শ্যামাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়: শাশ্বত মৌচাকের নিমগ্ন মৌমাছি

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 13 August 2021, 04:28 PM
Updated : 13 August 2021, 04:28 PM


সংক্ষেপে শামুদা, কেতাবি নাম শ্যামাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়। এই নামের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে শাশ্বত মৌচাক: রবীন্দ্রনাথ ও স্পেন নামক বইটির সূত্রে। তিনি ছিলেন এ বইয়ের সহলেখক, অন্যজন শিশিরকুমার দাশ। শিশিরকুমার দাশ তখনই তার নানান রকম কাজের সূত্রে–ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় লিখিত তার অসামান্য কাজগুলোর জন্য আমাদের কাছে নব্বই দশকে বেশ পরিচিত। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ-এর নাম আমরা আগে কেউ শুনিনি। আমি যদিও তাদের দুজনের রচিত শাশ্বত মৌচাক বইটির কথা আগে শুনেছিলাম, কিন্তু কী কারণে যেন পড়ার আগ্রহ তৈরি হয়নি। পরে ৯৩ কি ৯৪ সালে বইটি কিনে পড়তে শুরু করলাম। বইটি পড়ে আমি এতটাই মোহিত হয়েছিলাম যে সঙ্গে সঙ্গে এর একটি দীর্ঘ আলোচনা লিখেছিলাম আর সেটি প্রকাশিত হয়েছিল ইত্তেফাক পত্রিকায়। কিভাবে যেন সেই লেখাটি পরে বইটির লেখকদের কাছে পৌঁছে যায়। আমি লেখকদের দুজনকে চিনলেও তারা আমাকে চেনেন না, চেনার কথাও নয়। আমি তো তখন বয়সে তরুণ, লেখার মকশো করছি। কেইবা আমাকে চিনবে, দূর দেশে তো চেনার প্রশ্নই আসে না।
ওই সময় আমাদের শীর্ষস্থানীয় নাট্যকার সাঈদ আহমদের বেশ যাতাযাত ছিল ভারতের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। তিনি একদিন আমাকে তার বাসায় ডাকলেন। সম্ভবত রাইসুসহ তার লালমাটিয়ার বাসায় গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে একটি চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, "তোমারে দিল্লী থেইকা এক লেখক চিঠি পাঠাইছে।" সাঈদ ভাই তার স্বভাবসুলভ চিরাচরিত ঢাকাইয়া ভাষায় বলতে শুরু করলেন। আমি তো অবাক দিল্লীতে আমার কেউ নেই, তাও আবার লেখক ? কে আমাকে চিঠি পাঠাবেন? "তুমি নাকি মিয়া একটা রিভিউ লিখচ শামু গাঙ্গুলীর বইয়ের উপর? তোমার রিভিউ পইরা তো উনি ইমপ্রেসড। কী লিখছ?" আমি খানিকটা লজ্জা ও আনন্দে রাঙা হয়ে বললাম, "না, তেমন কিছু না। বইটা আমার খুব ভালো লেগেছিল। সেই ভালো লাগাটাই গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করেছি।" "উনি কইলেন, বুঝলেন সাঈদ সাব, আমাগো কলকাতাই বি এমন ভালো লিখবার পারে নাই। আমি কী কইলাম জান?" আমি সাঈদ ভাইয়ের দিকে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,কী বললেন। "আপনারা তো বাঙালদের বুঝলেন না, বাংলাদেশের একটা আলাদা দিল আছে, তাগো দরদ আর মহব্বত আপনারা বুঝবার চান নাই। এখন তো দেখলেন।" সাঈদ ভাইয়ের কথা শুনে আমি হাসতে হাসতে মরে যাই। "যাউকগা, উনি তোমার খুব তারিফ করছে। এই লও। চিঠিটা পাইছ, এইটা জানাইয়া উত্তর দিও।"

এভাবেই শুরু শামুদার সাথে আমার পরিচয়। অল্প কদিন পরেই আমি তাকে চিঠির জবাব দিয়েছিলাম।
এরপর হঠাৎ করেই শামুদাকে না জানিয়ে আমি তার কর্মস্থল জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সকালে হাজির। তিনি তখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্প্যানিশ ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান। আমি সাতপাঁচ কিছুই না ভেবে, তাকে না জানিয়ে হঠাৎ করে পৌঁছে যাওয়ায় তিনি রীতিমত অবাকও হয়েছিলেন। আর বোধহয় খানিকটা বিব্রতও হয়ে থাকতে পারেন আগেই তাকে না জানিয়ে পৌঁছে যাওয়ায়। "আরে কী আশ্চর্য্য, আপনি এখানে? আপনি আসবেন আগে জানাবেন না? আপনার থাকা খাওয়ার একটা ভালো বন্দোবস্ত করার সুযোগ না দিয়ে চলে এলেন?" "শামুদা, আমি তো থাকার জন্য আসিনি, আমি আপনাকে আর শিশিরদাকে দেখতে এসেছি। এত সুন্দর একটি বই লিখেছেন, সেটার জন্য সরাসরি কৃতজ্ঞতা জানাতে এলাম।" আমি বুঝতে পারছিলাম, শামুদা স্পষ্টতই খুব বিস্মিত হয়েছেন। তিনি বোধহয় এতটা কল্পনায়ও ভাবেননি। যাইহোক, সেদিন তার ডিপার্টমেন্টে ‍খুব কাজ হয়তো ছিল না, যে কারণে তিনি আমাকে বাসায় নিয়ে আতিথেয়তা করলেন। তার বাসাতেই আমি তার একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সেটি পরে বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সাক্ষাতে শামুদা আমাকে তার সম্পাদিত Papeles de la India বইটি অটোগ্রাফসহ দিলেন। বইটি পেয়ে আমি খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম,কিন্তু দুঃখের বিষয় সেটি পড়ার এলেম আমার তখন কিছুই ছিল না। এখন আশ্চর্য হয়ে ভাবি শামুদা আমাকে কেন ওই বইটি দিয়েছিলেন? তিনি তো জানতেন আমি স্প্যানিশ ভাষা জানি না। তিনি কি তবে দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছিলেন যে আমি একদিন এই বইটি পড়তে পারবো? তার সাথে দেখা হওয়ার আরও অন্তত তিন বছর পর আমি মেক্সিকোতে যাই। কিন্তু তখন তো আমিও ভাবিনি যে মেক্সিকোতে যাবো এবং পড়ার মতো করে স্প্যানিশ ভাষাটি রপ্ত পারবো। পুরো ব্যাপারটিকেই আমার কাছে এখন খুব অদ্ভুদ মনে হয়।

শামুদার সাথে আমার আরও একবার দেখা হয় ১৯৯৯ সালে যখন আমি দিল্লীতে মেক্সিকান ভিসা নেয়ার জন্য যাই। আমি মেক্সিকো যাচ্ছি জেনে তিনি খুব খুশী হলেন। হওয়ার কারণ, তিনি জানতেন স্প্যানিশ সাহিত্য আমার আগ্রহের এলাকা। আর তিনি তো এই বিষয়ে রীতিমত হাফেজ। স্প্যানিশ এবং লাতিন আমেরিকান অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্য সম্পর্কে সম্ভবত গোটা ভারতবর্ষেই তার মতো পণ্ডিত দ্বিতীয়জন আছেন কিনা সন্দেহ। স্প্যানিশ তিনি প্রায় মাতৃভাষার মতো জানেন। তার স্প্যানিশ বিদ্যাচর্যার স্বীকৃতি লাতিন আমেরিকার বহু সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় আর রাষ্ট্র বিভিন্ন সম্মাননার মাধ্যমে দিয়েছে। মেক্সিকো পর্যন্ত তাকে আজটেক এওয়ার্ড-এ ভূষিত করেছে।
শামুদার সাথে আমার তৃতীয়বার দেখা হলো ২০১৫ সালে তার দিল্লীর বাসভবনে। এবার অবশ্য একা নয়, সপরিবারে। শামুদা ঠিক আগের মতোই আছেন। বয়স তো বেড়েছে বটেই কিন্তু সেটা বুঝা যায় না। কী এক জাদুবলে তিনি শরীরের উপর বয়সের ভার চাপতে দেননি।


বাঙালি পাঠকরা শামুদাকে একটু কমই চেনেন। এর জন্য অবশ্য তিনি নিজেই দায়ী। বাংলার চেয়ে তিনি বরং ইংরেজি ও স্প্যানিশেই বেশি লিখেছেন। সম্পাদিত বইগুলোও ওই দুই ভাষাতেই। স্পেনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ও চর্চা সম্পর্কে তিনিই প্রথম পূর্ণাঙ্গ একটি গবেষণা করেন, সেই গবেষণারই ফল শিশিরকুমার দাশের সাথে রচিত শাশ্বত মৌচাকঅদ্ভুত দিগ্বিজয় বলে বিপিনবিহারী চক্রবর্তীর একটি বই আছে যেটি আসলে দন কিহোতের প্রথম বাংলা অনুবাদ, এটি বেরিয়েছিল ১৮৮৭ সালে। শামুদার সম্পাদনা ও ভূমিকাসহ এটি আবারও প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে। বাংলায় তার সম্পাদিত আরও হয়তো একটি দুটি বই আছে। কিন্তু তার পাণ্ডিত্য ও চর্চার তুলনা এই সংখ্যা অতিশয় অপ্রতুল। কিন্তু ইংরেজি ও স্প্যানিশে রচিত ও সম্পাদিত বইয়ে সংখ্যা আরও বেশি। এটা খুবই দুঃখজনক যে তিনি বাংলায় লিখলেন খুব কম। তার দিল্লী-বাসই হয়তো বাঙালি পাঠককে বঞ্চিত করার মূল কারণ। কোলকাতায় থাকলে তিনি হয়তো এখানকার বাঙালি লেখক-পাঠক-প্রকাশক ও বাঙালি পরিমণ্ডলের কারণে বাংলা লিখতে আগ্রহী হতেন বেশি। আমি শ্রদ্ধার সাথে প্রায়ই তাকে অভিযোগ করে বলি, আপনি বাঙালি পাঠকদেরকে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত করলেন। তিনি সলজ্জ হাাসি দিয়ে অভিযোগকে লঘু করার চেষ্টা করেন।

স্প্যানিশ জগত সম্পর্কে তার তথ্যভাণ্ডার রীতিমত ইর্ষণীয় রকমের বিপুল। শাশ্বত মৌচাক শীর্ষক বইটিতে স্পেন ও রবীন্দ্রনাথের যে-সম্পর্ক তিনি আবিস্কার করেছেন, সে সম্পর্কে আমাদের আগে কোনই ধারণা ছিল না। তিনিই প্রথম ইউরোপের প্রধান একটি ভাষায় রবীন্দ্ররচনার অভিঘাতকে আমাদের সামনে নিয়ে আসেন যেখানে স্পেনের প্রধান লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা, এমনকি চলচ্চিত্রকার ও দার্শনিকরাও কিভাবে রবীন্দ্র-প্রসঙ্গে জড়িত হয়েছিলেন, তার হদিস আমাদেরকে জানিয়েছেন। তার সাথে বহুবার কথা বলে দেখেছি তিনি লাতিন আমেরিকার সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক বিষয়ে বেশ ওয়াকিবহাল, যদিও বাংলায় তিনি এ নিয়ে খিখেছেন খুবই অল্প। স্প্যানিশ ও ইংরেজিতে কিছু কিছু লিখেছেন। তবে চাইলেই তিনি বাংলায় একটি পূর্ণাঙ্গ বই লিখেতে পারতেন। এ বিষয়ে আমি দক্ষিণে সূর্যোদয় বলে একটি বই লিখেছিলাম। কিন্তু সেটা লেখার পেছনে আমার কোনোই কৃতিত্ব নেই। ভাষা জানার সুবাদে কিছু তথ্য হাতের কাছে ছিল বলে সহজেই লেখা হয়েছিল। কিন্তু আমি জানি, তিনি লিখলে আমার চেয়ে অনেক বেশি ভালো করতেন।
আজকে ভাবতে আশ্চর্য লাগছে, তার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে কখনো কল্পনাও করিনি যে একদিন তার ও আমার চর্চার এলাকা অভিন্ন হয়ে উঠবে। যদিও এখ্খুনি স্বীকার করা উচিৎ যে তার আগ্রহ ও চর্চার এলাকা আমার চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত ও গভীর। এক অর্থে, অলক্ষে তিনি, তার শাশ্বত মৌচাক বইটির মাধ্যমে আমার মধ্যে স্প্যানিশপ্রীতির একটি বীজ বুনে দিয়েছিলেন। কিংবা যদি বুনে না-ও দিয়ে থাকেন, অন্তত এই প্রীতিকে জোরালো ও স্থায়ী করার পেছনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

স্প্যানিশ ভাষা ও সংস্কৃতির কোনো অনুষঙ্গ আমার কাছে যদি অষ্পষ্ট মনে হয়, সঙ্গে সঙ্গে আমি তার দারস্থ হই। এ বিষয়ে তিনি আমার কাছে অভিধানের মতো। আমার ধারণা, শিশিরদা বেঁচে থাকলে তাকে দিয়ে বাংল ভাষায় আরও কিছু লিখিয়ে নিতে পারতেন। কিংবা হয়তো কোলকাতায় থাকলেও সেটা হতে পারতো। দিল্লী যেন বাংলার সতীন হয়ে উঠলো শামুদার ক্ষেত্রে।
বহুভাষী, পণ্ডিত ও স্প্যানিশ রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ শ্যামাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের আজ জন্মদিন। এই শুভদিনে তাকে আমার আলিঙ্গন।