কেবল যাবার থাকে, জেনারেল?

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 25 May 2021, 07:10 AM
Updated : 25 May 2021, 07:10 AM


সিরাজী ভাই চলে গেলেন। এক মাস আগে তিনি শরীরের নানান জটিলতা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে। খুব সম্ভবত ভর্তি হওয়ার সপ্তা দুয়েক আগে তার সাথে শেষ দেখা হয়েছিল তারই অফিসে। সেবার অবশ্য তার সাথে দেখা করার জন্য নয়, মূলত বন্ধু মোবারক হোসেনের সাথে দেখা করার জন্য গিয়েছিলাম। তাছাড়া বাংলা একাডেমিতে গেলে আমি সবসময়ই এক ঢিলে দুই নয়, একাধিক পাখি মারার মতো করে দেখা করি বন্ধু কবি সরকার আমিন, গবেষক জালাল (ফিরোজ)ভাই, দুই কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান এবং মোজাফ্ফর হোসেনের সাথে। আর আগে থেকে বলে না গেলেও – যদি জানতে পারি যে সিরাজী ভাই আছেন—তখন দেখা করাটা অবধারিত। আর আগে থেকে বলে গেলে তো কথাই নেই। কিন্তু সিরাজী ভাই ছিলেন সেই রকম মানুষ, আগে থেকে বলে না গেলেও তিনি দেখা করতে গেলে খুশী হতেন। পদ ও মর্যাদার সরু কিংবা পুরু কোনো দেয়ালই তিনি নিজের চারিদিকে তুলে রেখে কথা বলতেন তো না-ই, অপর পক্ষ যাতে ওরকম কোনো অনুভূতি অর্জন না করেন, সে ব্যাপারে তিনি অবচেতনেই দিলখোলা হয়ে থাকতেন। আসলে বলা ভালো, তিনি দিলখোলা মানুষ ছিলেন বলেই ওই পদ ও মর্যাদা তার স্বতঃস্ফূর্ত আচরণকে প্রভাবিত করতে পারেনি কখনোই।

২০১০ সালের পর থেকেই সিরাজী ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ শুরু। কিন্তু তাকে আমি চিনি আশির দশক থেকেই। এমনকি, এখন বললে অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য শুনাবে যে আশির দশক থেকে আমি কেবল তাকে চিনিই না, ঢাকা শহরের দুতিনটি শুড়িখানায় একই সাথে সময় কাটাবার অভিজ্ঞতাও আমার সঞ্চয়ে আছে। কিন্তু তখনও তিনি আমাকে চেনেন না, কারণ আমি তখন লেখার জগতে হামাগুড়ি দেয়া শিশু। কবি আবিদ আজাদের হাত ধরে শিশুর মতো এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই। আবিদ ভাইয়ের সূত্রে ও প্রশ্রয়ে ওই সব জায়গায় আগতদের দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম, তাদেরকে চেনবার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে তাদের চেনার কোনই কারণ ছিল না, যেহেতু তখন আমি কোনভাবেই উল্লেখ করার মতো কেউ ছিলাম না। সিরাজী ভাইকে সেভাবেই তখন থেকে চিনি। তার প্রথম দিককার দুতিনটি কবিতার বইও তখন পড়া হয়ে গিয়েছে। মধ্যরাতে দুলে ওঠে গ্লাস কিংবা হাওয়া কলে জোড়া গাড়ি অথবা নোনা জলে বুনো সংসার বেশ ভালো লেগেছিল। কিন্তু মদ্যপদের কাছে মধ্যরাতে দুলে ওঠে গ্লাস বেশ মুখরোচক একটি নাম হয়ে উঠেছিল। যদিও সিরাজী ভাইকে তখন কিংবা পরেও কখনো সে কথা জানানো হয়নি। হয়তো এটা তিনি অন্যদের কাছ থেকে আগেই শুনে থাকবেন। এই সিরাজী ভাইয়ের সাথে ওইসব জায়গায় তিন চারবার দেখা হওয়ার পর আর খুব একটা দেখা হয়নি কাছ থেকে। এরপর, বহু বছর পরই বলা যায়, কদাচিৎ এখানে সেখানে দূর থেকে দেখেছি। কিংবা হয়তো কাছাকাছি দেখা হয়েছে, কিন্তু এমন কোনো হৃদ্যতা তখনও তৈরি হয়নি যে দেখা হওয়ামাত্রই হই হই করে উল্লাসে ঝাপিয়ে পরবো। তাছাড়া তিনি আমার কম করে হলেও দুই দশকের অগ্রজ কবি। সুতরাং বয়স ও দশকের দূরত্ব আমাদেরকে তখন এতটা কাছে ভিড়তে দেয়নি। এরশাদের সময় যখন কবিরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে একদল এশীয় কবিতা,অন্য দল জাতীয় কবিতা পরিষদ গড়ে তুললেন, তখন দ্বিতীয় দলে ছিলেন সিরাজী ভাই। কিন্তু কবিতা লিখলেও, দলভীতি আমার যেহেতু ছিল, তাই জাতীয় কবিতা পরিষদের সূত্রেও তার সাথে পুরোনো সংযোগকে নতুন করে ঘষেমেজে চকচকে করার কোনো সুযোগ ছিল না। এরপর, অনেক বছর পরই আমি দেশান্তরিত হয়ে যখন ২০১০ সালে ফিরে এলাম, তখন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার সূত্রে রাইটার্স ক্লাবে খানিকটা নিয়মিতই কিছুদিন দেখা সাক্ষাৎ ও আড্ডা হয়েছিল। হুদা ভাইয়ের কল্যাণেই বলা যায় ওই প্রথম সিরাজী ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ হয়। দেখলাম সিরাজী ভাই আগের মতোই দিলখোলা, নির্জটিল, আর স্বচ্ছতা ও স্নিগ্ধতাপ্রবণ। মিষ্টি হাসি, উদার আচরণ আর অপরের প্রতি—অনুজ হলেও – সম্মান জানাবার সুরুচি অক্ষুন্ন রাখতেন সবসময়। ওখানেই সাহিত্য নিয়ে, মূলত কবিতা নিয়ে তার সাথে যেসব আলোচনা হতো তাতে সিরাজী ভাইকে নতুন করে আবিস্কার করছিলাম।


ছবি: সাইমন জাকারিয়া
হঠাৎ করেই একদিন, খুব সম্ভবত ২০১৭ বা ১৮ সালের মাঝামাঝি ঢাকা ক্লাবে কবি মারুফুল ইসলামের আমন্ত্রণে দীর্ঘ একটা আড্ডা হয়েছিল সিরাজী ভাইয়ের সাথে । ওখানে কথাসাহিত্যিক মইনুল আহসান সাবেরও ছিলেন। ওই দিনের আড্ডাটাও ছিল মূলত সাহিত্যপ্রধান। সেদিন মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নিয়ে লম্বা সময় নিয়ে কথা হচ্ছিল। সিরাজী ভাই, মাইকেল সম্পর্কে সেদিন চোখধাঁধানো অনেক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মুক্ত ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন আমাদের সামনে। নজরুল নিয়ে প্রায় অনুরূপ কথার ফুলঝুড়িও দেখছিলাম মুগ্ধ হয়ে। মারুফুলও খুব ভালো কিছু মন্তব্য করেছিলেন মাইকেলকে নিয়ে। সেদিনই লক্ষ্য করলাম সিরাজী ভাই ভীষণভাবে এবং ন্যায়সঙ্গত কারণেই মাইকেল-মুগ্ধ। সম্ভবত এই মুগ্ধতার এক প্রকাশ্য স্বীকৃতি তিনি দিয়েছিলেন ২০১১ সালে প্রকাশিত কবিতাসমগ্র নামক বইটির উৎসর্গ পত্রে ।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সিরাজী ভাই বাংলা একাডেমিতে যোগ দেয়ার পর, তার সাথে দেখা সাক্ষাৎ বেড়ে যায় প্রধানত বিডিআর্টস-এর জন্য তার কাছ থেকে নিয়মিত লেখা পাওয়ার তাগিদের কারণে। তাছাড়া, জালাল ভাই, মোবারক, আমিন , স্বকৃত ও মোজাফ্ফর-এর কারণে যখনই একাডেমি যেতাম তখন সিরাজী ভাইয়ের সাথে দেখা হতোই। যদিও তার রুমে ঢোকার পর পরই আমি বলতে ভুলতাম না যে , "সিরাজী ভাই, আমি যেহেতু আপনাকে আগেভাগে জানিয়ে আসিনি, তাই আপনার সময় নষ্ট করবো না, শুধু মাত্র আপনাকে এক নজর দেখে চলে যাবো। ' কিন্তু সিরাজী ভাই কখনোই ওই অসময়ের দেখাকে অসময় বলে মনে তো করতেনই না, উল্টো চা সিগারেট না খেয়ে উঠতে দিতেন না। তার আচরণের এই অনন্যতা কেবল আমার সাথেই নয়, সবার সাথেই ছিল। শুনেছি বাংলা একাডেমির কর্মরত সবাই তার বন্ধুসুলভ আচরণের প্রশংসা করতেন। পদের বিভেদ ভুলে সবার সাথে স্বজনের মতো আচরণ করতেন। তারা বলতেন, বাংলা একাডেমির জীবনে সিরাজী ভাই ছিলেন পুরোপুরি এক ব্যতিক্রম। আমি অনুমান করতে পারি, তার প্রয়াণে সিরাজী ভাইয়ের সহকর্মীরা, বিশেষ করে যারা লেখালেখির সাথে যুক্ত তারা কেবল একজন মহাপরিচালককে নয়, তারা একজন সত্যিকারের সুহৃদ ও সজ্জনকে হারাবার বেদনা অনুভব করছেন। তার যারা সত্যিকারের বন্ধু, তারা হারালেন এমন একজন বন্ধুকে যিনি মনুষ্যগুণেই শুধু নয়, বন্ধুত্বের আবশ্যকীয় সমস্ত গুণাবলী সম্পন্ন বলতে যা বুঝায় তার সবটাই কানাকানায় পূর্ণ ছিল, হয়তো উপচে পড়ার মতোই ছিল।

যখনই সিরাজী ভাইকে ফোন করতাম, কোনো কল-এ ব্যস্ত না থাকলে সঙ্গে সঙ্গে ধরতেন। ব্যস্ত থাকলে পরে ঠিকই কল ব্যাক করতেন। এমনভাবে কথা বলতেন যে তার আচরণের মিষ্টতা দিয়ে আপনাকে প্রাণবন্ত করে তুলতো। জ্ঞান ফলানো, দাম্ভিকতা, পদাধিকারের অহংকার—এসবের কোনো কিছুই তার আত্মাকে কলুষিত করতে পারেনি বলে একদম সমমনস্ক আর সমবয়সীর মতোই সমতলের একটা অনুভূতি পাওয়া যেত তার সাথে কথা বললে। আচরণের এই সংবেদনশীলতা তিনি যে খুব সতর্কতার সাথে রক্ষা করতেন তা কিন্তু নয়, এটা ছিল তার স্বভাবের স্বতঃস্ফূর্ত রূপ। আজকাল এমন মানুষ খুব একটা নেই। তিনি বাংলা একাডেমিতে যোগ দেয়ার বছর দেড়েক পরে তার একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তার আগে আমি ষাটের কবিদের মধ্যে আবদুল মান্নান সৈয়দ আর মুহম্মদ নূরুল হুদার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। মনে হলো সিরাজী ভাইয়ের একটা সাক্ষাৎকার নিতে পারলে বেশ ভালো হয়। সাক্ষাৎকারটি ছিল দেড় থেকে দুঘন্টার। তার সাহিত্যকর্ম,বাংলা সাহিত্য এবং বিশ্বসাহিত্য নিয়ে অনেক আলাপ। আমার প্রশ্নের সূত্রে তার কিছু কিছু কবিতার খুব সুন্দর বিশ্লেষণ তিনি করেছিলেন। সাক্ষাৎকারে আমার সামান্য নেক আছে বলেই হয়তো তিনি সাক্ষাৎকারটি এতই পছন্দ করেছিলেন যে একেবারে ভনিতাহীনভাবেই শিশুর মতো সারল্য নিয়ে বলেছিলেন, "আমার খুব লোভ আপনার সাথে আমার একটা সাক্ষাৎকারের বই হোক। " আমিও তাকে সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলাম , "সিরাজী ভাই, সেরকম হলে তো এটা আমার জন্যই সৌভাগ্যের হবে। আপনি সময় বের করে আমাকে জানাবেন , আমরা সুবিধাজনক কোথায়ও বসে আলাপ চালিয়ে যাবো। " কিন্তু করোনা আমাদেরকে শুধু বিলম্বিত করলো না, আজ তার মৃত্যু সেই পরিকল্পনাকে পুরোপুরি ধ্বস্ত করে দিল। আমারও খুব কৌতুহল ছিল তার তিরিশ পঁয়তিরিশটি কাব্যগ্রন্থের কবিতা, তার রুমি ও রসুল গমজাতভের অনুবাদ নিয়ে আলাদা করে অন্তত আরও একবার বসার। কিন্তু ব্যাধি আর মরণশীলতা অকস্মাৎ সমস্ত পরিকল্পনাকে ভণ্ডুল করে দিয়ে গেল। সিরাজী ভাইয়ের সুস্বাস্থ্য, আন্তরিকতা আর দিলের কোলম পরশ কখনো একথা ভাবতে দেয়নি যে মানুষের মৃত্যু এত আকস্মিক, এত অভাবনীয় আর এত বেদনাবহ হতে পারে। যদিও তার প্রিয় কবি মাইকেল বলেছিলেন,
জন্মিলে মরিতে হবে,
অমর কে কোথা কবে,
এটা জানার পরও , সিরাজী ভাই, আপনার প্রয়াণকে অন্যায্য মনে হয়। যদি সম্ভব হতো তবে বেয়াদবের মতো প্রত্যাখ্যান করতাম আপনার মৃত্যুকে।


২.
হাবীবুল্লাহ সিরাজী ছিলেন ষাটের শেষার্ধের কবি। কবি হিসেবে তিনি রফিক আজাদের মতো সেই সব চমক জাগানো কোনো পংক্তির জনক ছিলেন না যা তাকে মুহূর্তেই পাঠকের নজরে নিয়ে আসবে। ছিলেন না নির্মলেন্দু গুণের মতো যৌনতা, রাজনীতি ও ইতিহাসের অকপট উন্মোচনের জনপ্রিয় উল্লাস যা পাঠকের জন্য মুখরোচক হয়ে উঠবে । ছিলেন না আবদুল মান্নান সৈয়দের মতো অন্তর্গত ভূমণ্ডলের এক মাতাল মানচিত্র যা পাঠকের শিরা উপশিরায় কোমল আগুনের মতো প্রবাহিত হবে। এমন কি তা মুহম্মদ নূরুল হুদার মতো এই জনপদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কাব্যময় উদ্গীরণও নয় যা লাভাস্রোতের মতো পাঠকের হৃদয়কে উত্তাপে আপ্লুত করে তুলবে। কিন্তু হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতা ছিল বরফ আর আগুনের অন্বয়, এমন এক সহাবস্থান যা বিষয়ের উত্তাপকে বুননের শীতলতায় একান্নবর্তী করে তুলেছিলো। তার সমগ্র কবিতায় এতসব ব্যজ্ঞনের উপস্থিতি ছিল যে বিশেষ কোনো একটি খাবারের বৈশিষ্ট্য তাতে প্রধান হয়ে ওঠেনি। এর ফলে তার দশকের কবিদের কেউ কেউ কোনো একটি বিশেষ লক্ষণে সুশোভিত হয়ে নজরে পরলেও, তিনি ছিলেন কিছুটা উপেক্ষিত, ফলে খানিকটা অবজ্ঞাত। অথচ তার সমসাময়িক কবিদের আত্মীকৃত সবরকম উপাদান ও হলাহল পান করে তিনিও ছিলেন পুরোদস্তুর কবি। কিন্তু তিনি সেই কবি যিনি নিজের বৈশিষ্ট্যকে নিহিত রেখেছেন অনুচ্চ স্বরে, শিল্পের ঘরোয়া বুননে। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের পদ অলংকৃত করার আগে, তার কবিতা খুব একটা আলোচিত যেমন হয়নি, তেমনি তা মনোযোগও কাড়েনি বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীর। কিন্তু তার বিপুল কবিতাসম্ভার থেকে বিকীরিত সারিবদ্ধ জ্যোৎস্না পাঠকের হৃদয়কে আলোকিত করবে – এতে কোনো সন্দেহ নেই। আপনাকে বিদায়ী স্যালুট, জেনারেল হাবীবুল্লাহ সিরাজী।

ইতিপূর্বে আর্টস-এ প্রকাশিত হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য লেখা:
হাবীবুল্লাহ্ সিরাজী: বাংলা একাডেমির দরোজা এখন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আর ধর্মান্ধদের ছাড়া সবার জন্য খোলা