কাজী রকিব: “আমি মাথা দিয়ে চলি না, মন দিয়ে চলি”

chintaman_tusar
Published : 27 Jan 2015, 07:46 AM
Updated : 27 Jan 2015, 07:46 AM

গত ১৬ জানুয়ারি থেকে শিল্পী কাজী রকিব(জন্ম ৫ ফেব্রুয়ারি , ১৯৫৫)-এর প্রদর্শনী শুরু হয়েছে উত্তরায়, গ্যালারি কায়ায়; প্রদর্শনী চলবে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত। তবে অবরোধ ও হরতাল অব্যাহত থাকায় প্রদর্শনীর সময়সীমা আরও এক সপ্তাহ ( ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) বাড়ানো হয়েছে। শিল্পীর একাদশতম এই একক প্রদর্শনীতে মোট ৭৫টি শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে এক্রেলিক অন ক্যানভাস ১৭টি, ওয়াটার কালার ১৩টি, এক্রেলিক অন পেপার ৮টি, অয়েল অন ক্যানভাস ৪টি, পেন্সিল অন পেপার ৬টি, প্রিন্ট ৪টি, ড্রয়িং ২৩টি, কোলাজ ২টি, গ্লাসওয়ার্ক ২টি, প্যাস্টেল অন পেপার ১টি। মাধ্যম এবং বিষয়ের বৈচিত্র্যে শিল্পী কাজী রকিবের এই প্রদর্শনী এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। নানান ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শিল্পী নিজেকে বদলে নিয়েছেন বারবার। এমনকি, রংয়ের ক্ষেত্রেও তিনি কখনও একই ধারণায় বন্দী হয়ে থাকেননি। 'ঢাকা পেইন্টার্স'(১৯৭৪-৭৭)-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কাজী রকিব সুররিয়ালিজমের মতো প্রকরণকেও আত্মস্থ করেছিলেন নিজের জন্য বহুবর্ণিল ও পরিব্যাপ্ত এক জগতকে নিশ্চিত করে তোলার লক্ষ্যে। এবং এই লক্ষ্যে তার সাফল্য তাকে আমাদের অগ্রগণ্য শিল্পীদের একজন করে তুলেছে। শিল্পকলার সাবেক শিক্ষক এই শিল্পী, শিল্পের দায়কে যে নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে উচ্চতর অবস্থানে নিয়ে গেছেন তা আমাদের কাছে অত্যন্ত গৌরবের– তাতে কোনো সন্দেহ নেই। চলমান এই প্রদর্শনী উপলক্ষে সম্প্রতি তার একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন চিন্তামন তুষার। অডিওতে ধারণকৃত সাক্ষাৎকারের লিখিত রূপটি এখানে প্রকাশ করা হলো। বি.স.

চিন্তামন তুষার: আপনার এর আগের এগজিবিশনটা কেমন ছিল?
কাজী রকিব: এর ঠিক আগের এগজিবিশনটা ছিল আমার কিছু ওয়াটার কালার ও গ্লাস ওয়ার্ক। মেইনলি গ্লাসওয়ার্ক, সেইসঙ্গে কিছু ওয়াটার কালার ছিল। আমি এই দুই মাধ্যমে কাজ করতে খুব সহজ বা ইজি ফিল করি। এই এগজিবিশনের জন্য আমি আবার এক্রেলিকের কাজ করেছি– নতুন, ক্যানভাসের উপরে। আমার এগজিবিশনের অর্ধেক কাজই তো পুরোনো। ১৯৭৩ সালের একটা কাজ আমার কাছে আছে। কিন্তু ডিসপ্লেতে সেটা রাখতে পারিনি।
চিন্তামন তুষার: সেটা কি টাইম স্প্যান ধরার কারণে?
কাজী রকিব: না, রাখতে পারিনি। এটা আমার বোনের বাড়িতে আছে, গ্রামে। আমরা যখন প্ল্যান করছি এগজিবিশন করবো, তখন যোগাযোগ ঠিকঠাক মতো করতে পারিনি। তাই ওইটা আর আনা হয়নি। এমনিতে অয়েল পেইন্টিংয়ের কাজ প্রথম ১৯৭৩ সালে। আর্ট কলেজে ভর্তি হই ১৯৭২ সালে। তারপর ১৯৭৩ সালে আমাদের অ্যাকাডেমিক সিস্টেমের কারণে আমরা ওয়েল পেইন্টিং করতে পারি না।
চিন্তামন তুষার: সেটা কি সিলেবাসে না থাকার কারণে?
কাজী রকিব: না, এটা থার্ড ইয়ারে গিয়ে করতে হয়। আমি তো তখন সেকেন্ড ইয়ারে শিক্ষার্থী।
চিন্তামন তুষার: কোর্সে ছিল না তখন…
কাজী রকিব: কোর্সের সিডিউলে ছিল না। অ্যাকাডেমিক কাজ যেটা করতে হয়, সেটা করতাম। আমার নিজের যা করতে ইচ্ছা করে, সেটাও আমি পাশাপাশি করতাম। ফ্রম দ্য বিগেনিংয়ে বলি, এই কারণে আমি ১৯৭৩ সাল থেকে নিয়মিত আমার ছবি আঁকি। কিন্তু সাধারণত অনেকে আর্ট কলেজ থেকে পাস করার পর নিজেরটা করে। কারণ এই সময়টা তার অ্যাকাডেমিক কাজের, নিজের না। কিন্তু আমি আমার নিজের কাজ ওই সময়টা থেকেই করি। এখানে আছে ১৯৭৫ সালের কাজ। তখন আমার বয়স বিশ বছর। আমাদের তখন একটা গ্রুপ ছিল 'ঢাকা পেইন্টার্স' নামে। সেই গ্রুপের সবাই সুররিয়ালিজমের উপর আলাদাভাবে নজর দিলাম। সুররিয়ালিজমের একটা এগজিবিশন হয়েছিল আমাদের, তখন আমরা থার্ড ইয়ারে পড়ি আমরা। গ্রুপ থেকে মোট ছয়টা এগজিবিশন করেছিলাম। কিন্তু ফাইনালি হয় কী, আমরা যখন আর্ট কলেজ থেকে পাস করলাম, পাস করার পরে নানানভাবে, বিভিন্ন দিকে চলে গেলাম। নানান চাকরী-বাকরী ব্যাবসা-বাণিজ্য এইসব করতে গিয়ে, তাতে আর গ্রুপ অ্যাক্টিভিটি কন্টিনিউ করল না। কিন্তু আমার এই গ্রুপটা আমাকে অন্যরকম কাজ করার সাহস দিল। অন্য সবাই যে পথে যাচ্ছে আমি আর সে পথে গেলাম না। নতুন করে পথ খোঁজা শুরু করলাম। তারই চল্লিশ বছরের বিভিন্ন সময়ের কাজ নিয়ে এই এগজিবিশন। আমি ওয়াটার কালার করেছি, প্রিন্ট করতাম, এমনকি ফটোকপি করে আমি ওইটাকে আর্ট ওয়ার্ক বলছি। ফটোকপি করার যে গ্লাসটা, সেটায় আমি নানান জিনিসপত্র রেখে কপি করি। আমি সেটাকে বলছি, দিস ইজ মাই আর্ট ওয়ার্ক।
চিন্তামন তুষার: এটা কি জেরোগ্রাফি …
কাজী রকিব: হ্যাঁ, জেরোগ্রাফি। জেরক্স থেকে ওইটাকে জেরোগ্রাফি নাম দিয়েছি। জেরোগ্রাফি নামে কোন টার্ম আর্টওয়ার্কে আছে কিনা আমি জানি না। ওইটা আমি দিয়েছি। আপনি ইন্টারনেটে সার্চ করে দেখতে পারেন, কিছু আছে কীনা। আমি দেখলাম যে 'ফটোকপি' সুন্দর শব্দ না। জেরক্স শব্দটা শুদ্ধ। তো জেরক্স থেকে জেরোগাফি।
চিন্তামন তুষার: ঢাকা পেইন্টার্সদের যে সংগঠন করেছিলেন আপনারা, সেই সংগঠন করার বদৌলতে আপনার কিছু ছবি এসেছিল নিশ্চয়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সালের কিছু ছবি রেখেছেন আপনি, কাজগুলো কী সেই সংগঠনের ফসল?
কাজী রকিব: ১৯৭৫ সালে
চিন্তামন তুষার: এক্সপ্রেসনিস্ট তো বলছেন…
কাজী রকিব: হ্যাঁ, ছাপ আছে তার… পরবর্তীতে আমি সেখান থেকে সরে এসেছি। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে আমি নিজের পথে চলে এসেছি এবং আমাদের এখানে একটা প্রবণতা আছে, যখন কোনো একটা বিশেষ স্টাইল অ্যাপ্রিসিয়েশন হয়, তখন সে আর্টিস্ট তার স্টাইল ঠিক করে নেয়; তার একটা মার্কেটের ব্যাপার আছে। আমি আমার ছবির আর্ট মার্কেট নিয়ে কখনই ভাবিনি। আমাকে যদিও আর্ট ওয়ার্ক করেই জীবনযাপন করতে হয়েছে। এটা কখনই ভাবিনি। আমার চিন্তাই ছিল আমার যা করতে ইচ্ছা হয়েছে আমি তাই করব। সে কারণে আমার ছবি দেখলে বোঝা যাবে যে, অনেক রকমের কাজ… আমার যেরকম করতে ইচ্ছা করেছে আমি সেরকমই করেছি। তাতে কোন কিছু হয় কী না, সেটা আমার জানার দরকার নেই। আমি স্যাটিসফাই কিনা সেটাই ছিল আমার দরকার। পরে আমি লক্ষ্য করলাম, আমাকে অনেকেই বলছে যে, 'তোমার অমুক কাজ তো ওইখানে দেখেছি'। আমি জিজ্ঞেস করেছি, তুমি কী আমার সাইন দেখছ? বলে না, 'তোমার কাজ দেখলেই তো চেনা যায়'। তখন বুঝলাম আমার একটা ক্যারেক্টার তৈরি হয়ে গেছে। আমি এই ক্যারেক্টারকে গুরুত্ব দিয়েছি। স্টাইলকে না। স্টাইল মানে একটা জায়গায় থেকে যেতে হয়। যেমন আমরা নিজেরা কাপড়চোপড় পরি। এখন যদি দেখি এবছর শীতের কাপড় কী হল, সবাই কেমন পরছে, আমি এর মধ্যে থেকে একটা কিনে পরলাম। তাহলে কিন্তু আমার ক্যারেক্টারটা তৈরি হল না। আমি বোঝাতে চাচ্ছি স্টাইল আর ক্যারেক্টরের মধ্যে পার্থক্যটা কী। তাতে দেখলাম দীর্ঘদিন মনোযোগ দিয়ে কাজ করলে, আত্মতৃপ্তির জন্য কাজ করা হয়, মার্কেটের কথা না ভেবে। তাহলে একটা চরিত্র তৈরি হয়। মানুষের নিজের চরিত্র যদি ঠিক থাকে, তাহলে তার কাজের চরিত্রও ঠিক থাকবে। আমি ওইটাই বিশ্বাস করেছি।
চিন্তামন তুষার: কিন্তু আপনাদের গ্রুপটা ভেঙ্গে যাওয়ার পরে…
কাজী রকিব: গ্রুপটা ইনফ্যাক্ট ভেঙ্গে যায়নি। গ্রুপটা কেমন করে ডিজল্ভড হয়ে গেছে। আমরা অ্যাক্টিভিটি বন্ধ করে রেখেছি। এখনও আমরা মাঝেমধ্যে ঢাকা পেইন্টার্সদের লোকজন একসঙ্গে বসি। আমরা পুরোনো দিনের গল্প করি। এবং বিশ বছর পূর্তিতে আমরা একটা শো করেছিলাম। তারপরে এটাকে গ্রুপ অ্যাক্টিভিটি হিসাবে যে ধরনের জীবন যাপন করতে হয় সেটা আর করিনি। কারণ আমাদের বিভিন্ন সদস্যদের জীবন…
চিন্তামন তুষার: অনেকেই তো বোধহয় বিদেশ গেল?
কাজী রকিব: বিদেশ গেল, কেউ কেউ ছবি আঁকা ছেড়ে দিল। অনেকে ব্যবসা করছে।
চিন্তামন তুষার: আপনাদের আন্দোলনটা তো একটা শিল্পধারা তৈরি করা বা শিল্পের মাধ্যমে আরও কিছু করার চেষ্টা…
কাজী রকিব: সেটা ছিল। কিন্তু আমরা পরে আসলে… আগে একটা জিনিস বলি, আমরা যখন কমিউনিস্ট হয়ে যাই,… এখন তো কমিউনিস্ট নাই। একটা দিকে থাকে আদর্শ, আদর্শের কারণে হয়। আরেকটা থাকে, এর মধ্যে এক ধরনের রোমান্টিসিজম আছে। আমাদের গ্রুপের অনেকের মধ্যে রোমান্টিসিজম ছিল। ইয়াং বয়স তো, যে কারণে পরে তারা কেউ কেউ সরে গেছে। কারণ নিশ্চিত জীবন নেই আর্ট অ্যাক্টিভিটিতে। আমি অন্য একটা জিনিস পাচ্ছি, কেন করব না? পরে গ্রুপের অনেকেই আছে, সে হয়ত আর্ট অ্যাক্টিভিটি করে কিন্তু মেইনস্ট্রিমে আর নেই। সে নিজের মতো করে কাজ করছে। এগজিবিশন হয়ত আর করে না। মাঝে মাঝে আর্টওয়ার্ক করে, মাঝে মাঝে অন্য কাজ করে। আবার কেউ কেউ আর্টওয়ার্ক ছেড়েই দিয়েছে। তাদের মধ্যে আমার জানামতে একজন ছাড়া অন্য সবাই আর্টওয়ার্কের মধ্যেই আছে। হয়ত তারা মেইনস্ট্রিমের কাজে নেই। সুকুমার পাল সরা আঁকে। সে অন্য ধারায় কাজ করছে। বিমল বণিক সে এখন ক্রাফট ডিজাইন করে। সে হয়ত পেইন্টিং এগজিবিশন করে না, আমি জানি না। কুহু ফ্যাশন ডিজাইন করে। দীপা তো মারা গেলেন। মাসুদুল আলম, সে গ্রাফিক্স ডিজাইনে খুব ভালো আর্টওয়ার্ক করছে। সে নিউ ইয়র্কে থাকে। ইদানিংকার কাজ আমি দেখেছি, খুব ভালো কাজ করছে। কিন্তু সে শো করে না। আমি তাকে বলেছি, ঢাকায় শো করার জন্য। যে, এটা তোমার কাজ। ঢাকা পেইন্টার্সের বিশ বছরের এগজিবিশনটা করেছিলাম আমরা। তখন আমরা আমাদের প্রত্যেকটা সদস্যকে বলেছিলাম। তুমি যাই করো, তুমি নজরুল, তুমি একটা গার্মেন্ট ডিজাইন করো অথবা একটা ড্রাফট রেডি করো। সেটাই তুমি শো করো।


চিন্তামন তুষার: যার যার ক্যারেক্টারেসটিকস তুলে ধরা…
কাজী রকিব: হ্যাঁ, ঢাকা পেইন্টার্সের তুমি একজন সদস্য। তুমি এখন আর অয়েল পেইন্টিং করো না। তুমি এরকম একটা ডিজাইন করো বা জিনিসটার এখানে লাল হবে, হলুদ হবে। সেটাই আমরা এখানে এগজিবিট করবো, অসুবিধা কী। এটা তোমার কাজ, তুমি এখন এই কাজটাই করছ। কেউ যদি বলে যে না… আমাদের এক বন্ধু মিউজিকে চলে গেছে। তাকে বললাম– তুমি মিউজিকে গেলে, তোমার দুয়েকটা অডিও আমরা এখানে বাঁজাতে থাকি। যে, সে এখন আর ছবি আঁকে না, সে মিউজিক করে। তো এরা কেউ ভাবল ওভাবে বোধহয় ঠিক হবে না। আমি বোধহয় পথভ্রষ্ট। আমি কিন্তু কখনই এটা মনে করি না। আমি এখন ছবি আঁকছি বলেই আমি আছি। আমি যদি ছবি না আঁকতাম, আমি যদি অন্য কাজ করতাম। আমি যদি কৃষি কাজ করতাম, আমি হয়তো আসতাম তিনটা আম নিয়ে। আমি আমের এই চেহারাটা তৈরি করেছি। আমি এককালে ঢাকা পেইন্টার্সের সদস্য ছিলাম। আমি এই তিনটা আম (এখন) ডিসপ্লে করছি। আমার কিন্তু সে সাহস আছে, আমি সেটা পারতাম। যে এখন আমি কৃষি কাজ করি। এইটা হয়ত অনেকের নাই।
চিন্তামন তুষার: সময়টা ছিল আবেগের, সময়টা পার হয়ে এসেছে, জীবনের বাস্তবতা দেখেছে…
কাজী রকিব: অনেকের এই রকম হয়… আমি খুব ব্যক্তিগতভাবেই বলি… অনেকে হয়তো এটা নিয়ে আফসোস করে। আমি হয়ত ট্র্যাক চেইঞ্জ করেছি। আমি হয়ত অনেক অর্থশালী, আমার হয়ত অনেক অর্থ আছে, কিন্তু আমি হয়ত এই জায়গাটায় যেতে… যেমন ধরেন আমরা যখন পাবলিকলি ছবি আঁকি তখন দুইটা ঘটনা ঘটে। প্রথমত প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলে, সুনাম গড়ে উঠলে তার ছবি বিক্রি হয় এবং তার অনেক অর্থ হয়। আরেকটা হয়– সে এগুলোকে কখনই কেয়ার করেনি। তার বাড়ি ভাড়া দিতে হয়, বাচ্চাকে স্কুলে দিতে হয়, বৌয়ের কাপড়চোপড় কিনতে হয়। বৌয়ের অসুখ হলে তার খরচ-খরচা যোগাতে হয়। এটা সে কোনোভাবে ম্যানেজ করে এবং ম্যানেজ করতে তার কষ্টও হয়। তবু সে নিজের মতো করেই ছবি আঁকে। এটা করে অনেকেই। বিভিন্নভাবে মানুষ জীবনকে দেখে। এখন আর্টওয়ার্ক তো আলাদা কিছু না। একজন ইঞ্জিনিয়ার কোনো একটা অফিসে চাকরী করে। ওই ইঞ্জিনিয়ার যখন বুয়েটে পড়ত, তখন সে জানত যে সে প্রকৌশলের ব্যাপারে সাংঘাতিক একটা ভূমিকা রাখবে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ভেবেছে, 'আমি বড়সর কোনো একটা প্ল্যান করব।' কিন্তু দেখা গেল– সে যখন চেয়ার টেবিলে বসে গেল, তখন কন্ট্রাক্টরের কাছ থেকে কীভাবে টাকা-পয়সা নিতে পারবে। সেসব নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছে। এটা কিন্তু পথভ্রষ্ট হয়ে যাওয়া। তখন সে আর বড় গলায় একথা বলে না, আমি এরকম একটা প্ল্যান করেছি।
চিন্তামন তুষার: আপনি বলছিলেন, ঢাকা পেইন্টার্সের অন্যরা সরে গেল, চলে গেল। আপনি এসময়ে নিজের ক্যারেক্টার খোঁজার চেষ্টা করছিলেন। সেই ক্যারেক্টার খুঁজতে গিয়ে আপনি কতোগুলো মাধ্যমকে নিজের চর্চার মধ্যে আনলেন?
কাজী রকিব: মাধ্যমের কথা বললে, একটা মজার বিষয় বলি— আর্ট অ্যাক্টিভিটিসে 'মিডিয়াম' নিয়ে কথা বলায় আমি বিশ্বাস করি না। আমি আল্লাহ বিশ্বাসী মানুষ। আমার মনে হয়েছে, যখন কোনো মানুষকে আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠায়, তার আশপাশে তার জন্যে খাদ্য রাখা হয়। আরব দেশের যে মানুষটার জন্ম, তার জন্য খেজুর রাখা হয়েছে। তার আশপাশে খেঁজুরের গাছ জন্মায়। এখন হয়ত আমাদের ট্রেড সিস্টেমের কারণে আমরা মরুভূমিতে বসে সিল মাছের স্টেক খাচ্ছি। এটা অন্য ব্যাপার। কিন্তু আল্লাহর দুনিয়ার যে হিসাব, আমি জন্ম নিয়েছি যে জায়গায় তার আশপাশে আমার খাদ্য আছে। আমি মনে করি, আল্লাহ যখন একজন মানুষকে আর্টিস্ট করে এক জায়গায় পাঠায়, তার আশপাশে আর্ট ম্যাটেরিয়াল থাকে। ম্যাটেরিয়াল হিসেবে যদি ভাবি, অমুক কোম্পানির রঙ হতে হবে, তমুক কোম্পানির পেন্সিল হতে হবে। সেটা একটা বিষয়, জিনিসের উপরে আমার ফ্যাসিনেশন।

একদম প্রাচীন আর্টিস্টরা, সে হয়ত একটা গাছকে খোদাই করেছে। সে একটা রঙ দিয়ে একটা দেয়ালের ভেতর লেপেছে, সেই রংটা হয়ত আশপাশেই পাওয়া যায়। তাই বলা যায়, যেকোন ম্যাটেরিয়াল দিয়ে আর্টওয়ার্ক করা যায়। এখন সেটা টিকবে কীনা এই প্রশ্নটা আসে। অনেক আর্টিস্টের কাজ আছে। যেগুলো টেকানো নিয়ে এখনকার মিউজিয়ামগুলোকে ব্যস্ত থাকতে হয়। ভ্যান গগের অনেক পেইন্টিং আছে যেগুলো ঝড়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয়েছে। কারণ ভ্যান গগ তো এতো সময় দিতে পারেনি। সে অনেক কষ্ট করে জীবনযাপন করেছে। তার জীবিতকালে একটাও ছবি বিক্রি হয়নি। সে টাকা পাবে কোত্থেকে। ভাই তাকে সাহায্য করেছে বলে, বাঁচতে পেরেছে কিছুদিন। তাই তার অনেক কাজ প্রোপারলি হয়নি…
চিন্তামন তুষার: সংরক্ষণে সমস্যা…
কাজী রকিব: সমস্যা, সেগুলো যখন মিউজিয়ামে এসেছে… মিউজিয়ামওয়ালাদের তো অনেক ব্যস্ত থাকতে হয়। আমি একটা মাটি দিয়ে কাজ করলাম, কাঁচামাটি। মাটিটা রোদে শুকাবে। আর কিছু আমি করিনি। আমি একটা সিগনেচার করলাম। এখন এটা কাজী রকিবের কাজ। এখন কাজী রকিব যদি একজন মূল্যবান মানুষ হয়, তাহলে এটাকে কিভাবে রাখতে হবে। যে এটাকে সংগ্রহ করবে, সে এটাকে কাচের ফ্রেমে রাখবে নাকি কোনও কিছু স্প্রে করবে। সেটা টেকনিশিয়ানদের আবিস্কার করতে হবে। আমার তো এই মুহূর্তে এই মাটিটাকে এমন করতে ইচ্ছে করছে। আমিও সেই ইচ্ছাটাকে গুরুত্ব দিয়েছি। যে করণে আমি কাগজে কাজ করেছি, আমি কাঠের উপর কাজ করেছি, আমি প্রিন্ট করেছি, এনগ্রেভ করেছি, ট্যাপেস্ট্রি করেছি। আমি টেরাকোটার কাজও করেছি। কপারে কাজ করেছি; কপার পুড়িয়ে, কপারে এসিড ঢেলে। যেটা আমার কাছে ভালো লেগেছে আমি সেই কাজটাই করেছি।
চিন্তামন তুষার: গ্লাসওয়ার্ক…
কাজী রকিব: গ্লাস তো শেষের দিকে। যখন ক্লাস ফোরে পড়ি, আমার বয়স নয় কী দশ হবে। সে সময় আমি প্রথম কক্সবাজার যাই। আমার বড় ভাইদের একটা টিম যাচ্ছিল, আমাকে তারা সঙ্গে নিয়েছিল। তো নানা জিনিস আমি কুড়িয়ে এনেছিলাম। ফাইনালি দুইটা জিনিস আমার কাছে দীর্ঘদিন ছিল। এরমধ্যে একটা খুব ডেকোরেটিভ একটা শামুক। শামুকটা আমার কাছে এসে মারা গেছে। পরে ওটা বাসায় এনে পরিষ্কার করলাম। আর একটা চেপ্টা পাথর পাই, সেটা বালির ভিতর পেয়েছিলাম। পাথরটা লাইটে ধরলে আলো দেখা যায়। তার মানে সেমি ট্রান্সপারেন্ট এবং আমাদের আশেপাশের কন্সট্রাকশনে, নানা কাজের জন্য ওই বয়সে যে রকম পাথর দেখতাম, সেগুলোর কোনোটাই ট্রান্সপারেন্ট ছিল না। যে কারণে পাথরটিকে আমার কাছে একটা হীরক খণ্ডের মতো মূল্যবান মনে হয়েছিল। সেটা দীর্ঘদিন আমার কাছে ছিল। তারপর এক সময় হারিয়ে গেলে, আমি কেঁদেছি। মা আমাকে বলেছিলেন, 'কোনোদিন তোর এগুলো হবে'। আমার মা অন্য ধরনের এক নারী ছিলেন। আমি বাসায় কোনোকিছু হারিয়ে ফেললে– মা বলেছেন, 'পাবি, তুই এতো অস্থির হোস না, তুই ওইটা খুঁজে পাবি'। আমি দুয়েক মাস পরে সেটা খুঁজে পেয়েছি। আবার কোনো সময় বলেছেন, 'থাক, কতো মানুষের কতো কিছু হারায়, আবার পাবি, অন্য একটা জিনিস পাবি'। আমি জানি যে আমি আর ওই জিনিসটা পাবো না। কিন্তু আমার মা বললেন, 'কোনোসময় ওই জিনিসটা তোর হবে। এটা নিয়ে কান্নাকাটি করিস না।' এটা আমার অনেক ছোটবেলায় বলেছিলেন, আমি এখন এটা রিকলড করি। আমি আসলে সেই ট্রান্সপারেন্ট পাথর পাইনি। আমি একটা ট্রান্সপারেন্ট ম্যাটেরিয়াল পেয়েছি। যেটা নিয়ে আমি কাজ করেছি। তার মধ্যে গ্লাসকে ফ্রস্ট করে কাজ করেছি। ফ্রস্ট করার পরে আবার যখন একটু ক্লিয়ার করা হয়, তখন কিন্তু ওই পাথরের যে ইমেজটা, লাইটটা আসত সেটা আমি ফিল করি। এবং আমি ওই যে লাইট, একটা লাইট ব্লক করে দেয়, একটা কমিয়ে দেয়, একটা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে– এই জিনিসটাই কিন্তু আমি আমার কাজের মধ্যে করি। সেটাই আমার খেলা, আমি আনন্দটা সেখানেই পাই। এখন সেই কাজটা করতে গেলে একটা ডিজাইনের ফর্মে করতে হয়। তখন তাকে আমরা আর্টওয়ার্ক বলি। কিন্তু আমি আনন্দ পাই, লাইটটা আসলো, আসলো না, বা আসতে পারল না অথবা অনেক বেশী আসলো।
চিন্তামন তুষার: তার পিঠে আপনার দৃষ্টিটা যে আটকে যাচ্ছে সেটা কি ফিল করছেন আপনি? অস্বচ্ছ একটা মাধ্যম আবার স্বচ্ছ কিছুটা। ওপরে একটা প্রলেপ থাকে, আলো ঠিকরে পরছে, সেদিকে কী নজর পরে আপনার?
কাজী রকিব: আমি মূলত গ্লাসের চকচকেভাব কমিয়ে ফেলি। মানে গ্লাসের চকচকেভাবকে যতো কম করতে পারি, যতো মুছে ফেলতে পারি– এটা আমার প্রথম প্রচেষ্টা থাকে।
চিন্তামন তুষার: এটা কী ভেতর দেখার কোন বিষয়…
কাজী রকিব: আমরা ম্যাটেরিয়ালকে ভালোবাসি। কিন্তু ম্যাটেরিয়ালের সঙ্গে নিষ্ঠুরতাও করি আমরা। আমরা তাকে আমার মতো করতে চাই। অয়েল কালার টিউব থেকে বের করলে সোজা বের হয়। কিন্তু আমি সেটাকে ব্রাশ দিয়ে ইচ্ছামতো লাগাই। আমি আমার মতো লাগাতে চাই। আমি যে কোনো ম্যাটেরিয়ালকে… একজন আর্টিস্ট যখন ডিকটেটর হয়ে যায়। সম্পূর্ণ না পারলেও, ওই ম্যাটেরিয়ালটাকে বলে যে তুমি আমার কাছে এসো। আমার পছন্দমতো হও। আমি গ্লাসে কাজ করি, গ্লাসে আলো পাস করে বলে। কন্সট্যান্ট ট্রান্সপারেন্সির জন্য না। আমি গ্লাসে খুব বেশি পেইন্ট করি না। এচিং করি কেমিক্যাল দিয়ে। এর যে গ্লসিনেসটা আমি অফ করে দেই, কিন্তু ট্রান্সপারেন্সি ঠিক রাখি। গ্লসিনেসের অসুবিধা হলো, তখন আমি ওইখানে স্থির থাকতে পারি না। যদি এটা মিরর হয়, ব্যাক করে। আর ন্যাচারাল ক্লিয়ার গ্লাসে– ওপারে চলে যায়। চোখদুটিকে আটকানোর জন্যই আমি গ্লসিনেসটাকে অফ করে দেই। এই অফটাকে আমি কতোটা কম করব, বেশি করব, আবার কতোটা একদমই ঘোলা হবে, কতোটা প্রায় ট্রান্সপারেন্ট হবে– সেটাই হলো আমার খেলা। খেলাটা আমি করি গ্লাসের ভেতরে।


চিন্তামন তুষার: তাহলে আপনার কাজের প্রিয় একটি ধারা হচ্ছে, গ্লাসওয়ার্ক।
কাজী রকিব: হ্যাঁ, গ্লাসওয়ার্ক।
চিন্তামন তুষার: এরপরে আপনার কোন ধরনের কাজ করতে ভালো লাগে?
কাজী রকিব: যেমন, গ্লাসওয়ার্কটা আমার খুব রিসেন্ট কাজ। এর আগে আমার কাজ ছিল, ওয়েল পেইন্টিং।
চিন্তামন তুষার: রিসেন্ট কাজ বলতে, আপনার তো প্রায়…
কাজী রকিব: গ্লাসওয়ার্কে পনেরো বছর হলো প্রায়।
তার আগে চল্লিশ বছরে আমি গ্লাস ছাড়াও অন্য অনেক কাজ করেছি। তার মধ্যে অয়েল পেইন্টিংটা ছিল আমার আরলি এইজের। জীবনের শুরুতে অয়েল পেইন্টিংটা আমার কাছে খুব পছন্দ হতো। আর ওই টাইপের কালার হলো এক্রেলিক। আমি কিন্তু অয়েলে খুব একটা কাজ করি না। আমি যখন পেইন্ট করি ক্যানভাসে, তখন এক্রেলিক দিয়ে করি। গ্লাস ছাড়া, অন্য ম্যাটেরিয়াল বলতে আমি ওয়াটার কালার খুব পছন্দ করি। সবসময় ওয়াটার কালারটা থাকে। আমার দুইটা কাজ খুব বেশি থাকে। আমার এখনকার অবস্থার কারনে অথবা জীবন যাপনের স্টাইলের কারণে আমাকে ট্রাভেলিং করতে হয়। আমি ঢাকায় থাকি, নিউ ইয়র্কে থাকি, গ্রামে থাকি— এরকম একটা অবস্থায় সবসময় তো বসে থাকতে পারি না। যে কারণে আমাকে ইজি মুভমেন্টের ম্যাটেরিয়াল চুজ করতে হয়। তারমধ্যে একটা পেন্সিলের কাজ করি আমি। আর ওয়াটার কালার করি। আর খুব ছোট সাইজের এক্রেলিকের কাজ করি, যেখানে যাই সেখানেই কাজ করি। তারপরে ওই যদি কোথাও কয়েকমাস থাকি তখন হয়ত বড় কাজ করি। সড় সাইজের কোন কিছু আঁকি।
চিন্তামন তুষার: ওয়াটার কালারের কথা বলছিলেন, এই এগজিবিশনে আপনি ওয়াটার নামে তিনটা আর্টওয়ার্ক রেখেছেন। যেগুলো পেন্সিলে আঁকা…
কাজী রকিব: পানি এবং বৃষ্টি, এই দুই আমার খুব পছন্দের জিনিস। বৃষ্টি নিয়ে আমার বেশ কয়েকটা সিরিজ আছে এবং পানিকে বিষয় করে জীবনে বেশ কিছু সময় ছবি একেছি। আমার একটা কাজ ন্যাশনাল মিউজিয়ামে আছে, পানি নিয়ে আঁকা। সম্ভবত ১৯৯৪ সালে আাঁকা। আবার এখনও বড় কাজ করলাম পেন্সিল দিয়ে, সেটাও পানি নিয়ে। আমি তো আর ওইরকমভাবে নিজেকে আটকাই না, যে এটা করতে হবে, আমি এটাই করব। আমি মাথা দিয়ে চলি না, মন দিয়ে চলি। যে কারণে যখন যেটা ভালোলাগে তখন আমি সেই কাজটাই করি এবং যারা আমার ছবি দেখতে আসে, তারা অনেকে বলেছে— 'আমি তো এটা বুঝি না'। আমি বলি, না বোঝার কি আছে, তার আগে আমি জানতে চাই সমস্যা কোথায়(?) তখন তারা বলে, 'আপনারা যে আর্টওয়ার্ক করেন— গ্লাস, পেইন্টিং, এটা সেটা, তারপরে আপনাদের কম্পোজিশন। এইসব জিনিস তো আমি বুঝি না।' আমি বলি, সেটা তো আপনাকে বোঝার দরকার নেই। কাজটা আপনার ভালো লেগেছে না খারাপ লেগেছে? বলে, 'ভালো লেগেছে, আমার মনে হয় এটা এরকম'। আমি বলি- ওইটাই সেটা। বাকি যেটা সেটা পণ্ডিতদের কাজ। এটা এক্রেলিক কীনা, এটার সাইজ ঠিক হয়েছে কীনা, কম্পোজিশন ঠিক আছে কীনা, এখানে রাখা ঠিক হয়েছে কীনা। এসব পণ্ডিতদের কাজ, তাদের ব্যাপার। একজন সাধারণ দর্শকের জন্য আমি বলব, আপনাকে গুরুত্ব দিতে হবে মনটাকে। আমার মন কী বলছে। আপনার যখন একটা মেয়েকে দেখে ভালো লাগে, মেয়েটা কালোও হতে পারে। সে মেয়েটার হয়ত নাক থ্যাবড়াও হতে পারে। কিন্তু কোনও কারণে তাকে আপনার ভালো লেগেছে। তার চোখ ভালো লেগেছে, তার হাঁটার স্টাইল ভালো লেগেছে। তার অ্যাপিয়ারেন্স ভালো লেগেছে। তো এই ভালো লাগাটা তো মনের ব্যাপার। তাই গুরুত্ব দিতে হবে মনকে। কাজ করতে হবে বুদ্ধি দিয়ে। আমি মনকে গুরুত্ব দিয়েছি সারাজীবন, সবকিছুতে। মন চাইছে যে, না, তোমাকে স্বাধীন থাকতে হবে। চাকরী-বাকরী করে আটকে গেলে হবে না। আমার প্রথম জীবনের ছয় বছর শিক্ষকতা করেছি। তারপর আর চাকরী করিনি কখনও। ভাগ্যিস, আমি একটা ভালো বউ পেয়েছি। আমাকে সে কখনও ডিস্টার্ব করেনি। আমাকে স্বাধীন থাকতে সাহায্য করেছে। যে কারণে আমি এগজিবিশনের বইটা তাকে উৎসর্গ করেছি। আমি বলেছি, আমাকে স্বাধীন থাকতে সাহায্য করেছে সে। তো স্বাধীন না হলে আর্টওয়ার্ক করা খুবই মুশকিল। আর্টওয়ার্ক হলো স্বাধীন কাজ।
চিন্তামন তুষার: আপনি ট্রাভেলিংয়ের কথা বলছেন। আপনি তো অনেক দিন থেকেই ট্রাভেলিং করছেন যদি ধরি। অর্থ্যাৎ- চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এলেন, ঢাকা থেকে রাজশাহী হয়ে আবার ঢাকায় এরপর যাচ্ছেন জাপান, মালয়েশিয়া, নিউ ইয়র্ক এবং গ্রামেও থাকছেন আপনি। এই ট্রাভেলিং শিল্পীদের এলোমেলো করে না? শিল্পীদের একটা জায়গায় জবুস্থুবু হয়ে বসে থাকার ব্যাপার থাকে। একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাওয়াই কি ভালো না?
কাজী রকিব: আমার কাছে এই ট্রাভেলিং জিনিসটা খুব পজিটিভ জিনিস মনে হয়। এই কারণে যে, আমি আলাদা করে ভাবি আরকি। আমাকে এই দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছে। দুইটা চোখ দিয়ে দুনিয়াটা দেখার জন্য এবং আমি যতো বেশি দেখব ততো বেশি জানবো। আমি নিজে না জানলে আরেকজনকে জানাবো কী করে। যে কারণে আমি দুনিয়া ঘুরতে চাই আসলে দেখার জন্য। আমার এমনিতে যেটা হয়, যে কোন জায়গায় বসে ছবি আঁকার আমার অসুবিধা নেই। যে কোন পরিবেশে বসে আমি ছবি আঁকতে পারি। ক্রাউডের মাঝে বসে আমি নিরিবিলি কাজ করতে পারি। আমি তখন আইসোলেটেড করে ফেলি নিজেকে। আবার খুব অল্প জায়গা, নৌকার মধ্যে বসে আছি। আমার অতো বড় স্টুডিও না। ছোট কাগজ দিলেও আমি কাজ করতে পারি। এই সুবিধাটা আমি আমার অভ্যাসের মধ্যে তৈরি করে নিয়েছি এবং আমি যে কোন জায়গায় গেলে। যে কোন নতুন শহরে, দেশে গেলে আমি প্রথমে কোন দোকানে ঢুকে আর্ট ম্যাটেরিয়াল কিনি। আমি এমন কতোগুলো ম্যাটেরিয়াল কিনি যেগুলো পোর্টেবল। যেহেতু আমি যে কোন মিডিয়ামেই কাজ করি। যেকোন ম্যাটেরিয়াল কিনে কাজ করি। জাপানে পুরস্কার আনতে গেলাম। তারা অনেক টাকা দিল। আমি একটা ভালো জায়গায় উঠলাম। তারপর… যেহেতু আমার ছয় মাসের ভিসা নেই। আমি কোন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করতে পারি না। আমাকে তাই টাকাগুলো পকেটে নিয়ে ঘুরতে হয়। আমি আর আমার স্ত্রী দুজনে ঘুরছি। আমার আবার গাড়ির নেশা আছে। জাপানে তখন এমন সব গাড়ি চলছে রাস্তায়, যেগুলো আমি কোনোদিন ক্যাটালগেও দেখিনি। (আমাদের এখানে মার্কেটিং করার জন্য যে ক্যাটালগগুলো আসে)। তো এখানে যে গাড়িগুলো চলবে, যে গাড়িগুলো ইফোর্ট করতে পারবো সেই ক্যাটালগই এখানে আসে। দেখলাম দরজা উপর দিকে উঠে যাচ্ছে, মানুষ ঢুকে যাচ্ছে। একটা ফান ফেয়ার হচ্ছে সেসব দেখে। দুতিনদিন খুব ভালো লাগল, গাড়ি দেখলাম। লম্বা লম্বা বিল্ডিং দেখলাম, কাচের বাড়ি দেখলাম। এরপর মনে হল, কি যেন নেই, কি যেন নেই। আমি তখন আমার স্ত্রী মাসুদাকে বললাম— দ্যাখো আমাদের টাকা আছে। যা ইচ্ছে তাই খেতে পারছি। ভেন্ডিংমেশিনে পয়সা ফেলে ইচ্ছামতো পানীয় নিচ্ছি। এরকম একটা জায়গায় আমার নাই নাই মনে হবে কেন? তারপর আবিষ্কার করলাম যে, আমি তো দেশে কাজ করি। দেশেও খাই, ঘুমাই, হাঁটাচলা করি। কাজও তো করি। এই কাজটা আমরা করছি না। আর্ট ম্যাটেরিয়াল শপে গেলাম, পছন্দ করি এমন কিছু জিনিসপত্র কিনলাম। কিনে আমরা কাজ শুরু করলাম। প্রতিদিন দুতিনঘন্টা কাজ করি আর বাকিটা সময় ঘুরি। তখন দেখলাম যে না, কমফোর্টফিল করছি। একটা অভ্যাসে পরিণত করেছি। আমাদের একটা সময় ছবি আঁকতে হয়। ট্রাভেল করতে একটু আধটু সময় তো পাওয়া যায়। ওটা দিয়ে আমি কাজ করি, তখন আমার ভালো লাগে। কাজ না করলে ভালো লাগে না।
চিন্তামন তুষার: এরকম ভ্রমণের মধ্যে থাকার চিহ্ন মনে হয় একটা ছবিতে রয়েছে, প্রসেশন নাম তার…
কাজী রকিব: প্রসেশনটা অবশ্য ঢাকায় বসে করা। আমাদের সময় আমরা আন্দোলন করতাম। প্রতিবাদ করতাম আমাদের বয়সে। সেটা আমরা রাস্তায় প্রসেশন করতাম। এখন কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা আর সেটা নাই। এখন টেলিভিশনে অথবা গোপন জায়গা থেকে সিগনাল দেওয়া হচ্ছে, গাড়িতে আগুন লাগছে। আর আমি যখন সরকারে থাকি, আমি ভারী ভারী যন্ত্র নিয়ে আর্মি, পুলিশ নামিয়ে দিচ্ছি। ওদেরকে প্রতিরোধ করার জন্য। এখন প্রতিবাদ করা এবং প্রতিবাদ ঠেকানোর ধরন চেইঞ্জ হয়ে গেছে। যখন একুশে ফেব্রুয়ারিতে গুলি হল, সালাম, বরকত মারা গেল। মানুষ কিন্তু অবাক হয়ে গেছে, গুলিটা মাথায় লাগলো কেমন করে। গুলি তো পায়ে লাগার কথা। কারণ হাটুর নিচে গুলি করার কথা বলাই ছিল এবং সেটা পুলিশ মানেনি দেখেই মানুষ এতো বিক্ষুদ্ধ। এর আগেও ব্রিটিশ আমলে গুলি করা হয়েছিল। জালিয়ানওয়ালাবাগ অন্য বিষয়। আমার কাছে মনে হয়েছে যে আমরা আমাদের প্রতিবাদের ভাষাকে একটা অসুন্দর জায়গায় নিয়ে গিয়েছি। এখানে যদি প্রসেশন হয়। হ্যাঁ, ঠিক আছে, আমি এই মানুষটাকে, এই দলকে অথবা এই সরকারকে পছন্দ করি না। আমার এক সুইস বন্ধু ছিলেন, যোসেফ নামে। আমাদের তখন ক্যাসেটের যুগ। সে আমাকে একটা ক্যাসেট দিল। একপিঠে য্যাম্ফিরের বাঁশি। অপরদিকে কতোগুলো গ্রিক গান। গায়কদের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। কিন্তু গানের ভাবটা আমার এখনও মনে আছে। গানের ভেতর থেকে কান্না এবং প্রতিবাদ– এরকম একটা ভাব উঠছে মনে হচ্ছে। আমি যোসেফকে বললাম, যোসেফ আমি তো এসব বুঝি না। কিন্তু গানগুলো এরকম কেন? সে তখন বলল যে, 'পম্পেডু গর্ভনমেন্ট যখন আর্মি শাসন করল, তখন কোনরকম প্রতিবাদ করা নিষেধ। কোনও রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়া যাবে না। রাজনৈতিক মিছিলও হবে না। তখন একজন সুরকার সে ভাবল যে, তার একটা ডিউটি আছে। সে প্রতিবাদ করবে। সে তার ব্যান্ড নিয়ে রাস্তায় নেমে গেল। রাস্তায় ব্যান্ড বাজাচ্ছে, বাজনার মাঝে গান।' তো সে ব্যান্ড বাজাতে বাজাতে রাস্তায় হাটছে। এতে তো নিষেধ ছিল না। তার একটা কথা ছিল, জগতে আমরা এমন একটা জিনিস ইন্ট্রোডিউস করলাম। যেটা আমরা নিজেরাই নষ্ট করেছি। মানে সে গণতন্ত্রের কথা বলছে। জগতে আমরা একটা জিনিস এনেছিলাম। যা আমরাই নষ্ট করেছি। ওখানে তখন গণতন্ত্র নাই। কথা বলা যায় না কোথাও এবং এই লোকটা রাস্তা দিয়ে গান বাজাতে বাজাতে যাচ্ছে, আস্তে আস্তে তার পিছনে লোকজন মিছিল করে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছে। তারাও তার সুরে গাইতে গাইতে হাঁটছে।
চিন্তামন তুষার: হ্যামিলনের বাশিওয়ালার মতো…
কাজী রকিব: হ্যাঁ, সেরকমই কিছুটা। তারাও তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে রাস্তায় হাঁটছিল। পরে বড় একটা প্রসেশনের দিকে চলে যায় সেই মার্চ। গভর্ণমেন্টও বলে রেড অ্যালার্ট। এটা করা যাবে না।
চিন্তামন তুষার: এটা কতো সালের ঘটনা?
কাজী রকিব: আমি অ্যালবামটা পেয়েছিলাম ১৯৭৯ সালে। তার আগের ঘটনা ছিল– সেটা ১৯৭৩ সালের কথা মনে হয়। সেসময় গ্রিসে একট আর্মি গভর্নমেন্ট হয়েছিল। মাঝে মাঝে মনে হয়, প্রসেশন মানুষের প্রতিবাদের একটা সুন্দর উপায়। আমি রাস্তা দিয়ে হেটে গেলাম। এই প্রসেশন যতো শৃঙ্খলা মেনে হবে ততো সুন্দর। সেটা যদি একটা মৌন মিছিলও হয়। মৌন মিছিল তো আমার কাছে সব থেকে বেশী ভালো লাগে। এতোগুলো লোক রাস্তায় হাঁটছে, কোন কথা বলছে না। হেঁটে চলে যাচ্ছে। চুপচাপ চলে যাচ্ছে। মানে সে প্রতিবাদ করার জন্য চিল্লাচিল্লি করাকে অসুন্দর মনে করছে। বাংলাদেশে অথবা কোন দেশে এমন একটা মানুষকে মেরে ফেলা হল অথবা এমন একটা মানুষকে জেলে নিয়ে গেল। আমরা খুব ব্যাথা পেলাম। ব্যাথাটা আমরা জানালাম, যে আমি ব্যাথা পেয়েছি। এটার জন্য আমার রাগ নেই, আমি বাসে আগুন দেবো না। আমি আরেকটা মানুষকে মারবো না। আমি সরকারী পুলিশের উপর হামলা করবো না। পুলিশও আমাকে হামলা করবে না। গভর্নমেন্ট দেখবে যে এই ঘটনার জন্য এতোগুলো লোক বিরক্ত হয়েছে। এতোগুলো লোক মনে কষ্ট পেয়েছে। তাহলে এই ঘটনা অন্যভাবে করা যায় কী না! এই যে প্রসেশনের সুন্দর দিকটা। ছবিটার নামও…
চিন্তামন তুষার: সময়ের সঙ্গে গণজাগরণ মঞ্চকে ধরার চিন্তা ছিল কী?
কাজী রকিব: না, সময়টাকে আমি আলাদা করে ধরতে চাইনি।
চিন্তামন তুষার: প্রায় সমসময়ে ওয়াল স্ট্রিট, তাহরির স্কয়ার, আরও আন্দোলন গড়ে ওঠে।
কাজী রকিব: ব্যক্তিগতভাবে শাহবাগের গণজাগরন মঞ্চ যে বিষয়টা, আমি তাতে সাংঘাতিক টাচড ছিলাম। আমি যে ওখানে গেছি তা না, আমি ফিল করেছি।


চিন্তামন তুষার: আপনি ১৯৮১ সালের দিকে একটা প্রিন্ট এগবিশনে করেছিলেন।
কাজী রকিব: সেটা তো এগজিবিশন ছিল না, আমি কিছু প্রিন্ট করেছিলাম। সেগুলো বিভিন্ন এগজিবিশনে এগজিবিট করেছিলাম। সেটা ছিল আমার একটা প্রিন্ট সিরিজ 'একাত্তর পরবর্তী আর কতকাল'। আমরা একাত্তর পরবর্তী জানি, তখনও ইউনিভার্সিটিতে গুলি হয়, ছাত্ররা মারা যায়। আমার একটা ছবি আছে, সেটা আমি এখানে শো করতে পারিনি। সেটার আর কোনও কপি আমার কাছে নেই। নিরু-বাবলু দুইভাই ছিল না! বাবলু মারা গেল। বাবলু ম্যারেড ছিল। পরদিন ছবি ছাপা হলো, বাবলুর বউ একটা জায়গায় বসে কাঁদছে। সেই ছবিটা পত্রিকায় বড় করে ছাপা হল। তো বাবলুর লাশ দেখা গেল। পত্রিকায় যেভাবে ছাপা হয় আরকি। আমি একটা ছবি এঁকেছিলাম– একটা মেয়ের। মাথা গুজে বসে আছে, সামনে একটা মৃতদেহ। আমরা একাত্তর সালে, যেটার জন্য এতো সংগ্রাম করেছি, এতো ত্যাগ করেছি, রক্ত দেওয়া হয়েছে, এতো মানুষ নিগৃহীত হয়েছে। আমরা চাইছিলাম যে এটায় ম্যাক্সিমাম ইফোর্ট দিবো, ম্যাক্সিমাম বেনিফিটের জন্য। বেনিফিটা কী? আমরা ভালো থাকব। আমরা কোনও অশান্তির মধ্যে আর যাবো না। আমরা আমাদের কল্যাণের কাজ করব। তারপরেই তো এটা নষ্ট হয়ে গেল। হয়নি আর কিছু… সে কারণেই আমার সিরিজটা করা। 'একাত্তর পরবর্তী আর কতকাল'। আমি এখন আর কোনও পলিটিক্যাল ছবি আঁকি না। আমাকে…
চিন্তামন তুষার: যে কোনও প্রতিবাদ করাকেই কী আপনি পলিটিক্যাল বলবেন?
কাজী রকিব: না, প্রতিবাদ করা পলিটিক্যাল না। প্রতিবাদ করার সুযোগ পেলে আমি প্রতিবাদ করি। আর প্রতিবাদ করার একটা মূল্য থাকতে হবে তো। যেমন— বাচ্চারা কান্নাকাটি করে। কোনো জিনিসের জন্য কান্নাকাটি করে। কান্না করে কেন? জানেই যে মা জিনিসটা তাকে দেবে। যদি বোঝে মা তাকে এটা কখনই দেবে না বা মা নেই, তখন বাচ্চাটা কাঁদবে না। জিনিসটা খুঁজে নেবে, তাকে খুঁজে পেতে হবে। আমার জায়গা থাকতে হবে। প্রতিবাদটা আমি কোথায় করব? আমার প্রতিবাদ শুনবে কে? প্রতিবাদ করলাম। প্রতিবাদের একটা শারীরিক ক্ষতির দিক আছে। আমি রেগে যাই, রেগে গেলে আমার প্রেসার বেড়ে যায়। আমার বুক ধড়ফড় করে। এসব ব্যাপার আছে না প্রতিবাদের। আমি শারীরিক সেই ত্যাগটা স্বীকার করব বেনিফিটের জন্য। কিন্তু যদি আমার কথার কোনও মূল্য না থাকে তাহলে তো আমার এরকম করে লাভ নেই। মনে মনে কষ্ট হবে, আমি হয়তো করবো কিছু, নীরবে কিছু করে যাবো। এছাড়া তো কিছু করার নেই। ১৯৯৬-এর যেই আওয়ামী গভর্নমেন্ট আসল– ওটা শেষ হল কবে?
চিন্তামন তুষার: ২০০১ সালে এবং আবার বিএনপি জয়ী হয়।
কাজী রকিব: ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ১৫ অগাস্ট ফ্ল্যাগ অর্ধনমিত হয়েছে সরকারীভাবে। ২০০১-এর পর কিন্তু এটা আর হচ্ছে না। তখন আমাদের বন্ধু তারিক সুজাত, আমার কাছে আসলো। এসে বলল, 'রকিব ভাই, এ বছর ১৫ অগাস্ট কয়েকদিন পর, ফ্ল্যাগ কিন্তু হাফপাস্ট হবে না। এটা একটা খুবই দুঃখজনক দিন। আমরা এ কয়েক বছর তো করেছি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদিনে এরকম একটা ঘটনা ঘটবে না।' আমি বললাম, আমরা তো কিছু করতে পারি না। গোপনে একটা জায়গায় নামাতে পারি পতাকা। কিন্তু সেটা আর কে দেখবে? এতে মানুষ আসলে ব্যাথিত হবে না মনে কষ্ট পাবে! বিরক্তও হতে পারে তো… একটা পতাকা অর্ধেক তুলে লাভটা কী? এরকমও তো মনে করবে কেউ কেউ। তখন আইডিয়াটা তার কাছ থেকেই আসল। সে বলল, একটা কাজ করা যাক। আপনি একটা একদম ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত এক কলাম সাইজে এই রকম একটা ওয়াটার কালার করে দেন, যে পতাকাটা অর্ধনমিত। আমি পতাকা আঁকছি, এরমধ্যে সে বিভিন্ন পত্রিকায় ফোন করে, ওমুক জায়গায় ফোন করে বলে যে বাদিকের কলামটা আমাদের জন্য রাখেন। আমরা একটা ছবি ছাপবো। ওটায় কিন্তু কোনও কথা লেখা নেই। বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার চাই— এরকম কোনও বক্তব্য নেই। জাস্ট একটা পতাকা, আকাশ, অর্ধনমিত উড়ছে… ওই পতাকা আমি এঁকে দিয়েছিলাম। সেটা পরপর দুতিন বছর ছাপা হয়েছে প্রথম পৃষ্টায়। পরেরদিকে আস্তে আস্তে পিছনের দিকে চলে গেল। এইরকমভাবে কোনও প্রতিবাদে অংশ নিতে আমার আপত্তি নেই। আপত্তি না, আমি বরং খুব ভালো ফিল করি যে, ওই ঘটনার সঙ্গে আমি ইনভল্ভ ছিলাম। কিন্তু প্রতিবাদের যদি মূল্য না থাকে…
চিন্তামন তুষার: ব্যক্তিগত বক্তব্য, ব্যাক্তিগত আশা-আকাঙ্খার প্রকাশ- এইসব তো অরাজনৈতিকভাবেও করা যায়।
কাজী রকিব: সেটা করা যায়, করিও আমি। আমার সেরকম ছবি আসে মনে, আমি আঁকি। আমার মনে আছে, একটা সময় বঙ্গবন্ধুর কথা বলা যেতো না। নির্মলেন্দু গুণ একবার বলে গেলেন বটতলায়। এরপর আর কেউ বলেনি। বঙ্গবন্ধুর কথা কোন জায়গায় বলা হয় না। আমি একটা ছবি আঁকলাম। ড্রয়িং, পেন্সিলের। ড্রয়িংটা হলো, এক বালক এক লাইটপোস্টের নীচে দাড়িয়ে আছে। সে রাস্তার স্ট্রিট বয়। হাফপ্যান্ট পরা খালি গায়। তার পেছনে একটা ওয়াল। ওয়ালে একটা পোস্টার লাগান আছে। পোস্টারটা কি, এরিনমোর টোবাকোর পোস্টার। পোস্টারে লেখা আছে, 'এরিনমোর ইজ দ্য বেস্ট টোবাকো'। সেখানে একটা টেবিলের উপরে একটা চশমা আছে, একটা পাইপ আছে। এরিনমোরের একটা কৌটা আছে। পেছনে বঙ্গবন্ধুর কোটটা হ্যাঙ্গারে ঝোলান আছে। বঙ্গবন্ধু এরিনমোর পছন্দ করতেন। হ্যাঁ, আমি তো বঙ্গবন্ধুর কথা বলিনি। আমি বলেছি, এরিনমোর ইজ দ্য বেস্ট টোবাকো। এটা আমার লেখা ছিল। এরকম ইনডাইরেক্ট আমি আমার কথা বলেছি। আমি তো কোনও কিছু ভুলে যাইনি। এরকমভাবে বলা যায় তো। কিন্তু মুশকিলটা হলো, সময়টা পার হয়েছে অনেকটুকু। এসময়টা ঘুরে যাবে। আমি আমার বাচ্চাদের উপর খুব ভরসা করি। এইসব বিষয়ে আমি টিনদের সঙ্গে কথা বলি। ওরা হয়ত আমাদের অনেক সেন্টিমেন্টের কোনও কেয়ারই করছে না। কিন্তু ওরা যাচ্ছে। ওরা সেন্টিমেন্টকে কেয়ার করছে, অ্যাট দ্য সেইম টাইম আমাদের অনেক খারাপ জিনিসকেও কিন্তু অপছন্দ করছে। এরা ধরেন আরও ছোট যারা আছে… একজন আমাকে প্রশ্ন করেছিল— 'এরা যে ঠিকঠাক বড় হয়ে উঠবে, কেমন করে? স্কুলগুলোর সিলেবাসে তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা লেখা নেই', ওমুক নাই, তমুক নাই। এসব কথা বলছিল। আমি বললাম, না স্কুল কলেজগুলোতে যে সিলেবাস তৈরি করে সেসব তো রাজনীতিক লোক। সেটা হয়ত কোনও অপদার্থ লোক মন্ত্রী হয়েছে। কিন্তু আমি তো জানি আমার বাচ্চাকে কিভাবে মানুষ করতে হয়। আমি তো আমার লেসনটা তাকে দেই। স্কুল, কলেজে পাস করতে হয় চাকরীর জন্য। যারা এসএসসি, এইচএসসি পাস করেছে তাদেরকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম কি করার ইচ্ছা। বলে, 'আংকেল কি পড়ার ইচ্ছা, সেটা তো বলতে পারব না। আমরা জাহাঙ্গীরনগর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লাই করেছি। দেখি কোন গ্রুপে চান্স পাই।' তার মানে আমি আমার ভবিষ্যৎ নিজে আর নির্ধারণ করতে পারি না। এখন সেই দশায় আমি পড়লে… আমি কিন্তু ফাস্ট ডিভিশনে পাস করেছি দুইটা লেটার মার্কস নিয়ে। আমার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার কথা। আমি বলেছি, না, আমি আর্ট কলেজে পড়ব। জোর করে আমি আর্ট কলেজে পড়ব বলতে পারছি। তার মানে কী এখনকার ছেলেমেয়েরা তো নিজের ইচ্ছায় বড় হচ্ছে না। প্রত্যেকটা মানুষকেই তৈরি করা হয় কিছু একটা হওয়ার জন্য। কিন্তু আমরা উৎপাদনশীল কোনও একটা কিছু বানাবো… ছেলেটা কবিতা লেখে। আরে দূর কবিতা লিখে কি হবে। শামসুর রাহমান একজন দুজন, তুই তার চেয়ে বরং অংকে ভালো করেছিস, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়। তাকে তো ইঞ্জিনিয়ার বানালাম, সে কবিতাও লিখল না। হতাশ হতাশ ভাব। একটা জীবন নষ্ট করে দিলাম। আমরা যা হবো সেটা তো আমরা হতে পারি না। কিন্তু তাকে তো সুযোগটা দেওয়া উচিত ছিল। আমার মনে হয় যে, আমাদের এই সময়টা কেটে যাবে। তার কারণ হল… আমি যদি দুয়েকটা রাজনৈতিক কথাই বলি। পলিটিকালি যখন এ বলছে খারাপ হচ্ছে, ও বলছে খারাপ হবে। এ আসলে দেশটাকে অন্য জায়গায় বিক্রি করে দেবে। ও আসলে ওমুক জায়গায় বিক্রি করে দেবে। এইসব কথাগুলো ওরা বলছে কার জন্যে? আপনার জন্য, আমার জন্য। না। একথা বলছে সে ওই চেয়ার চায়। তার কথার জন্য পঁচিশটা লোক মারা যাবো। ছয়শো গাড়ি পুড়বে। তারপর ফাইনালি সে ওই চেয়াটায় বসবে। তারপর সে অর্থ উপার্জন করবে। সেই অর্থে সে তার ছেলেমেয়েকে বিদেশে পড়তে পাঠাবে। আমি আমেরিকার কথা বলি। আমেরিকা পৃথিবী লুট করেছে, এখনও লুট করে তারা। যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়ে, তেল সব নিয়ে চলে যায়। কেন? ওদের দেশের লোকজনকে ভালো রাখার জন্য। আমি ইমিগ্র্যান্ট ওখানকার। আমার একটা হেলথ ইন্সুরেন্স আছে। ওখানে গেলে আমার অনেক রকমের চিকিৎসা ফ্রি। ব্যাবস্থা তারা করেছে। কারণ তারা নিজের দেশের লোকজনকে ভালো রাখতে চায়। বাইরে থেকে লুট করে নিয়ে এসে। আমি দরকার হলে আরেকজনের ক্ষেতের জিনিস নিয়ে আসবো, আরেকজনের খাবার চুরি করে নিয়ে আসবো, আমার সন্তানকে দেওয়ার জন্য। এটা একদম জগতের নিয়ম, এটাকে নেগেটিভভাবে দেখার কিছু নেই। হ্যাঁ, এটা আনার সময় আমি যদি বলে আনতে পারি– ভাই, তোমার এটা দাও, আমার বাচ্চা না খেয়ে আছে। তাহলে হয়ত সুন্দর হয়। কিন্তু ওকে তো আমার খাওয়াতেই হবে। ওকে তো আমার বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। ওই সরকার বাইরে থেকে লুট করে তাদের দেশের জনগণকে দিচ্ছে। আমাদের দেশের লোকজন কী করে, এখানকার ধনীরা? ওই ধনীরা তাদের সব ছেলেমেয়েকে বিদেশ পাঠিয়ে দিচ্ছে। তাদের বাড়িঘর হচ্ছে ওখানে। এখানে কিছুই রাখছে না। অথচ সে কিন্তু এখানে কোনও সামাজিক সঙ্কটে নাই। এমন নয় যে সে একজন হিন্দু মানুষ, এখানে মুসলমানদের কাছে থাকতে পারছে না তাই চলে যাচ্ছে। তাও না। সে একজন মুসলমান মানুষই। তাহলে তো তার কোনও সঙ্কটই নেই। তাহলে কেন আমি আমার সম্পদ বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। কেন তুমি তোমার দেশটাতে কিছু করছ না। প্রতিবাদ করতে হলে প্রতিবাদ রেখে যেতে হবে। কনস্ট্যান্ট প্রতিবাদ করে আমার এনার্জি নষ্ট করে লাভ নেই। আমার তো সুন্দর দিক আছে, সেসবও বলে যেতে হবে। পরের জেনারেশন যারা আসবে, তারা খালি প্রতিবাদ প্রতিবাদ না দেখে কিছু একটা দেখে একটু শান্ত মেজাজে থাকুক, সৌম্য জীবনযাপন করুক। সেই কাজটাও তো করতে হবে কাউকে।
চিন্তামন তুষার: আপনি বলছেন ভবিষ্যৎ ভালো হবে, প্রকৃতপক্ষে বৈশ্বিক চাপের বিষয়টা এড়ানো সম্ভব হবে কী? বাংলাদেশ বা তৃতীয় বিশ্বের দেশ যেগুলোকে বলছি। যেখানে লুটপাট হচ্ছে… চলছেই তো। এরাই তো প্রোডাকশন বেশি করছে। সব ধরণের প্রোডাকশন, কিন্তু সেই প্রোডাকশনের সুফল তো সেইখানেই যাচ্ছে।
কাজী রকিব: এটা দুরকমভাবে হবে, একটা জাতি অথবা দেশের। একটা হলো আত্মিক উন্নতি, যেটা আমাদের এখানে একদমই নষ্ট হয়ে গেছে। আরেকটা অর্থনৈতিক উন্নতি। অর্থনৈতিক উন্নতি আমাদের আরও একটু ভালো হতে পারত। কিন্তু একদমই কম হয়নি। আমি এখন কোনও রিক্সাওয়ালাকে খালি গায়ে, খালি পায়ে ঘুরতে দেখি না। আমার ছোটবেলায় একটা রিক্সাওয়ালাকে সেলাই করা লুঙ্গি আর খালি গায়ে রিক্সা চালাতে দেখেছি। গেঞ্জিটা পর্যন্ত নাই। পুরা শরীর পুড়ে কালো হয়ে গেছে। সে অবস্থা এখন নাই। এখন আমি আমার গ্রামের বাড়িতে, একদম উঠানে আমার গাড়ি নিয়ে যাই। তারমানে আমাদের অনেক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। লুটপাট না হলে আমরা আরও অনেক ভালো করতে পারতাম। আমরা যখন একাত্তরে যুদ্ধ করি, ওই সময় দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থা খুব বেশি ভালো ছিল না। এখন দক্ষিণ কোরিয়া কোথায় চলে গেছে। অর্থনৈতিকভাবে গেছে, আত্মিকভাবে দেখেন… জাপান যেমন, ওদের জাতির মধ্যে একটা সৌন্দর্য্য এবং সৌম্যের ভাব তৈরি করেছে। অথচ ওরা কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাংঘাতিক নিষ্ঠুর ছিল। চীনাদের তারা সাংঘাতিক অত্যাচার করেছিল। তারপর থেকে ওরা সৌম্য হয়ে গেল। এই নিষ্ঠুরতার পর ওদের যা দূদর্শা হলো, হিরোশিমা, নাগাসাকিতে যে লস হল। ওরা তখন বুঝল নিষ্ঠুরতায় কোনও লাভ নাই। ওদের ট্র্যাডিশনাল সৌন্দর্য্য পিপাসা ছিল, রুডনেসও ততোটা ছিল। তবে ওরা আবার সৌন্দর্যে্যর দিকে ফিরে গেল। কোরিয়া সর্ম্পকে ততোটা জানি না। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে কোরিয়া খুবই… আমি যখন মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলাম ১৯৯২ সালে, তখন ঢাকা শহরের চেয়ে খারাপ অবস্থা ওদের। কিন্তু আমরা দেখেছি যে ওরা উঠছে। উঠার প্ল্যান করছে এবং সে প্ল্যান অনুযায়ী ওদের… সে প্ল্যানটা ভুল হবে কীনা– কেউ কেউ প্রতিবাদ করছে। আমি যখন গেলাম, ওদের যে পেট্রোনার্স টাওয়ার অর্থ্যাৎ টুইন টাওয়ার আছে না, সেই টাওয়ার তৈরি করবে– এরকম একটা ডিক্লারেশন হয়েছে। সেখানে গিয়ে আমার এক বন্ধু হয়েছে, আর্টিস্ট লং তে সি। সে বলল চলো তুমি আমাদের সঙ্গে। আমাদের একটা প্রটেস্ট আছে। ওখান থেকে কাজ সেরে আমি তোমাকে নিয়ে যাবো। সে আমাকে কুয়ালালামপুর ঘুরে দেখাবে। আমি বললাম প্রটেস্ট কিসের আগে তো বুঝি। প্রটেস্টটা তো করতে পারবো না, আমি দেখছি দাড়িয়ে আছে অনেক লোকজন। সে বলল, 'এখানে একটা বড় বিল্ডিং তৈরি করবে। সেই বিল্ডিং হলে এখানে প্রচুর গাড়ি আসবে। বিল্ডিং এতোবড় না করে বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটা বিল্ডিং তৈরি করুক। অথবা রাস্তা তৈরি করুক যাতে ঝামেলা না থাকে এবং ওই গভর্নমেন্ট তাদের কথা শুনেছে।
চিন্তামন তুষার: দ্বিতীয়টা করেছে।
কাজী রকিব: হ্যাঁ, রাস্তা করেছে। মহাথিরের একটা প্ল্যান ছিল যে তার ওই জায়গাটা দেখাতে হবে। সেজন্য তার এতোবড় একটা বিল্ডিং বানাতে হবে। কিন্তু ওরা যে বলছে রাস্তার সমস্যা হবে। সরকার রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে যাতে আমাদের ঢাকা শহরের মতো জ্যামে পড়তে না হয়। তো এখন প্রতিবাদ করলে শোনে কেউ। সবসময় প্রতিবাদ প্রতিবাদ… অনেক সময় নীরব থাকাটাও দরকারী। দেশের জালিম সরকার যদি হয়… তখন কিন্তু নীরবতাও এক ধরণের… যদি শক্তি না থাকে তখন কিন্তু প্রতিবাদ করা বোকামি। মরে যাওয়ার ভেতরে কিন্তু কোনও শান্তি নেই। প্রচুর সয়েছে লোক, আমাদের বীর দরকার, গাজী দরকার। তো সেটার জন্য জীবিত থাকতে হবে। মৌনতাও একটা প্রতিবাদ।
চিন্তামন তুষার: মৌন থাকা, কথা না বলা বা প্রত্যুত্তর না করা অনেক সংস্কৃতিতে কাপুরুষোচিত আচরণ বিবেচনা করা হয়। এখন ইন্টারনেটের যুগ, নানাদিকের নানা কেচ্ছা কাহিনি চলছে, দেখছি। এসব দেখে মৌনতা দিয়ে কি কাপুরুষোচিত আচরণ ঢাকা যায়?
কাজী রকিব: ঢাকা যায় না। আমাদের সময়টা খুব খারাপ। মৌনতাও হবে না, বীর হিসেবেও আমরা কোনও কাজ করতে পারছি না। আমাদের প্রতিবাদের আর কী রাস্তা আছে। রাস্তা হচ্ছে গাড়ি পোড়ানো। গাড়ি পোড়ান ছোট্ট একটা কেইস… ক্ষতি কার হচ্ছে গভর্নমেন্ট, আমি…
চিন্তামন তুষার: গাড়ি কিন্তু সাধারণ মানুষ পোড়াচ্ছে না…
কাজী রকিব: সাধারণ মানুষকে তো পোড়াচ্ছে। সাধারণ মানুষকে তো মারা হচ্ছে এবং প্রতিবাদের শব্দ হিসেবে পোড়ান হচ্ছে এটাসেটা। যারা গাড়ি পোড়াচ্ছে, দেখেন তারা কিন্তু খুব প্রফেশনাল গাড়ি পোড়ানোর লোক। তারা দলের ক্যাডারও না হয়তো। তারা হয়তো হায়ার্ড। তারা টাকা পয়সা নিয়ে গাড়ি পোড়াচ্ছে। তাদের তো হায়ার করা হচ্ছে। ভীতি সঞ্চার করা হচ্ছে। কাকে? সরকার? না তো। এটা তোমাকে, আমাকে। আমি বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় চিন্তা করছি, আমার বের হওয়াটা ঠিক হবে কীনা। প্রাইম মিনিস্টার কোথাও যখন যাচ্ছে, আগে পরে সিকিউরিটি দিয়ে তিনি তো আলাদাই যাচ্ছেন। তার তো চলাফেরা করতে অসুবিধা হচ্ছে না। কোনও মন্ত্রীর চলাফেরা করতে অসুবিধা হচ্ছে না। আমরা নিজেরা এটা বুঝতে পারি না। আমাদের নেতা দরকার। সে নেতা তো আমাদের মধ্যে নেই। এদের মধ্যে থেকে তো আমি নেতা খুঁজে পাবো না। আমি তো নেতা নিজের কাছেই চাইবো। সেটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এটা জাতির জন্য দূর্ভাগ্য। আমাদের নতুন করে অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের নেতা দরকার, নেতা ছাড়া আমাদের ডাক দিলে কে আসবে। একাত্তরে বঙ্গবন্ধু, একজন নেতা ছিলেন। তিনি ডাক দিয়েছেন, মানুষ এসেছে। তারপরের ইতিহাস অন্যরকম। কিন্তু সেরকম ক্যারিশমাটিক নেতা হতে হবে। সেই নেতা না হলে, এখন যে জায়গায় গিয়েছি সেটা খুব সাধারণ জায়গা না। সাধারণ জায়গা বলতে কী, ইন্ডিয়া যেমন থাকে। ওদের একটা সরকার চেইঞ্জ হয়, আরেকটা সরকার আসে। ওদের অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে খুব বেশি চেইঞ্জ হয় না। আমাদের এখানে কিন্তু চেইঞ্জ হয় সাংঘাতিক।
চিন্তামন তুষার: ছোট দেশ হওয়ার কারণে?
কাজী রকিব: ছোট দেশ হওয়ার কারণে। ছোট দেশ, মানুষ বেশি। মানুষের লোভ বেশি। সুযোগও বেশি। আমাদের মানুষগুলো অনেক কম বোঝে অথবা কম রিস্ক নিতে চায়। আমি নিউইয়র্কে থাকলে, যখন কোনো শপিং মলে যাই। কোনো গার্মেন্টেসের দোকানে ঢুকি, ঢুকলে দেখা যায় সেখানে ফিফটি পার্সেন্ট কাপড়চোপড়ে লেখা মেইড ইন বাংলাদেশ। আমি সেটা কিনি। আমার খুব ভালো লাগে যে, মেইড ইন বাংলাদেশ লেখা দেখাচ্ছে।
চিন্তামন তুষার: আপনি সুন্দর মুখের কথা বলছিলেন। কিছু পোর্ট্রেট দেখলাম, এরমধ্যে একটার নাম আপু। এটা কি আপনার বোন সম্পর্কিয় কেউ?
কাজী রকিব: আমার স্ত্রীর বড়বোন। তাকে আমরা সবাই আপু ডাকি। তিনি আমাদের সাথেই থাকতেন একসময়। কোনও একদিন পড়াশুনা করছিলেন। আমি বসে আঁকছিলাম। খুব সিম্পল জিনিস।
চিন্তামন তুষার: পোর্ট্রেট কি কম আঁকা হয়েছে? এগজিবিশিনে দেখলাম, কয়েকটা পোর্ট্রেট রেখেছে
কাজী রকিব: আমি সবসময় পোর্ট্রেট আঁকি। সবসময় সব সম্পর্কে।
চিন্তামন তুষার: ইদানিংকালের কোন পোর্ট্রেট দেখলাম না… একটা সেল্ফ পোর্ট্রেট খুব ভালো লাগল দেখে…
কাজী রকিব: ইদানিংকালের আমার একটা সেল্ফ পোর্ট্রেট দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু অনেক বেশি কাজ হয়ে গেছে। পরে আর রাখা হয়নি। কিন্তু আমি সবসময় পোর্ট্রেট আঁকি, অন্যের পোর্ট্রেট আঁকি, মেমোরি থেকেও পোর্ট্রেট আঁকি।
চিন্তামন তুষার: আপনার শিফন কাজটা, গত বছর থেকে শুরু করেছেন। সিরিজের আরও কাজ আসবে কী?
কাজী রকিব: না, একদম শেষ করে দেইনি। শিফনে আমার আরও কাজ করার ইচ্ছা আছে।
চিন্তামন তুষার: শিফন নিয়ে কি আলাদা এগজিবিশন করার ইচ্ছা আছে?
কাজী রকিব: শিফন নিয়ে আমি কোনকিছু ভাবছি না। আমি আসলে পার্টিকুলার বিষয় নিয়ে কখনও কোন এগজিবিশিন করিনি। আমি হয়তো এক বছরে দুতিন রকমের কাজ করি। এগজিবিশনে তার সবই থাকে। আমি আলাদা করে কোনোদিন কাজ করিনি। জানি না সামনে করবো কীনা। তবে শিফন নিয়ে আমি আরও কাজ করব।
চিন্তামন তুষার: শিফনের বিষয়টা একটু খোলাসা করবেন?
কাজী রকিব: আবারও বলি, ওই যে ট্রান্সপারেন্ট, ট্রান্সলিসেন্ট জিনিসের প্রতি একটা আগ্রহ এবং ফেব্রিকের মধ্যে শিফন হলো সবচেয়ে ট্রান্সপারেন্ট। মসলিন ছিল এককালে, সেটা তো আর দেখিনি। সবসময় ব্যবহার করা যায়, একদম নিম্নশ্রেণী থেকে একদম উচ্চবিত্ত পর্যন্ত শিফন ব্যবহার করে। কমদামের শিফন আছে, খুব সাংঘাতিক দামি শিফনও আছে। ম্যাটেরিয়ালটা ট্রান্সপারেন্ট অলমোস্ট। এরমধ্যে দিয়ে আমি বাইরের অন্যকিছু দেখতে পাই। এইছিল ফ্রেবিকটা চয়েস করার ইচ্ছা। তারপর আঁকতে গিয়ে কতো রকম শিফন আঁকা যায়, কতোভাবে আঁকা যায়, কতো টেক্সচারে আঁকা যায় এইসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা…
চিন্তামন তুষার: বিহাইন্ড দ্য শিফনও আঁকলেন…
কাজী রকিব: হ্যাঁ, বিহাইন্ড দ্য শিফনও আঁকলাম।
চিন্তামন তুষার: আপনি বলছিলেন, নতুনদের জন্য তরুণদের জন্য কিছু দেখার মতো, শেখার মতো কাজ রেখে যেতে চান। শিফন কি সেই প্রচেষ্টার ফসল?
কাজী রকিব: না, ওইরকম করে আমি কাজ করি না। আমি আলাদা করে কাজ করি না। আমার জীবনের যে কোন কাজকে আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করবো… মোনালিসা মাস্টারপিস কাজ না? এমন আরও কয়েকটা আছে। জয়নুল আবেদিনের আছে… কিন্তু মাস্টারপিস কাজ তো কেউ প্ল্যান করে না। আমি একটা মাস্টারপিস আঁকবো– এভাবে তো প্ল্যান করে আঁকা যায় না। যখন আমি ছবিটা আঁকতে যাব, আঁকতে আঁকতে একটা জায়গায় কানেক্ট হতে হবে। স্রষ্টার সাথে। আমাকে চৌদ্দটি ছবি এঁকে অমুককে দিতে হবে– তখন কিন্তু তার সঙ্গে কানেকশনটা হয় না।
চিন্তামন তুষার: সবশেষে আপনার পরবর্তী কাজের পরিকল্পনা, যা জানলে পাঠকরা উপকৃত হবে…
কাজী রকিব: আমার কাজের পরিকল্পনা না, জীবনের পরিকল্পনা বলতে পারি। আমাকে আরও বছর দুয়েক আমেরিকায় থাকতে হবে, ইমিগ্রেশনের আইন-কানুনের জন্য। ফিরে আমি গ্রামে যাবো। আমার গ্রামে আমার থাকা, আঁকাআঁকি, স্টুডিও বানানোর প্রচেষ্টার মধ্যে আছি। আমার মনে হয়েছে গ্রামে একটু যোগাযোগা রাখা ভালো। গ্রাম্য জীবনযাপন করাও। এর ফলে আমাদের দ্বারা কেউ কেউ উপকৃত হয়, মানুষগুলো বঞ্চিত হবে কেন, একটা কারণ। আরেকটা হলো, ফ্রেশ বাতাস পেলাম আরকি। ঢাকা শহরে অনেক রকম ট্রিক্স আছে, সেই ট্রিক্স থেকে তো দূরে থাকলাম! ট্রিক্স না করলে… আমাকে আরেকটা ট্রিক্স করতে হয় একটা ট্রিক্স থেকে বাঁচতে। সেসব বাদ দিয়ে একটু সেফ থাকা। আগামী মাসে আমার ষাট বছর বয়স হবে। গড় হিসেবে হয়ত আর কদিন বাঁচবো। শেষ কটা দিন গ্রামে কাটাবো।
আমি যে গ্রামে যাবো সে গ্রামটায় বাংলাদেশের খুব বিখ্যাত লক্ষীসরা তৈরি হয়। আমি ওদের সঙ্গে কাজ করব। আমাদের ওখানে পেটান পিতলের কাজ হয়। আমার সে কাজেও আগ্রহ আছে। আর আমরা যখন গ্রামে যাই, আমার স্ত্রীও তো আর্টিস্ট। মেয়েরা ওর কাছে আসে নানারকম ডিজাইন শিখতে। ও বলছে, আমি এমনিতেই তো ফেব্রিকে আঁকি। ওখানে গেলে মেয়দেরকে শিখিয়ে দিলাম। ওদের যদি কিছু অতিরিক্ত আয় রোজগার হয়। আমাদের জন্য না, ওরা শিখে নিজেদের মতো জীবনযাপন করুক। বাড়িতে মেয়েটা হয়ত ক্ষেতে কাজ করে। ক্ষেতের কাজ তো সবসময় থাকে না। বসে একটু বাড়তি কাজ করলো। আর গ্রামটাও একটু কালারফুল হল। ওদের জীবন একটু চেইঞ্জ হল। আমরা তো আর এনজিও না, যে আমরা ওদের জীবনকে বিরাট চেইঞ্জ করে দেবো। সে চেষ্টা আমি করতে চাই না। আমি চাই ওরা ওদের মতো থাকুক, মাঝ থেকে একটু বাড়তি কিছু করুক। ওদেরকে ঢাকা শহরের মানুষ বানিয়ে ফেললে তো হবে না। ওরা ওদের জায়গায় থাকুক। তাতে হয় কি, অর্থনৈতিকভাবেও ভাল থাকল। আমি ঘরে থাকলে তো আমার সঙ্গীর দরকার হয়। ঢাকা থেকে প্রফেসর সাহেবরা তো যাবেন ওখানে। বেড়াতে যাবেন, বছরে একবার দুবার। আমাকে সবসময়, ওদের সঙ্গেই চলতে হবে।