সালাউদ্দীনের চিত্রকলা: বিহগদৃষ্টিতে মুঘল-ঢাকা

শিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 10 Nov 2015, 11:38 AM
Updated : 10 Nov 2015, 11:38 AM

২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকা আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে কাজি সালাউদ্দীন আহমেদের একক চিত্রপ্রদর্শনী হয়ে গেলো। এই প্রদর্শনীর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে সবগুলো ছবিতেই ঢাকা শহরকে বিহগাবলোকনে (Bird's eye view) দেখানো হয়েছে। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, বৃষ্টিস্নাত গাছপালার ঘন সবুজের ফাঁকে দুই একটি রাস্তা, অল্পবিস্তর বাড়িঘর। এক সময় ঢাকার বেশিরভাগ অংশ এরকম ছিল এবং এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাটা বিহগ-দৃষ্টিতে এরকম মনে হতে পারে, জানালেন সালাউদ্দীন। প্রদর্শনীর আরও দুই একটি ছবিতেও সবুজ আছে, তবে তা ঢাকা শহরের দূষণকবলিত, ধূলিধুসরিত গাছপালার বিবর্ণ, ফিকে সবুজ।

সালাউদ্দীনের ছবিগুলোতে বিভিন্ন আকৃতির চতুর্ভূজের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যাবে। বাড়ির ছাদের প্রতীক চতুর্ভূজগুলো এমন অগোছালোভাবে একটি আর একটির সাথে লেগে-লেপ্টে আছে যে বোঝাই যায় না কোথায় এক একটি মহল্লার শুরু, কোথায়ইবা তার শেষ। চতুর্ভূজগুলো সাদাকালো, কারণ পুরোনো ঢাকার বাড়িগুলোর বয়স হয়েছে। এককালে দেয়ালে-ছাদে রঙ থাকলেও কালের প্রবাহে সে রঙ সাদাটে হয়ে গেছে। চতুর্ভূজের ফাঁকে ফাঁকে কালো রঙের দাগগুলোকে দুই ভবনের মাঝের অপরিসর কালো পিচের রাস্তা বলে মনে করা যেতেই পারে।

কয়েকটি ছবির চতুর্ভূজগুলোতে হলুদ, গেরুয়া রঙের প্রাধান্য দেখে মনে হয়, ঢাকা নয়, প্যারিস বা প্রাগ দেখছি বিহগাবলোকনে। ছাদে হলুদ বা কমলা রঙ লাগাবেন বা রঙিন টালি দিয়ে ছাদ করবেন–এমন রঙরসিয়া বাড়িওয়ালা কি আছে ঢাকা শহরে। থাকতো যদি তবে বিহগাবলোকনে সেই বাড়িগুলো কী চমৎকার দৃশ্য সৃষ্টি করতে পারতো তারই আভাস দিয়েছেন সালাউদ্দীন। একটি ছবিতে চতুর্ভূজগুলো নীল আর সবুজ। নীলেরই প্রাধান্য। শরতের কোনো সন্ধ্যায় আকাশ থেকে তাকালে ঢাকা শহরকে এ রকম মনে হতেও পারে।

সালাউদ্দীনের জন্ম ১৯৬৩ সালে, পুরনো ঢাকায়। প্রদর্শনী করছেন ১৯৮৭ সাল থেকে। দেশে ও বিদেশে এ পর্যন্ত ৩৫টির মতো একক এবং ৩২টির মতো যৌথ প্রদর্শনী করেছেন। অংশ নিয়েছেন ১০টির মতো কর্মশালায়। ৯টি পুরষ্কার পেয়েছেন। সালাউদ্দীন প্রথাগতভাবে, আর্টস্কুলে ছবি আঁকা শেখেননি। 'আর্ট আপনি কোথায়, কীভাবে শিখলেন সেটা বড় কথা নয়, আর্ট আপনি প্রতিদিন কতটা অনুশীলন করছেন সেটাই বড় কথা!' — প্রত্যয়ের সাথে জানালেন সালাউদ্দীন।

গত তিন দশকে সালাউদ্দীনের অঙ্কনের বিষয় ছিল একটাই: ঢাকা, বিশেষত মুঘল ঢাকা, যাকে আমরা বলি 'পুরান ঢাকা'। সিংহাবলোকন, কীটাবলোকনে পুরনো ঢাকাকে দেখিয়েছেন। এবার দেখালেন বিহগাবলোকনে। 'হেলিকপ্টার বা বিমান থেকে কখনও কি দেখেছেন ঢাকা শহর?' –প্রশ্ন করেছিলাম সালাউদ্দীনকে। 'একেবারেই না! ঢাকা কেন, কোনো শহরই আমি কখনও উপর থেকে দেখিনি। প্রথম যখন এ ধরনের ছবি আঁকি তখন পর্যন্ত বিমানে ওঠারই সুযোগ হয়নি আমার। উপর থেকে না দেখলেও নিচে পুরোনো ঢাকার অলিগলিতে প্রচুর হাঁটি আমি। হাঁটতে হাঁটতেই মহল্লাগুলোকে কল্পনায় দেখতে চেষ্টা করি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে।'

সালাউদ্দীনের প্রয়াত বাবা ছিলেন ব্যাবসায়ী। নিজে লেখাপড়া খুব বেশি করে উঠতে পারেননি, কিন্তু তিনি চাইতেন, ছেলেমেয়েরা যেন ভালো পরিবেশে বড় হয়ে উঠে, তাদের বন্ধুবান্ধবেরা যেন শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনা পরিবারের হয়। পুরনো ঢাকায় সে সুযোগ ছিল না বলে সন্তানদের তিনি আবাসিক স্কুলে রেখে পড়িয়েছেন। '১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে এম. এ. পাস করার পর অন্য সবার মতো চাকরি-বাকরি না খুঁজে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করছিলাম। মাঝে মাঝে বাবার দোকানেও বসছিলাম অবশ্য। বাবা একদিন জিগ্যেস করলেন: 'কী করবা ঠিক করছ।' আমি সোজা বলে দিলাম: 'ছবি আঁকুম।' আব্বা বললেন: 'ঠিকতো? ছবি আঁকলে কিন্তু ছবিই আঁকতে অইবো। ছবি আঁকা বন্ধ করতে পারবা না! যাও, আইজকা থেইক্যা তোমারে আর দোকানে বইতে অইব না।' শুরু হয়ে গেল ছবি আঁকা। প্রথম দিকে প্রদর্শনীতে ছবি খুব একটা বিক্রি হতো না। ব্যাবসায়ীর বউ, আমার মা অবিক্রিত ছবিগুলোর জন্যে খুব দুঃখ করতেন। 'আরে, অহনই যদি সব ছবি বিক্রি কইরা ফালায়, বাকি জীবনে হ্যায় কী বেচবো?' বলে মাকে আর আমাকে সান্তনা দিতেন আমার বাবা।'

স্ত্রী এবং কিশোর পুত্রের সাথে সালাউদ্দীন থাকেন ধানমণ্ডিতে। স্টুডিও পুরনো ঢাকায়, পৈত্রিক বাড়িতে। সকালে ওঠার অভ্যাস নেই, যদিও স্বীকার করেন যে সকাল বেলাটাই কাজ করার প্রশস্ত সময়। স্ত্রী ঠেলেঠুলে জোর করে স্টুডিওতে পাঠান। মুড়ির টিন বাস ধরে স্টুডিওতে পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে যায়। গেলেও সব দিন যে কাজ হয় তা কিন্তু নয়। 'কিন্তু যেদিন', সালাউদ্দীনের ভাষায়: 'লজিকের সাথে সেন্টিমেন্ট, অর্থাৎ যুক্তির সাথে অনুভূতি মিলেমিশে যায়, সেদিন কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এঁকে ফেলা যায় কয়েকটি ছবি।' আবার এমন দিনও আছে, যেদিন গায়ের ঘাম বেরিয়ে যায়, 'মাগার ছবি আহে না!' প্রায় একই ধরনের কথা বলেছিলেন ফরাসি কবি র‌্যাঁবো, ঊনবিংশ শতকে। কবিকে মিডিয়াম করে কবিতা নিজেকে লিখিয়ে নেয়। সালাউদ্দীনও মনে করেন, ছবি আঁকা যায় না, আঁকা হয়।

সালাউদ্দীন বাজার থেকে রেডিমেড রঙ কিনেন না। 'প্ল্যাস্টিক পেইন্টের কিছু পিগমেন্ট পাওয়া যায় বাজারে। সেগুলো কিনে একটার সঙ্গে আর একটা মিশিয়ে নিজের পছন্দ মতো রঙ বানাই।' অর্গানিক সিটি শীর্ষক প্রদর্শনীর ছবিগুলোতে যে বর্গক্ষেত্র, আয়তক্ষেত্রগুলো রয়েছে সেগুলো আঁকার জন্যে যে রঙ ব্যবহার করেছেন সালাউদ্দীন তাতে এ্যাক্রিলিক পিগমেন্টের সাথে কাঠের গুড়া, বালি ইত্যাদি মিশিয়েছেন। মিশ্রণটিকে স্প্যাটুলা দিয়ে ক্যানভাসের উপর লেপ্টে চতুর্ভূজগুলো আঁকা হয়েছে। রঙের সাথে কাঠের গুড়া আর বালি মেশানোতে ক্যানভাসে টেক্সচার আর রিলিফের সৃষ্টি হয়ে এক ধরনের সীমিত ত্রিমাত্রিক আবহ এসেছে ছবিগুলোতে।

নিকটের চাইতে দূর থেকে দেখলে সালাউদ্দীনের 'অর্গানিক সিটি' শীর্ষক কাজগুলো দৃষ্টিকে আরাম দেয়, উসকে দেয় কল্পনাকে। এগুলোকে একাধারে Semi-abstract এবং Semi-impressionist ধারার কাজ বলা যেতে পারে। ছবিগুলো সেমিএবস্ট্র্যাকট বা 'অর্ধ-বিমূর্ত', কারণ বাড়ির ছাদগুলোর মূর্ত রূপ ফুটে উঠেনি ক্যানভাসে, যদিও দূর থেকে চতুর্ভূজগুলোকে অনেকটাই বাড়ির ছাদ বলে মনে হয়। 'সেমি-ইম্প্রেশনিস্ট' বলছি ছবিগুলোকে, কারণ (মোনে, রনোয়া, পিসারো প্রমুখের) ইম্প্রেশনিস্ট ছবিতে বস্তুর প্রতিকৃতি বা দ্যোতক (Signifier) এবং আসল বস্তু বা নির্দেশিতের (Referent) মধ্যে যতখানি মিল আছে, সালাউদ্দীনের ছবিতে ঐ দুটি সত্তার মধ্যে তার চেয়ে অনেক কম মিল লক্ষ্য করা যাবে।

আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের প্রদর্শনীর শিরোনাম ছিল: 'অর্গানিক সিটি'। জৈব সার ও জৈব কীটনাশক ব্যবহার না করে ফলানো স্বাস্থ্যকর অর্গানিক শব্জির কদর খুব আজকাল। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলশ্রুতিতে শ্বাসরুদ্ধকর শহরে পরিণত হওয়া ঢাকা কোনো একদিন বাসযোগ্য অর্গানিক সিটি হবে– এমন স্বপ্ন দেখাতে চান সালাউদ্দীন। তিনি আশা করেন, ঢাকার মানুষের জীবন ও মনন থেকে যাবতীয় কৃত্রিমতা ও নিষ্ঠুরতা দূর হয়ে ফিরে আসবে পুরনো ঢাকার এক কালের সেই আন্তরিকতা আর সহমর্মীতা।

'ইটের পর ইট, তার মাঝে মানুষ-কীট, নাইকো ভালোবাসা, নাইকো স্নেহ।' লা গ্যালারির দেয়ালে ছবি ছাড়াও মেঝেতে ছিল শঙ্খ-আকৃতির একটি ভাষ্কর্য। হরেক রকম রঙে রাঙানো শ খানেক দণ্ডায়মান ইট দিয়ে তৈরি হয়েছিল শঙ্খের বুক আর মুখের দিকটা আর কালো রঙে ছোপানো খান বিশেক ইট রাখা হয়েছিল শঙ্খের লেজের মতো দিকটায়। বিহগাবলোকনে কালো ইটগুলোকে মনে হচ্ছিল জরাজীর্ণ, বিবর্ণ পুরোনো ঢাকা। হলুদ-গেরুয়া-বেগনি-নীল-কালো রঙে রাঙানো ইটগুলো ছিল চটকদার, রঙিন স্বপ্নের নতুন ঢাকার প্রতীক।

কালো নেকাব সরিয়ে এক বুড়ি শাহজাদির মুখের বলিরেখার বহুমাত্রিক রূপ তুলে ধরার চেষ্টা করছেন সালাউদ্দীন তাঁর ক্যানভাসে, দীর্ঘ তিন দশক ধরে, অভাবনীয় সব দৃষ্টিকোণ থেকে। জানি না, কোন 'অরূপ রতন আশা করে' এই মুঘল শহরের 'রূপসাগরে' তিনি একের পর এক ঢুব দিয়ে চলেছেন!