সাম্প্রতিক তিনটি চিত্র প্রদর্শনী

admin
Published : 19 May 2015, 12:13 PM
Updated : 19 May 2015, 12:13 PM

সম্প্রতি ঢাকায় ভিন্নধর্মী তিনটি চিত্র প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই প্রদর্শনীগুলো নিয়ে লিখেছেন অঞ্জন আচার্য এবং আব্দুল হালিম চঞ্চল।

শিল্পকলায় পক্ষকালব্যাপী ছাপচিত্র প্রদর্শনী

অঞ্জন আচার্য

গুরুশিল্পীরা কাজ করেছেন আর তার ছায়াতলে দীক্ষিত হয়েছে নবীন শিল্পীরা। তাই গুরুর কাজের শেষ রশ্মিটুকু নিয়ে আবার নতুন দিনের আলো জ্বালিয়েছে নবীন প্রজন্মের শিল্পীরা। আসলে সূর্যহীন অন্ধকারের কোন ইতিহাস নেই; ইতিহাস আছে শুধু সূর্যোদয়ের আর সূর্যের আলোয় উজ্জ্বল প্রহরের। এভাবে শেষ থেকে শুরু হতে হতে এদেশের শিল্পের প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়ে শাখা প্রশাখায় প্রসারিত হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ও শূণ্য আর্ট স্পেস যৌথভাবে একাডেমীর জাতীয় চিত্রশালায় ১৬ মে থেকে ৩০ মে "শেষ থেকে শুরু" শীর্ষক পক্ষকালব্যাপী ছাপচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। এ উপলক্ষে গত শনিবার বেলা ১২টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় চিত্রশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে পক্ষকালব্যাপী ছাপচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন বরেণ্য শিল্পী অধ্যাপক রফিকুন নবী। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্পেন-প্রবাসী বরেণ্য শিল্পী মনিরুল ইসলাম এবং শিল্পসমালোচক মইনুদ্দীন খালেদ। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন শূণ্য আর্ট স্পেস-এর প্রধান নির্বাহী জাফর ইকবাল। প্রদর্শনী প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা এবং শুক্রবার বেলা ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দর্শকদের জন্য খোলা থাকবে।


দেশভাগের আগে সেই ১৯৩০ এর দশকের শেষে সফিউদ্দিন আহমেদ-এর উড-এনগ্রেভিংয়ের কাজ যেহেতু আধুনিক ছাপচিত্রের আদি সাক্ষী, তাই এদেশের ছাপচিত্রশিল্পও আধুনিক চিত্রকলার সমান বয়সী। কিন্তু এই দৃশ্যশিল্প আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান নয়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ও শূণ্য আর্ট স্পেস যৌথভাবে একাধিক প্রদর্শনীর আয়োজন করে এ দেশের ছাপচিত্র চর্চার আনুপূর্বিক বৃত্তান্ত শিল্পরসিকজনদের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছে। প্রায় দেড়'শ ছাপচিত্রীর দুই শতাধিক কাজ পর্যায়ক্রমে প্রদর্শিত হবে এই আয়োজনে। প্রদশিত কাজগুলো প্রধানত ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে ধার করা। শিল্পকলা একাডেমীর সংগ্রহেরও অনেকাংশ এতে যুক্ত হয়েছে। বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন রুচির সংগ্রাহকের কাজের উপস্থাপনের ফলে দেশের ছাপচিত্রের বৈচিত্রময় বিকাশের ধারা এ প্রদর্শনীতে পাঠ করা সম্ভব। তবে কোনো কেনাবেচার হিসেব নেই এ প্রদর্শনীতে। শুধুই প্রদর্শনী। ছাপচিত্রের বৈচিত্রের রস আস্বাদন প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য। ছাপচিত্র বা প্রিন্ট মেকিংয়ের মর্ম উপলব্ধির জন্য আয়োজন করা হয়েছে সেমিনার। দেশি-বিদেশি তাত্ত্বিক ও শিল্পরসিকদের অংশগ্রহণে বিশ্লেষিত হবে ছাপচিত্রের নান্দনিক ও সামাজিক গুরুত্ব। সেমিনারে উপস্থাপিত প্রবন্ধ এবং প্রাসঙ্গিক আরও তথ্য ও মন্তব্য সমন্বিত একটি প্রকাশনাও বের করা হবে এ উপলক্ষে।
মানুষের পথ-চলায় কেবলই চিহ্ন, সংকেত আর ইমেজের নির্দেশ। গুহাবাসী আর বনবাসী জীবন পর্বেও কোনো-না-কোনো সংকেতে একজন অন্যজনকে প্রেরণ করেছে জরুরি সংবাদ। সেই থেকেই পদাঙ্ক অনুসরণ আর সভ্যতার অগ্রযাত্রা। পায়ের ছাপের পর হাতের ছাপেরও গুরুত্ব বেড়ে গেল। কররেখা পাঠ করে মানুষ আরও বিষদভাবে মানুষকে জানতে পারল। তা সে সম্রাটের পাঞ্জাই হোক আর সাধারণজনের হাতের তালুর ছাপই হোক, দুই ছাপই জরুরি হয়ে উঠল রাজ্য চালনার জন্য এবং মানুষে মানুষে মিতালির জন্য। তারপর সভ্যতার যখন আরো বয়স বাড়ল তখন আর পুরো হাতের প্রয়োজন হলো না, একটি আঙ্গুলের ডগার ছাপই মানুষকে চিনিয়ে দেয়ার জন্য অর্থাৎ মানুষে মানুষে যোগসূত্র খোঁজার জন্য যথেষ্ট হয়ে গেল। আমজনতা তার টিপসই দিয়ে সরকারকে নির্বাচন করে ফেলল এবং আরো অনেক দাপ্তরিক কাজেও বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপ অপরিহার্য হয়ে উঠল। চামড়ায়, বাকলে, কাঠে, পাথরে, রাবারে, ধাতব পাতে নানা চিহ্ন ও স্মারক এঁকে এঁকে রচিত হয়েছে মানুষের সম্পর্ক ও নানামুখী গণসংযোগ। শিলালিপি, তাম্রশাসন, তকমাপাতার পুঁথি, সীলমোহর সভ্যতার যোগাযোগের সূত্রগুলো দূর-সুদূর অতীত থেকে আজ পর্যন্ত ছাপাই চারুশিল্পেরই সাক্ষী।

আঁলিয়স ফ্রঁসেজ-এ সিরিজ ইভেন্ট

অঞ্জন আচার্য

এজেন্সি ফ্রান্স ডি ডেভেলপমেন্ট (ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা), আঁলিয়স ফ্রঁসেজ দো ঢাকা এবং ঢাকাস্থ ফরাসি দূতাবাস আয়োজন করেছে একটি সিরিজ ইভেন্টের। "জলবায়ু পরিবর্তন ও উন্নয়নের সেতুবন্ধন"(Bridging Climate Change and Development) শীর্ষক এই আয়োজনের সূচনা হয় ১৬ মে শনিবার আঁলিয়স ফ্রঁসেজে। চলবে ২৩ মে পর্যন্ত। ফরাসী রাষ্ট্রদূত সোফি ওবের শনিবার দুপুর ১টায় সূচনা আসরে সভাপতিত্ব করেন।

এদিকে চলতি বছরের ডিসেম্বরে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন, সংক্ষেপে COP 21 (সিওপি ২১,জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে ২১তম বার্ষিক আসর)। দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ২০১১ সালের সিওপি সতেরোয় ১৯৪টি দেশ একটি সম্মিলিত আন্তর্জাতিক জলবায়ু কার্যক্রম পরিচালনায় সম্মত হয়। এ বছর সে কার্যক্রম পর্যালোচনার সময় নির্ধারিত হয়েছিল। তাই সিওপি ২১ গুরুত্বপূর্ণ আগামীর কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণে উল্লেখ্য বিজ্ঞানীরা যেমনটি ভেবেছিলেন তার চেয়েও অধিক মাত্রায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে যেমন সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বা উষ্ণ ঢেউ। ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেইঞ্জ (আইপিসিসি) সম্প্রতি আবার বলেছে-জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মানুষই দায়ী এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সময় বেশি নেই। এ বৈরি সময়ে সব মানুষের একত্র হওয়া প্রয়োজন। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সবার অংশগ্রহণ জরুরি। এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে এ আয়োজন। আয়োজনের অন্যতম দুটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হচ্ছে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে ১৬ থেকে ২৩ মে।


এক. জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ষাটটি সমাধান : প্রখ্যাত ফরাসী আলোকচিত্র শিল্পী ইয়ান আরথাস-বারট্রান্ড জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন। তাঁর সিরিজের নাম 'ওপর থেকে পৃথিবী'। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব দেখেছেন সারা পৃথিবী ঘুরে। খুঁজেছেন সমাধান। তাঁর ছবি দেখে উপকার পেতে পারে সব মানুষ-সব নাগরিক বা কর্মকর্তা। তাঁর সমাধানের ধরন- গরীব বাড়ি সৌর চুলায় সাজাও বা একটি বড় বাঁধের চেয়ে কয়েকটি ছোট বাঁধ ভালো।

দুই. জলবায়ু পরিবর্তনে স্থানিক প্রতিক্রিয়া : নবীন আলোকচিত্রশিল্পী জুল তুলে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের ছবি তুলেছেন সাদা-কালোয়। তুলে চেয়েছেন তাঁদের ছবি তুলতে যারা জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে অথচ যাদের কোনো দায়ই নেই। তাঁর তোলা ২০টি ছবি থাকছে প্রদর্শনীতে। তুলে এখন ঢাকায় আছেন এবং ১৬ মে প্রদর্শনীর উদ্বোধনীতে উপস্থিত ছিলেন। এসব প্রদর্শনীর পাশাপাশি কয়েকটি বৈঠকের আয়োজন করছে ফরাসী দূতাবাস এবং এজেন্সি ফ্রান্স ডি ডেভেলপমেন্ট।
প্রথম বৈঠক উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন সমন্বয় : নিত্যকার রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন কার্যক্রমগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করার উপায় খোঁজেন এ বৈঠক। উন্নয়ন মডেলগুলো যেন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটকে ত্বরান্বিত না করে তার ওপর আলোকপাত করবেন বক্তারা। ড. কাজী খলিকুজ্জামান আহমদ (সভাপতি, গভর্নিং কাউন্সিল ও রেক্টর, ঢাকা স্কুল অব ইকনমিকস), ড. আইনুন নিশাত (উপ-উপাচার্য, ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়), জনাব তাকসেম এ. খান (ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ঢাকা ওয়াসা), ড. আতিক রহমান (নির্বাহী পরিচালক, বিসিএএস, বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ) এবং ড. আহসান উদ্দিন আহমেদ (সেন্টার ফর গ্লোবাল চেঞ্জের নির্বাহী পরিচালক) প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন বৈঠকে। বৈঠক পরিচালনা করেন জনাব কামরুল চৌধুরী (সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম)।

দ্বিতীয় বৈঠক বৈশ্বিক হুমকির স্থানিক সমাধান : সমস্যাটা যদিও বৈশ্বিক, স্থানিক সমাধানও জরুরি। যেহেতু প্রতিটি স্থানের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে, সংকটও তাই অনন্য। বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন বিশ্বব্যাপী সুখ্যাত বিজ্ঞানী ড. সলিমুল হক (পরিচালক, আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তন ও উন্নয়ন কেন্দ্র), মনিরুজ্জামান (মেয়র, খুলনা সিটি কর্পোরেশন), ড. মো. আনসার আলী (গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট), ড. শরীফুল ইসলাম (অধ্যাপক, বুয়েট) এবং ফারহানা শারমীন (প্রোগ্রাম ম্যানেজার, প্রাকটিক্যাল অ্যাকশন)। ঢাকা ট্রিবিউনের সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার আবু বকর সিদ্দিক বৈঠক পরিচালনা করেন।
তৃতীয় বৈঠক: ব্যবসা এবং জলবায়ু পরিবর্তন; প্রাইভেট সেক্টরে প্রস্তুতি : এই বৈঠকের লক্ষ্য এটা জানানো যে, কীভাবে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি ত্বরান্বিত করছে। আলোকপাত করা হবে প্রতিষ্ঠানগুলোর মোকাবিলায় কী কী প্রস্তুতি নিচ্ছে বা নিতে পারে। বৈঠকে অংশ নেবেন হার এক্সিলেন্সি সোফি ওবের ও জ্যঁ-মার্ক লেঙ্গার্ড (ব্যবসা উন্নয়ন ব্যবস্থাপক, ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্ট, সুয়েজ এনভায়রনমেন্ট), মুজিবুর রহমান (বিক্রয় ও বিপণন প্রধান, টোটাল বাংলাদেশ), আব্দুর রায়হান (প্রধান, বিজনেস কন্টিনিউটি ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট্ চেইঞ্জ, গ্রামীণফোন এবং জনাব হাসিব উদ্দিন (চেয়ারম্যান, এপিএস গ্রুপ)। বৈঠক পরিচালনা করবেন ড. আতিক রহমান (নির্বাহী পরিচালক, বিসিএএস, বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ)
আয়োজনের অংশ হিসেবে 'মানবকুল বনাম জলবায়ু পরিবর্তন' শিরোনামে কয়েকটি প্রামান্যচিত্র প্রদর্শিত হয় আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ মিলনায়তনে 'তৃষ্ণার্ত বিশ্ব:ইয়ান আরথাস বারট্রান্ড', 'পানির মতো সোজা: গ্লেন বাকের', 'শুনতে কি পাও :কামার আহমদ সাইমন এবং সারা আফরিন'। ছবিটি প্রদর্শনের পরপর একটি উন্মুক্ত প্রশ্নোত্তর পর্ব অনুষ্ঠিত হবে।

হাত দিয়ে দেখা – চোখ দিয়ে আঁকা

আব্দুল হালিম চঞ্চল

(ক) রেখাচিত্র, চিত্রশিল্পের প্রারম্ভিক ও মৌলিক উপাদান হিসাবে বিবেচনা করা হলেও, বিশ শতকের গোড়া থেকেই ইউরোপের মর্ডান মাস্টার শিল্পীরা এটিকে একটি স্বতন্ত্র শিল্প মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার শুরু করেছিল। তাদের কাজে রেখানির্ভর চিত্রের প্রধান্য এসেছিল মূলত প্রাচ্যের শিল্পের অনুপ্রেরণাতে; বিশেষত জাপানি ছাপায়-ছবি ও ইউরোপের কলোনিভুক্ত বিভিন্ন নৃগোষ্ঠির শিল্প থেকে। প্রাচ্যের চিত্র – রঙ, রেখা ও রূপের সমন্বয়। প্রাচ্যে চিত্রের এই মৌলিক তিনটি উপাদান একই সঙ্গে পটে বিরাজ করে, যা পশ্চিমা শিল্পে অনুপস্থিত ছিল। আমাদের এই বঙ্গ অঞ্চলে আদি থেকেই চিত্র রেখানির্ভর বা চিত্রে রেখার উপস্থিতি দৃশ্যমান। পাল পুঁথিচিত্র, দরবারি চিত্র, কোম্পানি আমলের চিত্র, কালিঘাটের পটচিত্র, গাজির পট, রিক্সাচিত্র থেকে লোকজ যে কোন শিল্প মাধ্যমে রেখার সমন্বয় ও প্রধান্য সহজেই নিরূপনীয়। এ অঞ্চলের আধুনিক ও প্রতিষ্ঠান নির্ভর শিল্পীদের ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা দেখা যায়। বিশেষত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর বেইজ, বিনোদবিহারী, সোমনাথ হোড়, জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, এস এম সুলতান, সফিউদ্দিন আহমেদ-এর শিল্পকর্মকে রেখানির্ভর চিত্র বললে অত্যুক্তি হয় না। বাংলাদেশের ২য় প্রজন্মের শিল্পীদের থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের শিল্পীদের ক্ষেত্রেও একই প্রবণতার ধারাবাহিকতা লক্ষণীয়। এ ক্ষেত্রে পর্যায় ক্রমে কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, মনিরুল ইসলাম, রফিকুন নবী, শাহবুদ্দিন আহমেদ, নিসার হোসেন, শিশির ভট্টাচার্য, মোহাম্মদ ইকবাল, মোস্তফা জামান, তৈয়বা বেগম লিপি, মাহবুবুর রহমান, রনি আহমেদ, শাওন আকন্দ প্রমুখ শিল্পীদের কাজ রেখানির্ভর চিত্রের পরিসরকে বিস্তৃত করেছে। এই প্রবণতার মাঝেই খুঁজে পাওয়া যাবে বাংলাদেশের শিল্পের স্বরূপ বৈশিষ্ট্য।

অন্যদিকে সাশ্রয়ী ও দ্রুত নির্মাণ পদ্ধতির কারণে সমসাময়িক সময়ে রেখানির্ভর চিত্রের জনপ্রিয়তা ও চর্চা বিশ্বশিল্পের একটি প্রধান চরিত্রে উপনীত হয়েছে। আবার নিরীক্ষার জন্যও এটি উন্মুক্ত। শারীরিক এক সম্মোহিনী ক্ষমতা আছে রেখানির্ভর চিত্রের। বিভিন্ন মাধ্যমে ড্রইং হয়ে ওঠে স্পর্শকাতর ও মর্মস্পর্শী। আমাদের এই ড্রইং বা রেখানির্ভর চিত্রের আগ্রহ মূলত বাংলাদেশের শিল্পের পরম্পরা ও সমসাময়িক বিশ্বশিল্পের অংশ হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা। আয়োজকরা মনে করেন সাধারণ দর্শক ও শিল্পানুরাগীদের মাঝে শিল্পের বৈচিত্রময় ব্যঞ্জনার সৃষ্টি হবে।

(খ) বাংলাদেশের আধুনিক ও প্রতিষ্ঠান নির্ভর শিল্পচর্চার বয়স খুব বেশি না হলেও শিল্পের গুণগ্রাহী ও দর্শকের আয়তন ও কলেবর ইতিমধ্যে একটি সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নিত হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে সাধারণ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের ব্যাপক অংশ বাংলাদেশের শিল্পকলার সমকালীন প্রদর্শনী দেখা থেকে বিরত রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায় এর অন্যতম কারণ ঢাকা নগরীর যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নগরীর মানুষের অধিক কর্মব্যস্ততা। এ কারণে এমন স্থানে প্রদর্শনীর পরিকল্পনা করা হয়েছে যেখানে ক্রেতা ও দর্শনার্থী সাধারণত দীর্ঘ সময়ের জন্য আসে। বসুন্ধরা সিটি শপিং মল এই ক্ষেত্রে একটি আদর্শ স্থান। বসুন্ধরা সিটি শপিং মলে প্রতিদিন গড়ে ১ লক্ষ ক্রেতা ও দর্শনার্থীর সমাগম হয়, আবার এটি শুধুমাত্র বিপণন কেন্দ্রই নয় বরং এখানে বিপণনের পাশাপাশি বিনোদনের ব্যবস্থা থাকাতে, এটি হয়ে উঠেছে দেশের নানা শ্রেণি পেশার মানুষের মিলন কেন্দ্র। এই বিপুল মানুষের সমাগমের কারণে এই স্থানটিকে চিত্র প্রদর্শনীর জন্য একটি বিশেষ স্থান হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে, যা এখানে আগত ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের বিপণনের পাশাপাশি নান্দনিক অভিজ্ঞতার সুযোগ তৈরি করবে।
অন্যদিকে বিশ শতকের গোড়া থেকেই পশ্চিমা বিশ্বে এবং ৬০এর দশক থেকে সারা বিশ্বে দৃশ্যশিল্পীরা পরিবেশ ও স্থানকে গুরুত্ব দিয়ে শিল্প নির্মাণ ও প্রদর্শনীর আয়োজন করে আসছে। উন্নত বিশ্বে শপিং কমপ্লেক্সে নানা মাত্রার প্রদর্শনী ইতোমধ্যেই সাড়া ফেলেছে। ধারণা করা যায় এই আয়োজন দেশের শিল্পচর্চা ও তৎপরতাকে বৈশ্বিক মানে উন্নিত করার প্রয়াস পাবে।

(গ) এই প্রদর্শনীটি 'আঁতুড় ঘর'র প্রথম প্রচেষ্টা। 'আঁতুড় ঘর' অন্য নবীন শিল্পীদের সাথে বিনামূল্যে শেয়ার করে একটি শিল্প তৎপরতার আয়োজনের মাধ্যমে। বলা বাহুল্য এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে স্টুডিও "আঁতুড়ঘর" ও আমাদের অঙ্কন নির্ভর শিল্প তৎপরতার আনুষ্ঠানিক সূচনা হলো। "আঁতুড়ঘর"-এর লক্ষ্য ভবিষ্যতে এমন আরো সময়োপযোগী শিল্পচর্চার আয়োজন সম্ভব করে তোলা, যেখানে নানা মাধ্যমের শিল্পীদের অংশগ্রহণে বৈচিত্রময় ও সৃষ্টিশীল শিল্পের নানামুখী তৎপরতা অব্যাহত থাকবে।

দৃশ্যশিল্পী মাত্রই তার একটি স্টুডিও বা কাজের স্থান প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান সময়ে ঢাকার আবাসিক অঞ্চলে নবীন শিল্পীদের স্টুডিও নির্মাণ অসম্ভব হয়ে উঠছে মূলত ব্যয়ভারের জন্য। আবার শিল্পশিক্ষা নিয়ে অধিকাংশ তরুণ শিল্পী জীবন নির্বাহের তাগিদে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরি গ্রহণ করাতে তাদের শিল্পচর্চাও বন্ধ হবার উপক্রম। এই দুটি বিষয়কে প্রধান্য দিয়ে "আঁতুড়ঘর" নিজের স্টুডিওকে অন্য শিল্পীদের সাথে শেয়ার করেছি। স্টুডিও ভিত্তিক একটি সক্রিয় শিল্পচর্চা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষেই ৬ মাস ব্যাপি একটি রেখানির্ভর শিল্প তৎপরতা/কার্যক্রম পরিচালনা করা। এই শিল্প তৎপরতার অংশ হিসেবে তারা বৈশ্বিক শিল্পের ধরন ও প্রবণতা বিষয়ক ধারাবাহিক পাঠচক্র যেমন করেছে, তেমনি রেখানির্ভর চিত্রের নানা ধরন, প্রক্রিয়া ও মাধ্যম বিষয়ে চর্চা করেছে। বর্তমান প্রদর্শনীটির চিত্রগুলো এরই নির্যাস।

শিল্প তৎপরতায় অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা হলেন পার্থপ্রতিম কুন্ডু, আবদেল্লা সাইদ, সাইফুল্লা বিন আসাদ ও অদৈত্য অভিজ্ঞান। নিরীক্ষার প্রতি তাদের আগ্রহ ও নিষ্ঠা এই আয়োজনকে করে তুলেছে সার্থক ও ব্যঞ্জণাময়। অভিব্যক্তি পার্থের শিল্পের মূল সুর। সমসাময়িক সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতিফলন ও প্রতিক্রিয়া পার্থের পটে স্বরূপ ও প্রতীকে দৃশ্যমান হয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত সাবলীল রেখার গতিতে। দীর্ঘ রেখার নিপুণ ছন্দে, প্রত্নপ্রতীক ও সমসময়ের মিলনে সাইদের পটে জেগে ওঠে নতুন মেটাফর। সাইদের রেখা হয়ে উঠতে চায় চিরন্তন মিথের রূপকার। বিপরীতধর্মী আকৃতি, রঙ ও রেখা যেন মানব-মানবীর আদি গল্পকেই বুনন করে চলেছে সাইদের প্রতিটি পটে। সাইফুল্লার কালো জমিনে বিমূর্ত ও মূর্তের মধ্যে চিরন্তন বোঝাপড়া বা পারস্পরিক যোগাযোগ চলতে থাকে স্পর্শকাতর সুক্ষ্ণ বর্ণিল রেখার স্ফূরণে। নৃ গোষ্ঠিদের শিল্পকর্মের নানা আকৃতি ও উপাদানের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা তার পটের রূপকল্পগুলো এ সময়ের মিথ যেন- অদ্ভুত, উদ্ভট আর সুন্দর চাষাবাদ যেখানে একই জমিনে হয়ে থাকে।
ব্লু রাইডার গ্রুপের প্রথম প্রদর্শনীর ক্যাটালগে কান্দিনেস্কি পশ্চিমা শিল্পীদের চর্চার ঐতিহ্য ত্যাগ করে শিশুদের চিত্র থেকে অনুপ্রেরণা নেবার ঘোষণা দিয়েছিলেন। শিশুর মতো সরল ও অকৃত্রিম দৃষ্টিতে পৃথিবীকে অবলোকন এবং রূপ গড়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল বিশ শতকের বহু শিল্পীর। শিশুশিল্পী অদ্বৈত অভিজ্ঞান "আঁতুড়ঘর"-এর শিল্পচর্চায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করে তাদের শিল্পচর্চায় এনেছে নতুন ব্যঞ্জনা । ওর আর "আঁতুড়ঘর"-এর মাঝে পারস্পরিক লেনদেন হয়েছে। বিশেষত বড়দের নানা জটিল বিষয় কত সহজেই রূপ দেওয়া যেতে পারে এই উপমা তারা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছি। প্রদর্শনীতে অদ্বৈত'র চিত্রগুলো তারই স্বাক্ষর।

"আঁতুড়ঘর"-এর এই প্রদর্শনীর পৃষ্ঠপোষকতা করেছে বসুন্ধরা গ্রুপ।