ইমদাদুল হক মিলন: সময়ের বাঁকাজল পেরিয়ে

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 7 Sept 2020, 08:34 PM
Updated : 7 Sept 2020, 08:34 PM


৯৬ বা ৯৭ সালে একবার কথাসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবের ভাইয়ের বাসায় পানাহারের এক দীর্ষ আড্ডায় জমে উঠেছিল বহু লেখকের উপস্থিতি। সাবের ভাই তখন ভিকারুন্নেসা নুন স্কুলের পেছনে ইস্টার্ন-এর এপার্টমেন্টে থাকতেন। কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, মশিউল আলম, আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনসহ এক দীপিত আড্ডা জমে উঠেছিল সেদিন। ব্রাত্য রাইসু এবং আহমাদ মোস্তফা কামাল কি সেই আড্ডায় ছিল? এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে মনে পড়ছে না। তবে কালাম যে ছিল সেটা সংশয় সত্ত্বেও মনের মধ্যে ভেসে উঠছে। যাই হোক, সেই আড্ডায় রাহমান ভাই ছিলেন আমাদের মধ্যমণি। বয়সে তিনি আমাদের সবার বড় হলেও হাসিঠাট্টায় আমরা সেদিন পৌঁছে গিয়েছিলাম সমসাময়িকতার স্তরে। মনে আছে রাহমান ভাই ঐ আড্ডাটা খুব উপভোগ করেছিলেন। উপভোগ করেছিলাম আমরাও। আড্ডা শেষে সবাই যে যার ঢেঁড়ায় ফিরব। 'মাতোয়ালা' রাহমান ভাইকে বোধহয় সাবের ভাই পৌঁছে দিয়েছিলেন। মিলন ভাইয়ের তখন একটা কী গাড়ি যেন ছিল। সম্ভবত ভক্সওয়াগন? নিশ্চিত নই। যাইহোক, সবশেষে আমি আর মিলন ভাই বেরুচ্ছি। হঠাৎ মিলন ভাই জিজ্ঞেস করলেন, রাজু কোথায় থাক?
আমি তো অনেক দূরে থাকি, সেই কুড়িলে, মিলন ভাই।
এত রাতে তুমি ফিরবা কীভাবে?
রিকসা, বেবিটেক্সি কিছু একটা পেয়ে যাব। আপনি চলে যান, মিলন ভাই।
না, না, তোমাকে এভাবে ছাড়া যায় না। গাড়িতে ওঠ, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আমি বাসায় ফিরব।
মিলন ভাই থাকেন তখন গেন্ডারিয়াতে। আমার বাসা থেকে তার বাসার দূরত্বটা আমি ভালো করেই জানি। ঢাকার একেবারে উত্তর প্রান্তে আমাকে রেখে তারপরে তিনি যাবেন ঢাকার প্রায় দক্ষিণ প্রান্তে। রাত যে তখন খুব বেশি হয়েছিল তা নয়, তবে একেবারে কমও নয়। আর আমিও এতটা মাতাল ছিলাম না যে 'দেয়ালে দেয়াল কার্নিশে কার্নিশ' হয়ে যাবে। আমার মৃদু আপত্তি উপেক্ষা করে তিনি ঠিকই আমাকে তার গাড়িতে করে বাসায় নামিয়ে দিলেন। কুড়িল তখন এতটা গমগমে শহর হয়ে ওঠেনি। মৃদু আলো আর শহরতলীর এক মিশ্র এলাকা। ফলে রাত খুব বেশি না হলেও সময় তখন মধ্য রাত অতিক্রম করে ঝুঁকে পড়েছে পরবর্তী দিনের শৈশবে। আমি সেদিন সৌজন্যকিরণ মানুষ মিলন ভাইয়ের প্রশ্রয়ী ও পৌর পরিচয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এ ধরনের সৌজন্যবোধ আমাদের মধ্যে খুব কম লেখকের মধ্যেই আমি দেখেছি। দেখেছি কী, দেখিই নি। বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি তখনও যেমন ছিল না, এখনও খুব একটা নেই। কিন্তু বিদেশফেরতদের মধ্যে এটা আমি লক্ষ্য করেছি। এর কারণ কি এই যে বিদেশে অন্য কারোর গাড়ি না থাকলে তাকে আড্ডার সঙ্গীদের কেউ না কেউ এই দায়িত্বটি স্বেচ্ছায় ও সাংস্কৃতিক বোধ থেকে নিয়ে নেন? আমাদের মধ্যে তো সেই সংস্কৃতি নেই, ফলে দায়িত্বের বালাইও থাকার কথা নয়। কিন্তু বিদেশ ঘুরে এলেও আমরা বিদেশের ইতিবাচক দিকগুলোর অনুশীলন করতে বিমুখ হই যদি তা নিজেদের আরাম ও আয়েশের বিপক্ষে যায়। মিলন ভাই ওই আরাম ও আয়েশের বিপক্ষে গিয়েই সেদিন আমার মতো অনুজ ও প্রাকৃতজনকে ঢেঁড়ায় পৌঁছে দেবার দায়িত্ব বোধ করেছিলেন। আমি তখনই জানতাম যে তিনি পরাধীনতা উপন্যাসটি লিখেছেন জার্মাানিতে থাকার সময়ে। সেখানকার আরামের জীবনে থাকা সত্ত্বেও পরাধীনতাকে উপলদ্ধি করেছিলেন বলেই দ্রুতই দেশে ফিরে এসেছিলেন, কিন্তু সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন পরদেশি ওই সৌজন্যবোধ।

তবে মিলন ভাইয়ের সাথে এই স্মৃতির বাইরেও আমার আরেকটা সম্পর্ক ছিল। সেটাও এখানে বয়ান করা উচিৎ।
মিলন ভাইয়ের একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম ১৯৯৮ সালের অক্টোবরে। তিনি ততদিনে জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত লেখক। ফলে সাক্ষাৎকার নেয়ার মধ্যে আমার কোনো কৃতিত্ব ছিল না, তার কৃতিত্বই আমাকে তার কাছে নিয়ে গেছে। এবং এও স্বীকার করা উচিৎ যে আমি পাঠক-জীবনের শুরুতে তার গল্প পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমার কৈশোর কেটেছে পুরান ঢাকার স্বামীবাগে। সেখান থেকে হেটে হেটে চলে আসতাম বাংলাবাজারের বইয়ের দোকানগুলোয় বইয়ের আকর্ষণে। সেখান থেকেই কিনেছিলাম তার প্রেমের গল্প বলে একটি বই। ওই বইয়ের কয়েকটি গল্প আমার কৈশোর জীবনের অনুভূতিকে আচ্ছন্ন করেছিল। তার পরাধীনতা নামক উপন্যাসটি পড়ে এতটাই আলোড়িত হয়েছিলাম যে আমার সত্যি সাত্যি জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে হয়েছিল তিনি আসলেই ওই উপন্যাসের নায়ক কিনা। কিন্তু সাক্ষাতের পরেও তার কাছে শেষ পর্যন্ত আর জানার সুযোগ হয়নি। আর এখন এই পরিণত বয়সে জানার ইচ্ছেও নেই এই কারণে যে একজন লেখক, নিজের অভিজ্ঞতাই হোক আর অন্যের অভিজ্ঞতা থেকেই হোক—লেখার জন্য তিনি যে-কোনো জায়গা থেকেই উপাদান সংগ্রহ করতে পারেন। সেই উপাদানের উৎস ও সত্যতা সম্পর্কে জানাটা তেমন জরুরী নয়। জরুরী হচ্ছে সেই অভিজ্ঞতাকে তিনি কতটা শৈল্পিক সুষমায় মণ্ডিত করতে পারছেন। মিলন ভাই সেই জায়গাটিতে খুব সফল ছিলেন ওই উপন্যাসে। তার প্রেমের গল্প আমাকে ওই বয়সে যে-ভাবে প্লাবিত করেছিল তা এখনও আমার পরিণত মনকে পরাজিত করে। এরপর তার আরও গল্প ও উপন্যাস পড়েছি। তিনি আখ্যান রচনায় অতুলনীয়। হয়তো এই কারণে তিনি — অনেকে সময়ের সাথে মিলিয়ে দেখেন না বলেই হয়তো জানেন না—-স্বাধীনতার পর তিনিই প্রথম জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। হুমায়ুন আহমেদ কিন্তু তার বেশ কয়েক বছর পরে। এবং এটাও উল্লেখ করা উচিৎ যে হুমায়ুন আহমেদ যদি বিটিভিতে তার নাটক নিয়ে হাজির না হতেন তাহলে জনপ্রিয়তার জন্য কত সময় অপেক্ষা করতে হতো কে জানে। যদিও এটা অস্বীকার করা যাবে না যে তার মধ্যে জনপ্রিয়তার উপাদান ছিল না। ছিল তো অবশ্যই । অতএব বিটিভির সূত্রে না হলেও, তিনি নিশ্চয়ই জনপ্রিয় হতেন। কিন্তু ঐতিহাসিক তথ্য ও সত্য এই যে ইমদাদুল হক মিলন জনপ্রিয় হয়েছিলেন বিটিভির বদৌলতে নয়, তার নিজের লেখার সূত্রেই। আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেটা হয়, অন্য দেশেও যে হয় না – তা নয়, তবে পার্থক্য এই যে বাংলাদেশে কোনো রকমের তদন্ত ও সাহিত্যবোধ ছাড়াই জনপ্রিয় লেখককে নস্যাস করে দেয়া। মিলন ভাইয়ের ক্ষেত্রেও সেরকম ঘটতে দেখেছি। তাতে ফু দিয়ে প্রত্যাখ্যানের আগুনকে আরও উস্কে দিয়েছেন তথাকথিত সিরিয়াস লেখকদের কেউ কেউ। কিন্তু মিলন ভাই ওসব তোয়াক্কা করেন নি কখনো। তিনি প্রায় নির্বিকার থেকেই লিখে গেছেন।


মিলন ভাইয়ের লেখার প্রতি আমার অনুরাগ যেমন আছে, তেমনি ব্যক্তি মানুষটির প্রতিও রয়েছে আমার গভীর অনুরাগ। তার মধ্যে কোনো ভনিতা নেই, নেই পাণ্ডিত্যের অহমিকা । বাংলা সাহিত্য নিয়ে তিনি যে দখল নিয়ে কথা বলতে পারেন তা আমাদের অনেক লেখকই বলতে পারেন কিনা সন্দেহ। বিদেশি সাহিত্য নিয়ে তার কেবল আগ্রহ নয়, রীতিমত বিশ্লেষী মনের এক কৌতূহল আমি দেখেছি। তিনি যেহেতু তার পাঠ ও পাণ্ডিত্য নিয়ে কোনো প্রবন্ধ লেখেন না, ফলে সেই পাঠের কোনো পলি কেউ দেখতে পান না। কিন্তু আড্ডায় তিনি ফুল্ল হয়ে উঠলে সেই পলির উর্বরতাকে মনস্বী ও সংবেদনশীল পাঠকমাত্রই আঁচ করতে পারেন। সেটা যে পারেন তার একটা উদাহরণ হচ্ছে হুমায়ুন আহমেদের সাথে তার পুস্তকদীর্ঘ সাক্ষাৎকারের বইটি। ওটায় তিনি কেবল লেখক নন, পাঠকের গভীর কৌতূহল ও অধিকার নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন আরেক জনপ্রিয় লেখকের। তিনি পাঠের যে-পুঙ্খানুপুঙ্খতা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন তাতে করে আমার মনে হয়েছে তিনি বাংলা কথাসাহিত্য গভীরভাবে অধ্যায়ন করেছেন। আর আমরা তো জানি, আপনি কখনোই নতুন কিছু করতে পারবেন না যতক্ষণ না আপনি আসলেই গভীরভাবে কোনো কিছু পাঠ ও উপলব্ধি করছেন। মিলন ভাইয়ের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা মহৎ সাহিত্য রচনা অনুধাবনে খুব সাহায্য করেছে বলে আমার বিশ্বাস।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক ইমদাদুল মিলন আজ ৬৪ বছরে পা দিয়েছেন। তিনি শতবর্ষ পেরিয়ে সৃজনী শক্তি ও আয়ুর দৈর্ঘে আরও বিস্তৃত হোন– এই কামনা করি। আপনাকে আলিঙ্গন, প্রিয় লেখক।