লাল করমচা মেয়ে ও কৈশোরের হিরন্ময় দ্যুতি

শাহাব আহমেদ
Published : 11 March 2020, 01:22 PM
Updated : 11 March 2020, 01:22 PM



গিয়াসের মাথা পেকেছে, আর আমার মাথা বাসুদের পরিত্যক্ত ভিটার মত। আমাদের ৬ মাসের বয়সের ব্যবধান, দুই চাচাতো ভাই, শৈশবের দুই হরিহর আত্মা। আমি লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম, গিয়াস বুদ্ধিমান ছিল। দুষ্টামীতে সে ছিল আমার গুরু।
ওই প্রশ্ন করলো, "তোর নাহিদা'র কথা মনে আছে?"
স্মৃতির কৌটা হাতড়াই, নাহিদা নামে কোন মেয়ের অস্তিত্ব সেখানে নেই।
"মনে নেই, ও অনেক বই পড়তো এবং আমরা কাকার ঘর থেকে চুরি করে ওকে একটি মজার বই পড়তে দিয়েছিলাম?"
মনে পড়ে না।

মন আমার ককেশিয়ার শৃংখলিত প্রমিথিউস-কাজবেক পাহাড়ের গিরিখাতে, এত তার গহীনতা যে, কিচ্ছু খুঁজে পাই না। প্রমিথিউসকে কাজবেক পাহাড় থেকে এনে এখন শৃংখলিত করা হয়েছে পাশের শহর প্রাগজ্যোতিষপুরে
যেখানে ক্ষমতা-শাবকদের নির্দেশে শকুনেরা খুবলে খাচ্ছে মানুষের হৃৎপিণ্ড, কলিজা, গলিত মাংস ও মগজ। আগুন জ্বলছে, গৃহ পুড়ছে, ধর্মালয়গুলো পুড়ে ও পুড়িয়ে পৈচাশিক অট্টহাসির প্রতিধ্বনি তুলছে।
প্রাগজ্যোতিষপুরে পৃথিবীর পুত্র ছিল "নরক" নামের এক অসুর। ছিল তার দেয়াল ঘেরা দুর্ভেদ্য দুর্গ। সে যেদিন অযোধ্যায় বিশ্বকর্মার কন্যাকে অপহরণ করে ধর্ষণ করেছিল, সবাই ভেবেছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা, আর কাউকে স্পর্শ করবে না। কিন্তু ধীরে ধীরে সে দেবকন্যা, গন্ধর্ব, অপ্সরা, মানবকন্যাদের ধরে এনে ধর্ষণ করে করে পার পেয়ে যায়। অভেদ্য দুর্গে বন্দি করে রাখে লাঞ্ছিতদের। অথচ জনগণ তাকে ভালোবাসে এবং পুজা করে দেবতা বলে। সে তার অসুর জন্মের কথা সুবচনে মানুষকে ভুলিয়ে দেয়। এবং
তার দূর্গে লাঞ্ছিত, নির্যাতিত, নিষ্পেষণে নির্বাক হয়ে থাকে ১৬,০০০ অবরোধবাসিনী।
এটা ছিল অতীতের কথা। প্রাগজ্যোতিষপুর এখন ১.৩ বিলিয়ন মানুষের রাজধানি, যেখানে নব্য 'নরক' রাজ্য শাসন করে।

না, আমার নাহিদার কথা মনে নেই।
গিয়াস মনে করিয়ে দেয়। আমরা তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, ও গ্রামে থাকে আমি নারায়নগঞ্জে ভাড়াটে বাসায়। সে প্রায়ই নারায়নগঞ্জ আসতো। আমাদের পাশের বাসায় থাকতো নাহিদা। ওদের উঠানে একটা বড় বরই গাছ ছিল। সে গাছ যখন বরই ফুলে ভরে যেত, তার ঘ্রাণে কেমন কেমন লাগতো। মৌমাছি উড়তো সেখানে মাতালের মত। কৈশোরের টোকা-মারা দরজায় আমাদের অবস্থা ছিল অনেকটা তাই। ওর সারা দেহে ছিল এক আন্তর্মহাদেশিয় ক্ষেপনাস্ত্রের মত ধ্বংসকারী শক্তি, যা সালোয়ার কামিজ ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখা হলেও আমরা তার রাডারের বাইরে যেতে পারতাম না। আমাদের মধ্যে তখন একটা তীব্র পতঙ্গ-প্রবনতা জন্ম নিয়েছিল। যে করেই হোক ওর দেহের নিউক্লিয়ার রিয়েক্টরে ঝাঁপ দিয়ে নি:শেষ হতেই হবে। সেটাই মনে হয়েছিল ইঁচড়ে পাকা জীবন-যাতনার সত্যিকারের নির্বাণ। কারণ নির্জন অরণ্যে স্নানরত চিত্ররথকে দেখে পরশুরাম-জননী রেনুকার যতটুকু কামোথ্থান হয়েছিল, নাহিদার চোখের কিরণ ও গায়ের ঘ্রাণে আমাদের হয়েছিল তারও চেয়ে অনেক বেশি।

তবে এ ছিল আমাদের স্বতন্ত্র মগজের আময়, খুব কাছের বন্ধু হলেও গিয়াস বা আমি নিজস্ব অনুভূতিগুলো একে অন্যকে প্রকাশ করতাম না। বামনাকৃতির একটা প্রতিযোগিতাও ছিল সতত জিয়ৎ।
নাহিদা ছিল এক ক্লাস উপরে, প্রস্ফুটিত পদ্ম-প্রসূনের মত। ইন্দ্র যার রূপে অন্ধ হয়েছিল ব্রহ্মার সেই মানসকন্যা অহল্যাও এত সুন্দর ছিল বলে আমার মনে হয়না। হতে পারেও না। বয়:ভারাক্রান্ত ইন্দ্রের চোখ কি কিশোরের চোখের চেয়ে তীব্র হতে পারে? সব রং ধরা পড়ার চোখ বৃদ্ধের আছে?
পিচফলের মত চামড়ার রং এবং ফালতু সব জামাকাপড় নাহিদার দেহের সৌন্দর্যের প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি গভীরতা, বন্ধুরতা না ঢেকে বরং আরও বহুগুণ তীব্র করে দিত। শৈলনিতম্বে বাঁধা অনম্বর এন্ড্রোমিডার যে সৌন্দর্য দেখে পার্সিয়াস মুগ্ধ হয়েছে আমরা নিরুদ্ধ নাহিদার দেহের সৌন্দর্য তারচেয়েও বহুগুণ বেশি কল্পনা করে নিয়েছি।

আমার সাথে খুব খাতির ছিল ওর।
না থাকার কারণ নেই, মনের ভিতরের ডেকচিতে কামনা ও লিবিডোর তপ্ত 'ডাইলে-চাইলে উতড়ানো' অনুভূতি থাকলেও বাইরে আমি খুব নিরীহ ছিলাম। অথচ অনুভূতি ও আকাংখা ছিল তীব্র! জাপানের হকুসাইয়ের বিশাল তরঙ্গ বা রাশিয়ার আইভাজভস্কির কৃষ্ণসাগরের ঝড়াক্রান্ত জাহাজের বিপর্যয় আমাদের কৈশোর ও যৌবনের যৌনতৃষ্ণার বিশালত্বের তুলনায় কিছুই নয়।

নারায়নগঞ্জের কালীর বাজারে একটি অতি প্রাচীন দালানে ছিল বাবার কাপড়ের দোকান, মোমেন বস্ত্রালয়। সেখানে কাজ করতো বাবার এক খালাতো ভাই। দোকানের পেছনে একটি ছোট কক্ষ ছিল। স্যাঁত স্যাঁতে আধো অন্ধকার। লাইট জ্বালালেও তার হলুদ টিমটিমে আলো ছিল পেঁচার চোখের আলোর চেয়ে বহুগুণ কম।
সেই কক্ষের পেছনে খালের মত বিশাল যে ড্রেন ছিল, সারা বাজারের শত শত বিল্ডিংয়ের পুরীষ, মুত্র, বীর্য, রান্না করার বর্জ সব যেত সেই ড্রেনে। সেখান থেকে কোথায় যেত বলা মুশকিল। শীতলক্ষ্যায়? কেন নয়?
সেই কক্ষে গন্ধে মাথা ঝিমঝিম করতো। বিভিন্ন দালানের বিভিন্ন তলা থেকে বাথরুমের জল পড়তো অবিরল, সেই শব্দ এখনও সততই কানে বাজে। সেই ছিল আমার জীবনের দেখা প্রথম জলপ্রপাত। পরে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জলপ্রপাতের জল পতনের যে শব্দ আমি শুনেছি, কালীর বাজারের ড্রেনের এই শব্দকণিকারা মিশে ছিল সেখানে।
স্মৃতি, স্মৃতি, স্মৃতি!
সে আধো অন্ধকার কক্ষটিতে থাকতেন কাকা, তখনও অবিবাহিত অথবা স্ত্রীকে গ্রামে রেখে এসে শহরে পার্ট-টাইম ব্যাচেলর। আমরা স্কুল শেষ হয়ে গেলে সেখানে সময় কাটাতাম, পরে বাড়ি ফিরতাম দিনশেষে। তার বালিশের নীচে একদিন একটি মহার্ঘ বই আবিস্কার করি। বই নয়, কলম্বাসের মহাদেশ, নাম তার কামসূত্র। কাগজ দিয়ে কভার করাছিল, সুতরাং বাইরে থেকে বোঝা যেতনা।
গিয়াস আসে তার দু'চারদিন পরেই। ওকে কালীর বাজারে নিয়ে গিয়ে সাবধানে সেই মহাদেশের নানা ভঙ্গির নানাবিধ রেড-ইন্ডিয়ানদের দেখাই।বলা বাহুল্য বইটি তারও মনে ধরে। নাহিদা বই পড়তে ভালোবাসতো। আমাদের বাসায় বইছিল প্রচুর। মাঝে মাঝেই আমার কাছ থেকে বই নিয়ে পড়তো। পড়তো সে ঘাসে অভ্যুক্ত গাভীর মত। গিয়াস ও আমার, দু'জনেরই মনে হয়েছিল এই বইটি নাহিদার খুব ভালো লাগবে।

সূর্যকন্যা তপতী একবার দেখা দিয়ে যখন অন্তর্হিত হয়ে যায় প্রেমমুগ্ধ রাজা সংবরণ নিজেকে সংবরণ করতে না পেরে মুর্ছিত হয়ে পড়েছিলেন। এ সবই নাকি প্রেমের বিষাক্ত ক্যামিকাল রিয়েকশন।আমরাও নাহিদার মায়া-বৃত্তে বাস্তবতা ও মুর্ছিত হবার পূর্বাবস্থার চেতনার অসংলগ্নতায় ছিলাম।ঠিক মুর্ছিত নয়, ঠিক পরিপূর্ণ বাস্তবতায় নয়, রোমান্টিকতায় ঘোরাক্রান্ত!

বইটি কে ওর হাতে তুলে দিয়েছিল মনে নেই, তবে যুক্তিতে মনে হয় আমিই, কারণ আমি ছিলাম ভালো ছাত্র আর গিয়াস বুদ্ধিমান। কোথায় বিপদ হতে পারে সে বিষয়ে ওর জ্ঞান ছিল টনটনে, আর আমার ছিল বোধের জঙলে ফ্লাট টায়ার। তিনদিন পরে বইটি ফেরত আনতে যাই।
নাহিদার গাল করমচা লাল, "এসব বাজে বই আমাকে দিতে লজ্জা করে না?"
যুক্তির প্রশ্ন। তবে তার মুখে যেটুকু রাগের চিহ্ন ছিল, তা ছিল কপট, তার নীচে একটি হাসি ছিল।
তার কপট রাগে লাল মুখটি আমার এখন, এই অর্ধশতাব্দ শেষে সত্যই সূর্যকন্যা তপতীর মুখ মনে হয়, কী সুন্দর, আলোকজ্জ্বল, নিষ্পাপ।
আমি রাজা সংবরণ নই, তাই আমি সংজ্ঞাহীন হয়ে তার হৃদয় জয় করতে পারি নাই। শুধুই গিয়াসের বন্ধু হয়ে জীবন কাটিয়েছি।

বইটি ওকে দিতে মোটেও লজ্জা হয় নি আমার, মনে হয়েছে যে বই আমাদের এত পছন্দ হয়েছে, তা নিশ্চয়ই তারও পছন্দ হবে। তবে ফেরত নেবার সময়ে যে লজ্জা পাইনি তা নয়, কারণ নাহিদা বলেছিল, পড়া তো দূরের কথা, সে নাকি বইটি খুলেও দেখেনি। আহা আফসোস! এত সুন্দর সুন্দর ছবি ছিল সেখানে, কত কত অদ্ভুত ভঙ্গীতে মানব ও মানবীর চিরন্তন ভালোবাসার নন্দনকাননে পরিভ্রমণ!
কত কত দেহজ অনুভূতির ভ্রুণ!
এরপরে আমাদের আর ওর কাছে ভেড়ার আর সময় হয়নি।
প্রথমে কিছুদিন মনে মনে লাল ছিলাম লজ্জায় এবং তা কাটিয়ে উঠতে উঠতেই ওরা বাসা বদল করে অন্যত্র চলে গিয়েছিল।

গিয়াস, নাহিদার কথা মনে করিয়ে দিলি, তুইতো জাপানের মানুষ, তোর কি প্রাচীন কবি শতোবা কোমাচির কথা মনে আছে? আজ আমি তাকে স্বপ্নে দেখেছি তারই কবিতার আঙিনায়:

"তোমার কথা ভাবতে ভাবতে
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম,
যদি জানতাম সেটা স্বপ্ন
তাহলে কি ঘুম থেকে জাগি?"

সে জাপানের সবচেয়ে সুন্দরী নারী ছিল। তার বুক ছিল সুন্দর, দামী ও দুর্লভ পাথর দিয়ে গড়া। সে তার প্রেমিককে বলেছিল, একশ রাত, যদি একশত রাত একবারও ব্যর্থ না হয়ে আমার বাগানের বেঞ্চে এসে বসতে পারো, তবেই শততম রাতে পাবে আমার ভালোবাসা।

মৌসুমী মুসল বৃষ্টি, তুষার-ঝঞ্ঝা, শীত, জড়তা, আময় ও ক্লান্তি, এমনকি পূর্ণ পূর্ণিমার ধানরাতের অনুষ্ঠানে প্রাসাদ চত্বরে উপস্থিত থাকার সম্রাটের আদেশ অমান্য করে প্রতিটি রাতে সে উপস্থিত থেকেছে তার আঙ্গিনায়। চাতকের মত তাকিয়ে থেকেছে জানালায়, রাত ঘন হওয়া পর্যন্ত, কিন্তু একবারও দেখতে পায়নি কোমাচির জোছনার পূর্ণিমা মুখ। দীর্ঘশ্বাস জোনাকি হয়েছে তার প্রতিরাতের নিস্ক্রান্তির পথে। আর কোমাচি তার গোপন খড়খড়ি দিয়ে ঠিকই দেখে
হেসেছে পরিতৃপ্তির হাসি। তারপরে আসে সেই কাংখিত শততম রাত, কোমাচির হৃদয় বিজয়ের রাত, ওষ্ঠ-চুম্বন ও আলিঙ্গনের মহাকালের লালা লসিত তিথি। এবং তার হৃৎপিণ্ডে তীব্র ব্যথার বিস্ফোরণ হয়, মহাবিশ্বের মহাবিস্ফোরণের মত, প্রতিক্ষা ও প্রত্যাশার বিষণ্ণ "বিগ ব্যাং"
ছিন্নভিন্ন করে দেয় তার বুক। যে হৃৎপিণ্ড ধুকপুক করতো ভালোবাসার উষ্ণতায়, তা হঠাৎ করে থেমে শীতল শিশির হয়ে যায়। সে মাটিতে নেতিয়ে পড়ে।
কোমাচি তখনও তার প্রতিশ্রুতির নৈবেদ্য নিয়ে এসে পৌঁছায় নাই।

গিয়াস, বলতে পারিস, কে বেশি সুন্দর ছিল, আমাদের নাহিদা, না জাপানের কোমাচি?

কী জানি হয়তো ওরা দুজনেই, অথবা, হয়তো তুই আর আমি, আমরাই, কৈশোরের হিরন্ময় দ্যুতিতে।

মার্চ ১, ২০২০
ওকালা