আমাদের কবিতা উৎসব

আনিসুর রহমান
Published : 2 Feb 2018, 03:59 AM
Updated : 2 Feb 2018, 03:59 AM

আমাদের এক শিক্ষক ছিলেন বিধুভূষণ মজুমদার। তিনি অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি বাংলঅ ব্যাকরন পড়াতেন খুব চমৎকারভাবে। তিনি একদিন কথা প্রসঙ্গে শ্রেণীকক্ষে জানালেন দেশের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পটুয়া কামরুল হাসান জাতীয় কবিতা উৎসব মঞ্চে 'দেশ এখন বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে আছে' এই লেখা সম্বলিত স্কেচ এঁকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি তখন অনুষ্ঠানের একটা পর্বের সভাপতিত্ব করছিলেন। তিনি আরও বিশদ করে জানালেন, এই বিশ্ববেহায়া শব্দটি দিয়ে তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদকে নির্দেশ করেছেন। তখন কল্পনার স্বাধীনতা নিয়ে ভাবতে থাকলাম একজন চিত্রশিল্পী কতটা সাহসী আর বিদ্রোহী হলে দেশের স্বৈরাচার রাষ্ট্রপতিকে বিশ্ববেহায়া বলতে পারেন। ইনি দেখছি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো দুর্দান্ত সাহসী। সেই সাহসী মানুষটি হাসপাতালে নেবার পথে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার গাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
জাতীয় কবিতা উৎস কবি শামসুর রাহমানের নেতৃত্বে ১৯৮৭ সালে শুরু হয়েছিল। স্বৈরতন্ত্রের জাঁতাকলে রাজনীতির সকল মঞ্চ, বত্তৃতা আর বিবিৃতি যখন নিষিদ্ধ, তখন কবিতা পড়তে তো আর বাঁধা নেই। কবিতার মঞ্চেও বাঁধা দেবে, সে হিম্মত কি বিশ্ববেহায়াদের থাকে?
১৯৮৭ সালে শুরু হওয়া সেই জাতীয় কবিতা উৎসবে সারাদেশ থেকে কবিরা আসবেন, নাম নিবন্ধন করবেন, মঞ্চে উঠবেন, কবিতা পড়বেন। সেই একই পুরনো কাঠামো ধরে আমাদের জাতীয় কবিতা উৎসবে চলছে, তিন দশক ধরে। যদিও উৎসবে নানা দেশের কবিরা অংশগ্রহণ করায় উৎসবটি হাল আমলে আন্তর্জাতিক মাত্রা লাভ করেছে।

কবিতা উৎসবের চেতনা বলয়ে থেকে শেখ হাসিনার সরকার যতটা লাভবান হয়েছে – তার তিল পরিমাণ পৃষ্ঠপোষকতা জাতীয় কবিতা উৎসব পায়নি। তার বিপরীতে ঔপনিবেশিক চেতনা-নির্ভর বেনিয়াপোষ্য হে উৎসব আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে কোটি কোটি টাকা প্রণোদনা পেতে পারে। অন্যদিকে কবিতা উৎসবের মতো উদ্যোগ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পায় না।
কবিতা উৎসব প্রসঙ্গে এক লেখায় কবি শঙ্খ ঘোষকে উদ্বৃত করে আমাদের কবি রফিক আজাদ লিখেছিলেন – শঙ্খ ঘোষের কথা ভুল প্রমাণিত করেছে বাংলাদেশের কবিরা। যিনি বলেছিলেন এক দশকে সংঘ ভেঙে যায়। কবিতা উৎসব আজ তিন দশকে।
এখানে আরো একটু বিশদ করে বলি, শঙ্খ ঘোষ কথাটা এমনি এমনি বলেননি। কবিরা হচ্ছেন লম্ফমান ব্যাঙের মতো। তাদের এক সাথে ধরে রাখা কঠিন। তাই কবিতা উৎসবের তিন দশক উদযাপন সহজ কথা নয়। কবিদের কেউ কেউ রাগ অভিমান করে বের হয়ে যান। আবার তাদের মান ভাঙিয়ে ফিরিয়ে আনা হয়। এমন কি এমনটি ঘটেছিল খোদ শামসুর রাহমানের ক্ষেত্রে। পরে রফিক আজাদ যখন সভাপতি এবং মুহাম্মদ সামাদ সম্পাদক – তখন তাঁরা শামসুর রাহমানের বাসায় গিয়ে তাঁর মান ভাঙাতে সক্ষম হন। পরবর্তীকালে যতদিন বেঁচেছিলেন তিনি জাতীয় কবিতা উৎসবে নিয়মিত ছিলেন। এরকমই তো কবিদের মান অভিমান আর আবেগ। যা চলছে, এবং চলবে। কে কবি আর কে অকবি, সে প্রসঙ্গটা বাদ দেয়াই ভালো, প্রশ্নটি যখন জাতীয় কবিতা উৎসবের। উৎসব মানে আনন্দ। অকবির কবিতা বিচারের দায়ভার পাঠক – শ্রোতাদের হাতে ছেড়ে দেয়াই ভালো।
জাতীয় কবিতা উৎসব এর আয়োজক সংগঠন জাতীয় কবিতা পরিষদের সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে দুই একটি কথা আমি বলতে চাই। এর শুরু থেকে বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামো অনেকটাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগঠনের আদলের। এই আদল থেকে বের করে সংগঠনটিকে পরিবর্তিত সময় ও প্রয়োজনের দিক বিবেচনা করে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া জরুরি। একটি ক্রিয়াশীল সংগঠন তিন দশকেও যদি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি না পায় তাহলে তা ভবিষ্যতে কোথাও গিয়ে আটকে গেলে বা শেষ হয়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
আমি একটি বিষয় ভেবে অবাক হই জাতীয কবিতা উৎসবের তিন দশকে কেনো আমাদের দেশে কথা সাহিত্য উৎসব নামে জাতীয় কোনো অনুষ্ঠানের শুরুই হলো না? আমাদের কথাশিল্পীরা কি শুধু জনপ্রিয়তার দৌড়ে নিজেদের পকেট ভারী করাতেই ব্যস্ত থাকবেন? কবিতা উৎসবের তিন দশক উদযাপনে কবিতা পরিষদের সামনে নতুন কিছু প্রশ্ন এসে যায়। এখন সংগঠনটি দেশের কবিদের গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রধান প্লাটফরম হিসেবে লেখকদের দাবি দাওয়া নিয়ে অধিকতর সোচ্চার হতে পারে। এ বিষয়টি নিয়ে সরকারের সাথে এবং সংসদের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সাথে সংলাপ করতে পারে।
এখানে উল্লেখ করতে চাই যে, সহসাই আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হবো। ১৮৫০ এর দশকে আজ থেকে দেড় শতাধিক বছর আগে নরওয়ের অর্থনীতি আজকের মত তেল বিক্রির টাকায় এতোটা রমরমা ছিল না। বরং বাংলাদেশের চেয়ে অনেকগুণে নাজুক ছিল। সেই নাজুক অর্থনীতির উপর দাঁড়িয়ে লেখকদের দাবির মুখে নরওয়ের কর্তৃপক্ষ দুনিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে লেখকদের জন্য স্বতন্ত্র এবং স্বায়ত্ত্ব শাসিত তহবিল প্রতিষ্ঠা করেন। এই তহবিলের অর্থের জোগান আসে সরকারের রাজস্ব খাত থেকে। রাজস্ব খাতের এই বরাদ্দ নির্ধারিত হয় প্রতি বছর দেশের গ্রন্থাগারগুলোতে কি পরিমাণ বই পাঠ করা ধার নিল তার উপর ভিত্তি করে, উদাহরণ স্বরূপ প্রতি ধারের বিপরীতে লেখক তহবিলে সরকার দুই টাকা বরাদ্দ দিবেন লেখক তহবিলে।
এই তহবিল থেকে একজন লেখক এক বছর দুই বছর, পাঁচ বছর দশ বছর এবং জীবনব্যাপী কর্মবৃত্তি পেয়ে থাকেন। এই বৃত্তির টাকার পরিমাণ শতকরা পঞ্চাশভাগ চাকরির মজুরি হিসেবে নির্ধারিত হয়। এই বৃত্তির বিপরীতে যথাযথ কর প্রদান করা হয়। এই বৃত্তির শর্ত একজন লেখক বৃত্তিকালীন সময় শতকরা পঞ্চাশ ভাগের বেশি কাজ করতে পারবেন না। কারণ এই বৃত্তি দেওয়ার শর্তই হচ্ছে লেখক তার লেখালেখির কাজে সময়টা ব্যয় করবেন।
হেনরিক ইবসেন এই বৃত্তি পেয়েছিলেন প্রথম দিকেই। নরওয়ের পরে গত শতাব্দীতে সুইডেন, ডেনমার্ক এবং ফিনল্যান্ড এরকম তহবিল চালু করে। সুইডিশ কবি টমাস ট্রান্সট্রয়মার এই বৃত্তির কল্যাণে সারাজীবন শতকরা পঞ্চাশ ভাগ চাকরি করে বাকি সময় কবিতার পেছনে দিতে পেরেছিলেন।
আমাদের কবিতা উৎসব প্রতিবাদের চেতনা দিয়ে শুরু হয়েছিল, সেখানে থেমে থাকলে তো চলে না। লেখালেখি, সম্পাদনা, প্রকাশনা, গুণগত মান ও উৎকর্য সাধনের মত বিষয়গুলো নিয়ে সংলাপ বিতর্ক ও কর্মশালা আয়োজন করতে পারে।
আমাদের দেশে আরেক দল কবি আছেন যারা কবিতা উৎসবের প্রতি বিরাগভাজন, কবিতা উৎসবে তারা হেনতেন কবিদের সঙ্গে কবিতা পড়তে চান না। তারা শামসুর রাহমান, রবীন্দ্রনাথকেও স্বীকার করতে চান না। তারা হুমায়ুন আজাদকেও পড়েন না, আহমদ ছফাকেও জানেন না। তারা নিজ নিজ কর্পোরেট সিন্ডিকেটে আবদ্ধ। কর্পোরেট তরিকা নিয়ে তারা সাহিত্যের কোন স্বর্গে যাবেন আমার জানা নাই।
কবিতা উৎসব নিয়ে হাজারটি প্রশ্ন্ তোলা যেতে পারে, যদি কেউ প্রশ্ন তুলতেই চায়। তাই বলে এটাকে উপেক্ষা করা, অবজ্ঞা করা, এর গুরুত্বকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নাই। কবিতা উৎসবকে ঘিরে কতকগুলো প্রশ্ন আমার মনের মধ্যে খেলে যায়:
১। কবিতা পরিষদ শেষে উৎসব নামে একটা কবিতা পত্রিকা বের হয়েছিল। পত্রিকাটি নিয়মিত করা যায় কি না?
২। যে কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আবাসিক লেখক বৃত্তি চালু করা যায় কি না?
৩। ঢাকায় একটি লেখক যাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা যায় কি না?
৪। জাতীয় কবিতা উৎসবে পঠিত প্রবন্ধগুলো নিয়ে একটা সঙ্কলন কবে প্রকাশ পাবে?
৫। কবিতা পরিষদকে একটা পরিচালনা পরিষদ ও একটা কর্মী পরিষদ এই দুই স্তরে ভাগ করে একই সাথে সারাদেশব্যাপী কবিদের সাধারণ সদস্যদের মর্যাদা ও সদস্য হবার কাঠামো চালু কবে হবে? কর্মীদল বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্রের আদলে কর্মসূচি পরিচালনা করবে।