আবু ইসহাকের অগ্রন্থিত আত্মজৈবনিক রচনা

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 25 April 2015, 07:01 PM
Updated : 25 April 2015, 07:01 PM

অতি সম্প্রতি দিল্লী সফর করতে গিয়ে দৈবের বশে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের আদিপর্বের প্রধান লেখকদের একজন কথাসাহিত্যিক আবু ইসহাকের অগ্রন্থিত এই লেখাটি নজরে আসে। হাফিংটন পোস্ট (ভারত)-এর বার্তা সম্পাদক ইন্দ্রানি বসু, তার বাবা লেখক অধ্যাপক দিলীপ কুমার বসু এবং লেখিকা ও শিক্ষিকা নন্দিতা বসুর ব্যক্তিগত পাঠাগার দেখার সুযোগ করে না দিলে এই আবিষ্কার আদৌ সম্ভব হতো কিনা সন্দেহ। তাদের উদার আতিথেয়তার সুযোগ নিয়ে ফাঁকে ফাঁকে চোখ বুলিয়ে নিয়েছিলাম লোভনীয় পাঠাগারের ঘুমিয়ে পড়া বইগুলোর দিকে। নিতান্ত কৌতূহলবশত–পুরোনো বইয়ের প্রতি যা আমার সদাজাগ্রত–শ্রীশৌরীন্দ্রকুমার ঘোষ এবং শ্রীপরেশ সাহার সম্পাদনায় কথাশিল্পী শীর্ষক ঘুমের অভিশাপে নিথর রাজকুমারীর গায়ে সোনারকাঠি ও রূপোরকাঠিসদৃশ প্রেমপ্রবণ আমার আঙুলের স্পর্শ মাত্র সে চোখ মেলে তাকালো। আমিও চোখ রাখলাম বইটির বারান্দায় (সূচীপত্রে)। দেখলাম সেখানে বসে অাছেন পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান লেখকদের পাশাপাশি বাংলাদেশের লেখক আবুল ফজল, আবু ইসহাক, মহীউদ্দীন চৌধুরী, মবিন উদদিন আহমদ এবং শামসুদদীন আবুল কালাম। এই গ্রন্থের জন্য লিখিত আত্মজৈবনিক এই লেখাগুলো এখনও পর্যন্ত তাদের কোনো গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে জানা যায় না। আমরা এই পর্বে লেখক আবু ইসহাকের লেখাটি প্রকাশ করছি।

শ্রীশৌরীন্দ্রকুমার ঘোষ এবং শ্রীপরেশ সাহা সম্পাদিত কথাশিল্পী গ্রন্থ সম্পর্কে জ্ঞাতব্য তথ্য হচ্ছে এই যে এটি প্রকাশ করেছিল কলকাতার ভারতী লাইব্রেরী, প্রকাশক ছিলেন জে. সি. সাহা রায়। কলকাতার লোয়ার সাকুর্লার রোডস্থ শতাব্দী প্রেস প্রাইভেট লি:-এর পক্ষে শ্রীমুরারিমোহন কুমারের তত্ত্বাবধানে মুদ্রিত হয়েছিল। এর প্রথম প্রকাশকাল ছিল পৌষ ১৩৬৪, আজ থেকে প্রায় সাতান্ন বছর আগে। ১৭০ পৃষ্ঠার সুমুদ্রিত এই বইটির দাম ছিল পাঁচ টাকা।

কথাসাহিত্যিক আবু ইসহাককে আজকের দিনের পাঠকদের কাছে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। তিনি অল্প লিখলেও, সে সব লেখা সুপরিচিত এবং পাঠকপ্রিয়। তিনি সর্বাধিক খ্যাতি পেয়েছেন তার সূর্য দীঘল বাড়ি উপন্যাসের জন্য। তবে এটি ছাড়াও তার আরও দুটি উপন্যাস আছে।
তার আত্মজৈবনিক লেখাটিতে প্রবেশের আগে আজকের পাঠকদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে আবু ইসহাকের জন্ম: ১ নভেম্বর, ১৯২৬ সালে শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানাধীন শিরঙ্গল গ্রামে। তিনি ১৯৪৬ সালে, মাত্র বিশ বছর বয়সে রচনা করেন বিখ্যাত উপন্যাস সূর্য দীঘল বাড়ী, যদিও এটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে কলকাতা থেকে। পরে এই উপন্যাসের ভিত্তিতে মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলীর যৌথ পরিচালনায় একটি শিল্পসফল চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছিল।
আবু ইসহাক ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন ১৯৪২ সালে, স্কলারশিপ নিয়ে। ১৯৬০ সালে পাকিস্তানের করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। তিনি আমলা পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৮৪ সালে তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি মৃত্যু বরণ করেন ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০০৩ সালে ঢাকায়।

প্রকাশিত গ্রন্থ
উপন্যাস
• সূর্য দীঘল বাড়ি (১৯৫৫) – চলচ্চিত্ররূপ – ১৯৭৯
• পদ্মার পলিদ্বীপ (১৯৮৬)
• জাল (১৯৮৮)

গল্প
• হারেম (১৯৬২)
• মহাপতঙ্গ (১৯৬৩)

পুরস্কার
• বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৩)
• সুন্দরবন সাহিত্যপদক (১৯৮১)
• একুশে পদক (১৯৯৭)

আবু ইসহাক

"আমার জন্ম ফরিদপুর জেলার শিরঙ্গল" গ্রামে ১৩৩৩ সালের (১৯২৬, নভেম্বর) ১৫ই কার্তিক। ঝিঝারী-উপসী উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় থেকে ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পাশ করি। একটি 'স্কলারশিপ'ও পাই। এই 'স্কলারশিপ' নিয়ে পড়তে যাই ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে। ১৯৪৩ সালে দেখা দেয় দেশ জোড়া দুর্ভিক্ষ। শতে শতে হাজারে হাজারে নয়– লাখে লাখে দুর্গত মানুষ পথে বেরিয়ে পড়ে। সমাজ সংসার ভেঙে যায়। সেই সময় 'স্বেচ্ছাসেবক' হয়ে দুর্গত মানুষদের সেবায় 'লঙ্গরখানায়' কাজ করি। দেশের– দেশের মানুষের চেহারাটা সেদিন থেকেই আমার সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আই এ পাস করি ১৯৪৪ সালে। এই সময় আমাদের সংসারে ঘটে বিপদ। বাবা মারা যান। সঙ্গে সঙ্গে আমার পড়াশোনারও ইতি ঘটে। চাকুরী নি' বেসামরিক সরবরাহ বিভাগে। চাকুরী জীবন কলকাতা, পাবনা, ঢাকা ও অধিকাংশ সময়ই নারায়ণগঞ্জে অতিবাহিত হয়। ১৯৪৯ সাল থেকে পুলিশ বিভাগে আছি।

ছোটবেলা থেকেই কবিতা ও গল্প নিয়ে চলে সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াস। প্রথম মুদ্রিত গল্প 'অভিশাপ' প্রকাশিত হয় ১৯৪০ সালে–কবি নজরুল ইসলাম সম্পাদিত 'নবযুগে'। আমার প্রথম উপন্যাস, সূর্য-দীঘল-বাড়ী' ১৯৫০-৫১ সালে 'নও বাহার' মাসিক পত্রে ধারাবাহিকভাবে বেরোয়। ১৯৫৫ সালে উহা পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে যা কিছু লিখতে পারি পূর্ব বাঙলার নানা কাগজে মাঝে মাঝে তা পত্রস্থ হয়।

আধুনিক বাঙলা উপন্যাসের প্রগতিশীল ধারার ক্রমবর্ধমান স্রোতোবেগ লক্ষণীয়। ইতিহাসের ধারা এবং সমাজের গতিশীলতার প্রতি এ ধারার ঔপন্যাসিকদের দৃষ্টি সজাগ। বস্তুবাদ এ ধারার কোন কোন ঔপন্যাসিকের নিয়ন্তা। আর একদল আছেন সত্য শুভ ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠাই তাদের মূলমন্ত্র।….

সাহিত্য সমাজ-জীবনের 'আয়না'ই শুধু নয়–'এক্স-রে' ফিল্মও বটে, কিন্তু লেখায় তাকে রূপ দিতে হ'লে লেখকের থাকা চাই গভীর অনুভূতি, জীবন-নিষ্ঠা, সত্য-সন্ধানী মন, অনাচ্ছন্ন ও অবাধ দৃষ্টি। বাঙলা সাহিত্যে আজ উপন্যাসের কমতি নেই। কিন্তু ক্রটিহীন সার্থক উপন্যাস খুব বেশী সৃষ্টি হয়নি বলেই আমার ধারণা। সাহিত্যের ধারা সমাজের গতি-প্রকৃতি লক্ষ্য করে চলে। সমাজের স্বাভাবিক গতি যখন ব্যাহত বা বিপথগামী হয় তখন তাকে কল্যাণকর পথে চালিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব সাহিত্যের অনেকখানি। এদিক দিয়ে বাঙলা উপন্যাস একেবারে উদাসীন বলা চলে না। উপন্যাসের ধারা আজ কৈলাস ছেড়ে দুঃখী মানুষের সমতল ভূমিতে নামতে শুরু করেছে–এই যা আশার কথা।"
(লেখকের বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে।)