বিজ্ঞানবিষয়ক বই দেখলে অনেকেই মনে করে নাস্তিকের বই

অলাত এহ্সান
Published : 22 Feb 2021, 06:52 AM
Updated : 22 Feb 2021, 06:52 AM

বাংলাদেশের অস্তিত্বের মূলে ছিল বাংলা ভাষার অধিকার। এই অধিকারের জন্য শহীদ হয়েছিলেন বাংলার বীর সন্তানেরা। তাদের স্মৃতিকে জাগ্রত রাখার লক্ষ্যে শুরু হয়েছিল ফেব্রুয়ারি মাসকে নানান অনুষ্ঠান ও মেলায় রাঙিয়ে তোলা। মাসব্যাপী বইমেলা তারই এক অনন্য রূপ। এটি আমাদের সাংস্কৃতিক আ্ত্মপরিচয়েরও এক প্রকাশ যেখানে লেখক, পাঠক ও প্রকাশকের মিলন ঘটে। কিন্তু কোভিড ১৯-এর কারণে এবারের বইমেলা ফেব্রুয়ারিতে না হয়ে, জনগণের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে মার্চের ১৮ তারিখে শুরু হতে যাচ্ছে। শত শত প্রকাশকের অংশগ্রহণে মুখরিত বইমেলা আমাদের মন ও মননের এক নান্দনিক অভিব্যক্তি। গত কয়েক বছর ধরে কম করে হলেও প্রতি বছর চার হাজার নতুন বই প্রকাশিত হচ্ছে। গতবছর প্রকাশিত হয়েছিল পাঁচ হাজারের মতো নতুন বই। কিন্তু বাংলা একাডেমির মতে এর সবটাই মানসম্পন্ন নয়। বড় জোর সাড়ে সাত শ' বইকে তারা মানসম্পন্ন বই বলে মনে করেন। প্রতি বছরই মেলায় বইয়ের বিক্রি বাড়লেও লেখকরা তাদের রয়ালটি ঠিকমত পাচ্ছেন কিনা, তার কোনো বিধিবদ্ধ রূপ আদৌ আছে কিনা তা অনেক লেখকেরই জানা নেই্। বই উৎপাদনের ক্ষেত্রে মান রক্ষায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে– এই বিষয়টিও বুদ্ধিদীপ্ত পাঠকদের একটি প্রধান কৌতূহল। করোনা ভাইরাস প্রকাশনাশিল্পকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে তা আমাদের কাছে অনেকটাই অজানা। বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকম-এর পক্ষে তরুণ গল্পকার অলাত এহসান এসব কৌতূহল ও প্রশ্ন নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকাশকদের। প্রতি পর্বে মোট পাঁচজন প্রকাশকের অভিমত প্রকাশিত হচ্ছে গোটা ফেব্রুয়ারি মাসে। আজ প্রকাশিত হচ্ছে চতুর্থ পর্ব। এতে অংশগ্রহণ করেছে চন্দ্রাবতী একাডেমি, বাতিঘর, চৈতন্য, চন্দ্রবিন্দু এবং উজান প্রকাশনী। বি.স

'মেলার উপর ছোট-বড় সব ধরনের প্রকাশনা সংস্থাই নির্ভর করে'
কামরুজ্জামান খন্দকার, প্রকাশক, চন্দ্রাবতী একাডেমি

বিডিনিউজ: গতবছর গ্রন্থমেলার পরই দেশে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরু; এই প্রভাব এখনও আছে। পুস্তক ব্যবসায়ের উপর করোনার প্রভাব কীভাবে পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
কামরুজ্জামান খন্দকার: লকডাউন চলা সময়ে বা বলা যেতে পারে, করোনার প্রভাবে মানুষের গৃহবন্দী সময়ে অনেকেই আবার বই পড়ার দিকে মনোযোগী হয়েছেন। অনেকেই ঘরে থাকা বিখ্যাত বইগুলো পড়েছেন। আমি বলতে চাই, বই পড়ার অভ্যাস ফিরে এসেছে অনেকের ভেতর। দীর্ঘমেয়াদে এই অভ্যাসটি পুস্তক ব্যবসায়ের অনুকূলে যাবে। তবে সরাসরি বইয়ের দোকানে ঘুরে ঘুরে বই কেনার আনন্দ থেকে অনেকেই বঞ্চিত হয়েছেন। অনলাইনে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বই বিক্রি করেছে। বইয়ের বাজারে অনলাইনে কেনাবেচা অবশ্যই একটা ইতিবাচক অবস্থা সৃষ্টি করবে।

বিডিনিউজ : আগে থেকেই বই বিপণনের সঙ্গে সাধারণ মানুষের একটা দূরত্ব ছিল। করোনায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা সীমিত হয়েছে। সব মিলিয়ে বইয়ের বিপণন, প্রচার আর পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে চন্দ্রাবতী একাডেমি কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে?
কামরুজ্জামান খন্দকার: বই বিপণনের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দূরত্ব চিরকাল ছিল না। এক সময় পাঠকরা বই কিনতেন বা লাইব্রেরি থেকে নিয়ে পড়তেন। বর্তমানে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রভাবে অনেকেই বই পড়ার প্রতি অনেকটা অমনোযোগী হয়েছেন। করোনাকালে বইয়ের বাজারজাত বা ব্যাপক প্রচার করার কোনো সুযোগ ছিল না। তবে ফেসবুকের মাধ্যমে কিছুটা প্রচার চলেছে।

বিডিনিউজ : বই প্রকাশের ব্যাপারে নীতিমালা নিয়ে প্রায়ই কথা উঠে। লেখক-প্রকাশক সম্পর্ক তিক্ততায় গড়ায়, মনোযোগী পাঠকের অতৃপ্তি থেকে যায়। যেমন, লেখকের সঙ্গে চুক্তি করা, তাদেরকে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রিত বইয়ের হিসেব বুঝিয়ে দেয়া, বিদেশী বইয়ের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন লাভ করা— এসব কি আপনাদের জন্য বাণিজ্যিকভাবে অনুকূল? আপনার প্রকাশনা এসব কি মেনে চলছে?
কামরুজ্জামান খন্দকার: একটি ভালো বই প্রকাশের ব্যাপারে লেখক এবং প্রকাশক— কারো অবদানই ছোটো করে দেখার উপায় নেই। একটি ভালো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কখনও লেখককে ঠকানোর চিন্তা করবে না। তাই প্রচলিত আইন মেনে লেখকের সাথে চুক্তি করা এবং বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে লেখককে হিসাব বুঝিয়ে দেওয়া খুবই প্রয়োজন। তবে করোনার সময়ের মতো অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বই বিক্রি না হলে, সে বিষয়টিও লেখককে বুঝতে হবে।
বিদেশী বই অনুবাদ করে বের করতে হলে অবশ্যই প্রকাশকের অনুমোদন প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে নির্ধারিত রয়্যালটি দিয়ে বইটি প্রকাশ করলে তা লাভজনক হবে কিনা, তা আগেই ভালো করে পরীক্ষা করতে হবে।

বিডিনিউজ : বই মানসম্পন্ন করতে সম্পাদনার বিকল্প নেই। প্রকাশনা সংস্থাগুলোতে নিজস্ব একটা সম্পাদনা পরিষদ থাকা জরুরি পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ে। এ নিয়ে প্রায়ই লেখকদের আক্ষেপ করতে দেখা যায়। চন্দ্রাবতী একাডেমি এটা কীভাবে করছে।
কামরুজ্জামান খন্দকার: বইয়ের মান নির্ভর করে সম্পাদনার মানের উপর। চন্দ্রাবতী একাডেমি জন্মলগ্ন থেকেই দেশের সেরা সম্পাদকদের নিয়ে কাজ করছে। পাণ্ডুলিপি নির্বাচন এবং প্রকাশনার প্রতিটি পর্যায়ে অভিজ্ঞ সম্পাদকগণ চন্দ্রাবতী একাডেমি'র বইয়ে কাজ করে থাকেন। ফলে আমাদের প্রকাশনার মান সাধারণভাবেই হয়ে থাকে উন্নত।

বিডিনিউজ : প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে যে বইমেলা হয়, তার উপর নির্ভর করে অনেক ছোট ছোট প্রকাশনী বিপণনের নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবনে বিমুখ হয়ে আছে। এটা কি প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য হুমকি নয়? আপনাদের মতো বড় বড় প্রকাশনীও এই মেলায় বিক্রি হওয়ার উপর খুব বেশী নির্ভর করেন?
কামরুজ্জামান খন্দকার : একুশের বইমেলা বাংলাদেশে একটি বড় উৎসব। ছোট ছোট প্রকাশনী এই মেলার উপর নির্ভর করে অনেক বই প্রকাশ করে থাকে। তাদের বই বিক্রি হয়। আর বড় প্রকাশনীগুলোর বই সারা বছর বিক্রি হলেও মেলায় প্রকাশনা সংস্থার এবং প্রকাশিত বইয়ের পরিচিতি পাঠকদের কাছে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিবেচনায় মেলার উপর ছোট-বড় সব ধরনের প্রকাশনা সংস্থাই নির্ভর করে।

বিডিনিউজ : চন্দ্রাবতী একাডেমি ইতিমধ্যে দুই শতাধিক গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। এত সংখ্যক বই প্রকাশ করতে গিয়ে গুণ ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদ্ধতি আপনারা অবলম্বন করেন?
কামরুজ্জামান খন্দকার: বইয়ের মান বইয়ের সংখ্যার ওপর নির্ভর করে না; মানসম্পন্ন বই প্রকাশের জন্য আন্তরিকতার ওপর নির্ভর করে। তাছাড়া, আমরা কখনোই আমাদের সাধ্যের বাইরে যাই না। আমাদের প্রকাশনার প্রধান ব্রত হচ্ছে মানসম্পন্ন বই বের করা। এক্ষেত্রে আমরা কোনোভাবেই আপোস করি না। চন্দ্রাবতী একাডেমি'র সব প্রকাশনাই মানসম্পন্ন। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, মানসম্পন্ন বই প্রকাশ করায় আমরা পর পর তিন বছর বাংলা একাডেমি থেকে 'রোকুনুজ্জামান খান দাদাভাই পুরস্কার' ও 'মুনীর চৌধুরী পুরস্কার' পেয়েছি।

বিডিনিউজ : চন্দ্রাবতী একাডেমি এ বছর কী কী বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে?
কামরুজ্জামান খন্দকার: শিশুতোষ, প্রবন্ধ, জীবনী, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে বই বেরুবে।

বিডিনিউজ : বহু প্রকাশক গত বছর থেকে বঙ্গবন্ধুর উপর প্রচুর বই বের করেছেন এবং আরো করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। এ বিষয়ে আপনারা কী কী গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন?
কামরুজ্জামান খন্দকার: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপর আমরা বেশ কিছু বই প্রকাশ করেছি এবং ভবিষ্যতে আরো বই প্রকাশ করতে যাচ্ছি।

বিডিনিউজ : প্রতিবছর গ্রন্থমেলায় প্রচুর বই থাকে সেবারই প্রথম। এর মান নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। বড় প্রকাশনীর একটা দায় থাকে সম্ভাবনাময় তরুণ লেখককে তুলে আনার। সেক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা করা, পত্রিকার লেখা দেখে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। আপনি কীভাবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে নির্বাচন করেন?
কামরুজ্জামান খন্দকার: সম্ভাবনাময় তরুণ লেখকদের তুলে আনার দায় অবশ্যই প্রকাশকদের আছে। তবে এক একটি প্রকাশনা সংস্থার পদ্ধতি এক এক রকম। আমরা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত লেখা বিবেচনা করে বা প্রকাশিত বই দেখে তরুণদের উৎসাহিত করি। এ ব্যাপারে আমাদের প্রতিষ্ঠানের পাণ্ডুলিপি নির্বাচন কমিটি সারাবছর ধরেই কাজ করে।

বিডিনিউজ : বাংলাদেশে প্রকাশনা-শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে কী কী বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন?
কামরুজ্জামান খন্দকার: বাংলাদেশে প্রকাশনা শিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রে তেমন কোনো বাধা আছে বলে আমি মনে করি না। তবে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার এই যুগে বা এর বিকাশলগ্নে প্রকাশনা শিল্পে একটু পশ্চাদমুখীভাব দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। সময়ের আবর্তে এই বাধা দূর হবে বলেই আমি মনে করি। মুদ্রিত বইয়ের আবেদন কখনও শেষ হয়ে যাবে না। বইয়ের আবেদনের ক্ষেত্রে একটা উঠানামার অবস্থা চলবে। সম্ভবত এখন বইয়ের চাহিদা আবার ঊর্ধ্বমুখে যাচ্ছে।
বিডিনিউজ : প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আপনার কি কোনো প্রস্তাব আছে?
কামরুজ্জামান খন্দকার: পৃথিবীর অন্য দেশে প্রতিটি শহরের কেন্দ্রে একটি করে সুবৃহৎ লাইব্রেরি থাকে। পাঠকরা, বিশেষ করে শিশুরা এসব লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়ে, আবার কিনে আনে। আমাদের দেশে এই ব্যবস্থাটি নেই। এক্ষেত্রে সরকার সহজেই এই উদ্যোগটি গ্রহণ করতে পারে। এতে প্রকাশনা শিল্প স্বাভাবিকভাবে বিকাশ লাভ করবে বলেই আমি মনে করি।
বিডিনিউজ : ধন্যবাদ, কামরুজ্জামান ভাই, আন্তরিক সময় দেয়ার জন্য।
কামরুজ্জামান খন্দকার: আপনাকেও আন্তরিক ধন্যবাদ।

'লেখকরা প্রকাশককে মোটেও সময় দিতে আগ্রহী নন'
দীপঙ্কর দাশ, প্রকাশক, বাতিঘর


বিডিনিউজ: করোনার প্রভাব পুস্তক ব্যবসার ওপর কিভাবে পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
দীপঙ্কর দাশ: অন্যান্য ব্যবসার মতো বইয়ের জগতেও করোনা মহামারির ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এমনিতেও আমাদের দেশে সৃজনশীল বইয়ের বাজার খুব বেশি বড় নয়। প্রকাশক ও বই বিক্রেতাদের মধ্যে বেশিরভাগই ক্ষুদ্র পুঁজির ব্যবসায়ী। করোনাকালে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক প্রকাশক রীতিমতো পুঁজি হারিয়ে ফেলেছেন! এর চেয়ে ভয়াবহ প্রভাব আর কি হতে পারে।

বিডিনিউজ: বইয়ের বিপণন, প্রচার আর বইকে পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে বাতিঘর কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে?
দীপঙ্কর দাশ: পাঠকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমেই মূলত বাতিঘর 'র যাত্রা শুরু হয়। ২০০৫ সালে চট্টগ্রামে মাত্র ১০০ বর্গফুট স্পেসে শুরু করার পর ১৪ বছরে দেশের তিনটি প্রধান শহরে বড় পরিসরে বাতিঘর বিক্রয়কেন্দ্র চালু হয়েছে। এছাড়া বাংলাবাজারে বাতিঘর প্রকাশনা বিভাগের বিক্রয়কেন্দ্র আছে। সারাদেশের পাঠকদের জন্য আমরা অনলাইনে বই বিক্রির কাজও ইতোমধ্যে শুরু করেছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবিধা নিয়ে বাতিঘর পাঠকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করছে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, ফেসবুকে বইপ্রেমীদের প্রচারের কারণে বাতিঘর'র বইয়ের সংগ্রহের খবর পাঠকদের কাছে দ্রুত ছড়িয়েছে।

বিডিনিউজ: বইপ্রকাশের ব্যাপারে যেসব নীতিমালা— যেমন লেখকের সঙ্গে চুক্তি করা, তাদেরকে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রিত বইয়ের হিসেব বুঝিয়ে দেওয়া, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন লাভ করা— এসব কি আপনাদের জন্য বাণিজ্যিকভাবে অনূকূল? আপনার প্রকাশনী কি এসব মেনে চলছে?
দীপঙ্কর দাশ: বইয়ের বিক্রয়কেন্দ্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বাতিঘর'র অভিজ্ঞতা প্রায় দেড় যুগ হতে চলেছে। কিন্তু প্রকাশক হিসেবে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছে মাত্র কয়েকবছর আগে। শুরুতে আমাদের প্রকাশনা বিভাগে পূর্ণকালীন একজন কর্মীও ছিলেন না। গত বছর থেকে মূলত আমরা প্রকাশনা বিভাগের সাংগঠনিক রূপ দেয়ার উদ্যোগ নিই। কিন্তু করোনা মহামারীর কারণে আমাদের এই উদ্যোগ থেমে যায়। চলতি বছর থেকে আমরা আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। বই প্রকাশের ব্যাপারে আমরা একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছি। এটা করতে পারলে আমরা লেখকের সঙ্গে চুক্তি, রয়্যালটি, বিদেশি বইয়ের ক্ষেত্রে অনুমতি বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কাজ করতে পারব বলে আশা করছি। বর্তমানে আমরা এসব বিষয়ে ১০০ ভাগ সফল একথা বলব না। তবে আমাদের আন্তরিক চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

বিডিনিউজ: বই মানসম্পন্ন করতে সম্পাদনার বিকল্প নেই। প্রকাশনা সংস্থাগুলো নিজস্ব একটা সম্পাদনা পরিষদ থাকা জরুরি পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ে। বাতিঘর এটা কিভাবে করছে?
দীপঙ্কর দাশ: বাংলাদেশে সৃজনশীল প্রকাশনার জগৎ খুবই ছোট। বেশিরভাগ প্রকাশকের মতো আমাদেরও সাংগঠনিক কাঠামো পরিপূর্ণ নয়। পাণ্ডুলিপি যাচাই বাছাই ও সম্পাদনার বিষয়টি শুধুমাত্র প্রকাশকের আগ্রহের ওপর নির্ভর করে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লক্ষ্য করি, লেখকরা এজন্য প্রকাশককে মোটেও সময় দিতে আগ্রহী নন। কিন্তু একটি মানসম্পন্ন বই প্রকাশের জন্য অবশ্যই আমাদেরকে সময় দিতে হবে। সময় ছাড়াও বই সম্পাদনার ক্ষেত্রে আর্থিক বিষয় জড়িত। পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাই আর সম্পাদনার জন্য ইতোমধ্যে আমরা কয়েকজন সম্পাদককে যুক্ত করেছি। কাজের ওপর ভিত্তি করে তাদের সম্মানী দেওয়া হয়।

বিডিনিউজ: বাংলাদেশে প্রকাশনা-শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে কী কী বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন?
দীপঙ্কর দাশ: বাংলাদেশে প্রকাশনা এখনও শিল্পের মর্যাদা পায়নি। আমাদের পাঠক সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। একটি অগ্রসর পাঠকগোষ্ঠী তৈরি করতে না পারলে প্রকাশনার কোনো মর্যাদা তৈরি হবে না। হাতে গোনা কয়েকজন বাদে বেশিরভাগ লেখকের বইয়ের বিক্রি আশানুরূপ নয়। বইয়ের বিক্রি বাড়ানোর জন্য শুধু প্রকাশকদের উদ্যোগ বিশেষ সুফলতা বয়ে আনতে পারবে না। এজন্য গ্রন্থনীতি প্রণয়নসহ সরকারকে পাঠাগার আন্দোলন বাস্তবায়নের জন্য উৎসাহী হতে হবে। স্কুল পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বই পাঠে উৎসাহী করে তুলতে হবে। তাতে শুধু বই বিক্রি বাড়বে— তা নয়; পুরো জাতিরই মানসিক বিকাশ ঘটবে। এর ইতিবাচক ফল হবে খুবই সুদূরপ্রসারি।

বিডিনিউজ:
প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে যে-বইমেলা হয়, তার ওপর নির্ভর করে অনেক ছোট ছোট প্রকাশনী বিপণনের নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবনে বিমুখ হয়ে আছে। এটা কি প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য হুমকি নয়? আপনাদের মতো বড় বড় প্রকাশনীও কি এই মেলায় বিক্রি হওয়ার ওপর খুব বেশি নির্ভর করেন?
দীপঙ্কর দাশ: বাংলাদেশে বছরজুড়ে যে পরিমাণ বই প্রকাশিত হয় তার ৮০ ভাগ প্রকাশিত হয় একুশে বইমেলার সময়। বছর জুড়ে যে পরিমাণ বই বিক্রি হয় তার প্রায় এক তৃতীয়াংশ বিক্রিও হয় বইমেলায়। তবে কোনো কোনো প্রকাশনা সংস্থা এর ব্যতিক্রম।
আমরা বছরজুড়ে বই প্রকাশ করার চেষ্টা করছি। এক্ষেত্রেও কতগুলো সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রথমত লেখকদের কাছ থেকে পাণ্ডুলিপি পাওয়ার সমস্যা। বইমেলাকে সামনে রেখে পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন তারা। পাণ্ডুলিপি পাওয়ার পর সময় স্বল্পতার কারণে মেলায় বই প্রকাশ করা সম্ভব হবে না জানালে অনেক লেখক পাণ্ডুলিপি তুলে নেন। এক মাস আগে দেয়া পাণ্ডুলিপি মেলায় বই আকারে বেরোবে না, এটা শুনলে কোনো কোনো লেখক অসুস্থ হয়ে পরতে পারেন। প্রকাশকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারেন চিরতরে। দ্বিতীয়ত একুশে বইমেলার সময় গণমাধ্যমে বইয়ের যেভাবে প্রচার হয় বছর জুড়ে তেমনটি হয় না।

বিডিনিউজ: বাতিঘর ইতিমধ্যে দুইশতাধিক গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। এতো সংখ্যক বই প্রকাশ করতে গিয়ে গুণ ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদ্ধতি আপনারা অবলম্বন করেন?
দীপঙ্কর দাশ: আমাদের প্রকাশনার সংখ্যা খুব বেশি নয়। বেশি বই প্রকাশ করার সাংগঠনিক সামর্থ্য আমাদের নেই। বইয়ের মানের প্রতি নজর দিতে গিয়ে গত এক বছরে আমাদের নতুন প্রকাশনার সংখ্যা কমে গেছে।

বিডিনিউজ: বাতিঘর এ বছর কী কী বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে?
দীপঙ্কর দাশ: ২০২০ সালের বইমেলার পর বাতিঘর ১৭টি বই প্রকাশ করেছে। ২০টির মতো বই প্রকাশের পথে। এর মধ্যে রয়েছে রিজওয়ানুল ইসলামের 'করোনাঘাতে অর্থনীতি ও শ্রমবাজার', মহিউদ্দিন আহমদের 'লাল সন্ত্রাস : সিরাজ সিকদার ও সর্বহারা রাজনীতি', আবদুল্লাহ জাহিদের 'বিশ্ব সংবাদপত্রে স্বাধীনতা যুদ্ধ', জাভেদ হুসেন অনূদিত 'সন্ত কবীরের দোহা', আনোয়ার হোসাইন মঞ্জুর অনুবাদে জহির দেহলভির 'দাস্তান-এ-গদর : সিপাহি বিদ্রোহের প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান', মোস্তাক শরীফের উপন্যাস 'নেফারতিতি', রাশিদা সুলতানার উপন্যাস 'মধুবার'।

বিডিনিউজ: বহু প্রকাশক গত বছর থেকে বঙ্গবন্ধুর উপর প্রচুর বই বের করেছেন এবং আরো করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। এ বিষয়ে আপনারা কী কী গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন?
দীপঙ্কর দাশ: বঙ্গবন্ধু বিষয়ক কয়েকটি বই বেরুবে এ বছর, তবে সময় লাগবে। বইয়ের নাম এখনই বলা ঠিক হবে না। ইতিমধ্যে বেরিয়েছে আবুল ফজলের 'শেখ মুজিব : তাঁকে যেমন দেখেছি', মহিউদ্দিন আহমদের 'ইতিহাসের যাত্রী' ও '৩২ নম্বর পাশের বাড়ি' 'বেলা-অবেলা : বাংলাদেশ ১৯৭২-১৯৭৫'।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর গ্রন্থমেলায় প্রচুর বই থাকে সেবারই প্রথম। এর মান নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। বড় প্রকাশনীর একটা দায় থাকে সম্ভাবনাময় তরুণ লেখককে তুলে আনার। সেক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা করা, পত্রিকার লেখা দেখে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। আপনি কিভাবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে নির্বাচন করেন?
দীপঙ্কর দাশ: তরুণ লেখকদের মধ্যে অনেকের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে। এর বাইরেও তরুণরা অনেক সময় ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করেন। আমরা পাণ্ডুলিপি যাচাই বাছাইয়ের মাধমে কিছু বই প্রকাশ করার চেষ্টা করি। তরুণ লেখকদের বেশ কিছু বই করেছে বাতিঘর। বেশ কয়েকজন তরুণের সঙ্গে কথা হয়ে রয়েছে। তারা বাতিঘরেরর জন্য পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করছেন।

বিডিনিউজ: প্রকাশনাশিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আপনার কি কোনো প্রস্তাব আছে?
দীপঙ্কর দাশ: আগেই বলেছি, প্রকাশনা আমাদের দেশে শিল্পের মর্যাদা পায়নি। বইয়ের পাঠক এবং ক্রেতা বাড়ানো না গেলে প্রকাশনা ব্যবসা হিসেবে ক্ষুদ্র শিল্পের মর্যাদা পাওয়া কঠিন হবে। এজন্য সরকারকে গ্রন্থনীতি প্রনয়ণ, শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ নানামুখি পদক্ষেপ নিতে হবে। লেখকদের লিখতে হবে সারা বছর। বছরের যেকোনো সময় বই প্রকাশিত হতে পারে— এটা তাদের মেনে নিতে হবে। এবং একটি পাণ্ডুলিপি বই হয়ে বাজারে যেতে সময় লাগে–এটা সব পক্ষকে উপলব্ধি করতে হবে।

বিডিনিউজ : ধন্যবাদ, দীপঙ্কর দা', আন্তরিক সময় দেয়ার জন্য।
দীপঙ্কর দাশ : ধন্যবাদ আপনাকেও।

'আগে মুক্ত চিন্তার প্রসার ঘটুক'
জাহিদুর রহমান চৌধুরী রাজীব, প্রকাশক, চৈতন্য


বিডিনিউজ: গতবছর গ্রন্থমেলার পরই দেশে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরু। অর্থনীতি-জনজীবনে এই প্রভাব এখনো আছে। পুস্তক ব্যবসার উপর করোনার প্রভাব কিভাবে পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
রাজীব চৌধুরী: গতবছর গ্রন্থমেলা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আমরা দেখেছি করোনার প্রকোপ মহামারি রূপ নেয়। আমাদের দেশও লকডাউন-এ চলে যায়। মেলা শেষ হওয়ার পর বই বিক্রির যে ধারাবাহিকতা থাকে সেটা বন্ধ হয়ে যায় এবং দীর্ঘদিন সেটা অব্যাহত থাকে। অন্যসব ইন্ড্রাস্ট্রির মতো আমাদের প্রকাশনাও বিপর্যয় পড়ে। একদিকে বই বিক্রি নেই, অন্যদিকে অফিস, স্টাফের বেতন, সবকিছুকে টিকিয়ে রাখতে হিমশীম খেতে হচ্ছে। টিকে থাকার এই যুদ্ধে আমরা বিপর্যয় কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

বিডিনিউজ: করোনা শুরুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেককে প্রতিশ্রুতি করতে দেখেছি— যারা ব্যস্ততার কারণে বই পড়তে পারেন নি, তারা লকডাউন বা হোম অফিসের সুযোগে বিস্তর পড়বেন। অনলাইনে বই বিক্রি এই সময়ই সবচেয়ে বিস্তৃত হয়েছে। দিনশেষে তারা কেমন বই পড়েছেন তা বোঝার বড় উপায় বই কেমন বিক্রি হলো। প্রকাশক হিসেবে আপনার অভিজ্ঞতা কি?
রাজীব চৌধুরী: বিশ্বের অন্যান্য দেশে চেয়ে বই বিক্রি শতকরা হারের তুলনায় আমাদের দেশে অনেক কম। যারা আসলেই বই পড়েন, নিজের চাহিদা অনুযায়ী খুঁজে নেন, তাদের মধ্যে এই চর্চাটা ছিল। অনলাইন প্লাটফর্ম এক্ষেত্রে বিকল্প মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ই-বুক পড়ার প্রবণতার চেয়ে, প্রিন্টেড বই সংগ্রহ করে পড়ার প্রবণতাই বেশি। এইসময় প্রত্যেক প্রকাশনীকে দেখবেন নিজস্ব ওয়েব সাইট, পেইজ ও বিভিন্ন অনলাইন বুকশপ বই বিক্রির প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে।

বিডিনিউজ: আগে থেকেই বই বিপননের সঙ্গে সাধারণ মানুষের একটা দূরত্ব ছিল। করোনা তাকে আরো কঠিন করেছে মনে করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে বইয়ের বিপনন, প্রচার আর পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে চৈতন্য কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে?
রাজীব চৌধুরী: এটা ঠিক বলেছেন, বই বিপনন প্রচার আমাদের একটা বিরাট সমস্যা। এই অভিযোগ অসংখ্য পাঠক ও লেখকরা করে থাকেন। বিশেষ করে আমরা যারা সৃজনশীল মননশীল বই প্রকাশ করে থাকি। দেশে এই পর্যায়ের বইয়ে দোকানের অভাব, যারা এইসব বই বিক্রিতে আগ্রহী হবে। যেখানে বিভাগীয় শহরগুলোতেই সমস্যা সেক্ষেত্রে প্রান্তিক মফস্বল শহর অনেক দূরের। কিন্তু গত কয়েকবছর ধরে আর করোনার সময় থেকে পাঠকদের কাছে বই প্রকাশের সংবাদ ও বই বিক্রির শক্তিশালী প্লাটফর্ম এখন অনলাইন। এতে পাঠকরা সহজেই বই সম্পর্কে ও প্রাপ্তিস্থান সম্পর্কে জেনে নিতে পারছেন। যেহেতু চৈতন্যর নিজস্ব আউটলেট নেই, তাই নিজস্ব ফেসবুক পেইজ ও বিভিন্ন অনলাইন বুকশপের মাধ্যমে বই বিক্রি ও প্রচারের পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। তাছাড়া দেশের শীর্ষস্থানীয় বইবিপণী বাতিঘর ও নির্বাচিতর সকল শাখায় চৈতন্যর বই পাওয়া যায়।

বিডিনিউজ: বইপ্রকাশের ব্যাপারে নীতিমালা নিয়ে প্রায়ই কথা উঠে। লেখক-প্রকাশক সম্পর্ক তিক্ততায় গড়ায়, মনোযোগী পাঠকের অতৃপ্তি থেকে যায়। যেমন লেখকের সঙ্গে চুক্তি করা, তাদেরকে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রিত বইয়ের হিসেব বুঝিয়ে দেয়া, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন লাভ করা— এসব কি আপনাদের জন্য বাণিজ্যিকভাবে অনুকূল? বড় প্রকাশনী হিসেবে আপনার সুযোগ আছে সেই উদারহণ তৈরি করা। আপনার প্রকাশনী এসব কতটা মেনে চলছে?
রাজীব চৌধুরী: এক্ষেত্রে পুরোপুরি পেশাদারিত্বের অভাব আছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, এখানে প্রকাশনা পুরোপুরি শিল্প হয়ে উঠতে পারে নি। এখানে অনেকেই প্রকাশককে ছাপনেওয়ালা ভাবেন। একটা পাণ্ডুলিপিকে যেভাবে সম্পাদনা, রিভিউ, পাঠক যাছাই, প্রি-বুকিং ইত্যাদির মাধ্যমে দৃষ্টিনন্দন করা উচিত, সে চেষ্টা কম। তার অন্যতম কারণ স্বল্প সংখ্যক বই ছাপিয়ে এতসব আয়োজন বেশ খরচের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। চৈতন্য যতটুকু পারে, চেষ্টা করে যাচ্ছে— পাণ্ডুলিপি গ্রহণ, চুক্তি, হিসেব, রয়ালিটি ইত্যাদির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে।
অনুবাদের ক্ষেত্রে বাইরের প্রকাশনীগুলোর সাথে আমরা ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি বই-এর কপিরাইট নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কিনে এনেছি, অনুবাদ করিয়েছি, বাজারে ছেড়েছি। সেক্ষেত্রে মূল প্রকাশনীর মতো অনুবাদকের রয়ালিটিও আমরা প্রদান করেছি। আসলে এসব ক্ষেত্রে সবকিছুর পেশাদারিত্ব থাকা দরকার। সেটা থাকলে লেখক প্রকাশকের সম্পর্ক তিক্ততা নিঃসন্দেহ দূর হবে।

বিডিনিউজ: লেখকস্বত্ব নিয়ে লেখকদের ক্ষোভ বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি। বিষয়টা অনেক সময় সভা, আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। এ সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি, কোনো কোনো লেখক মনে করেন, লেখকদের সাথে প্রকাশকদের চুক্তি ও রয়্যালটি প্রদানের তথ্য যে-সব প্রকাশনীর নেই, সেসব বই বা প্রকাশনীকে বইমেলায় অংশগ্রহণের জন্য অযোগ্য বলে ঘোষণা করা। আপনি কি তাদের এই দাবীর সঙ্গে একমত? আপনার পরামর্শে এর সমাধান কী হতে পারে?
রাজীব চৌধুরী: এটা এই মুহূর্তে সম্ভব না। অযোগ্যতার এই মাপকাঠিতে গেলে অনেক প্রকাশনী অংশ নিতে পারবে না। এটা লেখক-প্রকাশকের একান্ত বিষয়। কোন অভিযোগ উঠলে, সেটা নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। তবে আমাদের এখন এসব ক্ষেত্রে প্রামাণিক কাগজপত্রের স্বচ্ছতার বিষয়টা অনেকে মেনে কাজ করতেছেন। আমরাও করতেছি।

বিডিনিউজ: বই মানসম্পন্ন করতে সম্পাদনার বিকল্প নেই। প্রকাশনা সংস্থাগুলো নিজস্ব একটা সম্পাদনা পরিষদ থাকা জরুরি পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ে। এনিয়ে প্রায়ই লেখকদের আক্ষেপ করতে দেখা যায়। চৈতন্য এটা কিভাবে করছে?
রাজীব চৌধুরী: সম্পাদনা, প্রুফ রিডিং, পাণ্ডুলিপি বাছাইয়ের একটা পরিষদ আছে আমাদের। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা গুরুত্বপূর্ণ পাণ্ডুলিপি লেখকদের কাছ থেকে খোঁজ করে চুক্তিতে যাই। কিছু নিজস্ব পছন্দের বিষয়ের উপর পাণ্ডুলিপির কাজ করাই। সেক্ষেত্রে চৈতন্য তরুণদের উপর অনেকটা আস্থাশীল।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে যে-বইমেলা হয়, তার উপর নির্ভর করে অনেক ছোট ছোট, স্বল্পস্থায়ী প্রকাশনী বিপণনের নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবনে বিমুখ হয়ে থাকে। এটা কি প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য হুমকি নয়? আপনাদের মতো বড় বড় প্রকাশনীও এই মেলায় বিক্রি হওয়ার উপর খুব বেশি নির্ভর করেন?
রাজীব চৌধুরী: কথাটা আংশিক সত্য আমাদের। তার একটা কারণ— বইমেলায় বইপ্রকাশ সংস্কৃতি অনেকদিন ধরে আমাদের। সেটা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। চৈতন্য সারাবছর বই প্রকাশ করে। বইমেলা একটা উপলক্ষ যেহেতু, আর সারা মাস থাকে, সেখানে যা বিক্রি তা অন্যসব ইভেন্ট-এর চেয়ে বেশি বিক্রি হয়।

বিডিনিউজ: চৈতন্য সিলেটের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। দেশের বড় শহর থেকেও ভাল প্রকাশনা হওয়া উচিত। বিপরীতে দেশের অনেক লেখক, বই বিপনন ব্যবস্থা ঢাকা কেন্দ্রিক। এক্ষেত্রে চৈতন্য কে কিছুটা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। এগুলো কেমন? আপনারা কিভাবে তা সমাধান করেন? দেশের বড় শহর থেকেও কিভাবে ভাল প্রকাশনা চলতে পারে?
রাজীব চৌধুরী: বই প্রকাশ এখন শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক বিষয় নয়। যেকোন জায়গা থেকে প্রকাশনা চালানো সম্ভব। সিলেট থেকে চৈতন্য একমাত্র প্রকাশনী যে ৭ বছর আগে পেশাদারিত্ব মনোভাব নিয়ে প্রকাশনা শুরু করেছে। বইয়ের গুণগত মান, বিষয় বৈচিত্র্য, প্রডাকশনকে সবাই সাধুবাদ জানিয়েছিল। আমরা সেই প্রেরণা থেকে আরো বৃহৎ পরিসরে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। সিলেট থেকে নিয়মিত বইমেলায় অংশ নিয়ে যাচ্ছি। শুরুতে প্রতিবন্ধকতা একমাত্র বিপণনে ছিল। সেটাও কাটিয়ে উঠেছি আমরা অনেকটা। সব মিলিয়ে ঢাকার বাইরে থেকে প্রকাশনার এই চ্যালেঞ্জিং পেশাটা আমাদের কাছে উপভোগ্য।

বিডিনিউজ: চৈতন্য ইতিমধ্যে সম্ভবত প্রায় পাঁচশ গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। চৈতন্য শুরু থেকে মননশীল ও মান সম্মত প্রকাশনার প্রতিশ্রুতি বলে আসছে। এতো সংখ্যক বই প্রকাশ করতে গিয়ে গুণ ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদ্ধতি আপনারা অবলম্বন করেন?
রাজীব চৌধুরী: চৈতন্য এখন পর্যন্ত পাঁচশতাধিক বই প্রকাশ করেছে। তার একটা বিশাল জায়গা তরুণদের বই। আমরা বইয়ের বিষয়, তরুণদের প্রাধান্য, বিষয় বৈচিত্র্যমূলক বই প্রকাশ করে নির্দিষ্ট লক্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।

বিডিনিউজ: একটা অভিযোগ প্রায় মনোযোগী পাঠকের কাছ থেকে পেয়ে থাকি, বহুল বিক্রিত বা প্রকল্প নির্ভর বইয়ের দিকে বেশি নজর দেয়ার ফলে মননশীল বই— যার বিনিয়োগ উঠে আসতে সময় একটু বেশি লাগতে পারতো— সেই ধরণের বইয়ের চর্চাই কমে গেছে! যে কারণে দেখছি, বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে আমরা পিছিয়ে আছি। আবার এক জরিপে দেখছি, গত বছর চীন ও ভারতে সর্বোচ্চ বিজ্ঞান বিষয়ক বই প্রকাশ হয়েছে। এই সংকট উত্তরণে প্রকাশক কি ভূমিকার রাখতে পারে?
রাজীব চৌধুরী: এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমাদের এখানে আগে দেখতে হবে কি ধরনের বই প্রমোট হচ্ছে। বিজ্ঞান লেখক আমাদের আছে, বই আছে, কিন্তু প্রচার নেই। প্রচার না থাকায় এসব ক্ষেত্রে বই প্রকাশ কম। তাছাড়া মুক্তবুদ্ধি চর্চার ক্ষেত্রেও আমাদের এখানে আতংক আছে। অনলাইনে বেশির ভাগ দেখবেন— যেসকল বই প্রমোশন পাচ্ছে, তা বিজ্ঞান বা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার বই না।
উগ্রবাদিতা আমাদের এখানে সবচেয়ে বড় বাধা। বিজ্ঞানবিষয়ক বই দেখলে অনেকেই মনে করে নাস্তিকের বই। ধর্মীয় ইতিহাসের বই দেখলে, এক পক্ষের মতে না মিললে— ধর্মবিদ্বেষী ভাবেন। রাজনৈতিক বইয়ে ভিন্নমত প্রকাশ পেলে উগ্র আচরণের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আগে মুক্ত চিন্তার প্রসার ঘটুক। কলমের যুদ্ধ কলম দিয়ে হউক। অন্যথায় নয়।

বিডিনিউজ: চৈতন্য এ বছর কী কী বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে?
রাজীব চৌধুরী: চৈতন্য সারাবছর বই প্রকাশ করে। এই বছর বেশকিছু বই আসবে। এর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য কিছু— কথাসাহিত্যিক শাহনাজ মুন্নীর 'গল্পসংগ্রহ-১', কবি জফির সেতুর 'কবিতাসংগ্রহ', নিখিলেশ রায়ের 'কবিতাসংগ্রহ'। গল্পগ্রন্থ— হাসান মোরশেদের 'সমন শেকলের ডানা', ফারহানা নীলার 'সূর্যের কুসুম', নিবেদিতা আইচ-এর 'বিহংগম', দেব্যুদূতি রায়ের 'মেগমগ্ন'। উপন্যাস— সন্নাসী রতনের 'অপুংসক', ওয়াকিলা তাবাসসুম মুমুর 'ঝাঝি শ্যাওলা', সাদিয়া সুলতানার 'আজু মাইয়ের পৈতানের সুখ', মোস্তাফিজুর রহমানের 'বোকা কিশোরীর বোকা ডায়েরি'। অনুবাদ— মুহাম্মদ গোলাম সারোয়ার অনুদিত নোম চমস্কির 'অন প্যালেস্টাইন', লেসলি তানভীর অন্তর অনুদিত হ্যাজেলটনের 'আফটার দ্যা প্রফেট', মোহাম্মদ আজমের 'সিনেমা বিষয়ক তিনটি অনুদিত প্রবন্ধ'। মোস্তাক আহমাদ দীনের সম্পাদনায় কামালগীতি ইত্যাদি।

বিডিনিউজ: বহু প্রকাশক গত বছর থেকে বঙ্গবন্ধুর উপর প্রচুর বই বের করেছেন এবং আরো করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। এ বিষয়ে আপনারা কী কী গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন?
রাজীব চৌধুরী: বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ঢালাও ভাবে বই না করলেও, চৈতন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বই প্রকাশ করেছে— মুক্তিযুদ্ধ গবেষক হাসান মোরশেদ এর 'বঙ্গবন্ধুর নীতি ও নৈতিকতা'। মুক্তিযুদ্ধের আরেক গবেষক শামস শামীমের 'মুক্তিযুদ্ধের ৫নং সেক্টরের ইতিহাস', সুপা সাদিয়ার 'বঙ্গবন্ধুর জীবন আলেখ্য'।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর গ্রন্থমেলায় প্রচুর বই থাকে লেখকের হয়তো সেবারই প্রথম। এর মান নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। বড় প্রকাশনীর একটা দায় থাকে সম্ভাবনাময় তরুণ লেখককে তুলে আনার। সেক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা করা, পত্রিকার লেখা দেখে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। আপনি কিভাবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে নির্বাচন করেন?
রাজীব চৌধুরী: চৈতন্য শুরু থেকে তরুণ লেখকদের বই প্রকাশের প্লাটফর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনো সেটা ধারাবাহিকভাবে করে আসছে।

বিডিনিউজ: বাংলাদেশে প্রকাশনা-শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে কী কী বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন?
রাজীব চৌধুরী: আমাদের স্বচ্ছতার অভাব অনেক ক্ষেত্রে। নীতিমালার সুষ্ঠুতার অভাব, সিন্ডিকেট হয়ে যাওয়া। এসবে স্বচ্ছতা এলে, সমতা আসবে।

বিডিনিউজ: একটা বিষয় নিয়ে বলতেই হয়, তা হচ্ছে প্রকাশকের নিরাপত্তা প্রসঙ্গ। বই প্রকাশের কারণে জাগৃতি প্রকাশন-এর ফয়সল আরেফিন দীপনকে মরতে হয়েছে, মুন্সিগঞ্জে বিশাখা প্রকাশনীর শাহজাহান বাচ্চু খুন হয়েছেন, শুদ্ধস্বর এর আহমেদুর রশিদ টুটুল আক্রান্ত হয়েছে। এমনকি আপনার সিলেটে বিজ্ঞাপন পত্রিকা 'যুক্তি' র সম্পাদক অনন্ত বিজয় দাশ হত্যাকাণ্ড। এমন আরো কয়েকটি ঘটনা আছে। এগুলো দেশের প্রকাশনায় কি ধরনের প্রভাব ফেলেছে? আর প্রকাশকরা এখনো ঝুঁকির মধ্যের আছেন, আপনি কি মনে করেন?
রাজীব চৌধুরী: এই সম্পর্কে কয়েকটা কথা আমি আগে বলেছি। লেখালিখির জন্য মানুষ মেরে ফেলার যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে সেটা প্রকাশক-লেখকদের জন্য অত্যন্ত মর্মান্তিক। ভয়াবহ অশনিসংকেত। আমাদের দেশে বিচার হচ্ছে, রায় হচ্ছে, কিন্তু তাদের চেতনার বীজ রয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি চৈতন্য 'র একটা অনুবাদের বই নিয়ে সোস্যাল মিডিয়ায় ধর্মান্ধ, উগ্রবাদীরা যেভাবে কমেন্টস করে গিয়েছে, যা রীতিমত হুমকি বলা যায়। এদেরকে যারা প্রমোট করে যাচ্ছে, যারা বাংলাদেশকে জঙ্গিরাষ্ট্র বানাতে চায়, তাদের মূল-বীজকে উপড়ে ফেলতে না পারলে আমাদের জন্য দুঃখ আছে।

বিডিনিউজ: ধন্যবাদ, রাজীব চৌধুরী ভাই, আন্তরিক সময় দেয়ার জন্য।
রাজীব চৌধুরী: ধন্যবাদ আপনাকেও, এবং বিডিনিউজকে, এ বিষয়ে নজর দেয়ার জন্য। বই পড়ায় পাঠকের চৈতন্যের উদয় হোক।

'সেখানে সৃজনশীলতা আছে কিনা সেটাই দেখার বিষয়'
চৌধুরী ফাহাদ, কবি-প্রকাশক, চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন


বিডিনিউজ: গতবছর গ্রন্থমেলার পরই দেশে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরু। অর্থনীতি-জনজীবনে এই প্রভাব এখনো আছে। পুস্তক ব্যবসার উপর করোনার প্রভাব কিভাবে পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
চৌধুরী ফাহাদ: ব্যবসা শব্দটার সাথেই অর্থনীতি জড়িত। প্রকাশনা ব্যবসাও দৈনন্দিন জন-জীবনের বাইরের কিছু নয়। করোনা মহামারি প্রকাশনা ব্যবসায় সবচেয়ে বেশি ও গভীর প্রভাব ফেলেছে। কেননা বই পাঠ নিত্যপ্রয়োজন নয় দেশে, দৈনন্দিন জীবনের একটা ঐচ্ছিক অনুষঙ্গ মাত্র। যেখানে মানুষকে তাদের নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যের যোগান করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে বই ক্রয়ের মতো ঐচ্ছিক প্রয়োজনে খরচ করার অর্থ কোথায় মানুষের হাতে? কেমন প্রভাব পড়েছে তার চেয়ে বরং ভাবা যেতে পারে করোনা মহামারি কতটা গভীর ও সুদূরপ্রসারী ক্ষত সৃষ্টি করেছে প্রকাশনা ব্যবসার উপর। গত বইমেলার পর থেকে প্রকাশনা ব্যবসার উপর নেমে আসা করোনার খড়গ পুষিয়ে উঠতে বেশিরভাগ প্রকাশনীরই বেশ কয়েক বছর লেগে যেতে পারে, আদৌ ক্ষত সেরে উঠবে এমনটা নিশ্চিত করে বলা যায় না! এরই মাঝে অনেকগুলো প্রকাশনী তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে, সারাদেশে বেশকিছু প্রকাশনীর আউটলেট ও বুকশপ গুটিয়ে নিয়েছে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে। এইসবকিছুই দৃশ্যমান প্রভাব, করোনার ক্ষয় প্রকাশনা ব্যবসার শিকড়ে পৌঁছে গেছে। অন্যান্য ব্যবসার চেয়ে অনেক বেশি অনিশ্চয়তার পেন্ডুলামে ঝুলে আছে প্রকাশনা ব্যবসা।

বিডিনিউজ: করোনার শুরুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেককে প্রতিশ্রুতি করতে দেখেছি— যারা ব্যস্ততার কারণে বই পড়তে পারেন নি, তারা লকডাউন বা হোম অফিসের সুযোগে বিস্তর পড়বেন। অনলাইনে বই বিক্রি এই সময়ই সবচেয়ে বিস্তৃত হয়েছে। দিনশেষে তারা কেমন বই পড়েছেন তা বোঝার বড় উপায় বই কেমন বিক্রি হলো। প্রকাশক হিসেবে আপনার অভিজ্ঞতা কি?
চৌধুরী ফাহাদ: যে কোনো দুর্যোগকালীন সময়ে মানুষের মন অস্থির থাকে। বই পাঠের মতন শুভ্র একটি বিষয়ের জন্য যে পিস অব মাইন্ড জরুরি, এই করোনা মহামারির সময়ে সেই সুস্থিরতা কারোই ছিল বলে মনে হয় না। এই সময়ে পাঠ খুব বেশি অগ্রসর হয়েছে এমন ভাবার সুযোগ নেই। করোনার প্রথম ধাক্কার পরে কিছুটা পাঠস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এলেও, সে সময় বোধকরি আত্মসচেতন, স্কিল-ডেভলপমেন্ট কিংবা সাইকোলজিক্যাল বইয়ের দিকে বেশি ঝুঁকেছে। লকডাউনের সময় পাঠচাহিদা থাকলেও সবকিছু বন্ধ থাকার কারণে যোগান থেমে ছিল। যারা পাঠ করেছেন তারা পূর্ববর্তী সংগ্রহীত বই-ই বেশি পড়েছেন, তা অনলাইন প্লাটফর্মের প্রতিক্রিয়ায় দৃশ্যমান। অনলাইন মাধ্যমে এই সময়ে বই বিক্রি হয়েছে অনেক, মানুষের অর্থনৈতিক মন্দার কারণে তা স্বাভাবিক সময়ের বিক্রির তুলনায় কমই বলা চলে।

বিডিনিউজ: আগে থেকেই বই বিপননের সঙ্গে সাধারণ মানুষের একটা দূরত্ব ছিল। করোনা তাকে আরো কঠিন করেছে মনে করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে বইয়ের বিপনন, প্রচার আর পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে?
চৌধুরী ফাহাদ: আগে থেকেই ধীরে ধীরে অনলাইনে বই সংগ্রহ প্রবণতা বাড়ছিল পাঠকের। এই কারোনা মহামারির সময়ে বই বিপণনের জন্য অনলাইন মাধ্যমের সবচেয়ে প্রসার ঘটেছে। সরাসরি বই ক্রয় করতে না পারলেও অনলাইনে সহজেই বই সংগ্রহ করতে পারছেন পাঠক। বই বিপণন ও সহজে পাঠকের কাছে পৌঁছানোর জন্য চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন নিয়মিত অনলাইন প্রোগ্রাম করছে, বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মের পাশাপাশি সরাসরি পাঠকের সাথে প্রকাশনীর সংযোগ স্থাপনের জন্য চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন নিজস্ব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বই বাজারজাত করছে।

বিডিনিউজ: বইপ্রকাশের ব্যাপারে নীতিমালা নিয়ে প্রায়ই কথা উঠে। লেখক-প্রকাশক সম্পর্ক তিক্ততায় গড়ায়, মনোযোগী পাঠকের অতৃপ্তি থেকে যায়। যেমন লেখকের সঙ্গে চুক্তি করা, তাদেরকে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রিত বইয়ের হিসেব বুঝিয়ে দেয়া, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন লাভ করা— এসব কি আপনাদের জন্য বাণিজ্যিকভাবে অনুকূল? বড় প্রকাশনী হিসেবে আপনার সুযোগ আছে সেই উদারহণ তৈরি করা। আপনার প্রকাশনী এসব কতটা মেনে চলছে?
চৌধুরী ফাহাদ: চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন গণহারে ও গড়পড়তা বই প্রকাশ করে না। কোনো লেখক চাইলেই চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন তার বই প্রকাশের নিশ্চয়তা দেয় না। চন্দ্রবিন্দু টিম পান্ডুলিপি পড়ে, যাচাই-বাচাই করে সিদ্ধান্ত নেয় বই ছাপানোর। ফলতঃ যথাযত আইনানুগ নীতিমালা বিষয়ে সচেতন এবং লেখকের সাথে বুঝাপড়ার ব্যাপারটাকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।
আমাদের দেশে প্রকাশনাকে শিল্প বলা হলেও, কতটা শিল্পিত— তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ থেকে যায়। নানা কারণে প্রকাশনা জগতে পেশাদারিত্ব পুরোপুরিভাবে গড়ে ওঠে নাই।
পাঠকের ক্রয় ক্ষমতা বিবেচনা করলে কোনো বই অনুবাদ করার অনুমোদন খরচ বাবদ যে পরিমাণ ডলার বিনিয়োগ করা প্রয়োজন পড়ে তা প্রকাশনী ও পাঠক উভয়ের ঘাড়ে বিশাল অঙ্কের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

বিডিনিউজ: লেখকস্বত্ব নিয়ে লেখকদের ক্ষোভ বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি। বিষয়টা অনেক সময় সভা, আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। এ সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি, কোনো কোনো লেখক মনে করেন, লেখকদের সাথে প্রকাশকদের চুক্তি ও রয়্যালটি প্রদানের তথ্য যে-সব প্রকাশনীর নেই, সেসব বই বা প্রকাশনীকে বইমেলায় অংশগ্রহণের জন্য অযোগ্য বলে ঘোষণা করা। আপনি কি তাদের এই দাবীর সঙ্গে একমত? আপনার পরামর্শে এর সমাধান কী হতে পারে?
চৌধুরী ফাহাদ: আপনি হয়তো খেয়াল করে থাকবেন আমাদের প্রকাশিত বইয়ের নির্দিষ্ট একটা অংশের লেখকের কন্টিনিউটি আছে। আমরা বেশ কয়েকজন লেখকের জার্নির সাথে হাঁটছি। এবং আমরা সবসময় লেখকদের কাছে স্বচ্ছ থাকতে সচেষ্ট। চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন থেকে প্রকাশিত বইয়ের যে কোনো লেখক আমাদের সংরক্ষিত রেকর্ড নিজ চোখে দেখতে পারেন। চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন অনেকগুলো বই অ্যাডভান্স রয়ালিটি পরিশোধ করে প্রকাশ করেছে, আবার বই প্রকাশের নির্দিষ্ট সময় ও সংখ্যার পর লেখকের কাছে রয়ালিটি বুঝিয়ে দিয়েছে।
স্বচ্ছতা ও সততা কেবল একদিক দিয়ে আসলে হবে না। সবদিক দিয়ে আসা জরুরি। পদাধিকারীরা যতদিন পক্ষপাতমুক্ত মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে না পারবেন, নিজের ভেতর ততদিন সামগ্রিক প্রকাশনা অবস্থার ভিত মজবুত হবে না। তার সুযোগ নিতে চাইবে অনেকেই…

বিডিনিউজ: বই মানসম্পন্ন করতে সম্পাদনার বিকল্প নেই। প্রকাশনা সংস্থাগুলো নিজস্ব একটা সম্পাদনা পরিষদ থাকা জরুরি পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ে। এনিয়ে প্রায়ই লেখকদের আক্ষেপ করতে দেখা যায়। চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন এটা কিভাবে করছে?
চৌধুরী ফাহাদ: চন্দ্রবিন্দু একটি টিম। যদিও ছোট, কিন্তু আমরা মান ও সম্পাদনা বিষয়ে সতর্ক। আমাদের সীমাবদ্ধতার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে— সব প্রক্রিয়া শেষে একটি মানসম্পন্ন বই প্রকাশ হয়ে আসুক। তারপরও আমাদের টিমওয়ার্কের মাধ্যমে ত্রুটিপূর্ণ বই প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে বিগত সময়গুলোতে, এখন আমাদের সম্পাদনা প্রক্রিয়া আরো শক্তিশালী। যদি লেখকের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, এই আক্ষেপটা অমূলক নয়। কিন্তু যে দেশে অল্পকয়েকজন লেখক ছাড়া বেশিরভাগের নির্দিষ্ট একটা বই ৩০০ কপির ঊর্ধ্বে মুদ্রণ করা সম্ভবপর হয়ে উঠছে না, সেখানে সম্পাদনা পরিষদের মতো 'বিগ বাজেট কন্ট্রিবিউশন' যে কোনো বড় প্রকাশনীর জন্যও দুঃসাহসী চিন্তা। সামগ্রিকভাবেই পরিবর্তন জরুরি। ফুল-পাখি-লতা-পাতা-প্রেম এর বাইরে শক্ত ভিতের বই পড়ার একটা জনগোষ্ঠী যতদিন তৈরি না হচ্ছে এবং নীতিনির্ধারক শ্রেণির মননের মাঝে মানসিক ও অর্থনৈতিক ব্যারিয়ার উঠে না যাচ্ছে, ততদিন পেশাদারিত্ব কেবল প্রত্যাশিত ব্যাপার হয়ে থাকবে, বাস্তব হবে না। অনেকেই হয়তো চেষ্টা করছেন, অনেক প্রকাশনী উদ্যোগ নিচ্ছে, কিন্তু 'তৈলমগ্ন সিস্টেমের' সাথে কুলিয়ে উঠতে না পারে আবার নিজের ভেতরে গুটিয়ে যাচ্ছেন। তাদের এই চিৎকার ধনতন্ত্রের কনসার্টের নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে যে-বইমেলা হয়, তার উপর নির্ভর করে অনেক ছোট ছোট, স্বল্পস্থায়ী প্রকাশনী বিপননের নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবনে বিমুখ হয়ে থাকে। এটা কি প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য হুমকি নয়? আপনাদের মতো বড় বড় প্রকাশনীও এই মেলায় বিক্রি হওয়ার উপর খুব বেশি নির্ভর করেন?
চৌধুরী ফাহাদ: মৌসুমি ব্যবসায়ী সব ব্যবসাতেই থাকে, প্রকাশনায়ও আছে। তাদের আসা যাওয়াকে অতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি না। তারা আসেন, একটু ক্যাওয়াজ করেন, আবার ডুব। যারা দীর্ঘদৌড়ের জন্য প্রকাশনায় শামিল হয়েছেন তারা একটা প্লান নিয়েই কাজ করেন, লম্বা সময়ের জন্য কিন্তু কার্যকর। বাস্তবতা হচ্ছে, বইমেলা বই বিক্রির প্রধান মাধ্যম আমাদের দেশে। নানা কারণে ধীরে ধীরে এই সিস্টেম গড়ে উঠেছে। ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বইমেলা কেন্দ্রিক বই প্রকাশকে অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই।
চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনের যাত্রা শুরু হয়েছে ২০১৮ সালের মার্চ মাসে। তখন সবেমাত্র অমর একুশে বইমেলা শেষ হয়েছে। সে বছর থেকে চন্দ্রবিন্দু সারাবছর ব্যাপী বই প্রকাশ করে আসছে এবং পাঠকের কাছে পৌঁছাতে সচেষ্ট থেকেছে। শুরু থেকেই সারাবছর বই প্রকাশ করার ব্যপারে চন্দ্রবিন্দু সচেতন ছিল, যাতে বছরের নির্দিষ্ট একটা সময়ে এসে আলাদা করে অতিরিক্ত চাপ না আসে। আর বিক্রির চিত্রটা পুরোটা ভিন্ন। বই সারাবছর অল্প বিস্তর বিক্রি হলেও একেক সময় মূল বিক্রিটা হয় বইমেলায় বা বইমেলার সময়ে। সে সময় পাঠকেরও নতুন বই সংগ্রহ করার উদ্দীপনা থাকে। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন সারাবছর ধরে অনলাইনে-অফলাইনে সক্রিয় থাকে, যাতে বই প্রকাশ ও বিপণন প্রক্রিয়া গতিশীল থাকে। সারাবছর দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত হওয়া বেশিরভাগ বইমেলায় চন্দ্রবিন্দু সক্রিভাবে অংশগ্রহন করে থাকে।

বিডিনিউজ: চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন চট্টগ্রামের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। দেশের বড় শহর থেকেও ভাল প্রকাশনা হওয়া উচিত। বিপরীতে দেশের অনেক লেখক, বই বিপনন ব্যবস্থা ঢাকা কেন্দ্রিক। এক্ষেত্রে চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন কে কিছুটা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। এগুলো কেমন? আপনারা কিভাবে তা সমাধান করেন? দেশের বড় শহর থেকেও কিভাবে ভাল প্রকাশনা চলতে পারে?
চৌধুরী ফাহাদ: চেষ্টা থাকলে যেকোনো জায়গা থেকে, যেকোনো পরিস্থিতিতে কিছু করা সম্ভব। মূলত এভাবেই চন্দ্রবিন্দু উঠে এসেছে। যেহেতু চট্টগ্রাম থেকেই আমরা কাজ করি, সেহেতু অনেক প্রতিকূলতার মুখোমুখি আমাদের হতে হয়েছে, ধীরে ধীরে আমরা তা সামলে ওঠার চেষ্টা করছি এবং কাজ করে যাচ্ছি। এখানে ছাপা, বাঁধাই ও বিপননের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। যেগুলো আমরা অনেকটা কাটিয়ে উঠেছি। নিজেদের কাজের প্রয়োজনে আলাদা সহযোগী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হয়েছে। আমরা খেয়ালের বশে প্রকাশনা করিনি, প্রয়োজন ভেবে করেছি এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দাঁড়ানোর চিন্তা থেকে করেছি। পরিপূর্ণভাবে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান করতে গেলে যা যা করতে হয়, সেসব ব্যবস্থাও নিয়েছি। প্রতিকূল বা কষ্টসাধ্য ভেবে থেমে থাকিনি।

বিডিনিউজ: চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন ইতিমধ্যে ১০০ এর উপর গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন শুরু থেকে মননশীল ও মান সম্মত প্রকাশনার প্রতিশ্রুতি বলে আসছে। এতো সংখ্যক বই প্রকাশ করতে গিয়ে গুণ ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদ্ধতি আপনারা অবলম্বন করেন?
চৌধুরী ফাহাদ: গুণ ও মান নির্ধারণে যা যা করণীয়, তা করার জন্য আমাদের সর্বাত্মকভাবে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ভুল সংশোধনের জন্য আলাদা টিম রয়েছে, সেই সাথে অলংকরণ ও মুদ্রণে যথাযথ মান বজায় রেখে কাজ করে যাচ্ছে কর্মীরা। প্রত্যেকেই নিজস্ব একটি পদ্ধতি অনুসারে কাজ করে, আমরাও তাই করি। যার ফলাফল আমাদের বই। পাঠক সেটা নিয়ে কথা বলেন, আমরা অনেকক্ষেত্রে পাঠকের মন্তব্য থেকেই আমাদের যথার্থতা ও দুর্বলতা বুঝতে চেষ্টা করি এবং তার থেকে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করি। যেহেতু পাঠকের জন্যই বই, বইয়ের গন্তব্যই হলো পাঠক। সুতরাং পাঠকের বিচারে যা সেরা— এবং তা যদি আমাদের প্রকাশনা প্ল্যানের সাথে সমাঞ্জস্যপূর্ণ হয়— সেটা কর্মপদ্ধতিতে যুক্ত করার চিন্তা করি কিংবা তার চেয়ে ভালো কিছু করার চেষ্টা থাকে।

বিডিনিউজ: একটা অভিযোগ প্রায় মনোযোগী পাঠকের কাছ থেকে পেয়ে থাকি, বহুল বিক্রিত বা প্রকল্প নির্ভর বইয়ের দিকে বেশি নজর দেয়ার ফলে মননশীল বই— যার বিনিয়োগ উঠে আসতে সময় একটু বেশি লাগতে পারতো— সেই ধরণের বইয়ের চর্চাই কমে গেছে! যে কারণে দেখছি, বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে আমরা পিছিয়ে আছি। আবার এক জরিপে দেখছি, গত বছর চীন ও ভারতে সর্বোচ্চ বিজ্ঞান বিষয়ক বই প্রকাশ হয়েছে। এই সংকট উত্তরণে প্রকাশক কি ভূমিকার রাখতে পারে?
চৌধুরী ফাহাদ: বিজ্ঞান বিষয়ক বই হওয়া খারাপ কিছু না। সময়ের চাহিদাকে যোগান দিতে হবে। আমাদের সবসময় গল্প-কবিতা-উপন্যাসের বই পড়লে তো হবে না। জ্ঞানের বিচিত্র পরিসরে প্রবেশ করতে হবে। ভালো বই, যেকোনো রান্নার বইও হতে পারে, মাছচাষের বইও হতে পারে। সেখানে সৃজনশীলতা আছে কিনা সেটাই দেখার বিষয়। প্রকাশ মানেই শুধু কি গল্প-উপন্যাস ছাপানো?

বিডিনিউজ: চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন এ বছর কী কী বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে?
চৌধুরী ফাহাদ: এ বছর আমাদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই আসছে, যা পাঠকপ্রিয় বই হবে বলে আমাদের আশা। এরমধ্যে রয়েছে— সাক্ষাৎকার, প্রবন্ধ, অনুবাদ, উপন্যাস, গল্প ও কবিতার বই।

বিডিনিউজ: বহু প্রকাশক গত বছর থেকে বঙ্গবন্ধুর উপর প্রচুর বই বের করেছেন এবং আরো করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। এ বিষয়ে আপনারা কী কী গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন?
চৌধুরী ফাহাদ: বঙ্গবন্ধুর উপর বই প্রকাশ করা ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু হরেদরে বই করার পক্ষে আমরা নই। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কিছু বই করার পরিকল্পনা আমাদের আছে। ইতোমধ্যে 'শিশুদের বঙ্গবন্ধু' নামে একটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি নিয়ে আমরা কাজ করছি। একজন প্রবীণ কবি ও কলামিস্ট বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করছেন।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর গ্রন্থমেলায় প্রচুর বই থাকে লেখকের হয়তো সেবারই প্রথম। এর মান নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। বড় প্রকাশনীর একটা দায় থাকে সম্ভাবনাময় তরুণ লেখককে তুলে আনার। সেক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা করা, পত্রিকার লেখা দেখে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। আপনি কিভাবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে নির্বাচন করেন?
চৌধুরী ফাহাদ: আমরা একটা নির্দিষ্ট নিয়মে আমাদের কাজ করে যাচ্ছি। চন্দ্রবিন্দু যেহেতু একটি লিটলম্যাগ দিয়েই যাত্রা শুরু করেছিল, সেহেতু শুরু থেকেই আমাদের কাজ ছিল নতুনদের ভেতর যারা ভালো লিখছে তাদের নিয়ে কাজ করা এবং তাদের কাছে দিগনির্দেশনা স্বরূপ প্রবীণ-প্রথিতযশাদের উপস্থাপন করা। যদিও প্রকাশনায় এসে শুরুর দিকে সেভাবে বই প্রকাশ করতে গিয়ে আমরা বাণিজ্যিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থও হয়েছি এবং এখনো যার ধারাবাহিকতা টেনে যাচ্ছি। তবু আমরা এটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছি। একটা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে অনেককে একসাথে সুযোগ করে দেয়া যেহেতু সম্ভব নয়, সেহেতু আমরা প্রতিবছর নির্দিষ্ট পরিমান নতুন প্রতিভাবান লেখকের লেখা প্রকাশ করি।

বিডিনিউজ: বাংলাদেশে প্রকাশনা-শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে কী কী বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন?
চৌধুরী ফাহাদ: অনেক বাঁধা। এই তালিকা অনেক দীর্ঘ। বলতে গেলে পুরোটাই প্রতিকূল পরিবেশ। এটুকু যে আছে, তাও আশ্চর্যের ব্যাপার। তার ভেতর কিছু উল্লেখ করা যায়। যেমন ধরুন— প্রকাশনাশিল্পটা মুখে মুখে, যার বাস্তব কোনো কাঠামো নেই। ভালো প্রযুক্তির অপর্যাপ্ততা। প্রকাশকদের পরিকল্পনাহীনতা ও শিল্পসচেতনতার অভাব। লেখকদের একরোখা নীতি ও পশ্চাৎপদতা— তারা প্রকাশকদের নিয়ে কথা বলতে দেখা গেলেও প্রাতিষ্ঠানিক অনিময় নিয়ে কখনো মুখ খুলেন না। এটা হলে জবাবদিহিতার জায়গা তৈরি হতো। এছাড়া প্রকাশকদের সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দিক নিয়ে উদাসীনতা আছে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সঠিক তালিকা না থাকাও একটা কারণ।
সরকারি প্রণোদনা সবার কাছে সমভাবে না পৌঁছানো, গুটিকয়েকের সিন্ডিকেট দ্বারা নিয়ন্ত্রণ, সরকারি প্রণোদনায় নিদিষ্ট ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের অনৈতিক সুবিধা আদায়ের ফলে মাঝারি ও ক্ষুদ্রাকৃত্রির প্রতিষ্ঠানের বিলুপ্তি ঘটছে। যার ফলে ভালো চিন্তা ও পরিকল্পনা নিয়ে অনেকে এগিয়ে এলেও তারা শেষ পর্যন্ত থাকতে পারছেন না। পিছিয়ে যাচ্ছেন। সততা ও নিষ্ঠার অভাব অন্য সব জায়গার মতো এখানেও পর্যাপ্তভাবে দেখা যায়।

বিডিনিউজ: প্রকাশনাশিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আপনার কি কোনো প্রস্তাব আছে?
চৌধুরী ফাহাদ: সরকারি ও প্রাতিষ্ঠানিক বই ক্রয় পদ্ধতি আরও বিস্তৃত, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য করা জরুরি। সব প্রকাশনীর প্রতি সমদৃষ্টি রাখতে হবে। নির্দিষ্ট একটি গোত্রের প্রতি পক্ষপাতের বলয় ভেঙে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা সব প্রকাশনিকে অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রীতিভাজন হয়ে চটুল বই সংগ্রহের বাইরে এসে কন্টেন্ট যাচাই প্রক্রিয়া আরো শক্তিশালী করতে হবে; যাতে প্রকাশনিসমূহ মননশীল বই প্রকাশ করতে উদ্বুদ্ধ হয় এবং কেবল বাণিজ্যিক চিন্তা না করে সম্ভাবনাময় ও গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের খুঁজে বের করতে সচেষ্ট থাকতে পারে। সারাদেশে সকল স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-ইউনিভার্সিটিতে পাঠাগার নিশ্চিত করে সেখানে শক্তিশালী মনন গঠনের জন্য বই পাঠ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও আরো অনেক অনেক প্রস্তাবনা আনা যেতে পারে যা নীতিনির্ধারকরাও জানেন এবং মানেন, কিন্তু বাস্তবায়নের মতো কষ্টটুকু করতে আগ্রহী নন। এমন হাজার হাজার প্রস্তবনা অনেকেই দিয়েছেন যা শেষ পর্যন্ত সেই প্রস্তাব আকারেই ফিতাবন্দি হয়ে থেকে গেছে। বিড়ালের গলায় ঘন্টি বাঁধার মতো যোগ্য মন-মানুষকে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।

বিডিনিউজ: ধন্যবাদ, চৌধুরী ফাহাদ ভাই, আন্তরিক সময় দেয়ার জন্য।
চৌধুরী ফাহাদ: বিডিনিউজ ও আপনাকে ধন্যবাদ। পৃথিবী বইয়ের হোক।

'ভালো বইগুলো নিজেই নিজের পাঠক তৈরি করে'
সুলতান আহম্মেদ, অনুবাদক-প্রকাশক, উজান প্রকাশন


বিডিনিউজ: করোনার প্রভাব পুস্তক ব্যবসার উপর কিভাবে পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
সুলতান আহম্মেদ: নানাভাবে প্রভাব পড়েছে। প্রথমত সবারই প্রকাশনা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। পাঠকের বই কেনা এই সময়ে তুলনামূলক কম ছিল। করোনার প্রভাবে একুশে গ্রন্থমেলা হবে কি না— এই সংশয়েও ক্ষতি হয়েছে প্রকাশনা শিল্পের। সারা বিশ্বে যে প্রভাব পড়েছে করোনায়, যে অর্থনৈতিক ধাক্কা বিশ্বকে সামাল দিতে হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে, এর প্রভাব আগামীতেও অন্যান্য শিল্পের মতো প্রকাশনা শিল্পেও থাকবে। দেশের প্রকাশনা শিল্প অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেহেতু ছোট পুঁজির কারবার, সেহেতু প্রকাশকরা বড় ক্ষতির শিকার— এটা ধরে নিতে হবে এবং সে অনুযায়ী প্রণোদনা বা অন্যান্য ব্যবস্থাও নিতে হবে।

বিডিনিউজ:
বইয়ের বিপনন, প্রচার আর পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে উজান প্রকাশন কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে?
সুলতান আহম্মেদ: প্রকাশক হিসেবে আমরা নতুন। এই ক্ষেত্রে আমাদের বিপণন, প্রচার ও পাঠকলগ্নতার প্রক্রিয়াগুলোও নতুন। আমরা নতুন মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ব্যক্তিগত যোগাযোগ এসবকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি। সবচেয়ে বড় কথা আমরা ভালো মানের বই প্রকাশ করছি। ধরে নিচ্ছি যে, ভালো বইগুলো নিজেই নিজের পাঠক তৈরি করে। বিপণন ও প্রচারে ভালো বই নিজেই ভালো ভূমিকা রাখে।

বিডিনিউজ: বইপ্রকাশের ব্যাপারে যেসব নীতিমালা, যেমন লেখকের সঙ্গে চুক্তি করা, তাদের প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রিত বইয়ের হিসেব বুঝিয়ে দেয়া, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন লাভ করা— এসব কেউ কেউ বাণিজ্যিকভাবে অনুকূল মনে করেন না। আপনি কি মনে করেন? আপনার প্রকাশনী কিভাবে তা মেনে চলছে?
সুলতান আহম্মেদ: বই প্রকাশের ব্যাপারে আমরা নীতিমালা তো অবশ্যই, এমনকি সৌজন্যবোধ ও প্রতিশ্রুতির জায়গাগুলোও মেনে চলার চেষ্টা করি। লেখকদের সঙ্গে চুক্তি, নির্দিষ্ট সময়ে তাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি আন্তরিকভাবেই। প্রকাশক হিসেবে আমরা তো লেখকের সাথে একটি দীর্ঘস্থায়ী ও আন্তরিক সম্পর্ক বজায় রাখতে চাই এবং এ কারণেই স্বচ্ছ থাকতে চাই। বিদেশি বইয়ের অনুবাদ প্রকাশে সব ক্ষেত্রেই চুক্তির বাধ্যবাধকতা আছে তেমন তো নয়। যেসব ধ্রুপদী পুস্তকের স্বত্বের সময়সীমা পেরিয়ে গেছে সেসবে তো অনুমোদনের ব্যাপার নেই। যেসব ক্ষেত্রে অনুমোদন প্রয়োজন সেসব ক্ষেত্রে অনুমোদন আমরা নিচ্ছি। এসব ক্ষেত্রে আমরা লেখক বা প্রকাশকের সাথে যোগাযোগ করে অনুমোদন নিচ্ছি।

বিডিনিউজ: বই মানসম্পন্ন করতে সম্পাদনার বিকল্প নেই। প্রকাশনা সংস্থাগুলো নিজস্ব একটা সম্পাদনা পরিষদ থাকা জরুরি পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ে। উজান প্রকাশন এটা কিভাবে করছে?
সুলতান আহম্মেদ: মানসম্পন্ন বইয়ের জন্য সম্পাদনা একটি অনিবার্য ব্যাপার। অনেকেই মনে করেন আমাদের দেশের প্রকাশনাশিল্পে সম্পাদনা বলে কিছু নেই— এটা বোধহয় পুরোপুরি ঠিক নয়। যেসব প্রকাশনার নিজস্ব সম্পাদনা পরিষদ নেই তারা ভিন্নভাবে, বিকল্প উপায়ে সে কাজটা করিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে প্রকাশক নিজে কিংবা লেখক নিজে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আমাদের প্রকাশনা শিল্পের সবার তো আর পেশাদার সম্পাদনা পরিষদ রাখার সামর্থ নেই— এই বাস্তবতা তো মানতে হবে। আমাদের প্রকাশনাশিল্পের একটা বড় অংশ কিন্তু 'বিকল্প প্রকাশনা'। ধরা যাক, একটা লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশনা শুরু করেছে। তারা তখন কী করবে? সম্পাদনা পরিষদের কাজটা যথাসম্ভব নিজেরা পালন করবে কিংবা লেখককে দিয়ে তা করিয়ে নেবে। কিংবা লেখক বা প্রকাশক তাদের কাছের কোনো লেখককে দিয়ে তা করিয়ে নেবেন। আমাদের এখানে এই চর্চাটা হয়। আমরাও এই প্রক্রিয়াটা অবলম্বন করি। আবার কখনো পেশাদার সম্পাদকের আশ্রয় নিই।

বিডিনিউজ: বাংলাদেশে প্রকাশনা-শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে কী কী বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন?
সুলতান আহম্মেদ: আমাদের প্রকাশনা শিল্প কিন্তু অবিকশিত নয়, বিকশিত; কিন্তু তার আরও উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ দরকার। উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় সংস্কার দরকার আছে। একটা শিল্পকে রুগ্ন শিল্প বলে তাকে আটকে রাখলাম, একজন মানুষকে রোগী সাব্যস্ত করে তাকে হাসপাতালে রাখলাম কিন্তু দিনের পর দিন কোনো চিকিৎসা দিলাম না— ব্যাপারটা তো অনেকটা তেমন। একটা সমাজ, ১৬ কোটি বা ২০ কোটি লোকের একটা সমাজ। এখানে তো বইয়ের প্রয়োজন আছে। এই সমাজকে তো আজ হোক কাল জ্ঞানমুখী করতে হবে। সমাজকে জ্ঞানমুখী করার উদ্যোগগুলো আগে ভাবতে হবে। সমাজকে জ্ঞানমুখী করার উদ্যোগ নিলে প্রকাশনাশিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ অনেকটা এমনিতেই হয়ে যায়।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে যে বইমেলা হয়, তার উপর নির্ভর করে অনেক ছোট ছোট প্রকাশনা বিপননের নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবনে বিমুখ হয়ে আছে। এটা কি প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য হুমকি নয়? আপনাদের মতো বড় বড় প্রকাশনাও এই মেলায় বিক্রি হওয়ার উপর খুব বেশি নির্ভর করেন?
সুলতান আহম্মেদ: সৃজনশীল ও মননশীল বইপত্রের প্রকাশনা আমাদের এখানে অনেকটাই বছরের একমাসের বইমেলাকেন্দ্রিক। আমাদের একটা দেশ যেমন সবকিছুতে ঢাকাকেন্দ্রিক, এক নগরকেন্দ্রিক। একমাসের বইমেলাকেন্দ্রিকতাকে শুধু সমস্যা হিসেবে দেখব কেন, সম্ভাবনা হিসেবেও দেখা যায়। এক মাস ধরে বইমেলা হওয়া কিন্তু একটা বড় ব্যাপার। এতো সময় ধরে বইমেলা তো বিশ্বেই খুব কম হয়। আমরা বড় প্রকাশনা নই, ছোট প্রকাশনাগুলোও দীর্ঘ সময়ের এই মেলাকে টিকে থাকার জন্য বড় মনে করে। তবে বইমেলা দেশের বিভিন্ন স্থানে সারা বছর জুড়েই হতে পারে।
প্রচলিত ও বড় প্রকাশনার বাইরে ছোট প্রকাশনাগুলোর বিকল্প উদ্যোগ থাকা জরুরি। যেমন ধরুন, আমাদের দেশে তো লিটল ম্যাগাজিন মেলা নেই, কলকাতায় সেটা আছে। আমাদের বইমেলায় ছোট প্রকাশনাগুলোর তো কোনো দাঁড়ানোর জায়গা নেই। লিটল ম্যাগাজিনের যে বরাদ্দ আছে সেখানেই তো তাদের জন্য জায়গা করে দেওয়া যায়। ফেব্রুয়ারিতেও সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে বইমেলা হতে পারে। এখন ধীরে ধীরে তা হচ্ছেও। বইমেলা, বই নিয়ে আলোচনা, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষদের নিয়ে সারা দেশে নানা আয়োজন হতে পারে। অগ্রসর মানসিকতার একটা সমাজ বিকাশের জন্য তা জরুরিও।
এখন তো আমাদের দেশের প্রতিটি উপজেলায় শিল্পকলা একাডেমি গড়ে উঠছে। কিন্তু প্রতিটি উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পাঠাগার গড়ে উঠা জরুরি। শুধু পাঠাগার নয়, পাঠাগারের সাথে পাঠের সংস্কৃতিও থাকতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে শিল্প-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের মানুষকে সামাজিকভাবে পরিসর দিতে হবে। তাদের সামনের সারিতে না এনে, তাদের সামনের সারিতে না রেখে তো একটি অগ্রসর সমাজ আশা করা যায় না।

বিডিনিউজ: উজান প্রকাশন ইতিমধ্যে কয়েকটি বই পাঠক গুরুত্ব পেয়েছে। বই প্রকাশ করতে গিয়ে গুণ ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদ্ধতি আপনারা অবলম্বন করেন?
সুলতান আহম্মেদ: আমরা ভালো পাণ্ডুলিপি বা ভালো বইটি প্রকাশের জন্য বেছে নেওয়ার চেষ্টা করি। প্রকাশনায় আমরা শিশুদের জন্য ভালো বই, বিশ্বসাহিত্যের ভালো বইগুলোর অনুবাদ, তত্ত্ব-দর্শন নিয়ে বই এবং বিশেষ করে মানসম্পন্ন অনুবাদে আমরা বেশি জোর দিতে চাই। তবে আমরা যে শুধু এসব বিবেচনায় বই প্রকাশ করতে চাই, তা নয়। বিশেষায়িত থেকেও নির্বিশেষে ভালো পাণ্ডুলিপির ওপর জোর দিই আমরা।

বিডিনিউজ: উজান প্রকাশন এ বছর কী কী বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে?
সুলতান আহম্মেদ: বইমেলাকে কেন্দ্র করে আমাদের প্রকাশনা খুব একটা থাকবে না। করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার আমাদের মতো সীমিত সামর্থের প্রকাশকদের বই প্রকাশের তোড়জোর কম। এখন পাঁচ-ছটি বইয়ের কাজ চলছে। একটি অভিজিৎ মুখার্জির অনুবাদে বিদেশি গল্পের সংকলন 'বিগ্রহ ও নিরাকার', শাখাওয়াত বকুলের অনুবাদে তাত্ত্বিক ফ্রানৎস ফ্যানোর 'কালো চামড়া, সাদা মুখোশ'। এছাড়া শিশুদের জন্য কয়েকটি অনুবাদের বইয়ের কাজ চলছে।

বিডিনিউজ: বহু প্রকাশক গত বছর থেকে বঙ্গবন্ধুর উপর প্রচুর বই বের করেছেন এবং আরো করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। এ বিষয়ে আপনারা কী কী গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন?
সুলতান আহম্মেদ: মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এরই মধ্যে অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। বইয়ের সংখ্যা হিসাব করলে সেটি কিন্তু বিরাট বড় ঘটনা। আমাদেরও এ ব্যাপারে পরিকল্পনা আছে। এ বিষয়ে আমরা মানসম্পন্ন ও ভালো বই প্রকাশ করতে চাই। যুদ্ধবিরোধী একটি উপন্যাস আমরা প্রকাশ করেছি বিশ্বসাহিত্য থেকে, ছন্দা মাহবুবের অনুবাদে এলিনর কোয়েরের উপন্যাস 'কাগজের হাজার সারস'। হিরোশিমায় পরমাণুবোমার তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে একটি শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যুর ওপর ভিত্তি করে রচিত বিশ্বখ্যাত শিশুতোষ উপন্যাস।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর গ্রন্থমেলায় প্রচুর বই থাকে সেবারই প্রথম। এর মান নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। বড় প্রকাশনীর একটা দায় থাকে সম্ভাবনাময় তরুণ লেখককে তুলে আনার। সেক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা করা, পত্রিকার লেখা দেখে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। আপনি কিভাবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে নির্বাচন করেন?
সুলতান আহম্মেদ: বই প্রকাশ কিন্তু একটা অধিকার। একজন অলেখকেরও বই প্রকাশ ও ছাপার অধিকার আছে। একজন মানুষ তার পরিবার ও উত্তরসুরিদের জন্যও একটি স্মৃতিকথা লিখে যেতে পারেন। কোনো লেখক না হয়েও তিনি সেটা পারেন এবং সেই সুযোগ তার থাকা উচিত। সব সময় শুধু ভালো মানের বই প্রকাশ হবে এটা হয় না, এটা আশাও করা যায় না।
সিরাজগঞ্জের জনৈক অখ্যাত আজিমউদ্দিন চৌধুরী দেড়শ' বছর আগে একটা 'জীবনচরিত' লিখে গেছেন। একজন হতদরিদ্র আজিমউদ্দিন ব্রিটিশ পুলিশের কনস্টেবল হয়ে উঠার জন্য যে লড়াই করেছেন, সেটিই লিখে গেছেন তিনি। সেই বই তো আজ একটি সামাজিক ও ঐতিহাসিক দলিল। বরিশালের আরজ আলী মাতুব্বরের প্রথম বই 'সত্যের সন্ধান'ও তো সেই অর্থে প্রথাগত ও প্রচলিত বিবেচনায় অলেখকের বইই। ওই বই প্রকাশ হওয়ার পরই তো আমরা তাকে দার্শনিক হিসেবে চিনলাম, জানলাম। মানসম্পন্ন বই প্রকাশ হবে, মানহীন বইও প্রকাশ হবে। বই প্রকাশের সংস্কৃতিকে, যেকোনো ব্যক্তির বই লেখার ও প্রকাশের আগ্রহকে আমি ভালোই মনে করি।
তরুণ লেখকদের তুলে আনবে প্রকাশকরা নিজেদের প্রয়োজনেই। এখনকার আমাদের প্রতিষ্ঠিত ও বড় প্রকাশকদের দেখুন— তারা তাদের প্রজন্মের কিংবা তাদের সমবয়সী লেখকের বই প্রকাশক করেই বড় ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। যে প্রকাশকরা ওই লেখকদের মধ্যেই থেমে যাবেন তাদের প্রকাশনাও ধীরে ধীরে থেমে যাবে। নতুন লেখকদের সাথে নতুন প্রকাশকদের যোগসূত্র থাকবে— এটা তো সমসাময়িকতা, এটা তো প্রজন্মের বন্ধন। পুরনো, বড় ও প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনাও টিকে থাকার প্রয়োজনে নতুন লেখকদের বেছে নেবে এটাই স্বাভাবিক।

বিডিনিউজ: ধন্যবাদ, সুলতান আহম্মেদ ভাই, আপনি ষড়ৈশ্বর্য মুহাম্মদ নামে চমৎকার গল্প লিখছেন, অনুবাদ করছেন, আমরা জানি। আন্তরিক সময় দেয়ার আপনাকে জন্য।
সুলতান আহম্মেদ: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। ধন্যবাদ বিডিনিউজকেও। কাঁটাবনের কনকর্ড এম্পোরিয়ামে উজান-এর যে সমৃদ্ধ বইয়ের সুপরিসর আউটলেট আছে, এই বইয়ের সৌধে লেখক-পাঠককে সব সময় স্বাগতম।