরীক্ষা ভালো হয়েছে জানিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা গেল মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের বালিকা শাখার আফশিন মামুনকে।
তার মা নাসরিন মামুন মনে করেন, বৃত্তি পরীক্ষার কারণে বাচ্চারা পড়ালেখায় আরও মনোযোগী হবে, তবে তাড়াহুড়া করে এ পরীক্ষার সিদ্ধান্ত না নিয়ে আগে জানালে শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো হত।
তিনি বলেন, “এটা আরও আগে হলে বাচ্চারা আরও ভালোভাবে পড়াশোনা করত। বার্ষিক পরীক্ষাটাও আরও ভালো হত। আমরা পরীক্ষার ১৫ দিন আগে জানতে পারি বৃত্তি পরীক্ষা হবে। ওদের বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্টের দুদিন আগে আমাদের জানানো হয়েছে।”
মিরপুর ১১ নম্বরের আব্দুল মান্নান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাইসা ইসলামের মা ফাহিমা ইসলাম জানান, বৃত্তি পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ততার কারণে তার মেয়ে কয়েকটি সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে পারেনি।
“বৃত্তি পরীক্ষার কথা শোনার পর থেকেই ও পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে। আমিও ওকে না করিনি। পরীক্ষা দিতে চাচ্ছে দিক। আর আমরাও তো বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েছি। এই পরীক্ষা ফিরে আসায় আরও ভালো হয়েছে। বাচ্চাদের মেধার মূল্যায়ন হবে।”