জোবনামা বা ফেরঙ্গ মঙ্গল পুঁথি

নন্দিতা বসু
Published : 26 June 2022, 05:40 AM
Updated : 26 June 2022, 05:40 AM


সম্প্রতি ১৬৯০-এ কবি কনকন মোল্লা গৌড়চান রচিত 'জোবনামা বা ফেরঙ্গ মঙ্গল পুঁথি' নামে বেশ একটা মজার 'মঙ্গলকাব্য' হাতে এসেছে। অবশ্য পুঁথি আকারে নয়, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা থেকে ছাপানো। ছাপা হয়ে গেছে বলে অনেকেই হয়তো সেটা ইতিমধ্যে পড়ে ফেলেছেন। যাঁরা এখনো পড়ে উঠতে পারেননি তাঁদের জন্য এই লেখা।

বাংলাসাহিত্যের ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে চোদ্দ-পনেরো শতাব্দী থেকে বাংলায় 'মঙ্গলকাব্য' নামে একধরনের বেশ মোটাসোটা আখ্যানকাব্য লেখা হতে শুরু করে। এই মঙ্গলকাব্যের লক্ষ্য নূতন কোনো দেবতার মহিমা প্রচার করা। আজকাল যেমন রাজনৈতিক নেতাদের জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য তাঁর সাগরেদরা করে থাকেন। এই 'জোব নামা'ও তাই—কলকাতানগরীর স্থাপনাকারী জব চার্ণকের(১৬৩০—১৬৯৩) (কিন্তু ২০০৩-এ কলকাতা হাইকোর্ট এই দাবী নাকচ করে দিয়েছে) গুণগান করে রচিত। কিন্তু এর মধ্যে বেশ কিছু মজার 'প্যাঁচ' আছে! প্রথম কথা, মধ্যযুগের বাংল মঙ্গলকাব্য রচিত হ'ত হিন্দু দেবদেবীদের মহিমা প্রচার করে, (২) সেগুলো লিখতেন হিন্দু কবিরা, (৩) নির্ভেজাল ভক্তিরস ছিল সেগুলির মূল উপাদান। আর 'ফেরঙ্গ মঙ্গল' পুঁথির রচয়িতা একজন মুসলমান কবি, নাম মোল্লা গৌড়চান, কাব্যটি কোনো দৈব পুরুষকে নিয়ে রচিত নয়— একজন ঐতিহাসিক খৃস্টান ফিরিঙ্গি জব চার্নককে কেন্দ্র করে লেখা। 'কলিকাল' যে কত খারাপ, যে সময়ে শুধু টাকার জোরেই সব কিছু নির্ধারিত হয় তা বেশ শ্লেষ-বিদ্রূপের মাধ্যমে উপস্থাপিত করেছেন মোল্লা গৌড়চান! ১৬৯০ খৃস্টাব্দে যখন মোগল বাদশা ঔরঙ্গজেবের শাসন চলছে বাংলায়, পোর্তুগীজরা দাপিয়ে দাসব্যবসা চালিয়ে বাঙালির জীবন অতিষ্ঠ কতে তুলেছে, সেই অন্ধকার দিনে পুঁথি লিখে হাস্য-পরিহাস পরিবেশন করে একজন কবি বাঙালির মনোরঞ্জন করছেন, সামান্য পরিমাণে হলেও তাঁদের জীবনবিপন্নকারী গোরাকে ভূপতিত করে মজা লুটছেন। একজন সাদা মানুষকে নিয়ে রঙ্গরস করা, আজকের দিনে যাকে বলা হয়, 'অ্যান্টিকলোনিয়েল—ঔপনিবেশিকতাবাদবিরোধী—তা খুব ভালভাবেই জায়গা পেয়েছে 'ফেরঙ্গ মঙ্গল' পুঁথিতে।

এক সময়ে 'দোভাষী পুঁথি' নামে কিছু লেখা বাঙলায় প্রচলিত ছিল। এগুলিকে 'মুসলমানী পুঁথি'ও বলা হ'ত। তার কারণ এর রচয়িতারা ছিলেন মুসলমান ধর্মাবলম্বী, আর অনেক আরবী-ফারসী শব্দ এই পুঁথিগুলিতে ব্যবহৃত হ'ত। সাধারণত নারীপুরুষের প্রেমের রোমান্স অথবা মুসলমান কোন বীর পুরুষের যুদ্ধ ইত্যাদি বিজয়ের বর্ণনা এই 'দোভাষী' বা 'মুসলমানী পুঁথির বিষয়বস্তু ছিল। সেই হিসাবে 'জোবনামা'কে আমরা 'দোভাষী পুঁথি'র কোঠায় ফেলতে পারি। পুঁথিটির শুরুয়াত এভাবে: 'রব্বেরে কহিল কলি এ বান্দা হাজের।/কি হুকুম আছে পরভু আম্মার কাজের।। /কোথা যামু কি করিমু কোথা পামু ঠাঁই।/বান্দারে হদিশ দাও দুন্যার গোঁসাই।।/পরভু কহে কলি ভাল জান দুন্যাদারি।/দিনেরে করিতে রাত্র তোহ্মারনাহি জুড়ি।।/সাধুরে কর রে চোর সতীরে অসতী।/জান্নাতে পুষিলে তোরে হবে অধোগতি।।/নেকালিয়া যাও তুহ্মি জান্নাত হইতে।/গোজরান কর গিয়া দুনিয়া বিচেতে।।/মোল্লা গৌড়চান ভনে পরভুর কি আছে মনে মূড়মতি কেমনে বুঝিবে।/ দুইন্যায় আইল কলি করিল কত না কেলি পরভুর খায়েশ যাহা তাহাই হইবে।'

এরপর মধ্যযুগের রীতি অনুযায়ী কবি নিজের জন্মবৃত্তান্ত লিখলেন যা দৈবমায়ায় সংঘটিতঃ নিজের জন্মবৃত্তান্ত প্রকাশে অসমর্থ হয়ে তিনি যখন ঈশ্বরের দুয়ারে কান্নাকাটি করছিলেন তখন দৈববাণীতে ঈশ্বর মোল্লাচানকে নিজের 'দিল-এর দিকে নজর দিতে বল্লেন—'ওখানেই সব কথা লুকোনো আছে'। 'আত্মজ্ঞানের অভাবেই না যত কান্নাকাটি'—এই হ'ল ঈশ্বরের উক্তি! চোদ্দ-পনেরো বছরের যৌবনধন্যা কামাখ্যাসুন্দরী যৌবনের স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল, যত রসিক নাগর সুন্দরীকে ধাওয়া করেছিল রাহুকেতুর মতো। ভয়গ্রস্ত কামাখ্যাসুন্দরী 'মৌলা মৌলা' বলে সকাতরে ডাকতে থাকলে মৃদুমন্দ হেসে, মনোহর বেশে একজন দরবেশ আবির্ভূত হয়ে সুন্দরীকে কোলে নিয়ে নিজের মুখের চিবোনো পান তার মুখে দিলেন। মোল্লা গৌড়চান কামাখ্যাসুন্দরীর গর্ভে স্থান পেলেন! গর্ভে থেকেই তিনি আগম-নিগমের সমস্ত জ্ঞান অর্জন করে নিলেন। আর একথা জানাতেও ভুললেন না যে অমৃতসমান গৌড়চানজন্মবৃত্তান্ত যে শোনে সে-ই পুণ্যবান হয়!

'দৈববাণী বলে শুন মোল্লা গৌড়চান।/ কলির মাহাত্ম্য তুমি করিবে বয়ান।।/যথা ধর্ম স্তথা জয় বাতিল বচন।/যথা কলি তথা কড়ি নয়া প্রবচন।।/ …… শুন মোল্লা গৌড়চান পাতিয়া শব্দের ফাঁদ রচ নয়া কড়ির পুরাণ/ সিক্কা তঙ্কা বড় রূপি কড়ি যেন বহুরূপী/ ছুটিয়া আদম হয়রান।/ টন টন ঝুনঝুনি কড়ির সঙ্গীত শুনি/ মুর্দাও তামুক লাও হাঁকে।/ মোল্লা গৌড়চান ভবে কবি কন কন নাম লবে/ কড়ির পাঁচালি পুকারিবে।।/ পাইলে কড়ির গন্ধ আসিবে ফেরঙ্গ।/পুষ্পের সৌরভে যথা আসে মকরন্দ।।/ওলন্দাজ দিনেমার আসিবে হার্মাদ।/ফরাসী ইংলন্ডবাসী ভিন্ন ছিরিছাঁদ।/শুন মোল্লা গৌড়চান দৈববাণী কয়।/ ভাগিরথী তীরে কলি বসিবে নিশ্চয়।।/এক পারে সালকিয়া দক্ষিণে বেতড়।/ওপারে জঙ্গল বাদা হেন্তালের ঝাড়।।/দক্ষিণে গোবিন্দপুর ঊর্দ্ধে সুতানুটি।/দোঁহা বিচে হইবে দেখ কলির বসতি।।/টানিয়া আনিবে কলি ফেরঙ্গের পাল।/টানে টানে আইব জোব ফেরঙ্গের রাখাল।।/কলির ক্ষেত্র কড়ির ক্ষেত্র নাম কলিকাতা।/কলি কড়ি ভিন্ন নহে লিখ্যাছে বিধাতা।।/কলিতে কড়ির বাড়া আর কিছু নাই।/কড়ি পিতা কড়ি মাতা কড়ি পুত্র ভাই।।/কে বা আল্লা কে বা গড কে বা ভগবান।/এহো তিনে করে দেখ কড়িরে সালাম।।/কড়ি বুঝে কড়ি মান কড়িতে হরমত (?) জ্ঞান/কড়ি হইলে রণের ছিপাই।/ কড়িতে সকলই করে বেটা দিয়া বাপ মারে/ ভাই দিয়া ভাইরে লড়ায়।।/ শুন মোল্লা গৌড়চান্দ দেববাণী আসে।/ জোব নামা লিখ তুমি মৌলার খায়েশে।।

পুঁথির পরের অংশ জোব চার্নকের হুগলি হইতে পলায়ন।
উপরে অনেকটা তুলে দিতে হ'ল মূল পুঁথি থেকে। নাহলে যেন লেখকের বক্তব্যটা পুরোপুরি বোঝানো যাচ্ছিল না। একটু অবাক হয়ে লক্ষ্য করতে হয় যে মোল্লা গৌড়চান কলি,কড়ি আর কলিকাতাকে কেমন করে তুল্যমূল্য করে দিয়েছেন! কলিই ফেরঙ্গকে টেনে আনবে! কী নিদারুণ ভবিষ্যবাণী! আর তা করছেন একজন আধুনিক ঐতিহাসিকজ্ঞানবঞ্চিত হাটুরে লেখক! নিজেকে 'কবি কঙ্কণে'র জায়গায় ('চণ্ডীমঙ্গল' রচয়িতা ষোড়শ শতাব্দীর কবি) কবি 'কন কন' লিখেছেন! যদিও মোল্লা গৌড়চান আধুনিক শিক্ষা কতখানি পেয়েছিলেন আমরা জানি না। কারণ পুঁথির এক জায়গায় আছে যে ডাঙায় ফৌজদার আর নদীতে ঝড়ের দাপটে নাকাল জব লেখকের পরামর্শে কলির শরণাপন্ন হতে গিয়ে কলিকে 'ক্যালি' বলাতে কলি ভীষণ রুষ্ঠ হলে জবাবে জব বলেন 'নামে কিবা আসে যায় গোলাপ গোলাপ।/যে নামেই ডাক তার না হবে খেলাপ।।' প্রশ্ন হ'ল এই শেক্সপীরীয় উক্তিটি কীভাবে মোল্লা গৌড়চানের কলমনিঃসৃত হ'ল? যা-ই হোক 'কলিতে কড়ির বাড়া আর কিছু নাই।/কড়ি পিতা কড়ি মাতা কড়ি পুত্র ভাই।।/—- কলিতে পয়সার দাপট, এর সার্বভৌমতা যা সমস্ত পারিবারিক সম্পর্ককে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজেকেই সিংহাসনে বসিয়ে দেয়, সর্বসঙ্কটহর বটিকা হয়ে যায়, মোল্লা গৌড়চান কিন্তু তাঁর সময়ের এই অত্যন্ত একটি বড় সামাজিক সত্য 'জোব নামা'য় প্রতিষ্ঠা করে দিলেন। কারণ মোগল আমলের সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাধারায় টাকাপয়সার বন্ধনের চাইতে সামাজিক আনুগত্যের বন্ধন বড় ছিল। যা বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থা একদমই রাখতে দেয় না, সম্পূর্ণরূপে বিসর্জন দেয়।

'জোবনামা বা ফেরঙ্গ মঙ্গল পুঁথিপাঠের মজাটা এইখানে যে তা প্রবল প্রতাপশালী জব চার্নককে কলির হাতে অনেক নাকাল হতে দেখায়। লেখক পুঁথির শেষে বই রচনার তারিখ দিয়েছেন, 'রবি ঋতু গ্রহ শূন্য চব্বিশে আগুস্ত' যা দাঁড়ায় ১৬৯০র [রবি=১, ঋতু=৬, গ্রহ=৯, শূন্য=০] চব্বিশে আগুস্ত, যা তিনি স্পষ্ট করে তো বলেই দিয়েছেন, যদিও এই পুঁথির পরিশিষ্টে ১৬৯০-এর তিন বছর পরে যে জব চার্নকের মৃত্যু হবে এই কথা লেখা আছে যেমন লেখা আছে যে নবাবকে মেরে কোম্পানী রাজা হবে। এর থেকে মনে হয়, পরবর্তী কালে কোনো লিপিকার এই অংশটি জুড়ে দিয়েছিলেন, নয়, কবি গৌড়চান মোল্লাই পুঁথি শেষ করার অনেক দিন পর পুঁথি বাড়িয়েছিলেন। তবে মনে হয় প্রথম অনুমানটিই ঠিক কারণ ১৬৯০-এর পর ১৭৫৭ পর্যন্ত —- অর্থাৎ আরও সাতষট্টি বছর কবি জীবিত ছিলেন বলে মনে হয় না!

কবি গৌড়চান মোল্লা পুঁথি শুরু করেছিলেন এই কথা দিয়ে যে কলি ঈশ্বরকে জিজ্ঞেস করছে যে তার উপর প্রভুর কী আদেশ? উত্তরে ঈশ্বর বললেন যে দুনিয়াদারী কলির খুব ভালোই জানা আছে—-সাধুকে কীভাবে চোর বানাতে হয়, সতীকে অসতী। এহেন পাপীর জান্নাতে জায়গা নেই, সে যেন সত্বর বিদায় নিয়ে দুনিয়ায় চলে যায়। দুনিয়ায় এসে কলি কত কীর্তিই না করল। কিন্তু যেহেতু ঈশ্বরের সেটাই ছিল বাসনা তাই মোল্লা গৌড়চানকে কলিকীর্তিই লিখতে হ'ল। গৌড়চান নিজের জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা করে দুনিয়াতে কলির কীর্তিগাথা শুরু করলেন।

যদিও কবি এখানে জব চার্নকের কোনো ইতিহাসরচনা করছেন না, কিন্তু ঐতিহাসিক পুরুষ হিসাবে তার জীবন ছিল দুর্যোগপূর্ণ। ১৬৫০ নাগাদ প্রথমে অন্য চাকরি নিয়ে ল্যাঙ্কাশায়ার থেকে ভারতবর্ষে এলেও পরে ১৬৫৮তে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারী হিসাবে কোম্পানীর উচ্চ পদে বহাল হন এবং কোম্পানীর অন্য কর্মচারীদের অসদুপায়ে অর্থ উপার্জনকে বাধা দিয়ে সহকর্মীদের তীব্র বিরাগভাজন হয়ে যান। এই সময়ে মোগলসম্রাট আওরঙ্গজেবের সঙ্গে কোম্পানীর বিরোধ বাধে কারণ কোম্পানীর ব্যবসার উপর নবাব যে আবগারি কর দাবী করছিলেন, কোম্পানী তা দিতে প্রস্তুত ছিল না। ফলে নবাব কোম্পানীর কাশিমবাজারের কুঠী অবরোধ করেন। জব চার্নক এই কুঠীরই এজেন্টের দায়িত্বে ছিলেন। ততদিনে কোম্পানীর পক্ষ থেকে তাঁকে হুগলিতে বদলী করা হয়েছে। কিন্তু কুঠীতে অবরোধ থাকার ফলে চার্নক হুগলিতে স্থানান্তরিত হতে পারছিলেন না। এক সময়ে তিনি হুগলিতে পৌঁছোলেন ঠিকই, কিন্তু সেখানে নবাবের ফৌজ দ্বারা তীব্রভাবে আক্রান্ত হলেন যে কোম্পানীর মালকড়ি, কর্মচারীদের নিয়ে নদীপথে সুতানুটিতে ( সে সময় সুতানুটি ছিল নিচু জলাক্ষেত্র গ্রাম মাত্র) পালিয়ে গেলেন। মোল্লা গৌড়চান তাঁর পুঁথিতে হুগলি থেকে নানা ভাবে নাকাল চার্নকের 'কলি'র সহায়তায় পলায়ন বর্ণনা করেছেনঃ হুগলির ফৌজদার করি হুহুঙ্কার বলে জোবে কান ধরি।/ ফেরঙ্গের বেয়াদবি বরদাস্ত কভি নেহি হাতে দাও দড়ি।।/ সব বরবাদ কিয়া গোরা হারামিয়া শালে আভি দাও শূলে।/ রক্তচক্ষু ঘুরপাক কুম্ভকার চাক হেন বন বন ঘুরে।।/ ফৌজদারের হাঁক যেন মেঘের ডাক দুনিয়া কাঁপে থরথরি।/সেপাই লস্কর যত তেরিয়া মরিয়া শত বাদ্য বাজে চড়বড়ি।।/ জয়ঢাক দিল সাড়া দামামা নাকাড়া কাড়া শিঙ্গা ডাকে হ হ হর।/বন্দুক কামান ভারি হইল হুকুম জারি পাইকে টানে ঘড় ঘড় ঘড়।।/লড়ুয়া লেবাছ পিন্ধে যতেক ছিপাই।/যে যার হাতিয়ারবন্দ কোমরে গোঁজাই।।/যতেক মাওদান ঘোড়া আস্তাবলে ছিল।/মুখেতে লাগাম পিঠে জিন চড়াইল।/তেজি তাজি বাজি সাজি চিঁহি চিঁহি ডাকে।/জোর সোর অতি ঘোর ফেরঙ্গেতে কাঁপে।।/জাহাজে বসিয়া শুনে জোব চার্নক।/পড়িয়া বিপাকে ঘোর নিতে তার রোখ।।/ বিপাকে পড়িল জোব চার্নক।/ আশমানে তুফান দিয়া খরশান/ শন শন বায়ু বয়।।/ হায় হায় বিপাকে পড়িল জোব চার্নক।/ ডাঙ্গায় ফৌজদার বাম বাম হইল পানি।/ গঙ্গা দরিয়া হইল নাকানি চোবানি।।/ডাঙ্গায় ফৌজদারি ফৌজ বড়া মর্দান।/মাটিতে পা দিলে ধরি লিবে গর্দান।।/আসমানে মেঘের ঘটা দেয়া ঘোর হাঁকে।/ জাহাজ মোচার খোলা টেঁকে কি না টেঁকে।।/ পানিতে কুম্ভীর আছে তীরে আছে শের।/ উভয় সঙ্কট বড় বরাতের ফের।।/ (হায় হায় ) বিপাকে পড়িল জোব চার্নক।/ শলা করিবারে ডাকে কাপ্তানেরে।/আইস কাপ্তান মিঞা পড়িয়াছি ফেরে।।/ জোব বলে কাপ্তান আজি জান যায়।/পলায়ন ভিন্ন আর না দেখি উপায়।।/অখনই খুলিয়া দাও জাহাজের কাছি।/ ভাটিতে চালাও তবু জানে যদি বাঁচি।।/ কাপ্তান সারেঙ ডাকে সারেঙ টিন্ডেলে।/ শলা করি বলে চল যা থাকে কপালে।।/ সাত মাল্লা কাছি খুলে নাহি হয় শোর।/ জাহাজ ভাসাইয়া চলে বদর বদর।।/ তরাতরি যায় তরী আন্ধারি আলোতে।/ পার হইতে দেখা নাহি যায় ভাল মতে।।/ হুগলি ছাড়িয়া কাপ্তান বাদাম উড়ায়।/ বাদামে বাসাস পায়্যা তরী উড়ি যায়।।/সালকিয়া ছাড়িয়া তরী ঘুর্ণিপাকে পড়ে।/ বন বন তরী ঘুরে না যায় বেতড়ে।।/ হায় হায় জোব চার্নক বুঝি ডুইব্যা যায়।/
এরপর ভীষণ ঘুর্ণিঝড়ের দাপটে যখন হাল-মাস্তুল ভেঙে জব চার্নকের জাহাজ ডুবুডুবু ' আগা গলুই গোত্তা খ্যায়া পানিতে সিন্ধিল।/ ডুবিল ডুবিল বলি জোকার উঠিল।।/ পাটাতনে ছিল যারা গড়াগড়ি খায়।/ কে ফেরঙ্গ কে বা মাল্লা কুমড়া গড়ায়।।/জোবের জাহাজ করে উথালি পাথালি।/ কাপিতান বলে গড জোব বলে মেরি। (জব চার্নক নিজের হিন্দু স্ত্রীরও নাম দিয়েছিলেন মেরি)।।/ সারেং বদর পীর টিন্ডেল কালু গাজি।/ মাঝি মাল্লা বলে আল্লা রক্ষা কর আজি।।/ হুমকা হুমকা দমকা দমকা বাতাসের গুঁড়া।/কোথা গেল পরচুলা কোথা গেল জুতা।।/ উঠিবারে চায় জোব পড়ে খাইয়া টাল।/এমন সুন্দর সাজ হইল পয়মাল।।/…… গৌড়চান কয় জোব ঘাবড়াও মৎ।/যতক্ষণ শ্বাস আছে রাখ হে হিম্মৎ।।/ কোম্পানীর দূত তুমি অবধ্য সংসারে।/ কলিরে ডাকহ তুহ্মি বাঁচাবে তুহ্মারে।।/এতেক শুনিয়া জোবের দিলে আইল পানি।/ কাপ্তানে ডাকিয়া উভে করে কানাকানি।।/সারেং ধরিয়া হাল জাহাজেরে রাখে/ পাটাতনে হাঁটু জোব ক্যালি ক্যালি ডাকে।।/ কলি বলে আরে ভাই কেন দাও গালি।/ মোর নাম ক্যালি নহে মোর নাম কলি ।।/জোব বলে ঘুর্ণি হইতে নেকালিতে চাই।/ জাহাজ নিকালো আভি বন্দরে ভিড়াঞি।।/
এরপর জব চার্নক নিজের সম্বন্ধে বলে 'আমি কোম্পানীর লোক আমি বুঝি কাম'। একই সঙ্গে সে কলিকে নুনের দেওয়ান কিংবা আবগারী দারোগার পদের (দুটোতেই অসম্ভব পয়সার আমদানী) লোভ দেখায়। 'কলি বলে জোব বাৎ সমঝিয়া কর।/ আমি কলি নহি তোর বাপের নোকর।।/এক হাটে দুনিয়া বেচি আর হাতে কিনি।/ আহ্মারে দিবার চাস নুনের দেওয়ানি।।/দেখি যে ফেরঙ্গ বেটা আহ্মা হতে দড়।/ এখনই বুঝাব তোরে কে ছোট কে বড়।।/ জোবের গোস্তাকি কলি সহিতে না পারে।/তুফানে ছাড়িয়া দিল দরিয়া মাঝারে।।/আসমান সমান ডেউ জাহাজেরে তুলি।/সপাটে আছাড় মারে উথাকি পাথালি।।/মড়মড় করে তরী জোড় খুইল্যা যায়।/গলগল পানি উঠি তরীরে ডুবায়।।/কলি বলে জোব তোরে কোন বাপে বাঁচায়।/পইড়্যাছিস কলির কোপে তোর রক্ষা নাই।।/
এরপর শুরু হয়ে যায় জোবের কলির স্তবঃ (রাগ আংরেজি নটখট তাল বেয়াড়া চৌতালা!) কলির গোসসা দেখি ভাবিয়া আপন গোস্তাকি/ জোবের কলিজা কাঁপে ডরে।/খামোকা পড়িনু ফেরে কে এবে উদ্ধারে/ হাঁটু গাড়ি করে জোড় করে।।/অধমে কর হে কৃপা ক্যালি সরি কলি পাপা।/তুহ্মি মোদের বাপের ঠাকুর।।/ ফেরঙ্গের জিহ্বার ভাঙ্গে নাহি আড়/ তুহ্মি এ বিপদ কর দূর।।/এক কহি শুন আর এক তরফা অবিচার/ ক্ষমা কর অধমে গোসাঞি।।/ফুৎকারে করিয়া বৃষ্টি পুন কর সৃষ্টি/ পদতলে দেহ ঠাঁই।।/তুহ্মি ঠাঞি নাহি দিলে ফেরঙ্গের কপালে / যা হবার তা হবে।/কলির মাহাত্ম্যরঙ্গ বিনা ফেরঙ্গ/ কিন্তু কে প্রচারিবে।।/
এরপর কলি জোবের প্রতি তুষ্ট হলেন, এই বলে অভয় দিলেন যে জোবকে তিনি বাদাবনে (সুন্দরবনে) যেখানে ঘোর জঙ্গল, ফৌজদারের পেয়াদা মশা, ম্যালেরিয়া, ওলাউঠা, কালাজ্বর এবং জলে কুমীর, ডাঙ্গায় বাঘের ভয়ে ঢুকতেই পারবে না। 'এমন সুন্দর জায়গা না পাইবা জোব।/বিবি লইয়া ঘর বান্ধ না হইবে ক্ষোভ।।/কাট্যা বড় গড়খাই গড়ি তোল গড়।/হুগলি হিজলি চক্ষে রাখ আর বালেশ্বর।।/দক্ষিণে গোবিন্দপুর উজান সুতানুটি।/বিচে কলিক্ষেত্র হইবে কোম্পানির কুঠি।।/উঠ বাপ জোব ছাহাব তুলি লহ আজ।/আজি হইতে শুরু হবে ফেরঙ্গের রাজ।।/রবি ঋতু গ্রহ শূন্য চব্বিশে আগুস্ত।/ কলি বলে এই কথা হইল সাব্যস্ত।।/মোল্লা গৌড়চান কয় এত বড় রঙ্গ।/কলির ফজলে রাজা হইল ফেরঙ্গ।।
যেমন আগে বলেছি পুঁথির পরিশিষ্ট অংশে ভারতের ইতিহাসের পরবর্তী ঘটনা ষড়যন্ত্রের ফলে সিরাজদ্দৌলার শোচনীয় পরাজয়ের কথা বলা হয়েছে যেটা পুঁথিটি রচনার আরও সাতষষ্টি বছর পরের কথা। যাই হোক মোল্লা গৌড়চান ইতিহাস লেখেননি, কাব্যই লিখেছেন যার অন্যতম একটি উদ্দেশ্য পাঠকের মনোরঞ্জন করা। বাস্তবজীবনে চারদিক থেকে মার খাওয়া পাঠক তো বাঁচার তাগিদেই কাব্যসাহিত্যে একটু মনোরঞ্জন চাইবে, শুশ্রূষা চাইবে, তার বাস্তবজীবনের প্রতিপক্ষ/ শত্রুর কুপোকাত হওয়া দেখতে চাইবে। মোল্লা গৌড়চান রচিত 'জোবনামা বা ফেরঙ্গ মঙ্গল পুঁথি'তে কিন্তু সেটা খুব উপভোগ্যভাবে পাওয়া যায়। খুব আনন্দ হয়, পড়ে শান্তি পাওয়া যায়, 'মাইরি কেমন দিয়েছে'—এই ফূর্তি মনে জাগে। একজন বিদ্বান ব্যক্তি বলেছিলেন যে সাহিত্যপাঠের একটা আনন্দ হচ্ছে এই যে তা আমাদের একটি মুক্ত পরিসরে ছেড়ে দেয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবন থাকে নানা সামাজিক গণ্ডীর বেড়ে সীমাবদ্ধ, অনেক রকম বাধা আমাদের ডানা মেলতে দেয় না। কিন্তু সাহিত্য-শিল্প কল্পনার খাদ মিশিয়ে জীবনের সোনাকে মজবুত অলঙ্কারে পরিবর্তিত করে দেয় জীবনের বাস্তবকে স্বীকার করেই। কবি-শিল্পী কতখানি কল্পনাপ্রবণ, এবং সেই কল্পনাকে শিল্পে রূপান্তরে কতখানি দক্ষ—তার উপরেই নির্ভর করে পাঠক-শ্রোতা- দর্শকের সেই শিল্পকে গ্রহণ-বর্জন করা। 'জোব নামা'-তে ধার্মিক কট্টরতাকে খুব সুন্দরভাবে অতিক্রম করে মোল্লা গৌড়চান ভবিষ্যতের পৃথিবীকে আরও সুন্দর, বাসযোগ্য করেছেন: ধর্মের দিক দিয়ে মুসলমান হয়ে মোল্লা গৌড়চান হিন্দুর কাব্যরীতি 'মঙ্গলকাব্য' রচনা করলেন,–তা-ও একজন 'ফেরঙ্গ'কে নিয়ে, কবিকঙ্কণ মুকুন্দের দৃষ্টান্তে 'কবি কন কন মোল্লা' উপাধি ধারণ, কামাখ্যাসুন্দরীর গর্ভে দরবেশের সন্তান-উৎপাদন, 'ফেরঙ্গ' জব চার্নকের ভিন্ন ধর্মের পুরাণপুরুষ 'কলি'র শরণাপন্ন হওয়া, জাহাজের সারেঙ এবং কাপ্তান টিণ্ডেলের বদর পীর, কালু গাজীর কাছে ঝড় থেকে প্রাণে রক্ষা পাবার জন্য কাতর অনুনয় ইত্যাদি ইত্যাদি। শাদা চামড়ার শাসকেরা ভারতবর্ষের জনসাধারণকে লাগামছাড়া অত্যাচার করে—যখন-তখন মারধোর, মসলিন তাঁতীদের বুড়ো আঙুল কেটে নেওয়া যাতে তারা তকলিতে সূতা কাটতে পারে না, নীলকরের অত্যাচার—- হার্মাদ পোর্তুগীজদের তো কথাই নেই, অন্য শাদা চামড়ার লোকেরাও এ দেশীয় মানুষের মনে যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল, জোব নামা'তে জব চার্নকের কলির হাতে, ফৌজদারের হাতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাতে নাকাল হবার মধ্যে যেন কোনো ঐশ্বরিক সুবিচার প্রতিষ্ঠালাভ করে, অন্তত বাস্তবজীবনে প্রবলভাবে অত্যাচারিত এ দেশীয়দের তা-ই মনে হবার কথা। আমার এই লেখাটাতে আমি মূল 'জোব নামা'র অনেকটাই তুলে দিলাম এই কারণে যে অগ্রসর পাঠকেরা, যাঁরা পুঁথিটি হাতের কাছে পাবেন না, তাঁরা যাতে পুঁথিটির আরও গভীরে প্রবিষ্ট হয়ে ডুবুরীর মত অধিক মূল্যের মুক্তা ছেঁচে তুলতে পারেন। কারণ 'জোব নামা' আমাদের সেই প্রত্যাশা জাগানিয়া একটি পুঁথি। মধ্যযুগের কবিরা বানান নিয়ে অতো মাথা ঘামাতেন না, তাই 'কঙ্কণ' স্থলে 'কন কন' দেখে মুখ বেঁকানোর কিছু নেই। উত্তরসূরী পাঠক হিসাবে মোল্লা গৌড়চানের 'ফেরঙ্গ মঙ্গল পুঁথি'র আরও অনেক গভীরে প্রবেশ কাম্য।