বাংলা একাডেমির বইমেলা: বইবিক্রি বনাম চেতনার উৎকর্ষ

আহমাদ মাযহারআহমাদ মাযহার
Published : 2 Dec 2020, 02:57 PM
Updated : 2 Dec 2020, 02:57 PM


আরম্ভকথা: আমার বইমেলা

বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের বইমেলায় আমি প্রথম গিয়েছিলাম ১৯৮০ সালে। তখনও উচ্চ-মাধ্যমিকের দুয়ার পার হইনি। সবে লেখালিখির স্বপ্ন জেগে উঠতে শুরু করেছে। এর পর থেকে এমন বছর আসে নি যে-বছর বইমেলায় যাওয়া হয়নি। আশি সালে মেলার পরিসর ছিল অল্প। বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চের সামনের ছোট্ট ঘাসে ছাওয়া প্রাঙ্গণেই সীমিত ছিল বইমেলা। সাকুল্যে পনেরো কুড়িটি স্টল ছিল। বিকেল ৪টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ছিল মেলার সময়সীমা। বইমেলাকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন বই প্রকাশিত হওয়ার রেওয়াজ তখনও শুরু হয় নি। সন্ধ্যায় ঘেসো মাঠে ছোটখাটো আড্ডা বসতো লেখকদের। আজকের দিনের মেলার সঙ্গে তুলনা করে সেই মেলাকে জমজমাট বইমেলা কিছুতেই বলা যাবে না। কিন্তু সেই স্নিগ্ধ বইমেলার কথা আমার সবসময়ই মনে পড়ে। দেশের বিশিষ্ট লেখকদের সামনাসামনি দেখবার লোভে প্রায়শই আমি বইমেলায় যেতাম। স্পষ্ট মনে পড়ছে না সেটা ১৯৮১ নাকি ১৯৮২ সাল ছিল। সেবার সন্ধানী প্রকাশনীর আকর্ষণীয় স্টলসজ্জা করেছিলেন শিল্পী কাইয়ূম চৌধুরী। বিখ্যাত লেখকদের অনেকেই আড্ডা দিতেন সেই স্টলে। বাংলা একাডেমির বইমেলাতেই আমি বাংলাদেশের সাহিত্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখককে প্রথমবারের মতো দেখি।
প্রথম থেকেই বাংলা একাডেমির বইমেলা যতটা না বইয়ের মেলা তার চেয়ে বেশি ছিল দেশের উদীয়মান বাঙালি মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক চেতনাবিকাশের এক নতুন উপলক্ষ। ভাষা আন্দোলনের আত্মত্যাগ ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঘটেছিল বলে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলা একাডেমি ২১ ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে কিছু আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এ-উপলক্ষে স্বাধীনতা-উত্তর কালে জনসমাগম বইমেলা আয়োজনের প্রেরণা হয়ে দেখা দিয়েছিল। নবীন বাংলাদেশে প্রকাশনা সংস্থা বলতে তখন মুক্তধারাই ছিল প্রধান। হয়ত সে-কারণেই এর কর্ণধার চিত্তরঞ্জন সাহার মনে এই ধারণা প্রথম এসেছিল যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির যে-সংখ্যক প্রতিনিধিত্ব এখানে ঘটে একই সঙ্গে সামর্থ্যে ও সাংস্কৃতিক চেতনায় তাদের পক্ষেই সম্ভব বইয়ের ক্রেতা হওয়া। সুতরাং চট বিছিয়ে কিছু বই নিয়ে মুক্তধারা সেখানে হাজির হয়েছিল। বাংলা একাডেমির আনুষ্ঠানিকতার উপলক্ষ হিসাবে সংগত কারণেই জাতীয় সাংস্কৃতিক-চেতনা হয়ে উঠেছিল এর কেন্দ্রীয় শক্তি। বইমেলাও ক্রমশ এরই ধারক হিসাবে ক্রমবর্ধমান। এখানে যারা আসেন তাঁরা সকলেই অনুভব করেন ব্যাপারটা। এই অনুভব এখন আরো গভীরতর হয়েছে।

১৯৮৪ সালে বইমেলা হঠাৎ বিরাট আকার পায়। বলা যায়, তখন থেকেই বইয়ের মর্মগত সৌন্দের্যের চেয়ে বাণিজ্যিক স্বার্থ বড় হয়ে উঠতে থাকে; কারণ তখনই অনুভ‚ত হতে থাকে বই বিক্রি ব্যবসা হিসেবেও মন্দ নয়! তা ছাড়া এই ব্যবসার সঙ্গে সাংস্কৃতিক আভিজাত্যের যোগ ঘটায় ব্যবসা সম্পর্কিত বাঙালিসুলভ নেতিবাচকতা থেকেও মুক্ত থাকা যায়। সে বছরই বাংলা একাডেমি 'ভাষাশহীদ' গ্রন্থমালার আওতায় একশো একটি নতুন বই প্রকাশ করে। সে বছর থেকেই নতুন বইয়ের প্রকাশনা মেলায় গুরুত্ব পেতে থাকে। ছোট্ট ছিমছাম বইমেলা ক্রমশ হয়ে উঠতে থাকে মানুষের মহামিলন মেলা। এই মেলা বাংলাদেশের লেখক-সাহিত্যিকদের উৎসাহিত করতে থাকে; লেখকেরা বেশি করে ঝুঁকতে থাকেন বই প্রকাশের দিকে। এমনিতে যে-সব বইয়ের খোঁজ তেমন পাওয়া যেত না বাংলা একাডেমির বইমেলা হয়ে উঠল সেসব বইয়ের প্রাপ্তিস্থল। কারণ যাঁদের প্রকাশনার কোনো খোঁজ কেউ রাখে না সেসব বইয়ের সমাহার ঘটতে থাকে বইমেলায়। প্রকৃত পাঠক-ক্রেতাদের কাছেও বইমেলা তাই ক্রমশ গুরুত্ব পেতে থাকে। উৎকর্ষমুখী মধ্যবিত্ত মনের খোরাক সন্ধানীদের কাছে বাংলা একাডেমির বইমেলার গুরুত্ব বাড়তে থাকে দিন দিন।

নবীন লেখক হিসেবে আমিও অনুপ্রাণিত হই মেলায় আমার লেখা বই প্রকাশের ব্যাপারে। ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমির বইমেলাকে সামনে রেখে দিনরাত পরিশ্রম করে ছেপে বের করতে পারি আমার প্রথম বই, ছোটদের কবিতা-সংকলন ঘুমের বাড়ি। নিজের বই বের হবার পর থেকে কেমন যেন বইমেলা আরও বেশি আপন হয়ে ওঠে। ১৯৮৯ সালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত বইয়ের স্টল নিয়ে নিয়মিত হাজির থাকত¬াম। কিভাবে কিভাবে যেন মেলায় মেলায় ম্যালা বছর পার হয়ে যায়। কিন্তু বইমেলার প্রেম আমার কমে না, বরং বেড়েই চলে। মেলায় প্রবেশ যত হাঙ্গামারই হোক না কেন, মৌলবাদী হামলার যত আশঙ্কাই থাকুক না কেন বইমেলায় আমাকে যেতেই হবে। বাংলাদেশের বই-সংস্কৃতির সজীবতা এখানে যেমন অনুভব করা যায় তার তো আর কোনো বিকল্প নেই! এখানে এমন অনেক মানুষের দেখা পাওয়া যায় যাঁরা আমার প্রিয়জন। হয়তো সারা বছরে তাঁদের খোঁজ পাই না মেলাতেই দেখা মেলে তাঁদের। আনেক দিন পর হলেও প্রিয়মুখ দেখতে পাওয়ার আনন্দের কি তুলনা আছে? প্রতি বছরই অনুভব করি একসময় এমন অনেক প্রিয়মুখের নিয়মিত দেখা পেতাম যাঁদের আর কোনও দিন মেলায় দেখতে পাব না। বইমেলা তাই আমার হৃদয়ে একই সঙ্গে আনন্দ ও বিষণ্ণতার যুগল আধার।
পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতাদের চাঁদার অর্থ বইমেলার আয়োজনে যুক্ত হলেও মনে পড়ে গোড়ার দিকে মেলার ব্যবস্থাপনায় মূল ভূমিকা ছিল জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের। বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে মেলা হতো বলে বাংলা একাডেমির ভূমিকা ছিল প্রধানত আশ্রয়দাতা সহযোগীর। কারণ তার দায় ছিল একুশে উপলক্ষে অনুষ্ঠান আয়োজনের, বইমেলার নয়। কিন্তু ক্রমশ মেলা স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে স্ফীত হয়ে উঠতে থাকলে একাডেমির পক্ষে দায় এড়ানো সম্ভব হয়নি। বাঙালির জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক এই প্রতিষ্ঠানটি এর নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব নেয়। সেজন্যেই হয়তো একুশের বইমেলা সংবাৎসরিক বিদ্যাচর্চার মুক্তির সবচেয়ে বড় উপলক্ষ হয়ে উঠেছে। বাণিজ্যিকতা এই মেলাকে সবসময়ই চোখ রাঙায়, কিন্তু সাংস্কৃতিক চেতনার সঙ্গে পুরোপুরি পেরে ওঠে না। আমাদের কাছে তাই বইমেলার এই সাংস্কৃতিক রূপটাই বড় হয়ে ধরা দেয়। আমি তাই কেবল বাণিজ্যিকতার বিস্তারের বাস্তবতায় এই বইমেলাকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে সরিয়ে নেবার কিছুতেই পক্ষে নই। বাণিজ্যিকতার প্রয়োজন যখন সত্যিকার বড় হয়ে উঠবে তখন সে শক্তি অর্জন করবে বাণিজ্যিক শর্তপূরণের। বইমেলার আয়োজনে তার প্রাধান্য ঘটবে। আমার মনোভঙ্গি ছিল, বাংলা একাডেমির বইমেলা থেকে এর প্রাণকে কেড়ে নেয়ার বিনিময়ে যেন সে চেষ্টা না হয়। ২০১১ বা ১২ সালের দিকে বইমেলাকে বাংলা একাডেমি প্রঙ্গণের বাইরে নেয়ার কথা উঠলে আমার অবস্থান ছিল তার বিপক্ষে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বইমেলার মূল অংশই এখন বাংলা একাডেমির বাইরে। এটা যেমন বেশিরভাগ মানুষের চাওয়া এবং বাস্তবতা তা-ও অস্বীকারে উপায় নেই। কিন্তু যে জন্যে আমি তখন বিরোধিতা করতাম এত বিস্তৃতি সত্ত্বেও সে কারণগুলো এখনও বিদ্যমান। অনেকেই হয়তো বলবেন পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। কারণ চেতনাগত দিক এর গুরুত্ব হ্রাস পেয়ে বাণিজ্যিকতা প্রাধান্য পেয়েছে। না, আমি মোটেও বাণিজ্যিকতা-বিমুখ নই। তা সত্ত্বেও এই চেতনাগত প্রেক্ষণবিন্দু থেকে আমি এখনো বাংলা একাডেমি বইমেলার এই ধরনের অবয়বগত বিস্তারকে সমর্থন করতে পারি না। কারণ বইমেলার সম্প্রসারণকে কেবল চেতনাগত দিক থেকে দেখা যেমন বাস্তব নয় তেমনি বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও বাংলা একাডেমির বইমেলাকে দেখা সঙ্গত নয়। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বড় হওয়ার ফলে বইমেলার নিশ্চয় উল্লেখযোগ্য উন্নতিও ঘটেছে এবং এর বেশ কিছু ইতিবাচক প্রভাবও পড়েছে আমাদের সমাজে। কিন্তু তা যে বই-সংস্কৃতির উৎকর্ষের দিক থেকে এখনো ঠিক সন্তোষের কারণ হয়ে উঠতে পারেনি তা লেখক-পাঠক প্রকাশকদের কথায় প্রায়শই উঠে আসে। প্রতি বছর বইমেলার সম্প্রসারণ সত্ত্বেও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষপন্থীদের মধ্যে এই অসন্তোষ যথেষ্ট প্রবল তার কারণ খুঁজে দেখাও বেশ জরুরি।

বাংলা একাডেমির বইমেলা কেবল বইবিক্রির মেলা নয়

বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলার বাইরে নগরবাসীদের মধ্যে পুস্তক বিপণনের সন্তোষজনক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি, বরং পূর্ববর্তী ব্যবস্থা ক্ষীণতর হয়ে পড়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর কালে পুস্তক প্রকাশনায় নাই নাই করেও যতটা উন্নতি করেছে, যে পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগ হয়েছে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বই বিপণনের কার্যকর ব্যবস্থা বলতে গেলে গড়েই ওঠে নি। মফস্সলবাসীদের কাছে রেলস্টেশনের বুকস্টলগুলো ছিল কাক্সিক্ষত বইয়ের আধার ও উৎস। একটা সময় ছিল যে যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়া সত্ত্বেও ভিপিপি ব্যবস্থায় ডাকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বই পৌঁছে যেত। তখনকার প্রকৃত পাঠকসমাজের বাস্তবতার সঙ্গে তা ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশের সমাজে বিত্তমুখী রূপান্তর ঘটায় বইয়ের চাহিদার যেমন বদল ঘটেছে, তেমনি প্রকাশনায়ও এসেছে বৈচিত্র্য। রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপান্তরের সূত্রে দেশব্যাপী বই-সরবরাহের সেই ব্যবস্থা এখন আর কার্যকর নেই। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে বই পাঠানোর প্রক্রিয়াটিও ব্যয়বহুল বলে যথেষ্ট জনপ্রিয় হতে পারেনি। ফলে অনেক ধৈর্য ধারণ করে স্থানীয় বইয়ের দোকানের মাধ্যমে বাংলাবাজার থেকে সরাসরি সংগ্রহ করা ছাড়া ক্রেতাদের পক্ষে আর প্রায় কোনো সহজ উপায়ই নেই। প্রকাশকেরাও এখনো বৈচিত্র্যপূর্ণ পাঠকদের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো নির্ভরযোগ্য মাধ্যম গড়ে তুলতে পারেননি। তবে হাঁ, দুই-একজন জনপ্রিয় লেখক এই হিসেবের বাইরে পড়বেন। এ কারণে অধিকাংশ প্রকাশক এই দু-একজন জনপ্রিয় লেখকের ওপর ভরসা করেই প্রকাশনা ব্যবসায় আসতে চান। শুধু কতিপয় জনপ্রিয় লেখকের ওপর নির্ভর করে বইয়ের শিরোনামসংখ্যা বাড়ে না বলে অন্য ধরনের বইও প্রকাশকেরা প্রকাশ করে থাকেন। অনেকটা অব্যবসায়িক কাজ মনে করে বিচিত্র বিষয়ে যে-সব বই আজকাল প্রকাশিত হচ্ছে সেগুলোর সম্পর্কে পাঠকদের জানানোর উপায়ও তারা এখনো বের করে উঠতে পারেননি। জ্ঞানার্থীদের মধ্যেও অনেকেই আর জানতে পারেন না কোন বই কোথায় পাওয়া যাবে। দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা সাধারণ বইসন্ধানীদের কাছে বই পৌঁছাবার আর কোনো উপায় নেই। আমার ধারণা, অমর একুশের অনুভব ও অনুভূতির সঙ্গে বইয়ের সম্পর্ক যুক্ত হওয়ায় প্রকাশনাসংস্থা ও পাঠক উভয় দিক থেকেই বইপ্রেমীরা ধীরে ধীরে ব্যাপকভাবে বইমেলামুখী হয়ে উঠেছেন। এই অবস্থা গড়ে উঠেছে আমাদের এক ধরনের সাংস্কৃতিক স্বতঃস্ফূর্ততার মধ্য দিয়ে। সেজন্যই বাংলা একাডেমির মেলা থেকে কেবল বই ক্রয়ই উদ্দেশ্য থাকে না মেলায় আগত মানুষদের। বই দেখা-কেনার অতিরিক্ত একটা উৎসবমুখরতা, একটা দেশপ্রেমের চেতনা এর সঙ্গে যুক্ত থাকে বলে এই মেলাকে নিছক একটা বইবিক্রির ব্যবসায়িক মেলা ভাবা একেবারেই ঠিক হবে না। সেই বিবেচনাতেই অনেকে মনে করেন একুশের চেতনাগত ভাবমূর্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বইই থাকতে হবে এই মেলায়।

দেখা যায় যে নগরবাসী, কেবল নগরবাসীই-বা বলি কেন, একুশের চেতনাগত কারণে সারাদেশের মানুষেরই প্রত্যাশা থাকে মেলায় আসবার। লক্ষ্য নতুন নতুন বই দেখা, সামর্থ্য হলে কেনা। সাধারণ মানুষের এই রকম প্রত্যাশা থেকেই বাংলা একাডেমির বইমেলা বর্তমান প্রসারিত অবস্থায় উপনীত হয়েছে। যে-সব বিশেষত্বপূর্ণ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সারা বছর কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না তারাও এই মেলায় তাঁদের স্টল নিয়ে অসেন। পেশাদার প্রকাশকদের প্রকাশনা ছাড়াও অনেক নবীন লেখকের বই নিজ উদ্যোগে বা বন্ধু-বান্ধবের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে অনেক ভালো বইও থাকে। ফলে বাংলা একাডেমির এই বইমেলা সারা বছরের সৃজন ও মননাকাক্সক্ষার মেলা হয়ে ওঠে। এর ফলেই ক্রেতারা বিচিত্র বইয়ের খোঁজ পান এই মেলায়! এইসব মিলিয়েই পুস্তক বিপণনে বাংলা একাডেমির বইমেলার ভূমিকা এমন প্রবল হয়ে উঠেছে। ঢাকা মহানগরীতে বইয়ের দোকানের সংখ্যা যেমন অপ্রতুল তার চেয়ে অপ্রতুল প্রয়োজনীয় বইটির খোঁজ পাওয়া! আর এই মেলায় সর্বোচ্চসংখ্যক প্রকাশক তাদের নতুনপুরোনো বই নিয়ে আসে। ফলে কেবল প্রকাশকদের দিক থেকেই নয়, সত্যিকারের পাঠকদের দিক থেকেও বাংলা একাডেমির বইমেলার বিকল্প নেই!

আশির দশকের গোড়ার দিককার মেলায়ও বই বিক্রি নিশ্চয়ই হতো, কিন্তু বিক্রিতে ব্যবসাভাবের চেয়ে পাঠকের কাছে বই পৌঁছে দিতে পারার আনন্দ বড় ছিল। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই পরিস্থিতি বেশ বদলে যেতে থাকে। যতই সময় যায় প্রকাশকদের মধ্যে ততই বই-বিপণনাকাক্সক্ষা যেন এর অন্যান্য মর্মগত দিকগুলোকে উপেক্ষা করে বড় হয়ে উঠতে থাকে। স্টলসংখ্যা অহেতুক বেড়ে ওঠার এটাই মনে হয় সবচেয়ে বড় কারণ। আর স্টল বাড়তে থাকার প্রক্রিয়াতেই ক্রমশ ক্ষুণ্ণ হতে থাকে অমর একুশের বইমেলার মর্মগত ভাবমূর্তি। বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলার প্রকৃত সংকটও এটাই। প্রকৃতপক্ষে অমর একুশের ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নীতি সংরক্ষিত হবে এমন দৃঢ়তা থাকলে জায়গার অনটন এতটা প্রকট মনে হতো না! নব্বইয়ের দশক থেকেই দেখা যাচ্ছে প্রকাশনার সংখ্যা সামান্য হওয়া সত্ত্বেও অনেক এনজিওকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। যে-সব এনজিও সৃজনশীল বা মননশীল বই প্রকাশ করে বইমেলায় তাদের স্টল বরাদ্দ করায় আপত্তি থাকতে পারে না, কিন্তু বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন প্রতিষ্ঠানকে স্টল বরাদ্দ দেয়ার কী যুক্তি থাকতে পারে! বইমেলায় বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থা মেলার স্পনসর হতে পারে কিন্তু মেলার লক্ষ্যকে হুমকির মুখে ফেলে তাদের স্টল বরাদ্দ দেয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। মেলার প্রধান স্থানে স্টল থাকে একটি ব্যাংকের। সেটা একদিকে যেমন স্থান নষ্ট করেছে তেমনি অন্যদিকে ক্ষুণ্ণ করেছে বইমেলার মর্মগত ভাবমূর্তিও। এমনও গণমাধ্যমের স্টল দেখা গেছে যাদের বইমেলায় কোনো ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় নি। যদি সেবা দেয়ার স্বার্থে ব্যাংক রাখবার প্রয়োজনও হয় তাহলেও বইয়ের স্টলের স্থানের ক্ষতি করে তার অবস্থান হতে পারে না। বাণিজ্যিক প্রচারণা ছাড়া কাগজের দোকানের যথার্থ কী ভূমিকা থাকতে পারে বইমেলায়? মিডিয়াসেন্টার প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো একটি ইন্টারনেট সেবাদাতাকে স্টল দেয়া যেতে পারে কিন্তু তার স্থান মেলার মূল জায়গায় হতে হবে কেন? গণমাধ্যম বিবিসিরও স্টল ছিল; বইমেলায় বিবিসির ভূমিকা কী? যদি বিক্রি হবে এমন দু-একটা প্রকাশনা বিবিসির থাকতো তাহলেও একটা কথা ছিল। দু-একটা প্রকাশনার জন্য আস্ত স্টল না দিয়ে একটা সাধারণ স্টলে প্রদর্শন বা বিক্রয়ের জন্য বই রাখা যায়। উদ্দিষ্ট বইয়ের সন্ধানে ঐ স্টল থেকে ব্যতিক্রমী বইগুলো সহজে সংগ্রহ করার ব্যবস্থা থাকলে উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হতো আর বইমেলার মর্মগত ভাবমূর্তি জাগরুক থাকতে পারত। যে স্টলগুলোয় নিজেদের বিক্রয়যোগ্য বই নাই সে-সব স্টলের কর্মীরা বইমেলার নীতি বহির্ভূত অনেক বই বিক্রির জন্য রাখবার অবকাশ পেয়ে যান। বইমেলার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করবার অবকাশ এভাবেই বাড়তে থাকে।
বাংলা একাডেমি এই বইমেলার আয়োজক হলেও দেশের প্রধান পুস্তক-প্রকাশনা সংস্থাগুলো এর অংশগ্রহণকারী। সে কারণে বইমেলার আয়োজনে প্রকাশকদের সঙ্গে নিতে হবেই বাংলা একাডেমিকে। সেই সূত্রেই নীতিমালা প্রণয়নে তাদের অংশগ্রহণও থাকবে। কিন্তু দেখা যায় এই কমিটিতে প্রকাশক প্রতিনিধিরা নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থকে বড় করে দেখছেন বা সেই সংকীর্ণ স্বার্থের অনুক‚লে ভবিষ্যতের কোনো সুবিধার পথ তৈরি করে নিচ্ছেন। প্রভাবশালী প্রকাশকেরা নিজেরাই অনেকে এই মেলায় একুশের মর্মগত ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করবার ব্যাপারে যথেষ্ট দায়ী। মর্মগত ভাবমূর্তি রক্ষায় যথেষ্ট আন্তরিক নন এর সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বশীলদের অনেকেই। কিন্তু তাঁরাই নানা প্রক্রিয়ায় নেতৃত্বকে নিজেদের করতলগত করে রাখছেন। এসবের চাপে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ অনেক সময় সংগতভাবে যেমন মেলা ব্যবস্থাপনা করতে পারেন না তেমনি ধরে রাখতে পারেন না এর ভাবমূর্তিকেও। তা না-হলে গৃহীত নীতির ব্যত্যয় বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের দ্বারাই হয়ে থাকে কেন? এমন কিছু নীতি তাঁরা গ্রহণ করেন কেন যখন কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই জানেন যে ব্যত্যয় ঘটবেই! এই সুযোগেই অনুপ্রবেশ ঘটে নানা অসংগতির। দৃশ্যত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাবে এর নীতিমালা ভঙ্গের ঘটনা ঘটলেও নীতিভঙ্গের পেছনে সংশ্লিষ্ট অন্যদের ভূমিকাও কম নয়! কিন্তু দায় পড়ে কেবল ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বা বিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপর। যদি সংকীর্ণ স্বার্থকে বড় করা থেকে অন্যরা বিরত থাকে তাহলে রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের কর্মীদের বলদর্পিতা এমনিতেই কমে যাবে। এই ধরনের নীতিভঙ্গ যখন সমাজের সবচেয়ে উন্নত স্তর থেকে ঘটে তখনই এই ধরনের ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়!
বেশ কয়েক বছর ধরে দেখা গেছে, প্রথমে যত সংখ্যক স্টল বরাদ্দ দেয়া হয় তার থেকে স্টলসংখ্যা এক দুই করে বাড়তে থাকে! বাড়তে বাড়তে প্রায় স্টল না পাওয়ার মতো কেউ আর বাকি নেই! অথচ নীতির সীমাবদ্ধতার কারণে যে প্রকাশনার একাধিক ইউনিট পেলে হয়তো ভালো হতো তারা পায়নি। তারপর এমন নীতি প্রণীত হয় যাতে দীর্ঘ কাল ধরে নিষ্ক্রিয় প্রকাশকও একদা প্রকাশ করতেন বলে বড় স্টল পেয়ে যাচ্ছেন। যে-সব প্রকাশক সম্প্রতি প্রকাশনা শুরু করলেও বেশি সক্রিয় এবং ভালো মানের প্রকাশনা করছেন তারা ছোট আকারের স্টল পাচ্ছেন বা স্টলই পাচ্ছেন না। নীতির আওতায় আসে না বলে কোনো কোনো প্রকাশকের ভাগে স্টলই জোটে না! এই অবস্থাই চলমান দীর্ঘ কাল ধরে।
সা¤প্রতিক কালে তরুণ উদ্যমী কয়েকজন প্রকাশক বেশ সক্রিয় আছেন। তাঁরা বইয়ের সংখ্যায়, বিষয় বৈচিত্র্যে, প্রকাশনা মানে পুরোনো ঐতিহ্যবাহী প্রকাশকদের অনেকের চেয়ে ভালো এবং বেশি বই প্রকাশ করা সত্ত্বেও বড় স্টল পান না এই বলদর্পী ক্ষমতার সঙ্গে পেরে ওঠেন না বলে। একুশের ভাবমূর্তির স্বার্থে তাদের স্টল পাওয়া উচিত এ-কথা আয়োজক প্রতিনিধিদের অনেককে বলতে শোনা যায়। এ-কথাও বলতে শোনা যায়, তাঁরা তা অনুভব করেও সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারেন না বলদর্পী প্রকাশক-বৃত্তের চক্রব্যুহের কারণে। এতে করে বইমেলার স্বাভাবিক সৌন্দর্য রক্ষা করা কি যাচ্ছে? অথচ নীতি যদি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে, সততার সঙ্গে করা হয় তাহলে তাহলে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বেই! যেমন, ২০১২ সালের বইমেলায় নিয়ম করা হয়েছিল, যে-সব প্রকাশক পূর্ববর্তী সময়ে প্রকাশিত তাঁদের সব প্রকাশনা জাতীয় আর্কাইভে জমা দেবেন না তাঁরা স্টল পাবেন না। এই নিয়ম করবার পর থেকে এই সংক্রান্ত আইনের বাস্তবায়ন ঘটতে শুরু করেছে, এতদিন এর কোনো প্রয়োগই ছিল না সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতার অভাবে। তা ছাড়া দেখা যায়, আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতের মানুষদের কেউ কেউ নিজের অবস্থান ভুলে মেলা কমিটির কাছে অন্যায় আবদার নিয়ে আসেন বা প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করেন। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্যদের বলদর্পিতা যে মেলার ভাবমূর্তি প্রায়শই ক্ষুণ্ণ করে সে কথা আলাদা করে বোধ হয় বলার প্রয়োজন নেই। বইমেলা আয়োজনে এইসব অন্তরালের ঘটনা মেলার মর্যাদাকে ক্রমশ নিচে নামিয়ে আনে। বইমেলায় এমন অনেক স্টল থাকে যে-সব স্টলের উপস্থিতি অনিবার্য তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারণে। কিন্তু দেখা যায় যে স্টলগুলো পাবার পর আর এর ভাবমূর্তির দিকে সেইসব প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন দৃষ্টি রাখে না বা রাখবার সামর্থ্য তাদের নেই। তা ছাড়া এই কাজগুলো ঘটে আমাদের দেশের কোনো কোনো খ্যাতিমান মানুষের বিবেকহীনতা ও দায়িত্বহীনতার কারণেই।

সকলেই জানেন সব কিছুর ওপরে স্থান দিতে হবে শুভবুদ্ধিকে। বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জাতীয় শুভবুদ্ধিকে সমুন্নত করবার লক্ষ্যে। একটি ভালো নীতিকেও কলুষিত করে ফেলা যায় অশুভের কাছে নতি স্বীকার করলে। বাঙালির জাতীয় চেতনার সেই প্রেরণাকেই জাগিয়ে তুলতে হবে বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলার সাফল্যের জন্য। কারণ বাংলা একাডেমির বইমেলা কেবল বাণিজ্যিক লাভালাভমুখী বইবিক্রির মেলাই নয়, বাঙালির মননগত শক্তির মিলনমেলাও।


অনেক বেশি টাকার বই বিক্রিই কি বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলার সাফল্য?

২০১৬ সালে বাংলা একাডেমির বইমেলার আয়তন ৪ লক্ষ বর্গফুটে পৌঁছেছে। প্রায় ৪০০ টি প্রকাশনা-সংস্থা বিভিন্ন আয়তনের ৬৫০টি ইউনিটে বিভক্ত হয়ে তাদের পসরা সাজিয়ে বসবে। লক্ষ্যণীয়, পরিসর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিকতার চোখ রাঙানি আগের তুলনায় বাড়তে থাকে, কিন্তু বাঙালির সাংস্কৃতিকতা বাণিজ্যিকতার চেয়ে এগিয়ে থাকায় সাংস্কৃতিক চেতনার সঙ্গে পুরোপুরি পেরে ওঠে না। দীর্ঘ কাল ধরে বইমেলার সাংস্কৃতিক অভিযাত্রার দিকটিকেই বড় করে দেখা হয়েছে বলে সাংস্কৃতিকতাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। কিন্তু দেশব্যাপী যেখানে বাণিজ্যিক বিকাশের উপায়গুলোতে ঐতিহ্যের নানা রকম বিকৃতি বা পরিবর্তন ঘটে চলেছে বইমেলা কী করে এর বাইরে থাকবে! কারণ আধুনিককালে বাংলাদেশে শিল্পচর্চার সংস্কৃতিকে মোটামুটিভাবে যে ব্যবসাসংস্কৃতির অনুগ্রহের ওপরেই মূলত নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হয়! বাংলাদেশে নিচুমানের ব্যবসায়-সংস্কৃতির কাছে শিল্পসংস্কৃতি ক্রমশ মার খেয়ে চলছে বলে আমাদের সাংস্কৃতিকতাও আহত হয়ে চলেছে ক্রমাগত। ইদানিং সংবাদমাধ্যমে চোখ রাখলে যে অনুভব করা যায় লেখক-প্রকাশক উভয় মহলই বইমেলার স্টলসংখ্যা ও বইবিক্রির আর্থিক মাত্রাবৃদ্ধিতে আনন্দিতচিত্ত তার কারণও বাণিজ্যসংস্কৃতির এক ধরনের প্রতাপ! আরো অনুমেয় যে, এই আনন্দের উৎস মূলত বইয়ের ভুবনের অর্থনৈতিক-সমৃদ্ধি-বিবেচনা।

এ কথা স্বীকার্য যে, সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক উভয় মহলের নেতৃত্বের অমনোযোগিতার ফাঁক গলিয়েই বাংলা একাডেমির বইমেলার সমৃদ্ধির পরিমাপক এখন আর সাহিত্যের উৎকর্ষের আকাক্সক্ষায় নেই; বই-সাংস্কৃতির গুণগত সামর্থ্য অর্জনের লক্ষ্যও এখন আর মোটেও প্রাধান্য পায় না। পুস্তক-প্রকাশনার সংখ্যাধিক্য এবং কেবল বই বিক্রির আর্থিক পরিমাপ দিয়ে বাংলা একাডেমির বইমেলার সাফল্য বিচারই যেন সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। না, বই বিক্রির আর্থিক পরিমাপক, প্রকাশিত পুস্তকের সংখ্যা বৃদ্ধি কিংবা বিষয়ের বৈচিত্র্যপ্রসারকে ছোট করে দেখা কাম্য হওয়া উচিত নয় মোটেও। কিন্তু তাই বলে বাংলা একাডেমির বইমেলা যে তার চেতনাগত উৎস-অবস্থান থেকে ক্রমশ সরে যাচ্ছে এবং আমাদের সাহিত্যিক ও বৌদ্ধিক মহল যে এখন আর মোটেও এ নিয়ে ভাবনাকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার মনে করছেন না এই অবস্থাকে মেনে নেয়াও সংগত বলে মনে করা যায় না। সেইজন্যই প্রশ্ন ওঠে, অনেক টাকার বই বিক্রি এবং অনেক শিরোনামের বই প্রকাশ হওয়ার মধ্যেই বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলার সাফল্য অন্বেষণ কি সংগত?

বাণিজ্যসংস্কৃতি ও বইসংস্কৃতির বিরোধ কিভাবে দূর হবে?

বই-সংস্কৃতির দুটি মাত্রা; একটি বৌদ্ধিক, অন্যটি বাণিজ্যিক। বাংলা একাডেমির বইমেলার সম্প্রসারণে এই দুইয়ের পরস্পরবিরোধী স্বভাবকে কী করে সমন্বিত করা হবে তা নিয়ে আমরা এখনো ঠিক মতো ভেবে উঠতে পারিনি। শৈল্পিকতার সংস্কৃতি নিয়ে যাঁদের কারবার তাঁদের সাধারণত বাণিজ্যসংস্কৃতির গভীরে যাবার অনুশীলন নেই। অন্যদিকে বাণিজ্যসংস্কৃতির প্রতিনিধিরা আর্থিক সামর্থ্যরে নিরীখে সব কিছু দেখতে অভ্যস্ত বলে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চেতনাকে আহত করে। কারণ আমাদের সমাজে অর্থবিত্তের বিস্তার ও সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া যে সংস্কৃতি (অনেকেই একে অপসংস্কৃতি মনে করেন) গড়ে তুলেছে তাতে শৈল্পিকসাংস্কৃতির উৎকর্ষের আকাক্সক্ষার আহত হবার মাত্রা বাড়বারই কথা। এরই প্রতিক্রিয়ায় আমাদের সমাজে দিন দিন সাহিত্য বা শিল্পকলা-সংস্কৃতির শক্তি ও প্রভাব হ্রাস পেয়ে অর্থ-সংস্কৃতি বড় হয়ে উঠেছে। বাংলা একাডেমির বইমেলা এর সবচেয়ে দৃশ্যমান শিকার! সেজন্যেই এখানে স্টল পাওয়ার যোগ্যতা বই-সংস্কৃতিক উৎকর্ষে নির্ভরশীল না হয়ে প্রকাশনার শিরোনামসংখ্যা এবং পরিচিত লেখকের নাম নির্ভর হয়ে উঠেছে। উৎকর্ষ অর্জন তো কিছুটা সময়ক্ষয়কর ব্যাপার। তুলনায় যেনতেন প্রকারে স্বল্পসংখ্যক শিরোনামের কিছু কাগজ ছাপিয়ে বইয়ের মতো হাজির করা সহজ। ফলে কেবল অর্থদ্বারা সহজে পূরণীয় শর্ত পালন করে স্টল বরাদ্দ নিয়ে আপাত বাজার বড় দেখিয়ে সফলতা পাওয়া গেছে মনে করা সম্ভব। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলা একাডেমির বইমেলার আয়তনগত বিস্তারে এই ধরনের ভাবনাই ক্রিয়াশীল হয়েছে বলেই বইমেলার বিস্তার বর্তমান স্বভাব পেয়েছে।

সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের বই-সংস্কৃতির 'বৌদ্ধিক' ও 'বাণিজ্যিক' মাত্রাকে উভয় দিক থেকে আলাদা আলাদা ভাবে পরিচর্যা না করলে বাংলা একাডেমির বইমেলার সাফল্যে সংস্কৃতির উৎকর্ষ ভবিষ্যতে আরো কম মূল্য পেতে থাকবে। একই রকম পরিণতির সম্প্রসারণই ঘটতে থাকবে পুস্তককে কেবল পণ্য হিসেবে দেখলেও। আবার এর পণ্যতাগুণকে উপেক্ষা করলেও পরিণতি ভালো হবে না। প্রসঙ্গটি পরিস্কার বুঝবার জন্য ওষুধ ব্যবসায়ের সঙ্গে বইপুস্তক খাতকে তুলনা করে দেখা যেতে পারে। যেমন ওষুধ একটি বাণিজ্যপণ্য হলেও তার মান নিয়ন্ত্রণ করতে হয় ভিন্ন কর্তৃপক্ষের। মানরক্ষা কর্তৃপক্ষের নজরদারির বাইরে অভিভাবকত্বহীন বাজারনীতির হাতে কেবল ছেড়ে দিলে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহতার দিকে যেতে পারে তা অনুমান করতে আমাদের তেমন কষ্ট হয় না। তেমনি বই-সংস্কৃতির খাতকেও সাংস্কৃতিক অভিভাবকত্বহীন রেখে দিলে এর পরিণতি ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু তাই বলে আবার যদি কেবল সাংস্কৃতিক অভিভাবকত্বের নামে এই খাতের সবকিছুকে আভিজাত্যমুখী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে কেবল বিশেষ সংস্কৃতি-অনুক‚ল আর্থিক সুবিধা বা অনুদানের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয় তারও পরিণতি কোনো রকমেই ভালো হবার কথা নয়।
'বাণিজ্যপণ্য' ও 'সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ'–এই দুই ধরনের প্রত্যাশার টানাপড়েনে আমাদের বই-সংস্কৃতি এখনো যে সংকটসংকুল হয়ে আছে তার একটি বড় কারণ এই দুইয়ের বৈশিষ্ট্যগত ভিন্নতাকে কিভাবে দেখা হবে তার দিকনির্দেশনা খুঁজে না পাওয়া। 'বৌদ্ধিকতা' ও 'বাণিজ্যিকতা'র টানাপড়েন থেকে বাংলা একাডেমির বইমেলার উত্তরণ ঘটাতে গিয়ে যত উদ্যোগই নেয়া হয়েছে তাতে বইয়ের প্রকাশনাসংখ্যা বেড়েছে, টাকার হিসেবে বেড়েছে বইয়ের বিক্রি, বেড়েছে বইমেলার আয়তনও। কিন্তু খাতটির সঙ্গে একুশে ফেব্রুয়ারির সাংস্কৃতিক চেতনার মর্মগত উন্নতি ঘটেছে এমনটি কিন্তু বলা যাচ্ছে না। বরং দিন দিন পরিস্থিতিকে করে তুলেছে আরো জটিল। জটিলতা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এই খাতের উন্নতির খবরে রীতিমতো প্রাধান্য বিস্তার করতে শুরু করেছে দুর্নীতি ও সংস্কৃতির চেতনাগত সুস্পষ্ট অবনমন।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় নীতি নির্ধারকদের ভাবতে হবে গ্রন্থনীতি নিয়ে। এই নীতির সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে হবে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। বিভিন্ন খাতের উন্নত সাংস্কৃতিক মান সম্পন্ন গ্রন্থ প্রকাশের জন্য থাকতে হবে বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয় কেন্দ্রিক প্রকাশনা সংস্থা (ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে এ ধরনের একটি সংস্থা থাকলেও এর খুবই দৈন্যদশা)। বাংলা একাডেমিকে তার প্রত্যাশিত মূলনীতির খাতকে উৎকর্ষমুখিতার দিক থেকে করতে হবে জোরদার। মঞ্চের জাঁকজমকের চেয়ে বিষয়বস্তুর গভীরতায় দিতে হবে মনোযোগ, অর্থবরাদ্দ বাড়াতে হবে বই-সংস্কৃতির উৎকর্ষ বৃদ্ধির খাতে। এই উৎকর্ষের দৃষ্টি কেবল চোখ ধাঁধানো রঙচঙে কাগজের দিকে থাকলে হবে না। কারণ এতে বইয়ের মূল্য বৃদ্ধি ঘটলেও অন্তর্বস্তুর উন্নতি ঘটবে কম।
আমাদের পুস্তক-প্রকাশনা খাতটি এখনো যে কোনো আনুষ্ঠানিক খাত হয়ে উঠতে পারল না তার কারণ লেখক-প্রকাশক সম্পর্ক এখনো ন্যূনতম পেশাদারিত্বে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লেখক-প্রকাশকের অনুষ্ঠানিক কোনো চুক্তিপত্র থাকে না। বইমেলায় স্টল বরাদ্দ পাবার সবচেয়ে বড় শর্ত হতে হবে লেখক-প্রকাশক অনুষ্ঠানিক চুক্তিপত্র। যে-সব বইয়ের জন্য লেখক-প্রকাশক চুক্তিপত্র নেই সেসব বইয়ের বইমলায় প্রবেশাধিকার না দিলে বইমেলাকে গুরুত্ব দেয়া পুস্তক প্রকাশকেরা নিজেদের কর্মকাণ্ডকে পেশাদারিত্বের দিকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবেন। বাংলা একাডেমিও পারবে পুস্তক খাতের উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে প্রকৃত ভূমিকা রাখতে। বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের কথা বলা হয়ে থাকে এটাও হতে পারে তার অন্যতম কার্যকর উৎস।

অমর একুশে বইমেলাটি যেহেতু বাংলা একাডেমির সেহেতু উৎকর্ষ ও ন্যায়গত প্রশ্নে বইমেলা আয়োজনে বাংলা একাডেমি পুস্তক প্রকাশকদের ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারে। যেমন যথাযথ অনুমোদনহীন বিদেশি বইয়ের প্রকাশকদের বইমেলায় স্টল দেয়ার অনুপযুক্ত ঘোষণা করতে পারে বাংলা একাডেমি। যদি তা পুরোপুরি সম্ভব নাও হয় তাহলেও অন্তত বইমেলায় অনুমোদনবিহীন বইয়ের উপস্থিতির বিরুদ্ধে পারে নিষেধাজ্ঞা দিতে। এতে আমাদের যথাযথ ন্যায়সংগত অনুমোদনপ্রাপ্ত অন্য ভাষা থেকে অনূদিত বইয়ের প্রকাশকেরা যেমন উপকৃত হবেন তেমনি আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলেদেশের প্রকৃত পুস্তক প্রকাশকদের যোগাযোগ বাড়বে। পুস্তক প্রকাশনা খাত এতে পারবে আরো বেশি যোগ্য হয়ে উঠতে। পুস্তক খাতের উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে বাংলা একাডেমি এভাবেও পারে পরোক্ষ ভূমিকা রাখতে।

অমর একুশের চেতনা বৃদ্ধির জন্য কেবল বইমেলার জাঁকজমক বৃদ্ধির বরাদ্দ বাড়ালে চলবে না, বরাদ্দ বাড়াতে হবে সাহিত্য-সমাজ-সংস্কৃতি-ইতিহাসের জাতীয় উৎকর্ষ-অভিমুখী নানা ক্ষেত্রে গবেষণাধর্মী রচনার জন্য রাষ্ট্রের সংস্কৃতি খাতে। এই ধরনের কাজের জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়ে বৃত্তি প্রদান করা যেতে পারে নানা প্রতিষ্ঠানের নীতিমালার আওতায়। এই ধরনের বৃত্তি সমাজের তরুণতরদের বৌদ্ধিকতার চর্চাকে যেমন উৎসাহী করে তুলবে তেমনি পুস্তক-প্রকাশকদের পাÐুলিপি সন্ধান হয়ে উঠবে সহজতর। তৃষ্ণার্ত পাঠকেরা পাবেন কাক্সিক্ষত পাঠ্যসামগ্রী। গভীরতামুখী পাঠসতৃষ্ণদের কথা না ভেবে কেবল ক্রেতার কথা ভাবলে বাংলা একাডেমির বইমেলা কিছুতেই তার কাক্সিক্ষতের বিস্তার ঘটাতে পারবে না। বেসরকারী খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোও অর্থবৃত্তি প্রদান করতে পারে বিভিন্ন ধরনের সৃজনমননশীল পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এর মাধ্যমে অনুপ্রাণিত লেখকেরা যেমন তাঁদের কর্ম তৎপরতা চালিয়ে যেতে সহযোগিতা পাবেন তেমনি ভাবে পুস্তক-প্রকাশনা খাত হয়ে উঠবে সমৃদ্ধ। বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলাকে বিন্যস্ত করতে হবে সেইসব সৃষ্টি-মেধা-মননশীলতায় নিবেদিতদের জন্য।

ওপরে যেসব প্রস্তাব করা হয়েছে তা কিছুটা আয়াসসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু বাংলা একাডেমি এখনই সহজ দু-একটা পদক্ষেপ নিলে বিদ্যমান ব্যবস্থাতেই অমর একুশের চেতনাকে অগ্রাধিকার দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারে। সম্প্রতি কথাসাহিত্যিক ও বই-পুস্তক সম্পাদনা তথা উন্নত বই-সংস্কৃতি প্রয়াসী রাখাল রাহার কাছ থেকে পাওয়া ধারণা যেমন স্বল্পায়াসে বাস্তবায়ন যোগ্য তেমনি বাস্তবসম্মত ব্যাপারও মনে হয়েছে। প্রস্তাবটি বাংলাদেশ 'লেখক ঐক্যে'র সভাপতি হিসাবে ইতোপূর্বে তিনি সংবাদ সম্মেলনেও উত্থাপন করেছেন। তিনি মনে করেন, বাংলা ভাষার ধ্রুপদি সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের বিষয়ে তরুণ পাঠকদের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তা কমানোর স্বার্থে তাঁদের সব বই এবং তাঁদের সম্পর্কিত গবেষণাগ্রন্থগুলো যেন মেলায় সহজে পাওয়া যায় তার উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, শরৎচন্দ্র, মানিক, বিভূতিভূষণ, শহীদুল্লাহ, রোকেয়া এবং জসীম উদ্দীন-এর মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ চিরায়ত লেখকদের নামে পৃথক পৃথক স্টল রাখা যেতে পারে।
এই স্টলগুলোর বরাদ্দের জন্য আবেদন করতে পারেন ব্যক্তিবিশেষ অথবা পেশাদার বই বিক্রেতারা। পেশাদার বই বিক্রেতারা অগ্রাধিকার পেতে পারেন; কারণ তাঁদের পক্ষে সহজেই বাংলাদেশের প্রকাশকদের কাছ থেকে বই সংগ্রহ করে আনা সম্ভব হবে। বিশেষ বিশেষ লেখকের প্রতি অনুরাগী ব্যক্তিও আবেদন করতে পারেন। কারণ ব্যক্তিগত অনুরাগের কারণে তাঁর কাছে লেখকবিশেষের বইয়ের উৎসের খবর থাকা স্বাভাবিক। এই উদ্যোগে পুস্তক প্রকাশকেরাও খুশি হবেন তাঁদের প্রকাশনার গুরুত্বপূর্ণ অনেক বই যথার্থ পাদপ্রদীপের আলো পাবে বলে। আবেদনকারীদের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য চিরায়ত বিশেষ লেখকের যেসব বই এবং সেই লেখকের ওপর লেখা যেসব গবেষণাগ্রন্থ বা জীবনীগুলো সংগ্রহ করে প্রদর্শন ও বিক্রি করতে পারবেন তার উৎস সহ তালিকা চাওয়া হতে পারে। বেশি সংখ্যক আবেদন পড়লে লটারির মাধ্যমে তা নিষ্পত্তি করা যেতে পারে। যে লেখকের নামের স্টল বরাদ্দ দেয়া হবে সেই লেখকের একই বইয়ের প্রকাশকেরা তাদের নিজেদের স্টলেও বইগুলো রাখতে পারবেন। এতে পথের পাঁচালী বা পদ্মা নদীর মাঝির মতো বইয়ের কতগুলো সুন্দর ও বৈচিত্র্যপূর্ণ গ্রন্থরূপ আছে, তা যেমন অগ্রসর পাঠকের একত্রে দেখার সুযোগ সৃষ্টি হবে তেমনি ক্রেতারা নিজেরা বইয়ের মান ও রূপ দেখে যাচাই করে সন্তুষ্ট হয়ে বই কিনতে পারবেন। বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যও এতে সমুন্নত হবে। শুধু শর্ত থাকবে চিরায়ত লেখকের নামের বরাদ্দকৃত স্টলে এর বাইরে আর কোনো বই প্রদর্শন ও বিক্রি করা যাবে না। এসব ধ্রুপদি লেখকের অনেক অনুরাগী আমাদের সমাজে বিচরণশীল রয়েছেন যাঁরা অনেক সময় সহজে বই খুঁজে পান না বলে বিফল হয়ে ফিরে যান। লেখক বিশেষের অনুরাগীদের মধ্যে এমন মানুষ পাওয়া যাবে যাঁরা বইমেলায় এরকম একটা স্টল পেতে চাইবেন। অনুরাগী না হলেও বই বিক্রি থেকে কিছু লভ্যাংশ হবে এটা ভেবেও কেউ কেউ তা করতে চাইবেন।

ব্যবসায় হিসেবে পুস্তক-প্রকাশনা খাতকে এগিয়ে না নিলে তো চলবে না। কারণ শিল্প-সংস্কৃতির চর্চাকে ধারণ করতে হলে প্রয়োজন বাণিজ্যসংস্কৃতিরও উৎকর্ষ। তাই বই-সংক্রান্ত ভাবনাকেও তার সকল বাণিজ্যিক বাস্তবতাসহই ভাবতে হবে। কেবল বাংলা একাডেমির বইমেলার ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রিক অবস্থানে রেখে ভাবলে এবং কেবল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভর করে এর বিকাশ চলতে থাকলে বর্তমান অবস্থারই কেবল সম্প্রসারণ হতে থাকবে, অমর একুশের চেতনা বা জাতীয় মননের উৎকর্ষ-আকাঙ্ক্ষা খুব একটা যেমন হালে পানি পাবে না তেমনি আবার বাণিজ্যিকতাও তার ধর্ম অনুসারে এগাতে পারবে না।
শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত যে উদ্যোগের প্রত্যাশা এই রচনায় করা হয়েছে তত্ত¡গত ভাবে তার বাস্তবায়ন যে সম্ভব তার নিদর্শন নানা দেশেই বর্তমান। কিন্তু বাংলাদেশে তা অদূর ভবিষ্যতে সম্ভব বলে মনে হয় না। দীর্ঘকালের বিরাজনীতিকরণ এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন প্রক্রিয়ার ব্যাপক বিস্তারে এই ধরনের পদক্ষেপ প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভবের স্বপ্নের সঙ্গে উন্নয়ন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা–এই দুই প্রসঙ্গ এত ওতোপ্রোতো যে দীর্ঘ কালব্যাপী বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ায় এর গভীর গভীরতর ব্যবহার ঘটে চলেছে। সমগ্র বইসংস্কৃতির খাতটিও এই বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়াগত প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া বলয়েরই প্রবল বিষয়! সেজন্যেই প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হলে সহসা এ থেকে উত্তরণের সম্ভাবনা অনুভব করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় আমাদের কাছে! কিন্তু এর মধ্যেও আশা জেগে থাকার সূত্র একেবারেই যে খুঁজে পাওয়া যায় না তা নয়! দীর্ঘকাল ধরে উন্নয়ন ও বিত্তের বিস্তারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাকে রক্ষা করতে এবং ন্যূনতম মাত্রায় এগিয়ে নিতে হলেও সামান্য রাজনৈতিক অভিপ্রায় থাকা অবশ্যম্ভাবী–এখনো প্রত্যাশা জাগরূক থাকার সেই ভিত্তি-অবশেষ আমাদের সমাজে রয়ে গেছে। সেটুকুই আজও ভরসা আমাদের!