নজরুল গানের সুর-সংকলনের কাজ নজরুল ইন্সটিটিউটে আটকে আছে মাত্র ২১ বছর ধরে। কেনো জানেন? সংকলক শিল্পীদের অন্তর্কোন্দল আর রাষ্ট্রীয় অবহেলার কারণে।
Published : 25 May 2023, 11:04 PM
কাজী নজরুল ইসলাম এক সৃজনী দৈত্য, ক্রিয়েটিভ মনস্টার। বহুবিচিত্র তার সৃজনভুবন, সমসাময়িক প্রায় সবার থেকে আলাদা রাস্তা তৈরি করে হেঁটে গেছেন নিজের মতোন, স্ববিরোধিতায় ভরপুর, রাধাপ্রেমের প্রবল প্রতীক, চলতে চকিতে তাকিয়ে কখনো চাহেননি কারো দিকেই, নিজের কাব্যপংক্তির মতোই ‘বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা’-এক তিনি।
আসুন ঠিক ১০০ বছর আগে ফিরে যাই। ১৯২৩ সাল। কবি কাজী নজরুল ইসলামের বয়স ২৪। ১৯২৩ সালের জানুয়ারি মাসে বিচার চলছে নজরুলের। আদালতেই তিনি উপস্থাপন করলেন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’।
ভাবুন একবার, ব্রিটিশরাজের আদালতে নজরুল পড়ে চলেছেন তার প্রবন্ধ সেই দরাজ গলায়— “ আমি কবি, আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সেবাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে...”।
ছানাবড়া চোখে বিচারক অর্ডার অর্ডার বলতে ভুলে গিয়ে শুনছেন নজরুল পড়ে চলেছেন, “আমার হাতের বাঁশি কেড়ে নিলেই সে বাঁশির মৃত্যু হবে না। কেননা আমি আর এক বাঁশি নিয়ে বা তৈরি করে তাতে সেই সুর ফোটাতে পারি। সুর আমার বাঁশির নয়, সুর আমার মনে এবং বাঁশির সৃষ্টির কৌশলে, অতএব দোষ বাঁশির নয়, সুরেরও নয়, দোষ তার, যিনি আমার কণ্ঠে তার বীণা বাজান, ... সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে। কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়। সত্যদ্রোহী নয়। সে বাণী রাজদ্বারে দণ্ডিত হতে পারে। কিন্তু ধর্মের আলোকে ন্যায়ের দুয়ারে তা নিরপরাধ, নিষ্কলুষ, অম্লান, অনির্বাণ, সত্যস্বরূপ। ...তাকে শাস্তি দেয়ার মতো রাজশক্তি বা দ্বিতীয় ভগবান নেই। তাকে বন্দী করার মতো পুলিশ বা কারাগার আজো সৃষ্টি হয়নি। …
বিচারক জানে আমি যা বলছি, যা লিখেছি, তা ভগবানের চোখে অন্যায় নয়, ন্যায়ের এজলাসে মিথ্যা নয়। কিন্তু হয়তো সে শাস্তি দেবে। কেননা সে সত্যের নয়, সে রাজার। সে ন্যায়ের নয়, সে আইনের। সে স্বাধীন নয়, সে রাজভৃত্য। তবু জিজ্ঞাসা করছি, এই বিচারাসন কার? রাজার না ধর্মের? এই যে বিচার, এ বিচারের জবাবদিহি করতে হয় রাজাকে, না তার অন্তরের আসনে প্রতিষ্ঠিত বিবেককে, সত্যকে? ভগবানকে? এ বিচারককে কে পুরস্কৃত করে? রাজা, না ভগবান? না আত্মপ্রসাদ?”
বিচারকের চোখ তখন বিস্ফোরিত, এ কেমন আসামী রে ভাই! আর কেমন এ জবানবন্দী, স্বয়ং বিচারকের অবস্থান, রাষ্ট্রের ভুমিকাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে। তখনো নজরুল পড়ে চলেছেন— “আজ ভারত পরাধীন। তার অধিবাসীবৃন্দ দাস। এটা নির্জলা সত্য। কিন্তু দাসকে দাস বললে, অন্যায়কে অন্যায় বললে এ রাজত্বে তা হবে রাজদ্রোহ। এত ন্যায়ের শাসন হতে পারে না, এই যে জোর করে সত্যকে মিথ্যা, অন্যায়কে ন্যায়, দিনকে রাত বলানো এটা কি সত্য সহ্য করতে পারে? এ শাসন কি চিরস্থায়ী হতে পারে? এত দিন হয়েছিল, হয়তো সত্য উদাসীন ছিল বলে। কিন্তু আজ সত্য জেগেছে, তা চক্ষুষ্মান জাগ্রত-আত্মা মাত্রই বিশেষ রূপে জানতে পেরেছে। এই অন্যায় শাসনক্লিষ্ট বন্দী সত্যের পীড়িত ক্রন্দন আমার কণ্ঠে ফুটে উঠেছিল বলেই আমি রাজদ্রোহী?”
ব্রিটিশরাজের চাকর বিচারকের আর উপায় ছিলো মনে করেন! রাজবন্দীর শাস্তি ঘোষিত হলো, এক বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড। পাঠানো হলো আলিপুর জেলে। জেলেই নজরুল শুনলেন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথর তাঁকে উৎসর্গ করেছেন গীতিনাটক ‘বসন্ত’। আলিপুর জেলের জেলার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালেন, রাজদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলাম জেলেও অন্য বন্দীদের ক্ষেপিয়ে তুলছেন। তাকে স্থানান্তর করা হলো হুগলী জেলে। মে মাসে নজরুল শুরু করলেন অনশন ধর্মঘট। শিলং থেকে জেলে এলো রবীন্দ্রনাথের কমায় ভাঙা দুবাক্যের টেলিগ্রাম—Give up hunger strike, our literature claims you।
একশ বছর আগে আপনাদের নিয়ে গেলাম এজন্য যে, ২৪ বছর বয়সের নজরুল যে সাহস ও প্রজ্ঞা দিয়ে বহুমুখী এক মুক্তির লড়াই করছেন, লাথি মার ভাঙ্ রে তালা বলছেন, সেই সাহস এ প্রজন্মের কোথায়? সেই বিদ্রোহই বা কোথায়? কোথায় সে কবি যিনি বলতে পারেন, “বিদ্রোহী রণক্লান্ত/ আমি সেইদিন হব শান্ত/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না”।
আমার মনে হয় ‘বিদ্রোহী’র মতো প্রভাববিস্তারী কবিতা বাংলা ভাষার আর কোন কবি লেখেননি এখনো পর্যন্ত। শুধু উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, জাতিরাষ্ট্রের শেকড় ধরে টান, শুধু যেনো নজরুলই দিতে পারেন। তাকে ভক্তির মোড়কে আর রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতায় বেঁধে না রেখে তাই এখন কণ্ঠে তুলে নেয়া দরকার তরুণ প্রজন্মের, যাদের সামনে তাদের রাষ্ট্রের তরী, “দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কাণ্ডারী হুশিয়ার”। যাদের তিনি বলেছেন— “যায় প্রবীণ, চৈত বায়—/
আয় নবীন, শক্তি আয়।//
নজরুলের শক্তি প্রথাভাঙায়, প্রচলকে, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করায়, অগ্রজ বা পূর্ববর্তী কবিদের চ্যালেঞ্জ জানানোয়। নজরুলের কবিতার এই সমাজ-সংস্কারী প্রবণতাই বড় হয়ে উঠেছে— নজরুলকে এই অসমতার পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখবে চিরকাল। যতদিন শোষণ বঞ্চনা আছে সমাজে, আছে ধনী গরিবের বৈষম্য ততদিন নজরুল তাই বঞ্চিতের পাশে দাঁড়িয়ে বলবেন— “ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,/ ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।//
নজরুলের কবিতা কেন ভাল লাগে এই প্রশ্ন নিজেকে করলে আমি উত্তর পাই, নজরুল বাংলা ভাষার অভিভাবক এক কবি, উর্দু-ফারসী, আরবী আর হিন্দী কত শব্দ যে তিনি তার কবিতায় ব্যবহার করেছেন, সত্যিকারের আন্তর্জাতিকমনস্ক এক স্রষ্টার মতো-তার ইয়ত্তা নাই। দিল তো ওহি মেরা ফাস্ গায়্যি… (মানে কী না ওখানেই হৃদয় জিতে নিয়েছেন নজরুল।)
নজরুল প্রেমিক কবি, ব্যক্তিজীবনে যেমন, তার পাঠকদেরও যেনও তিনি দিক্ষিত করতে চেয়েছেন প্রেমে, রাধা-নিবেদনে। সেই নিবেদন থেকেই তো উঠে আসে—
“ক’রেছিলাম চাউনি চয়ন নয়ন হ’তে তোর,/ ভেবেছিলুম গাঁথ্ব মালা পাইনে খুঁজে ডোর!/ সেই চাহনি নীল-কমল/ ভ’রল আমার মানস-জল,/ কমল-কাঁটার ঘা লেগেছে মর্মমূলে মোর!/ বক্ষে আমার দুলে আঁখির সাতনরী-হার লোর!//
কিংবা “দূরের প্রিয়া! পাইনি তোমায় তাই এ কাঁদন-রোল!/ কূল মেলে না,-তাই দরিয়ায় উঠতেছে ঢেউ-দোল!/ তোমায় পেলে থাম্ত বাঁশী,/ আস্ত মরণ সর্বনাশী।/ পাইনি ক’ তাই ভ’রে আছে আমার বুকের কোল।/ বেণুর হিয়া শূন্য ব’লে উঠবে বাঁশীর বোল।//
কী যে আঁকুতি তার প্রেমের! নজরুলের বিদ্রোহীর চেয়েও বেশি ‘ভাল কবিতা’ আমি মনে করি ‘আগমনী’। এ কবিতায় নজরুলের শব্দচয়ন হৃদয় ছুঁয়ে দেয়া ও অসামান্য, লেটোর দল থেকে উঠে আসার কারণে তার ছন্দ, তালজ্ঞান যে কত অসামান্য হয়ে উঠেছিলো ‘আগমনী’ তার এক উদাহরণ।‘ প্রবর্তকের ঘুরচাকায়’-ও তাই।
তাঁর, “ওই/ ডম্বরু-ঢোলে ডিমিডিমি বোলে,/ ব্যোম মরুৎ স-অম্বর দোলে,/ যম বরুণ কী কলকল্লোলে চলে উতরোলে/ ধ্বংসে মাতিয়া তাথিয়া তাথিয়া/ নাচিয়া রঙ্গে, চরণ ভঙ্গে/ সৃষ্টি সে টলে টলমল!”// বা “যায় মহাকাল মূর্ছা যায়, প্রবর্তকের ঘুরচাকায়’’ তে সব ছাপিয়ে তার কবিত্বই বড় হয়ে ওঠে, প্রধান হয়ে ওঠে, মনে হয় লেটোর দলের তারল্য তাকে অধিকার করতে পারে নাই। নজরুলের সাথে সমাজ রাষ্ট্র কতকিছু যে পারে নাই। যেনো এক ক্ষ্যাপা দুর্বাশা তিনি, ইমামতি করেছেন, কিন্তু ধর্ম তাকে গ্রাস করতে পারে নাই, গান লিখেছেন, সুর-সংগীতায়োজন করেছেন, কিন্তু মৌলকবিতার জায়গায় থেকেছেন সৎ-নিষ্ঠাবান, কোন প্রবেশাধিকার দেন নাই কষ্টকল্পনা ও সাহিত্যিক নানা তত্ত্ব-সংঘাতের। লিটারারি টেক্সটের ব্যাপারে ছিলেন একেবারেই বক্তব্যপ্রধান, রসিকতা করে প্রচুর উপমা উৎপ্রেক্ষা ব্যবহার করেছেন বটে কিন্তু আধুনিক কবিতার শর্তে বা ২০-এর দশকের অন্য কবিদের দিকে তাকিয়ে, এমনকী রবীন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে নন্দনের জন্যই নন্দন-মার্কা কিছু কখনো লেখেন নাই। একাডেমিক শিক্ষার কুফল বহন করতে হয় নাই নজরুলকে, অনুসন্ধানী তার মন সর্বক্ষণ খুঁজেছে নতুন, শব্দ, ধারণা, প্রকরণ। এবং বহুপ্রতিভার নজরুল বহুরৈখিক কোন কষ্টপ্রকরণে নিজেকে নিজের সাহিত্যপ্রতিভাকে বিদ্ধ না করে রয়েছেন একরৈখিক, কম্যুনিকেটিভ আর পরিষ্কার। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই, শোষণ ও নিপীড়নবিরোধী সংগ্রামে কবিতাকে তিনি মিসাইল বানিয়েছেন, তেজোদ্দীপ্ত এক একটি শব্দকে বানিয়েছেন বোমা, সুরে সুরে তিনি গেয়েছেন মানব প্রেমের গান, ধারণ করেছেন অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনা।
নজরুলের কবিতার কোমল প্রেমের স্পর্শে কত প্রিয়াই না দুচোখে এঁকেছে স্বপ্ন প্রিয়র! নজরুলের রণহুঙ্কারে শোষকের মসনদ কেঁপে উঠেছে থরথর করে, অজপাড়াগাঁয়ের দুখু মিয়া থেকে তিনি হয়ে উঠেছেন বাঙালি জাতির স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, প্রাণের কবি। কবি নজরুলের ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতাতেই ব্যবহৃত হয়েছে প্রথম ‘জয় বাংলা’ শব্দগুচ্ছ যা এখন বাঙালির জাতীয় শ্লোগান। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা ‘পূর্ণচন্দ্রে’র জেল-মুক্তির দিনে অভিনন্দন জানিয়ে নজরুল লিখেছিলেন ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ কবিতাটি। এই কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম ‘জয় বাংলা’ শব্দটি ব্যবহার করেন। এরপর তাঁর ‘বাঙালির বাঙলা’ শিরোনামের প্রবন্ধও তিনি শেষ করেন “ বাঙলা বাঙালির হোক;/বাঙলার জয় হোক, “জয় বাঙলা”/ দিয়ে। বঙ্গবন্ধু এই কবিকে স্বাধীন বাংলার জাতীয় কবি ঘোষণা করে নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্তগুলোর একটা নিয়েছেন বলেও আমি মনে করি।
নজরুল চরিত্রের রহস্যের শেষ নাই। যৌবনে যে সময়টায় ফৌজে ছিলেন, কঠোর শৃঙ্খলার ফৌজ বা সেনাবাহিনীও মাতিয়ে রাখতেন নজরুল। সতীর্থরা তার নাম দিয়েছিলো ‘হৈ হৈ কাজী’। তবে নজরুলের নাম নিয়ে সবচেয়ে মজার উদাহরণটি শিবরাম চক্রবর্তীর। তাঁর আত্মজীবনী 'ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা'য় জেল-জীবনে সর্বগুণসম্পন্ন সখা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, kazi knows rule। কারণ, কাজী সকল কাজের কাজি। সব নিয়ম জানেন। জেলে বন্দিদের বিপ্লবী গান গাওয়ানো কি লেফট রাইট করানো থেকে পোলাও-কোর্মা রান্নাতক! এমন উপমায় আর-কেউ লেখেননি কাজী নজরুলের যোগ্য নাম!
একটা মজার গবেষণাচিন্তার বীজ দিয়ে জাতীয় কবির জন্মদিনের লেখা শেষ করি। ব্যাপারটা হলো নজরুল জীবনী থেকে প্রাপ্ত কবির লোকেশন বা বেঁচে থাকার কালাকাল। আসুন একটা চার্ট বা তালিকা খেয়াল করা যাক—
নজরুলের জীবিতকালের লোকেশন
সময়কাল | স্থান | কার্যকারণ বা কেন এই অবস্থান |
---|---|---|
১৮৯৯-১৯০৯ | ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোল শহরের চুরুলিয়া গ্রাম | জন্ম ও শৈশব, অতিদারিদ্রপীড়িত |
১৯১০ | আসানসোল শহরের রাণীগঞ্জ | সিয়ারসোল রাজ প্রাইমারী স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে অধ্যয়ন |
১৯১১ | বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট থানার মাথ্রুন গ্রাম | মাথরুন নবীনচন্দ্র ইন্সটিটিউশনে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি |
১৯১২ - ১৩ | হুগলি জেলার চন্দননগর মহকুমার প্রসাদপুর গ্রাম | বর্ধমানের অন্ডাল ব্রাঞ্চ রেলওয়ের বাঙালি খ্রিস্টান গার্ড সাহেবের খানসামার চাকরি |
১৯১২ - ১৩ | আসানসোল | এম. এ. বখ্শের চা রুটির দোকানে বয়-এর চাকরি |
১৯১৪ | ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের কাজীরসিমলা, দরিরামপুর | দরিরামপুর স্কুলের সপ্তম শ্রেণির অবৈতনিক ছাত্র |
১৯১৪ | চুরুলিয়া, বর্ধমান | সপ্তম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় পাশ করে অষ্টম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে ময়মনসিংহ ত্যাগ করে চুরুলিয়ায় ফিরে যান। |
১৯১৫ - ১৭ | আসানসোল শহরের রাণীগঞ্জ | রাণিগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন |
১৯১৭ | লাহোর | প্রিটেস্ট পরীক্ষার আগে সেনাবাহিনীর ৪৯নং বাঙালি পল্টনে যোগ দেন। সেপ্টেম্বরে হাওড়া স্টেশন থেকে একটা বড় দলের সঙ্গে লাহোরের পথে যাত্রা করেন। |
১৯১৭ - ১৯ | লাহোর-করাচি | সৈনিক জীবন, প্রধানত, করাচিতে গন্জা/গাজা বা আবিসিনিয়া লাইনে অতিবাহিত, ব্যাটালিয়ান কোয়ার্টার মাস্টার পদে উন্নতি, সাহিত্যচর্চা। |
১৯২০ | কলকাতা- | মার্চ মাসে সেনাবাহিনী থেকে প্রত্যাবর্তন, বঙ্গীয়-মুসলমান-সাহিত্য-সমিতির ৩২নং কলেজ স্ট্রিটস্থ দফ্তরে মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে অবস্থান। নজরুল ও মুজফ্ফর আহ্মদের ৮-এ টার্নার স্ট্রিটে অবস্থান, বরিশাল ভ্রমণ, বায়ু পরিবর্তনের জন্য দেওঘর গমন। |
[কলকাতা-বরিশাল-কলকাতা-দেওঘর/ঝাড়খন্ড] | ||
১৯২১ | কলকাতা | দেওঘর থেকে প্রত্যাবর্তন, ৩২নং কলেজ স্ট্রিটে অবস্থান। এপ্রিল মাসে কুমিল্লা গমন, আলী আকবর খানের সঙ্গে দৌলতপুর গমন ও দুই মাস দৌলতপুর অবস্থান, আলী আকবর খানের ভাগিনেয়ী সৈয়দা খাতুনি ওরফে নার্গিস আসার খানমের সঙ্গে ১৩২৮ সালের ২রা আষাঢ় তারিখে বিবাহ। বিবাহের রাত্রেই নজরুলের দৌলতপুর ত্যাগ ও পরদিন কুমিল্লা গমন এবং অবস্থান। জুলাই মাসে মুজফ্ফর আহ্মদের সঙ্গে কুমিল্লা থেকে চাঁদপুর হয়ে কলকাতা প্রত্যাবর্তন, ৩/৪সি তালতলা লেনের বাড়িতে অবস্থান, অক্টোবর মাসে অধ্যাপক (ডক্টর) মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র সঙ্গে শান্তিনিকেতন ভ্রমণ ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ। নভেম্বর মাসে পুনরায় কুমিল্লা গমন, অসহযোগ আন্দোলনে অংশ গ্রহণ। কলকাতায় প্রত্যাবর্তন। ডিসেম্বরের শেষ দিকে কলকাতায় তালতলা লেনের বাড়িতে বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ রচনা। |
[কলকাতা-কুমিল্লা-দৌলতপুর-কুমিল্লা-চাঁদপুর-কলকাতা-শান্তিনিকেতন-কুমিল্লা-কলকাতা] | ||
১৯২২ | কুমিল্লা-কলকাতা-কুমিল্লা | চার মাস কুমিল্লা অবস্থান, প্রমীলার সঙ্গে সম্পর্ক। ২৫শে জুন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যু, রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শোক সভায় যোগদান। নভেম্বর মাসে নজরুলকে কুমিল্লায় গ্রেপ্তার ও কলকাতা প্রেসিডেন্সি জেলে আটক। |
১৯২৩ | কলকাতা-আলিপুর-হুগলি-বহরমপুর | প্রায় সারাবছর জেলবন্দী |
১৯২৪ | মেদিনীপুর-হুগলি | বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের মেদিনীপুর শাখার একাদশ বার্ষিক অধিবেশনে যোগদান। প্রমীলার সঙ্গে বিবাহ, হুগলিতে নজরুলের সংসার স্থাপন, হুগলিতে প্রথম পুত্র আজাদ কামালের জন্ম ও অকালমৃত্যু। |
১৯২৫ | ফরিদপুর-কলকাতা | মে মাসে কংগ্রেসের ফরিদপুর অধিবেশনে যোগদান। জুলাই মাসে বাঁকুড়া সফর। |
১৯২৬ | পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর | জানুয়ারি থেকে কৃষ্ণনগরে বসবাস। মার্চ মাসে মাদারিপুর নিখিল বঙ্গীয় ও আসাম প্রদেশীয় মৎস্যজীবী সম্মেলনে যোগদান। জুলাই মাসে চট্টগ্রাম, অক্টোবর মাসে সিলেট এবং যশোর ও খুলনা সফর। |
[কৃষ্ণনগর- মাদারিপুর - আসাম – চট্টগ্রাম- সিলেট- যশোর-খুলনা] | ||
১৯২৭ | কৃষ্ণনগর | ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা সফর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে যোগদান |
[কৃষ্ণনগর-ঢাকা-কলকাতা- কৃষ্ণনগর] | ||
১৯২৮ | কৃষ্ণনগর-কলকাতা | ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় মুসলমান সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগদান। সেপ্টেম্বর মাসে কলিকাতা ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হলে গমন। ডিসেম্বর মাসে নজরুলের রংপুর ও রাজশাহি সফর। |
কলকাতায় নিখিল ভারত কৃষক ও শ্রমিক দলের সম্মেলনে যোগদান। ডিসেম্বরের শেষে কৃষ্ণনগর থেকে নজরুলের কলকাতা প্রত্যাবর্তন এবং প্রথমে ১১নং ওয়েলেস্লি স্ট্রিটে ‘সওগাত’ অফিস সংলগ্ন ভাড়া বাড়িতে ও পরে ৮/১ পান বাগান লেনে ভাড়া বাড়িতে বসবাস। | ||
[ঢাকা-কলকাতা-রংপুর-রাজশাহী- কলকাতা] | ||
১৯২৯-১৯৩১ | কলকাতা | |
১৯৩২ | কলকাতা | নভেম্বরে সিরাজগঞ্জে ‘বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলনের’ সভাপতিত্ব। |
[সিরাজগঞ্জ-কলকাতা] | ||
১৯৩৩ | কলকাতা | গ্রীষ্মে ‘বর্ষবাণী’ সম্পাদিকা জাহান আরা চৌধুরীর সঙ্গে দার্জিলিং ভ্রমণ ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ। |
[দার্জিলিং-কলকাতা] | ||
১৯৩৪-১৯৩৫ | কলকাতা | |
১৯৩৬ | কলকাতা | ফরিদপুর ‘মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশনের কনফারেন্সে’ সভাপতিত্ব। |
[ফরিদপুর-কলকাতা] | ||
১৯৩৭-১৯৪০ | কলকাতা | |
১৯৪১ | কলকাতা | মার্চে, বনগাঁ সাহিত্য-সভার চতুর্থ বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব। |
[বনগাঁ-কলকাতা] | ||
১৯৪২ | কলকাতা | নজরুলের বায়ু পরিবর্তনের জন্য ডক্টর সরকারের সঙ্গে মধুপুর গমন। মধুপুরে অবস্থার অবনতি। ২১শে সেপ্টেম্বর মধুপুর থেকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন। |
[মধুপুর-কলকাতা] | ||
১৯৪৩-১৯৫১ | কলকাতা | |
১৯৫২ | কলকাতা | জুলাই মাসে নজরুল ও তাঁর পত্নীকে রাঁচি মানসিক হাসপাতালে প্রেরণ। চার মাস চিকিৎসা, সুফলের অভাবে কলকাতা আনয়ন। |
[রাচি-কলকাতা] | ||
১৯৫৩ | লন্ডন-ভিয়েনা-কলকাতা | মে মাসে কবি ও কবিপত্নীকে চিকিৎসার জন্যে লন্ডন প্রেরণ। ডিসেম্বর মাসে নজরুলকে ভিয়েনাতে প্রেরণ। ডিসেম্বর মাসে নজরুল ও তাঁর পত্নীকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। |
১৯৫৪-১৯৭১ | কলকাতা | অসুস্থ বধির কবি |
১৯৭২ | ঢাকা | স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে নজরুলকে সপরিবার ঢাকায় আনয়ন, ধানমন্ডিতে কবিভবনে অবস্থান। |
১৯৭৩-১৯৭৬ | ঢাকা | ২৯শে আগস্ট ১৯৭৬ সকাল ১০টা ১০ মিনিটে কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। |
খেয়ালের বিষয় ১. নজরুল কত বিস্তীর্ণ ভুগোল চষে বেড়িয়েছেন, কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন অতি অল্পস্থায়ী জীবনে।
খেয়ালের বিষয় ২. তিনি কখনো পারস্য ইরান তুরান যান নাই, অথচ তিনি লিখেছেন ইরানী বালিকা যেনো মরুচারিণী। করাচি পর্যন্ত গিয়েই যিনি কাবুল ইরান তুরান এর ভাবনা মর্সিয়া তুলে আনতে পারেন রচনায়, তিনি বড় প্রতিভা, তাতে কোন সন্দেহ নাই।
খেয়ালের বিষয় ৩. হাফিজের ভাবশিষ্য, ওমর খৈয়ামের অনুবাদক, একেবারের লোকাল-জায়গা মানে ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশ চষেই এ অঞ্চলের রসসুষমায় ভরিয়ে দিয়েছেন তার রচনাবলী, পশ্চিম থেকে সমসাময়িক জীবনানন্দ বা অগ্রবর্তী ঠাকুরের মতো অপাত্রে কুম্ভদান করেননি।
খেয়ালের বিষয় ৪. অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত সময়েই অখণ্ড ভারতের চুরুলিয়া থেকে করাচি, কলকাতা, কুমিল্লা, ঢাকা যেখানেই তাকাবেন আছেন নজরুল। শুধু আছেন নন, সক্রিয় হয়ে আছেন, হৈ হৈ কাজী হয়েই আছেন।
এই যে ছুটে বেড়ানো ক্ষ্যাপা নজরুল, সৃজনমুখর নজরুল তার রচনাপাঠের চর্চা বাড়িয়ে, তার থেকে শিক্ষা নিয়েই তো ভবিষ্যতের কাণ্ডারী “আয় নবীণ, শক্তি আয়’দের উদ্ধার করতে হবে দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জলের এই দেশ। দূর করতে হবে অন্যায় অনাচার বঞ্চনা, লাঞ্ছিতের বুকে সুবিচারের আনন্দের গতি ফের করতে হবে জাগ্রত।
কিন্তু জাতি হিসেবে সে জায়গা থেকে আমরা বহু দূরে অবস্থান করছি, নজরুল ইনস্টিটিউট বা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় গড়েছি বটে, কাজের বেলায় আমরা বড়ই ঠনঠনা ঠন ঠন। এই দুই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কোন কাজেই নেই কোন পরিকল্পনার ছাপ, ফলে যা কিছু পরিকল্পনা তার বাস্তবায়ন ত দূরে থাক, রুটিন ওয়ার্কেও ইদানিং বড় বড় ছিদ্র চোখে পড়ে।
তা টের পাবেন যে কেউ, নজরুল ইনস্টিটিউটে ‘নজরুল রচনাবলী’ কিনতে গেলেই। বিশ্বভারতী যেখানে রবীন্দ্ররচনাবলীর পাশাপাশি নজরুল রচনাবলীরও বৈদ্যুতিন সংস্করণ প্রকাশ করেছে, আমাদের নজরুল ইন্সটিটিউট, বাংলা একাডেমি বা অধুনা “জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়’ -এর এরকম কোন অবদান কি আপনি দেখতে পান?
ও একটা খবর দিয়ে শেষ করি, নজরুল গানের সুর-সংকলনের কাজ নজরুল ইন্সটিটিউটে আটকে আছে মাত্র ২১ বছর ধরে। কেনো জানেন? সংকলক শিল্পীদের অন্তর্কোন্দল আর রাষ্ট্রীয় অবহেলার কারণে। এসবের বিরুদ্ধে কে বলবে আর, “লাথি মার ভাঙরে তালা, যত সব বন্দিশালা! আয় নবীণ, শক্তি আয়।’’ কে করবে আর দুঃশাসনের রক্তপান?
তথ্যসূত্র: https://nazrul-rachanabali.nltr.org/biography.php