জাফর ইকবাল, জিয়া হায়দার রহমান ও মৃত্যু সমাচার

সাগুফতা শারমীন তানিয়া
Published : 25 Dec 2014, 04:56 PM
Updated : 25 Dec 2014, 04:56 PM

বাংলাদেশ মৃত আর বাংলাদেশ মৃতদের দেশ এই দুইয়ের ভিতরে সামান্য কিন্তু দুর্লঙ্ঘ্য ফারাক আছে। বাংলাদেশকে মৃত বলা একটি ঢালাও প্রতিবেদন, আর বাংলাদেশ মৃতদের দেশ এই বলার ভিতরে সত্যদর্শীর অভিমান। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে বিতর্ক করার সময় ডক্টর মুহম্মদ জাফর ইকবালের জীবন এবং কথার উদ্ধৃতি দিয়ে আমরা আশাব্যঞ্জকভাবে ইতিবাচকভাবে বিতর্ক শেষ করতাম, ওঁর নাম ওঁর ভূমিকা ওঁর দেশে ফিরে আসা এইসবই বাংলাদেশের জন্যে একটি গৌরবের চিহ্ন বলে আমরা বিশ্বাস করতাম, এখনো করি। কিন্তু এবারে তাঁর একটি লেখা পড়ে এবং লেখাটির পিছনের 'আর্মচেয়ার ফিলসফি' দেখে আমার মনে হয়েছে আমি কিছু বলতে চাই।

আমার মনে হয়েছে বাংলাদেশের যে কোনো অবিচার-অনাচার নিয়ে কথা বলতে গেলেই যাঁরা হৈহৈ করে ওঠেন, যেকোনো অন্যায়ের জাতীয়ভাবে প্রতিবাদ করতে গেলেই যাঁরা 'দেশের সুনাম গেল' বলে বিবৃতি দেন, বিদেশের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ডোবানো গেল– এইসব বলেন তাঁদের বলবার ভঙ্গির সাথে মুহম্মদ জাফর ইকবালের এই লেখাটির আশ্চর্য্য মিল।

অস্বীকার করবো না জিয়া হায়দার রহমান তাঁর বক্তব্যে যখন প্রথম ঘোষণা দিলেন- বাংলাদেশ হচ্ছে 'ল্যান্ড অফ দ্য ডেড' তখন আমিও বিচলিত বোধ করেছি, যখন তিনি পাঁচতারা হোটেল সোনারগাঁও আসলে দেড়তারা হোটেল– এমন বলতে শুরু করেছেন আমার ভেতরে কিসব নড়েচড়ে উঠেছে- তৃতীয় বিশ্বে যাঁরা প্রথম বিশ্বের বাটখারা নিয়ে এসে মাপতে থাকেন তাঁদের প্রতি আমার বিরক্তি আছে। আমার শুনতে একটুও ভাল লাগেনি বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় কেবল ইংরেজি বলবার কমিউনিকেট করবার যোগ্যতায় চাকুরি করেন- অথচ আমার ভাল না লাগায় এই সত্যের কিছু যায় আসে না। কিন্তু তিনি যখন বারবার এই 'ল্যান্ড অফ দ্য ডেড' পংক্তিতে ফিরে আসতে থাকেন তখন একটি কবিতার সূচনা হয়, একটি দার্শনিক গন্তব্যের দিকে তিনি আমাদের টেনে নিয়ে যেতে থাকেন। আমি আমার বিরক্তি ভুলতে থাকি, আমার মনে পড়ে নিজেদের জন্যে আলাদা বাটখারা ব্যবহার করতে চাইবার সস্নেহ ইচ্ছার সাথে আসলে দরিদ্র মানুষটি দরিদ্র বলে তার অপরাধ করবার অধিকার আছে এই ভাবনার মিল আছে, কালো লোকটি কালো বলে অন্য লোকের প্রতি তার বর্ণবাদী নিপীড়ন চালাবার অধিকার আছে এমনি ভাবনার মিল আছে। আমাদের শুরু করতে হবে নিজের ভুলকে খামতিকে ভুল এবং খামতি হিসেবে জানা থেকে। নিজের ভুলকে ভুল জানা নিজের খারাপকে খারাপ জানার সাথে নিজের ভালতে বিশ্বাস করবার রাস্তায় কাটাকাটি নাই, উভয়ের গন্তব্য শুভ।

রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রগুলিতে যে আমরা 'মৃত'দের (মৃত পিতা, মৃত স্বামী) দ্বারা পরিচালিত- তা বলায় আমি ভুল দেখতে পাই না, যাকে জিয়া হায়দার রহমান বলেছেন 'রেসারেকশন অফ দ্য ডেড', মৃতদের আদর্শিক পুনরুত্থান, তা আমার রাষ্ট্রে কই, রাজনীতিতেই বা কই? আদর্শকে বাকি রেখে আমরা মৃতদের পুতুলনাচের পুতুলের মতন নাচিয়ে বেড়াচ্ছি।

ডক্টর মুহম্মদ জাফর ইকবাল লিখেছেন, যে আঠার বছর তিনি দেশের বাইরে ছিলেন, তিনি দেশের কোনো সমালোচনা করেননি। কারণ তিনি বিশ্বাস করেছেন যে, দেশের বাইরে নিশ্চিন্ত নিরাপদ আরামে থেকে দেশের সমালোচনা করবার অধিকার তাঁর নেই। যখন তিনি দেশে ফিরেছেন কেবল তখনি তাঁর নিজদেশের সমালোচনা করবার অধিকার হয়েছে। এই অংশটি পড়ে আমি বিব্রতবোধ করি, কারণ দেশের বাইরে সবাই নিরাপদ-নিশ্চিন্ত আরামে আছে বললে সে বলার ভিতরে একরকমের অসূয়া কাজ করে- সে বলার ভিতরে একরকমের অন্ধত্ব কাজ করে যা দেশের বাইরের হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিক-ছাত্র-কর্মজীবীর বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলবার অধিকারকে খর্ব করে দেয়, যাদের ঘাম-রক্ত-মৃত্যুর সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চাকার চালিকাশক্তির বিশাল যোগ আছে। আমার কাছে অনেকবার মনে হয়েছে বাংলাদেশে যাঁরা থাকেন, তাঁরা দেশত্যাগকে একরকমের ট্রিজন হিসেবে দেখেন, প্রবাসীদের একরকমের ফুটো জাহাজ থেকে নিজপ্রাণ নিয়ে পালানো স্বার্থপর অভিযাত্রী হিসেবে দেখেন, প্রবাসীর দেশপ্রেম-দেশচিন্তা-দেশের ভালমন্দে অংশগ্রহণ সবই বাঁকা চোখে দেখেন। মুহম্মদ জাফর ইকবালও এভাবে ভাবতে পারেন সেটা দেখে আমি যারপরনাই অবাক হয়েছি।

তিনি আসলে অত্যন্ত প্রত্যক্ষভাবেই জিয়া হায়দার রহমানের একটি কথাকে তাঁর লেখার ভিতর দিয়ে স্বীকৃতি দিয়ে ফেলেছেন, ঐ যে জিয়া বলেছেন, 'কনটেন্ট' নিয়ে কেউ ভাবিত নন, 'মটিভ' বা 'কন্সপিরেসি' নিয়ে ভাবিত। কি বলছে সেটা বাংলাদেশে জরুরী হচ্ছে না আর, কে বলছে সেটা জরুরী, কেন বলছে সেটা জরুরী। তাই করেছেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি প্রথমেই লিখেছেন কে বলছে তা নিয়ে- বলেছেন একজন বৃটিশ বাংলাদেশী, বলছেন কারণ তিনি ভাবছেন তাঁর অধিকার আছে (মটিভ), কারণ এইধরণের অসম্মানজনক কথাকে ফ্যাশন বা বুদ্ধিজীবীর অনুকরণীয় আদর্শ মানা হয় বলে মুহম্মদ জাফর ইকবাল দেখেছেন (কন্সপিরেসি)। জিয়া হায়দার রহমান তাঁর ভাষণে যে বলেছেন, "Idea doesn't have a status separate from the person who says it.", সেটাকে একেবারে প্রমাণ করে দিয়েছে মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখার শুরুটিই, মুহম্মদ জাফর ইকবাল একজন মানুষ এবং তার ভাষ্যকে তার বক্তব্যকে তার ভাবনাকে একত্র করে দেখেছেন। জিয়ার আইডিয়া হচ্ছে বাংলাদেশ মৃতদের দেশ, কারণ জিয়া পশ্চিমের আরামের দুনিয়ার ফ্যাশনেবল লেখক, কারণ জিয়া দেশ-পরিত্যাগী কাফেলার শিশু ছিলেন, কারণ জিয়া এবং জিয়ার মতন অনেকে বিদেশে হোটেলে বাসন ধোয়ার ফাঁকে ফাঁকে দেশ নিয়ে চিন্তা করেন, যাঁরা বাংলাদেশে থাকেন না এবং বাংলাদেশের হৃদস্পন্দন শুনতে পান না।

জিয়া একটি ভীষণ সত্য কথা বলেছেন, কন্টেন্টই হলো আইডিয়ার আধার, মাতৃকা। কন্টেন্ট শুনবার বেলায় যে জাতি বধির, যে জাতি সকল বক্তব্যকেই উদ্দেশ্যমূলক ভেবে নেয়- তার বুকে আইডিয়ার জন্ম কি করে হবে? কে ভাববে কারণ কে-ই বা শুনবে? এই যে মনোভাব প্রকাশের পথে এত প্রাথমিক পর্যায়েই এত বাধা-এত বাকবিতন্ডা, এই যে আইডিয়ার অচল দশা, এক হতে আরেকে স্থানান্তরিত না হতে পারার অক্ষমতা, এই যে আইডিয়ার স্ফূরণ-বিকাশ-লালনের প্রতি অভয়দায়ী সমাজের অনুপস্থিতি, রাজনৈতিক-সামাজিক পংক্তিবিভাজনের কারণে তৈরি এই অচলায়তনই তাঁর ভাষ্যে মৃতদের দেশ। এমনি করে তো নীরদ সি চৌধুরিও বলেছিলেন, বাঙালীকে নিয়ে তাঁর অনেক আশা থাকতে পারে- ভরসা বিশেষ নাই। অবশ্য তখনো আমরা কন্টেন্ট না দেখে না বুঝে কন্সপিরেসি নিয়েই লাফিয়েছি। বাংলাদেশে যাঁরা থাকেন, তাঁরা সকলেই আমাদের এই দেশটির ব্যক্তির বিকাশবিদ্বেষী, ব্যক্তিত্ববিনাশী, ব্যক্তিস্বাধীনতাগ্রাসী এবং সার্বিকভাবে ব্যক্তিবিরোধী সমাজ সম্পর্কে পূর্ণ মাত্রায় ওয়াকিবহাল। এদেশে এখনো বেশির ভাগ শিক্ষক ছাত্রের প্রশ্নকে 'বেয়াদবি' ভেবে চিৎকার করে উঠতে পারেন, অন্বেষণের সাথে আদবের কি অদ্ভূত রেষারেষি। আপনি চাইলেই যা ইচ্ছা ছবি আঁকতে পারবেন না, যেমন ইচ্ছে মূর্তি গড়তে পারবেন না, পুত্র ইসমাইলকে হত্যা করতে গিয়েছিলেন এই পরিতাপ ইব্রাহীমকে পিতা হিসেবে ছেড়ে গেছিল কি না এই নিয়ে কোনোদিন নাটক লিখতে পারবেন না, সর্বজনপূজ্যতে কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে সংশয়মূলক কিছু বলতে-লিখতে-ভাবতে পারবেন না। এর ব্যতিক্রমও রয়েছে, যদি আপনি অসম্ভব ক্ষমতাবান এবং অসম্ভব উচ্চপংক্তির কেউ হন যা জিয়া বলছেন- This country belongs to people with extraordinary power and privilege। রাজা হলে আপনি আমসত্ত্বভাজা টাঙিয়ে রাখতে পারবেন ছবির ফ্রেমে, রাজপিসী হলে আপনি কুমড়ো নিয়ে ক্রিকেট খেলতে পারবেন। এমন কি অভিনব বললেন জিয়া? এমন কি নতুন বললেন যে সব্বাই সহসা সচকিত?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল একবার লিখলেন যে, তিনি বিজ্ঞানের ছাত্র, ঢালাও কোনো কিছুতে তাঁর বিশ্বাস নেই তিনি বিভ্রান্তবোধ করেন, তাহলে এই এতগুলি ঢালাও মন্তব্য এবং ঢালাও বিশ্বাস কোথা থেকে এলো? বাংলাদেশের প্রতিই বা ঢালাও আস্থা কি করে এলো? আমরা যেসব বিতর্কে শ্রদ্ধার সাথে আশার সাথে তাঁর নাম বলতাম, সেইসব বিতর্কে এও আমাদের বলতে হতো, একসময় বাংলাদেশে আর বিজ্ঞানী জন্মাবে না, সূক্ষ্ণবুদ্ধির চর্চা এবং মননশীলতা লাগে এমন কোনোকিছুর চর্চ্চাই আর বাংলাদেশে সম্ভব হবে না, তার একটা বিশাল কারণ হবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়- পলিউশন। আমরা কিন্তু তখন সাংখ্যমান এবং তত্ত্ব-তথ্য হাজির করেই বলতাম।

আমি এখনো জানি, বিশ্বাস করি এবং দেখেছি- স্পিরিটের দিক থেকে বাঙালির আজো তুলনা মেলা ভার- সেটি একজন বাঙালি গৃহহীন মানুষকে উন্নত বিশ্বের যে কোনো গৃহহীন মানুষের সাথে তুলনা করলেই বোঝা যাবে। তপন রায়চৌধুরী যে লিখে গেছেন, পে'জ থ্রিতে নগ্নবক্ষা স্ত্রীলোক দেখা সভ্যতার চেয়ে অনেক সভ্য এবং প্রাচীন সভ্য আমাদের গ্রাম, সেটা তো সত্যি। নেই-দশা থেকে আমরা কি করে উঠতে পারি, সেইটির ব্যক্তিগত-সামাজিক-রাষ্ট্রীয় বহু উদাহরণ আছে, কিন্তু যা নেই তা মানতে অসুবিধে কোথায়? তাহলে যা নেই তা আহরণ করবো কি করে (শুধু দেশপ্রেমের মাদক বিলিয়ে তূরীয় দশা তৈরি করে বসে থাকব?)? যে হীনতাবশতঃ আমরা সকল বাচ্যের পিছনের পটভূমিকেই শুধু বিচার করতে থাকি সেই মন-সেই শ্রবণ বদলাতে হবে তো, নইলে নতুন কালের ডাক শুনব কি করে। হাতে গোনা কিছু সফল ব্যক্তির সফল কর্মকাণ্ডের উদাহরণ তুলে শত শত বাংলাদেশীর প্রতিদিনকার জীবনে অজস্র আইডিয়ার মৃত্যুকে অস্বীকার করা যায় কি? সাধারণ মানুষের নতুন ভাবনা নতুন পরিকল্পনার স্বাভাবিক যাতায়াতের পথ কোনটি বাংলাদেশে (কে সেগুলিকে 'allows them to ventilate'?), কোন রাস্তায় তা গন্তব্যে পৌঁছায়? কোন সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় পথ ধরে তা সাফল্যের মুখ দেখে?