নজরুল স্মরণ: আয় নবীন, শক্তি আয়

নজরুল গানের সুর-সংকলনের কাজ নজরুল ইন্সটিটিউটে আটকে আছে মাত্র ২১ বছর ধরে। কেনো জানেন? সংকলক শিল্পীদের অন্তর্কোন্দল আর রাষ্ট্রীয় অবহেলার কারণে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিনশিমুল সালাহ্উদ্দিন
Published : 25 May 2023, 05:04 PM
Updated : 25 May 2023, 05:04 PM

কাজী নজরুল ইসলাম এক সৃজনী দৈত্য, ক্রিয়েটিভ মনস্টার। বহুবিচিত্র তার সৃজনভুবন, সমসাময়িক প্রায় সবার থেকে আলাদা রাস্তা তৈরি করে হেঁটে গেছেন নিজের মতোন, স্ববিরোধিতায় ভরপুর, রাধাপ্রেমের প্রবল প্রতীক, চলতে চকিতে তাকিয়ে কখনো চাহেননি কারো দিকেই, নিজের কাব্যপংক্তির মতোই ‘বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা’-এক তিনি।

আসুন ঠিক ১০০ বছর আগে ফিরে যাই। ১৯২৩ সাল। কবি কাজী নজরুল ইসলামের বয়স ২৪। ১৯২৩ সালের জানুয়ারি মাসে বিচার চলছে নজরুলের। আদালতেই তিনি উপস্থাপন করলেন ‌‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’।

ভাবুন একবার, ব্রিটিশরাজের আদালতে নজরুল পড়ে চলেছেন তার প্রবন্ধ সেই দরাজ গলায়— “ আমি কবি, আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সেবাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে...”।

ছানাবড়া চোখে বিচারক অর্ডার অর্ডার বলতে ভুলে গিয়ে শুনছেন নজরুল পড়ে চলেছেন, “আমার হাতের বাঁশি কেড়ে নিলেই সে বাঁশির মৃত্যু হবে না। কেননা আমি আর এক বাঁশি নিয়ে বা তৈরি করে তাতে সেই সুর ফোটাতে পারি। সুর আমার বাঁশির নয়, সুর আমার মনে এবং বাঁশির সৃষ্টির কৌশলে, অতএব দোষ বাঁশির নয়, সুরেরও নয়, দোষ তার, যিনি আমার কণ্ঠে তার বীণা বাজান, ... সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে। কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়। সত্যদ্রোহী নয়। সে বাণী রাজদ্বারে দণ্ডিত হতে পারে। কিন্তু ধর্মের আলোকে ন্যায়ের দুয়ারে তা নিরপরাধ, নিষ্কলুষ, অম্লান, অনির্বাণ, সত্যস্বরূপ। ...তাকে শাস্তি দেয়ার মতো রাজশক্তি বা দ্বিতীয় ভগবান নেই। তাকে বন্দী করার মতো পুলিশ বা কারাগার আজো সৃষ্টি হয়নি। …

বিচারক জানে আমি যা বলছি, যা লিখেছি, তা ভগবানের চোখে অন্যায় নয়, ন্যায়ের এজলাসে মিথ্যা নয়। কিন্তু হয়তো সে শাস্তি দেবে। কেননা সে সত্যের নয়, সে রাজার। সে ন্যায়ের নয়, সে আইনের। সে স্বাধীন নয়, সে রাজভৃত্য। তবু জিজ্ঞাসা করছি, এই বিচারাসন কার? রাজার না ধর্মের? এই যে বিচার, এ বিচারের জবাবদিহি করতে হয় রাজাকে, না তার অন্তরের আসনে প্রতিষ্ঠিত বিবেককে, সত্যকে? ভগবানকে? এ বিচারককে কে পুরস্কৃত করে? রাজা, না ভগবান? না আত্মপ্রসাদ?”

বিচারকের চোখ তখন বিস্ফোরিত, এ কেমন আসামী রে ভাই! আর কেমন এ জবানবন্দী, স্বয়ং বিচারকের অবস্থান, রাষ্ট্রের ভুমিকাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে। তখনো নজরুল পড়ে চলেছেন— “আজ ভারত পরাধীন। তার অধিবাসীবৃন্দ দাস। এটা নির্জলা সত্য। কিন্তু দাসকে দাস বললে, অন্যায়কে অন্যায় বললে এ রাজত্বে তা হবে রাজদ্রোহ। এত ন্যায়ের শাসন হতে পারে না, এই যে জোর করে সত্যকে মিথ্যা, অন্যায়কে ন্যায়, দিনকে রাত বলানো এটা কি সত্য সহ্য করতে পারে? এ শাসন কি চিরস্থায়ী হতে পারে? এত দিন হয়েছিল, হয়তো সত্য উদাসীন ছিল বলে। কিন্তু আজ সত্য জেগেছে, তা চক্ষুষ্মান জাগ্রত-আত্মা মাত্রই বিশেষ রূপে জানতে পেরেছে। এই অন্যায় শাসনক্লিষ্ট বন্দী সত্যের পীড়িত ক্রন্দন আমার কণ্ঠে ফুটে উঠেছিল বলেই আমি রাজদ্রোহী?”

ব্রিটিশরাজের চাকর বিচারকের আর উপায় ছিলো মনে করেন! রাজবন্দীর শাস্তি ঘোষিত হলো, এক বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড। পাঠানো হলো আলিপুর জেলে। জেলেই নজরুল শুনলেন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথর তাঁকে উৎসর্গ করেছেন গীতিনাটক ‘বসন্ত’। আলিপুর জেলের জেলার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালেন, রাজদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলাম জেলেও অন্য বন্দীদের ক্ষেপিয়ে তুলছেন। তাকে স্থানান্তর করা হলো হুগলী জেলে। মে মাসে নজরুল শুরু করলেন অনশন ধর্মঘট। শিলং থেকে জেলে এলো রবীন্দ্রনাথের কমায় ভাঙা দুবাক্যের টেলিগ্রাম—Give up hunger strike, our literature claims you।  

একশ বছর আগে আপনাদের নিয়ে গেলাম এজন্য যে, ২৪ বছর বয়সের নজরুল যে সাহস ও প্রজ্ঞা দিয়ে বহুমুখী এক মুক্তির লড়াই করছেন, লাথি মার ভাঙ্ রে তালা বলছেন, সেই সাহস এ প্রজন্মের কোথায়? সেই বিদ্রোহই বা কোথায়? কোথায় সে কবি যিনি বলতে পারেন, “বিদ্রোহী রণক্লান্ত/ আমি সেইদিন হব শান্ত/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না”।

আমার মনে হয় ‘বিদ্রোহী’র মতো প্রভাববিস্তারী কবিতা বাংলা ভাষার আর কোন কবি লেখেননি এখনো পর্যন্ত। শুধু উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, জাতিরাষ্ট্রের শেকড় ধরে টান, শুধু যেনো নজরুলই দিতে পারেন। তাকে ভক্তির মোড়কে আর রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতায় বেঁধে না রেখে তাই এখন কণ্ঠে তুলে নেয়া দরকার তরুণ প্রজন্মের, যাদের সামনে তাদের রাষ্ট্রের তরী, “দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কাণ্ডারী হুশিয়ার”। যাদের তিনি বলেছেন— “যায় প্রবীণ, চৈত বায়—/

 আয় নবীন, শক্তি আয়।//

নজরুলের শক্তি প্রথাভাঙায়, প্রচলকে, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করায়, অগ্রজ বা পূর্ববর্তী কবিদের চ্যালেঞ্জ জানানোয়। নজরুলের কবিতার এই সমাজ-সংস্কারী প্রবণতাই বড় হয়ে উঠেছে— নজরুলকে এই অসমতার পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখবে চিরকাল। যতদিন শোষণ বঞ্চনা আছে সমাজে, আছে ধনী গরিবের বৈষম্য ততদিন নজরুল তাই বঞ্চিতের পাশে দাঁড়িয়ে বলবেন— “ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,/ ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।//

নজরুলের কবিতা কেন ভাল লাগে এই প্রশ্ন নিজেকে করলে আমি উত্তর পাই, নজরুল বাংলা ভাষার অভিভাবক এক কবি, উর্দু-ফারসী, আরবী আর হিন্দী কত শব্দ যে তিনি তার কবিতায় ব্যবহার করেছেন, সত্যিকারের আন্তর্জাতিকমনস্ক এক স্রষ্টার মতো-তার ইয়ত্তা নাই। দিল তো ওহি মেরা ফাস্ গায়্যি… (মানে কী না ওখানেই হৃদয় জিতে নিয়েছেন নজরুল।)

নজরুল প্রেমিক কবি, ব্যক্তিজীবনে যেমন, তার পাঠকদেরও যেনও তিনি দিক্ষিত করতে চেয়েছেন প্রেমে, রাধা-নিবেদনে। সেই নিবেদন থেকেই তো উঠে আসে—

“ক’রেছিলাম চাউনি চয়ন নয়ন হ’তে তোর,/ ভেবেছিলুম গাঁথ্‌ব মালা পাইনে খুঁজে ডোর!/ সেই চাহনি নীল-কমল/ ভ’রল আমার মানস-জল,/ কমল-কাঁটার ঘা লেগেছে মর্মমূলে মোর!/ বক্ষে আমার দুলে আঁখির সাতনরী-হার লোর!//

কিংবা “দূরের প্রিয়া! পাইনি তোমায় তাই এ কাঁদন-রোল!/ কূল মেলে না,-তাই দরিয়ায় উঠতেছে ঢেউ-দোল!/ তোমায় পেলে থাম্‌ত বাঁশী,/ আস্‌ত মরণ সর্বনাশী।/ পাইনি ক’ তাই ভ’রে আছে আমার বুকের কোল।/ বেণুর হিয়া শূন্য ব’লে উঠবে বাঁশীর বোল।//

কী যে আঁকুতি তার প্রেমের! নজরুলের বিদ্রোহীর চেয়েও বেশি ‘ভাল কবিতা’ আমি মনে করি ‘আগমনী’। এ কবিতায় নজরুলের শব্দচয়ন হৃদয় ছুঁয়ে দেয়া ও অসামান্য, লেটোর দল থেকে উঠে আসার কারণে তার ছন্দ, তালজ্ঞান যে কত অসামান্য হয়ে উঠেছিলো ‘আগমনী’ তার এক উদাহরণ।‘ প্রবর্তকের ঘুরচাকায়’-ও তাই।
তাঁর, “ওই/ ডম্বরু-ঢোলে ডিমিডিমি বোলে,/ ব্যোম মরুৎ স-অম্বর দোলে,/ যম বরুণ কী কলকল্লোলে চলে উতরোলে/ ধ্বংসে মাতিয়া  তাথিয়া তাথিয়া/ নাচিয়া রঙ্গে, চরণ ভঙ্গে/ সৃষ্টি সে টলে টলমল!”// বা “যায় মহাকাল মূর্ছা যায়, প্রবর্তকের ঘুরচাকায়’’ তে সব ছাপিয়ে তার কবিত্বই বড় হয়ে ওঠে, প্রধান হয়ে ওঠে, মনে হয় লেটোর দলের তারল্য তাকে অধিকার করতে পারে নাই। নজরুলের সাথে সমাজ রাষ্ট্র কতকিছু যে পারে নাই। যেনো এক ক্ষ্যাপা দুর্বাশা তিনি, ইমামতি করেছেন, কিন্তু ধর্ম তাকে গ্রাস করতে পারে নাই, গান লিখেছেন, সুর-সংগীতায়োজন করেছেন, কিন্তু মৌলকবিতার জায়গায় থেকেছেন সৎ-নিষ্ঠাবান, কোন প্রবেশাধিকার দেন নাই কষ্টকল্পনা ও সাহিত্যিক নানা তত্ত্ব-সংঘাতের। লিটারারি টেক্সটের ব্যাপারে ছিলেন একেবারেই বক্তব্যপ্রধান, রসিকতা করে প্রচুর উপমা উৎপ্রেক্ষা ব্যবহার করেছেন বটে কিন্তু আধুনিক কবিতার শর্তে বা ২০-এর দশকের অন্য কবিদের দিকে তাকিয়ে, এমনকী রবীন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে নন্দনের জন্যই নন্দন-মার্কা কিছু কখনো লেখেন নাই। একাডেমিক শিক্ষার কুফল বহন করতে হয় নাই নজরুলকে, অনুসন্ধানী তার মন সর্বক্ষণ খুঁজেছে নতুন, শব্দ, ধারণা, প্রকরণ। এবং বহুপ্রতিভার নজরুল বহুরৈখিক কোন কষ্টপ্রকরণে নিজেকে নিজের সাহিত্যপ্রতিভাকে বিদ্ধ না করে রয়েছেন একরৈখিক, কম্যুনিকেটিভ আর পরিষ্কার। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই, শোষণ ও নিপীড়নবিরোধী সংগ্রামে কবিতাকে তিনি মিসাইল বানিয়েছেন, তেজোদ্দীপ্ত এক একটি শব্দকে বানিয়েছেন বোমা, সুরে সুরে তিনি গেয়েছেন মানব প্রেমের গান, ধারণ করেছেন অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনা।

নজরুলের কবিতার কোমল প্রেমের স্পর্শে কত প্রিয়াই না দুচোখে এঁকেছে স্বপ্ন প্রিয়র! নজরুলের রণহুঙ্কারে শোষকের মসনদ কেঁপে উঠেছে থরথর করে, অজপাড়াগাঁয়ের দুখু মিয়া থেকে তিনি হয়ে উঠেছেন বাঙালি জাতির স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, প্রাণের কবি। কবি নজরুলের ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতাতেই ব্যবহৃত হয়েছে প্রথম ‘জয় বাংলা’ শব্দগুচ্ছ যা এখন বাঙালির জাতীয় শ্লোগান। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা ‘পূর্ণচন্দ্রে’র জেল-মুক্তির দিনে অভিনন্দন জানিয়ে নজরুল লিখেছিলেন ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ কবিতাটি। এই কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম ‘জয় বাংলা’ শব্দটি ব্যবহার করেন। এরপর তাঁর ‘বাঙালির বাঙলা’ শিরোনামের প্রবন্ধও তিনি শেষ করেন “ বাঙলা বাঙালির হোক;/বাঙলার জয় হোক, “জয় বাঙলা”/ দিয়ে। বঙ্গবন্ধু এই কবিকে স্বাধীন বাংলার জাতীয় কবি ঘোষণা করে নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্তগুলোর একটা নিয়েছেন বলেও আমি মনে করি।

নজরুল চরিত্রের রহস্যের শেষ নাই। যৌবনে যে সময়টায় ফৌজে ছিলেন, কঠোর শৃঙ্খলার ফৌজ বা সেনাবাহিনীও মাতিয়ে রাখতেন নজরুল। সতীর্থরা তার নাম দিয়েছিলো ‘হৈ হৈ কাজী’। তবে নজরুলের নাম নিয়ে সবচেয়ে মজার উদাহরণটি শিবরাম চক্রবর্তীর। তাঁর আত্মজীবনী 'ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা'য় জেল-জীবনে সর্বগুণসম্পন্ন সখা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, kazi knows rule। কারণ, কাজী সকল কাজের কাজি। সব নিয়ম জানেন। জেলে বন্দিদের বিপ্লবী গান গাওয়ানো কি লেফট রাইট করানো থেকে পোলাও-কোর্মা রান্নাতক! এমন উপমায় আর-কেউ লেখেননি কাজী নজরুলের যোগ্য নাম!

একটা মজার গবেষণাচিন্তার বীজ দিয়ে জাতীয় কবির জন্মদিনের লেখা শেষ করি। ব্যাপারটা হলো নজরুল জীবনী থেকে প্রাপ্ত কবির লোকেশন বা বেঁচে থাকার কালাকাল। আসুন একটা চার্ট বা তালিকা খেয়াল করা যাক—

নজরুলের জীবিতকালের লোকেশন

খেয়ালের বিষয় ১. নজরুল কত বিস্তীর্ণ ভুগোল চষে বেড়িয়েছেন, কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন অতি অল্পস্থায়ী জীবনে।
খেয়ালের বিষয় ২. তিনি কখনো পারস্য ইরান তুরান যান নাই, অথচ তিনি লিখেছেন ইরানী বালিকা যেনো মরুচারিণী। করাচি পর্যন্ত গিয়েই যিনি কাবুল ইরান তুরান এর ভাবনা মর্সিয়া তুলে আনতে পারেন রচনায়, তিনি বড় প্রতিভা, তাতে কোন সন্দেহ নাই।

খেয়ালের বিষয় ৩. হাফিজের ভাবশিষ্য, ওমর খৈয়ামের অনুবাদক, একেবারের লোকাল-জায়গা মানে ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশ চষেই এ অঞ্চলের রসসুষমায় ভরিয়ে দিয়েছেন তার রচনাবলী, পশ্চিম থেকে সমসাময়িক জীবনানন্দ বা অগ্রবর্তী ঠাকুরের মতো অপাত্রে কুম্ভদান করেননি।
খেয়ালের বিষয় ৪. অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত সময়েই অখণ্ড ভারতের চুরুলিয়া থেকে করাচি, কলকাতা, কুমিল্লা, ঢাকা যেখানেই তাকাবেন আছেন নজরুল। শুধু আছেন নন, সক্রিয় হয়ে আছেন, হৈ হৈ কাজী হয়েই আছেন।

এই যে ছুটে বেড়ানো ক্ষ্যাপা নজরুল, সৃজনমুখর নজরুল তার রচনাপাঠের চর্চা বাড়িয়ে, তার থেকে শিক্ষা নিয়েই তো ভবিষ্যতের কাণ্ডারী “আয় নবীণ, শক্তি আয়’দের উদ্ধার করতে হবে দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জলের এই দেশ। দূর করতে হবে অন্যায় অনাচার বঞ্চনা, লাঞ্ছিতের বুকে সুবিচারের আনন্দের গতি ফের করতে হবে জাগ্রত।

কিন্তু জাতি হিসেবে সে জায়গা থেকে আমরা বহু দূরে অবস্থান করছি, নজরুল ইনস্টিটিউট বা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় গড়েছি বটে, কাজের বেলায় আমরা বড়ই ঠনঠনা ঠন ঠন। এই দুই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কোন কাজেই নেই কোন পরিকল্পনার ছাপ, ফলে যা কিছু পরিকল্পনা তার বাস্তবায়ন ত দূরে থাক, রুটিন ওয়ার্কেও ইদানিং বড় বড় ছিদ্র চোখে পড়ে।
তা টের পাবেন যে কেউ, নজরুল ইনস্টিটিউটে ‘নজরুল রচনাবলী’ কিনতে গেলেই। বিশ্বভারতী যেখানে রবীন্দ্ররচনাবলীর পাশাপাশি নজরুল রচনাবলীরও বৈদ্যুতিন সংস্করণ প্রকাশ করেছে, আমাদের নজরুল ইন্সটিটিউট, বাংলা একাডেমি বা অধুনা “জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়’ -এর এরকম কোন অবদান কি আপনি দেখতে পান?
ও একটা খবর দিয়ে শেষ করি, নজরুল গানের সুর-সংকলনের কাজ নজরুল ইন্সটিটিউটে আটকে আছে মাত্র ২১ বছর ধরে। কেনো জানেন? সংকলক শিল্পীদের অন্তর্কোন্দল আর রাষ্ট্রীয় অবহেলার কারণে। এসবের বিরুদ্ধে কে বলবে আর, “লাথি মার ভাঙরে তালা, যত সব বন্দিশালা! আয় নবীণ, শক্তি আয়।’’ কে করবে আর দুঃশাসনের রক্তপান?


 তথ্যসূত্র: https://nazrul-rachanabali.nltr.org/biography.php