আহমদ ছফার অগ্রন্থিত লেখা: স্মৃতির শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়া

ahmad_sofa
Published : 11 Jan 2013, 03:53 PM
Updated : 11 Jan 2013, 03:53 PM

প্রয়াত লেখক আহমদ ছফার এই লেখাটি এখন্ও তার কোন গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে জানা যায়নি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সংস্কৃতিকর্মী ইকবাল খান চৌধুরী সম্প্রতি এটি উদ্ধার করেছেন। লেখাটি ব্রাহ্মবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমীর যুগপূর্তি অনুষ্ঠানে যোগদান উপলক্ষ্যে লিখিত হয়েছিলো। পরে ওই একাডেমীর বিশেষ সংখ্যায় তা প্রকাশিত হয়। লেখাটিতে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাসের স্মৃতিচারণ করেছেন। আহমদ ছফার প্রায় হারিয়ে যা্ওয়া এই লেখাটি বিডিনউজটোয়েন্টিফোরডটকম-এর পাঠকদের জন্য এখানে প্রকাশ করা হলো ।

ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে আমি দ্বিতীয় জন্মস্থান মনে করি। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আমার একরকম নব জন্ম ঘটেছিল। আজকে আমি যা হয়েছি, তাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অবদান অল্প নয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সম্পর্কে লিখতে গেলে আমাকে পুরো একটা বই লিখতে হবে। তাতেও আমার কথা ফুরোবেনা। জীবনের ঐ পর্বের উপর একটা উপন্যাস লিখে, আমি যে সময় সেখানে ছিলাম সে সময়ের ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে জাগিয়ে তোলা যায় কিনা একবার চেষ্টা করে দেখবো। কবে সে দিন আসবে ভবিষ্যতই বলতে পারে।

আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কতগুলো খণ্ড খণ্ড চিত্র তুলে ধরছি। তার মধ্যে প্রথমটি হলো এরকমঃ

একদিন খুব সকালে আমার ঘুম ভেঙ্গেছিল। রাতটা আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের হোস্টেলে ছিলাম। রেল লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি কুড়ুলিয়া খালের ব্রিজের গোড়ায় চলে এসেছিলাম। ব্রিজের তলার দিকে তাকিয়ে দেখি তিতাস নদীর বুক ভেদ করে সূর্যটি জেগে উঠছে। শিশু সূর্যের কাঁচা আলোতে নদীর সমস্ত জল রাঙিয়ে গেছে। ব্রিজের গোড়ায় ঠিক রেল লাইনের নীচে একজন জেলে ছোট্ট একটি নৌকায় নদীতে জাল ফেলে বসে আছে। আমি যদি চিত্রকর হতাম তবে এই দৃশ্যটি নিয়ে-একটি ছবি আঁকতাম। আমার বুকের ভিতর সেই সকাল বেলা, সেই ঘুম জড়ানো তিতাস, সেই সূর্যোদয়, সেই জেলে এখনো অক্ষয় হয়ে বেঁচে আছে। জীবনে দেশ বিদেশে আমি কম সুন্দর দৃশ্য দেখিনি। কিন্তু এ রকম দ্বিতীয়টি কোথাও দেখেছি বলে মনে হয় না।

দ্বিতীয় ঘটনার কথা বলিঃ ১৯৬৫ সালের দিকে একটি ভয়ংকর রেল দুর্ঘটনা ঘটেছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তাও কুড়ুলিয়া খালের কাছে, ব্রিজটির গোড়ায় অনেকগুলো বগি লাইনচ্যুত হয়ে গিয়েছিল। মানুষের পোড়া, আধাপোড়া থেতলানো মৃতদেহ, বিচ্ছিন্ন হাত পা এই সমস্ত জিনিস আমাকে দেখতে হয়েছে। বীভৎস জিনিসও কম দেখিনি জীবনে। ২৫মে মার্চের রাতে ঢাকায় ছিলাম। পাকিস্তানী সৈন্যের নির্বিচার গণহত্যা আমি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছি। আমি দেখেছি মানুষকে তারা ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির মতো গুলি করে মেরেছে। সেসব মৃত্যু দৃশ্য আমার মনে আছে। চোখ বন্ধ করে ধ্যান করতে হয়। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রেল দূর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের চেহারা বিনা আয়াসে আমার মনে জেগে ওঠে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের উত্তর দিকে শ্মাশানের পাশে কাল ভৈরব মূর্তিটিকে দেখে আমার কেমন যেন আপনার নিজের মানুষ মনে হয়েছিল। একবার কবি রফিক আজাদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া গিয়েছিলেন। আমরা তাকে কালভৈরব দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। রফিক এক নজর দেখেই মন্তব্য করেছিল 'বেটাকে তো দেখতে ডঃ আহমদ শরীফের মতো লাগে।' পাকিস্তানী সেনাবাহিনী শুনেছি এই মূর্তিটি ভেঙ্গে ফেলেছিলো। সেই জায়গাতেই নতুন আর একটি মূর্তি তৈরী হয়েছে।

মিন্নাত আলী সাহেবের কারণে আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া গিয়েছিলাম। আসাদ চৌধুরী সাহেব সেখানে কলেজে কাজ করছিলেন বলেই আমার থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। আমি দু' বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছিলাম। প্রথম দিনই মুহম্মদ মুসা বি, এ, এর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। বি. এ. শব্দটা লিখলাম বলে কেউ রাগ করবেন না। মুছা বি, এ, শব্দটাকে তার নামের অংশ হিসেবে ব্যবহার করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সকলেই তা জানেন। মুম্মদ মুসার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অধ্যাপক মোমেন সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। আমরা ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ এবং কমিউনিস্ট পার্টির লোক ছিলাম। এ রাজনৈতিক খানদানের যত লোকছিলেন সকলের সঙ্গেই আমার সম্পর্কে সৃষ্টি হয়েছিল। অনেকের কাছ থেকেই স্নেহ, ভালবাসা এবং আদর-অনাদর পেয়েছি। ডাঃ ফরিদুল হুদা, ডাঃ জে. আমীন, ব্যাংকার আঃ মান্নান, হোমিও ডাক্তার চন্ডীপদ চক্রবর্তী, অধ্যাপক বিজন ভট্টাচার্য প্রমূখের সঙ্গে আমার পরিচয় রাজনৈতিক সূত্রে। ট্যাংকের পান্ডের হুমায়ুন আমার বন্ধু ছিল। মৌলভীপাড়ার ডেপুটি সাহেবের ছেলে সাফকাত এবং আদনান তাদের দু'জনের সঙ্গে আমার পচিয় হয়েছিল। মাশুকুর রহমান চৌধুরী, মাহবুবুল করিম; মুহম্মদ সিরাজ, পলাশ বাড়ীর জমিলা খালা, এদের সকলের সঙ্গে সাহিত্য সম্পর্কিত কারণে আমি ঘনিষ্ট হয়েছিলাম। আমাদের নিজস্ব রাজনৈতিক গণ্ডির মধ্যে আমার পরিচয় সীমাবদ্ধ ছিল না। অন্যান্য দলের লোকদের সঙ্গেও আমার সম্পর্ক ছিল। মৌড়াইলের মুকুল, সফিক এবং বাদল এরা আমাদের রাজনীতি করতো না। কিন্তু বন্ধুত্ব আটকায়নি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গায়ক, বাদক, বক্তা, এমন কি মোল্লা মৌলানা অনেককেই আমি চিনতাম। সুরকার সুবল দাস এবং তার বোন শকুন্তলার সঙ্গে আমার জানাশুনা ছিল। মৌলভী পাড়ার দিলারার বাড়ীতে যাওয়া-আসা করতাম। সঙ্গীতজ্ঞ চান মিয়া এবং তবলচী গৌরাঙ্গ আমার বন্ধু ছিলেন, তবলচী ফুল মিঞাকেও চিনতাম। ওস্তাদ ইসরাইল খাঁ সাহেব আমাকে স্নেহ করতেন। গৌরাঙ্গ আগরতলা চলে গেছেন। চাঁন মিয়া মারা গেছেন, ইসরাইল সাহেবও বেঁচে নেই। এই সব বন্ধুদের কথা চিন্তা করলে মনটা কেমন করে উঠে। রেকটোর বাচ্চু, ভাই রবিউল্লার হোটেল, ধর্মষ্টল, অন্নদা রেষ্টুরেন্ট এবং মহাদেব মিষ্টান্না ভাণ্ডার- সমস্ত দোকানের মালিকদের সঙ্গে আমার খাতির ছিল। আমার ধারণা বাচ্চু মিয়া সাহেব আমার কাছে এখনো কিছু পয়সা পাবেন। রাম কানাই হাই স্কুলের বামদিকে মালেকদের বাসা। আমি ঐ বাসায় কিছু দিন ছিলাম। মালেকের মা আমাকে বি, এ পরীক্ষার সময় রান্না করে খাইয়েছিলেন। মালেকের পরিবার, ডাঃ ফরিদুল হুদার পরিবার, ডাঃ চণ্ডী বাবুর পরিবার এবং জামিলা খালার পরিবার এদের সকলের কাছে আমার যে ঋণ তা কখনো শোধ করতে পারবো না।

আমি সরাইলের দেওয়ান মাহবুব আলী সাহেবের বাড়ীতে একবার গিয়েছি। শাহবাজপুরের রবিনাগের বাড়ীতে অনেকবার গিয়েছি। রবিদার একটি চমৎকার গোলাপ বাগান ছিল। তিরিশ চল্লিশ রকমের গোলাপ পাওয়া যেতো। একবার সুভাস বসু নাকি এ বাগান দেখতে এসেছিল। তার স্ত্রী বার্মিজ ভাষায় গান করতেন। দুটি মেয়ে অম্বা ও চম্পা-তাদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। যুদ্ধের সময় আগরতলাতে একই জায়গায় রবিদার পরিবারের সঙ্গে কাটিয়েছি।

আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সাংবাদিক হিসেবে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে এ, এ পাস করেছি। সে সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যে সংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিল, গোটা দেশে তার কোন তুলনা ছিল না। ঢাকা থেকে রনেশদা, সত্যেনদা, বিমেষ করে সত্যেন দা হর হামেশা যাতায়াত করতেন। একটা সুন্দর, প্রাণপূর্ণ পরিবেশ আমরা সৃষ্টি করতে পেরেছিলাম।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাসার তিতাস সাহিত্য পরিষদের কথা মনে আছে কিনা জানিনা। এ প্রতিষ্ঠানটি এক সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাণ করেছিল।

ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আমরা অনেক ধরনের কাজ করেছি। এই স্বল্প পরিসর রচনায় সবটা বলা সম্ভব হবে না।

শেষ করার আগে আরও কয়েকজনের কথা বলবো। কলবো মিনুর কথা। এই ছেলেটার অনেক সম্ভাবনা ছিল। সঠিক প্রেক্ষিত এবং সঠিক আদর্শের অভাবে ছেলেটা বাউল হয়ে গেল। খালার বাড়ীতে আমি ভাড়া থাকতাম। খালা এবং খালু আগরতলা থেকে এসেছিলেন। খালু এক সময় বেশ অবস্থাসম্পন্ন লোক ছিলেন। কিন্তু তাকে বিত্তবেসাত সব খুইয়ে আসতে হয়েছিল। কোনরকমে হোমিওপ্যাথি ডাক্তারী করে দিন যাপন করতেন। এই খালাটির মন স্নেহ মমতায় পরিপূর্ণ ছিল। শত অভাব দুঃখের মধ্যেও খালার স্বতঃস্ফূর্ততার কখনো ঘাটতি হয়নি। খালাই আমাকে তিতাস নদীর শ্রাবণ মাসের তরঙ্গ দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন-শ্রাবন মাস জলের জন্মমাস এবং তরঙ্গগুলো জলের ছাওয়াল।

গত বছর শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মরণ সভায় আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া গিয়েছিলাম। সে সময় মৌড়াইলের সফিকের ছোট ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে এক সময় সফিকের খুব নাম ডাক ছিল। এখন সফিকের নাম কেউ স্মরণ করে না। আমি যদি একটা লেখায় সফিকের কথা বলি, তার পরিবারের সকলে খুশি হবেন। এই ক্ষুদ্র রচনায় অত্যন্ত স্নেহের সঙ্গে আমি সফিকের কথা স্মরণ করলাম।

নিতাই পালের কথাও আমাকে বলতে হবে। এই ভদ্রলোক ছিলেন ব্যবসায়ী ও দানবীর। অনেকবার তার কাছ থেকে চাঁদা আনতে গিয়েছে। তিনি অনেকগুলো গরীব ছেলে মেয়ের পড়াশুনার খরচ দিতেন। এডিশন্যাল এম.ডি ও ছিলেন মনসুরুজ্জামান। তার দুই ছেলে মাসুদ এবং মাহমুদ আমার বিশেস স্নেহভাজন ছিল। তার বড় ছেলে এয়ারফোর্সে চাকুরী করে। মাসুদ এখন থাকে আমেরিকায়। তাদের আসল বাড়ী ছিল সোনারগাঁয়ের কাছে। আমি সেখানে গিয়েছি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমার আর এক বন্ধু আমিনের কথা বয়ান করে আমি এ রচনা শেষ করবো। গত বছর যখন গিয়েছিলাম, তার মুখে দাঁড়ির একটা পাহাড় দেখেছি। বোধহয় এখন ধর্ম-কর্ম করে। আগে কি করতো সেটা বলার চাইতে কি-না করতো সেটা বললে ভাল হয়। আমিন সবগুলো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলো। সুযোগ পেলে সব দলের সভায় বক্তৃতা দিতো। শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি থেকে শুরু করে গরু ছাগলের ব্যাধি সম্পর্কে কথা বলতে পারতো। আমিন একটা বিয়ে করেছিল। সর্ববিদ্যাবিশারদের ঘর করা বৌটির ভাগ্য হয়নি বলে চলে গিয়েছে। এই আমীন আমার বন্ধু। তাকে নিয়ে একটা ছোট গল্প লিখেছি। সেটা টেলিভিশনে নাটক করা হয়েছিল। আমি খুব লজ্জিত। একটি মহাকাব্য লিখেও তার কথা ফুরোবেনা।