‘উন্নতির পথে’ নামে রোকেয়ার অগ্রন্থিত একটি গল্প ১ মওলানা আকরম খাঁ সম্পাদিত মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় বাংলা ১৩৩৫ সালের পৌষ (১৯২৮ খৃষ্টাব্দ) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। উন্নতি বা আধুনিকতার নামে সমসাময়িক যুবসমাজের কোনো প্রবণতাকে ব্যাঙ্গ করে এটি লেখা হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়। রোকেয়া রচনাবলী১ বইতে এই লেখাটিকে প্রবন্ধ শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে; সম্ভবতঃ ‘মোহাম্মদী’তেও তাই করা হয়েছিল। সাম্প্রতিক কালে মোরশেদ শফিউল হাসান ২ এটিকে এক ‘ব্যাঙ্গধর্মী রচনা’ বলে উল্লেখ করলেও রোকেয়ার অন্যান্য অনেক রচনার তুলনায় এটি নিয়ে আর কোনো আলোচনা আমার চোখে পড়েনি।
কিন্তু আমার বিবেচনায় এটি লেখকের ক্ষুরধার ও সূক্ষ্ম চাতুর্যের সাথে ছোট্ট এবং ব্যাঙ্গ-কৌতুক রসে ভরা অত্যন্ত উপভোগ্য একটি বিজ্ঞান কল্প-কাহিনী। এই নিবন্ধের প্রথমাংশে আমি গল্পের সারাংশ ও আমার বিশ্লেষণ, এবং শেষাংশে গল্পের কল্পবিজ্ঞান বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো। ধারণা করি গল্পে বর্ণিত এরোপ্লেনের অসম্ভব গতি এবং সময়কে উত্তীর্ণ করে ভ্রমণের প্রসংগ থাকায় গল্পটিকে তখন প্রবন্ধ মনে করা হয়েছিল।
আশি বছর বয়স্ক গল্পকার এক শিশি ‘ক্রুশেন সল্ট’ খাওয়ার এক সপ্তাহের মাঝেই আঠারো বছরের যুবকে রূপান্তরিত হয়ে যান। তিনি দেখতে পান যুবকরা সমস্বরে
‘নগ্ন শির সজ্জা নাই লজ্জা নাই ধড়ে,
কাছা কোচা শ বা খসে খসে পড়ে-‘
গান গাইছে। নয়া কৈশোর-যৌবনপ্রাপ্ত এই বৃদ্ধ যুবকদের দলে মিশে গেলেন। তাদের ঘণ্টায় ষাট হাজার মাইল বেগের দ্রুতগামী এক বিমানে চড়ে বসলেন। তরুণরা বৃদ্ধদের ‘স্থবির’তায় আস্থা হারিয়ে উন্নতির আশায় এই অসম্ভব গতির বিমান নির্মাণ করেছে। এই বিমানে আরোহী ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের যুবক-যুবতীরা।
ওরা সবাই উপরোক্ত গানটি গাইতে গাইতে মাথায় শুধু একটি হ্যাট রেখে একে একে গায়ের সব কাপড় খুলে ফেলে দিচ্ছিল। নবযৌবনপ্রাপ্ত বৃদ্ধের পশ্নের উত্তরে এক নওজোয়ান জানালো স্বাধীনতা ও উন্নতির আশায় পোষাক-পরিচ্ছদ, সবকিছু বিসর্জন দিতে ওরা প্রস্তুত। তা ছাড়া দেশোদ্ধারের অভিযানে মগ্ন বলে কখন যে ওদের দেহ থেকে পোষাক খসে পড়ছে সে খেয়াল নেই কিন্তু রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে মাথায় শুধু একটি হ্যাট থাকলেই যথেষ্ট। কিছু কিছু মেয়েও পোষাকের বাহুল্য কমিয়ে ফেলছে। বৃদ্ধের ভয় হলো তাহলে মেয়েরা যেহেতু হ্যাট পড়ে না, এক সময় ওরা কি পুরোপুরি দিগম্বরই হয়ে যাবে?
বৃদ্ধ তখন কাবুলী তরুণকে প্রশ্ন করলেন তোমরা তো পরাধীন নও, তবে তুমি কেন পোষাক ত্যাগ করছো? উত্তরে সে জানালো তার দেশটি আবর্জনায় ভরে গেছে। ‘পাগড়ী ও প্রকাণ্ড কাবুলী পায়জামা, আর চুল দাঁড়ি – এসব নিয়ে কাজ করতে গেলে কাদার ছিটায় (চুল, দাঁড়ি, পাগড়ী, পায়জামা) সব বিদিকিচ্ছি হয়ে যাবে যে! তাই কেবল হ্যাট ছাড়া দেশে আর কোনো আবরণই থাকবে না’।
বৃদ্ধ অনুধাবন করলেন যে তরুণরা যে পথে হাঁটছে তা সম্মুখপানের না হয়ে এক পশ্চাতমুখী যাত্রা। বর্তমান সভ্য মানুষের কাপড় পড়া ছেড়ে দেয়া মানে অতীতের গুহাবাসী জীবনে ফিরে যাওয়া।
সর্বকালেই সব দেশে এক শ্রেণির যুবকের দেখা পাওয়া যায় যারা অগ্রগতির নামে সমাজের কঠিন বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করতে চায়। নব্বইয়ের দশকে আমেরিকার স্কুলগামী ছেলেরা প্যান্টের কোমর অংশটি ঢিলা করে নিতম্বে নামিতে আনতো। স্বাধীনতার পরপর বাংলাদেশে একশ্রেণির যুবক মদ ও গাঁজার আশক্তিকে আধুনিকতা ও অগ্রগতি বলে বিবেচনা করতো। কিন্তু দুই দেশের অধিকাংশ লোক, বিশেষ করে বয়স্করা এই প্রবণতাকে ভালো চোখে দেখতেন না। স্থুলভাবে দেখতে গেলে ‘উন্নতির পথে’ গল্পটি তৎকালীন যুবসমাজের তেমন কোনো আচরণকে উদ্দেশ্য করেই লেখা হয়ে থাকতে পারে।
কিন্তু সূক্ষ্ম বিচারে এই গল্পটি ব্যাঙ্গ ও হাস্যরসের হলেও পোষাক পরিচ্ছদ ত্যাগ করার বিষয়টি রূপকধর্মী বলেই যুক্তিযুক্ত মনে হয়। ১৯২০র দশকে ভারতবর্ষে যুবকদের মাঝে ইংরেজ বিতারণের আন্দোলন পুরোদমে যেমন চলছিল, এদেশে পশ্চিমা সভ্যতা-প্রীতির নজিরও কম ছিল না। কিন্তু অসম্ভব বেগের দ্রুতগামী বিমানের আরোহীদের মাঝে বৃদ্ধ শুধুমাত্র ইরানী, তুরানী, তুর্কী, আলবেনিয়ান, ইরাকি, ও কাবুলী, এবং অন্যান্য যুবকদের দেখা পেয়েছিলেন। মনে রাখা প্রয়োজন যে তখন আলবেনিয়া এবং ইরাক তুর্কী সাম্রাজ্যের অধীনস্ত ছিল। লেখক কোনো ভারতীয়, খৃষ্টান-ইউরোপীয় অথবা এশিয়ার অন্য কোনো দেশের যুবকের কথা উল্লেখ করেননি।
এ থেকে ধরে নেয়া যায় স্বকীয়তা ছেড়ে তুরস্ক এবং আফগানিস্তানের মুসলমানদের পশ্চিমা সভ্যতা-প্রীতিকে ব্যাঙ্গ করেই এই হাস্যরসটি রচিত হয়েছিল। স্মর্তব্য যে আধুনিক বিশ্বে উত্তরণের উদ্দেশ্যে ১৯২১ সালে ক্ষমতারোহন করা মুস্তফা কামাল পাশা এবং ১৯১৯ সাল থেকে বাদশাহ আমানুল্লাহ খান যথাক্রমে তুরস্ক (তুরান) এবং আফগানিস্তানে সমাজ সংস্কারের ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। পাঠক লক্ষ করুন উল্লিখিত দুই নেতা ১৯১৯-৩৮ সাল পর্যন্ত তাঁদের সংস্কার কাজ চালানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। আর ‘উন্নতির পথে’ গল্পটি লেখা হয়েছিল ১৯২৮ সালে।
মুস্তফা কামাল ৪২ বৎসর বয়সে তুরস্কের প্রেসিডেণ্ট পদটি অধিকার করলেও মাত্র ১৮ বছর বয়সে ‘ইয়ং টার্ক’ দলের যোদ্ধা হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন। আমানুল্লাহ খান মাত্র ২৭ বৎসর বয়সে আফগানিস্তানের নেতা হয়েছিলেন। সম্ভবত: তাঁদের অল্প বয়সকে গল্পে যুবকদের প্রতিভূ বলে দেখানো হয়েছে, এবং এই কারণেই গল্পের ৮০ বছরের বৃদ্ধ ‘ক্রুসেন্ট সল্ট’ খেয়ে ১৮ বছরের যুবকে পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন। দেশ দুটিতে পশ্চিমের শিক্ষা ও বিজ্ঞান আয়ত্ব করার মানসে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছিল, এমনকি আরবি হরফের বদলে তুরস্কের লিখিত ভাষা ইংরেজি হরফে লেখার প্রচলন হয়েছিল। সেসব দেশে মুসলমানের প্রচলিত পোষাকের বদলে ইউরোপীয় শার্ট-প্যান্ট-স্যুট-কোট এবং রুমি-টুপি পাগড়ির বদলে ইউরোপীয় হ্যাট পড়াকে এই গল্পে রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। তখন সমানাধিকারের নামে নারীর পোষাকেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছিল। এ দুটি দেশে সহস্রাধিক বছরের পুরনো মুসলিম সামাজিক সংস্কৃতিকে রাতারাতি পশ্চিমা সভ্যতায় রূপান্তরিত করার প্রয়াসকে এক অবাস্তব গতি সম্পন্ন বিমানের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
আমার এই ধারণার আরও একটি কারণ আছে। ‘উন্নতির পথে’ প্রকাশের (বাংলা ১৩৩৫, পৌষ) ঠিক আট মাস পরে, বাংলা ১৩৩৬ সালের ভাদ্র মাসে রোকেয়া সওগাত পত্রিকায় ‘বেগম তরজীর সাথে সাক্ষাৎ’ শিরোনামে একটি অনুবাদ (উর্দু থেকে) প্রবন্ধ৩ লেখেন। বেগম তরজী ছিলেন আফগানিস্তানের সিংহাসনচ্যুত বাদশাহ আমানুল্লাহ খানের শ্বাশুড়ী, যিনি কন্যা ও জামাতা ও পাঁচ নাতি-নাতনী সহ বোম্বের এক জাকজমকপূর্ণ হোটেলে অবস্থান করছিলেন। এই বেগম তজরী এবং তাঁর অতিশয় রূপবতী রাজকন্যাদের সবার মাথার চুলই মেমদের মতো ছোটো করে কাটা ছিল এবং তাঁদের পোষাকও ছিল পুরোপুরি ইউরোপীয় ধরনের। শুধু তাই নয়, সেই প্রবন্ধে বাদশাহ ও তাঁর স্ত্রী কর্তৃক আফগানিস্তানে উন্নতির জন্য অনেক কিছুর সাথে পাশ্চাত্যের ধারায় মহিলাদের পোষাক এবং স্ত্রীশিক্ষা প্রচলনের চেষ্টা করছিলেন। আফগানিস্তানের ধর্মীয় মোল্লারা তা মেনে নিতে পারেন নি। তদুপরি এই অনুবাদ প্রবন্ধ এবং ‘উন্নতির পথে’ প্রকাশের মধ্যবর্তী সময়ে রোকেয়া অন্য কিছু প্রকাশ করেছিলেন কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলা না গেলেও রচনা দুটি রোকেয়া রচনাবলী১ বইতে পরপর স্থান পেয়েছে।
অন্যদিকে স্মরণ করা যেতে পারে যে তুরস্কভিত্তিক অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের সূচনায় বিশ্বের, বিশেষ করে ভারতবর্ষের মুসলমানরা তাঁদের বিগত গৌরব পুণরুদ্ধারের জন্য নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিল। একদল খিলাফতের পক্ষে ছিল, আরেকদল পশ্চিমা শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে উন্নত হতে চাইছিল। গল্পের গানটিতে ‘কাছা’ এবং ‘কোচা’র ব্যবহার তাঁদের, অর্থাৎ ভারতীয়দের উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে বলে মনে হয়।
অন্তর্নিহিত কারণটি যাই হোক না কেন, লেখক সমাজকে পুরোপুরি প্রস্তুত না করে (অর্থাৎ অসম্ভব দ্রুতগতির যান বানিয়ে) দ্রুতগতিতে সমাজ পরিবর্তনের ধারণাটিকে সমর্থন করতে পারেননি। সেটি তিনি এই বলে প্রকাশ করেছেন যে এই দ্রুতগামী বিমান তাদেরকে অচিরেই গাছের ছাল-পরিহিত মুনিঋষিদের যুগ পেরিয়ে পরিচ্ছদহীন, সৃষ্টির প্রথম মানব-মানবীতে পরিণত করবে। এই উপলব্ধি নিয়ে তিনি সেই দ্রূতগামী বিমান থেকে নেমে পড়েন। লেখকের এই দৃষ্টিভংগী যে একেবারেই অমূলক ছিল না, তা বাদশাহ আমানুল্লাহর গদিচ্যুত হবার ঘটনা, এবং আজকের আফগানিস্তান ও তুরস্কের রাজনৈতিক-ধর্মীয়-সামাজিক অবস্থার দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
গল্পের শেষাংশ নিম্নরূপঃ ‘আমি কাকুতি করে বললুম, “দোহাই ভায়া তরুণ, আর না! আমি বুঝতে পেরেছিঃ তোমরা এখন আদি-মাতা হজরত হাবার যুগে এসে পড়বে। আদি-পিতা অভিশপ্ত হয়ে স্বর্গ থেকে বিতারিত হয়ে গাছের তিনটা পাতা চেয়ে নিয়ে – একটায় তহবন্দ, একটা দিয়ে জামা আর একটা দিয়ে মাথা ঢাকবার টুপী করেছিলেন। আর আদি-মাতা তার লম্বা চুল খুলে সমস্ত গা ঢেকেছিলেন। কিন্তু এখনকার তরুণীদের মাথায় তো চুলও নেই – এরা কি দিয়ে গা ঢাকবে?’
এখন দেখা যাক গল্পের বৈজ্ঞানিক উপাদানগুলো কী কী। লেখক জানাচ্ছেন যে যুবকদের বানানো বিমানটি ষাট হাজার মাইল গতিবেগের। পাঠক লক্ষ করুন বর্তমান পৃথিবীতে রকেটের গতি ১৭,০০০ মাইল হলেও যাত্রীবাহী নয়, শব্দের চেয়ে দ্রুতগামী কোনো কোনো যুদ্ধ বিমানের গতি ঘণ্টায় ১৫০০ মাইলের বেশি নয়! অর্থাৎ আজ থেকে ৯৪ বছর আগে ৬০,০০০ মাইল গতিবেগের বিমান বানানো একটি অসম্ভব ব্যাপার ছিল! কিন্তু কল্পনায় অনেক কিছুই করা সম্ভব। কল্পনার অসম্ভব বিজ্ঞানকেও লেখক সম্ভব করে তুলেছেন। বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক অধ্যাপক দীপেন ভট্টাচার্যের মতে ‘অনেক সময়ই গল্পে আমরা এমন সমস্ত প্রক্রিয়া বর্ণনা করি যা হয়তো ভবিষ্যতেও কখনো বাস্তবায়িত হবে না (যেমন আলোর গতিবেগের বেশিতে বা অন্য একটি মহাবিশ্বে ভ্রমণ), কিন্তু লেখক যদি সেই প্রক্রিয়ার জন্য যুক্তির ভিত্তিতে কোনো নীতি প্রণয়ন করেন তাহলে সেটি (বিজ্ঞানকে ভাঙলেও) বিজ্ঞান কল্পকাহিনি হিসেবে বিবেচ্য হতে পারে’৪। কাজেই ষাট হাজার মাইল গতিবেগের বিমান বানিয়ে বেগম রোকেয়া কল্পবিজ্ঞানের সংজ্ঞা থেকে দূরে সরে পড়েননি। কিন্তু গল্পটিকে এর মূল লক্ষ্যে, অর্থাৎ অতীতের দিকে সঞ্চারিত করতে পেরেছেন, যা নিচে আলোচনা করেছি।
গল্পে বিজ্ঞানের দ্বিতীয় উপাদানটি হচ্ছে পৃথিবীর আহ্নিক ও বার্ষিক ঘুর্ণন। উভয় ঘুর্ণনের ফলেই স্থুল অর্থে পৃথিবী তার আগের অবস্থানে ফিরে আসে, কিন্তু আমরা জানি দুটো গতিই ভবিষ্যতমুখী। দেহের পোষাক ত্যাগ করার কারণ জিজ্ঞেস করলে তুরানী তরুণের উত্তর ছিল, ‘এ কোথাকার ওল্ড ফুল!পৃথিবীটা যে চক্রাকার পথে ভ্রমণ করে – অর্থাৎ যেখান থেকে যাত্রা করেছে, ঘুরে আবার সেইখানে পৌছাব – এ তাও জানে না! এখানে এক অর্থে পৃথিবীর ভবিষ্যতের দিকে ঘুর্ণনের কথা যেমন বলা হয়েছে, অন্য অর্থে মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ফিরে পাবার চেষ্টাও ধরে নেয়া যেতে পারে। তুরানী তরুণের ‘যেখান থেকে যাত্রা করেছে, ঘুরে আবার সেইখানে পৌছাব’ উত্তরটি সেই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছিল বলেই ধরে নেওয়া যায়। গল্পের পটভূমি এবং এই উক্তির তাৎপর্য বিশ্লেষ করলে দেখা যায় লুপ্ত গৌরব ফিরে পাবার জন্য যে পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে, তাতে পেছনে ফিরে যাওয়া সম্ভব হলেও অগ্রগতি নিশ্চয়ই হবে না। ফলে এই গল্পের বৃদ্ধ অতিরিক্ত গতিশীল এই বিমানটি যাত্রীদের প্রাগৈতিহাসিক যুগে নিয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখতে পেলেন।
গল্পের তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাল্পনিক বৈজ্ঞানিক উপাদানটি হচ্ছে নিজ অক্ষে পৃথিবীর ঘুর্ণনের গতি এবং যুবকদের বানানো এরোপ্লেন বা বিমানের গতির তুলনা। বৃদ্ধ নিজ জবানীতে বলছেন,‘আমি বললুম, “ভায়া! পৃথিবীর গতি ঘণ্টায় ৭২০ মাইল, আর তোমার এরোপ্লেনের গতি ৬০,০০০ মাইল?” বর্তমান জ্ঞানে আমরা জানি পৃথিবীর দৈনিক বা আহ্নিক ঘুর্ণনের গতি ঘণ্টায় প্রায় ১০০০ মাইল। ধারণা করি আজ থেকে ৯০-১০০ বছর আগে বিজ্ঞানীরা এই গতিকে ঘণ্টায় ৭২০ মাইল বলে ভাবতেন। তা রোকেয়া কোন বিবেচনায় তরুণদের বিমানের গতিকে ৬০,০০০ মাইল বলে সাব্যস্ত করেছিলেন?
রোকেয়া বা বৃদ্ধ ভয় পাচ্ছিলেন যে বিমানটি শীঘ্রই আদম-হাওয়ার যুগে ফিরে যাবে। আদম ও হাওয়ার ধারণাটি ঈহুদী-খৃষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল থেকে পাওয়া। সেই বাইবেলের তথ্য থেকেই মনে করা হয় আদম ও হাওয়া স্বর্গ থেকে ৬০০০ (ছয় হাজার) বছর আগে বিবস্ত্র অবস্থায় পৃথিবীতে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। বিজ্ঞান এবং কল্পবিজ্ঞানের যে কোনো ছাত্রেরই টাইম-ট্র্যাভেল বা সময়কে অতিক্রম করে ভ্রমণ করার ধারণার সাথে নিশ্চয়ই পরিচয় আছে। কাল্পনিক দ্রুতগামী যানবাহনে চড়ে এইচ জি ওয়েলস সহ পাশ্চাত্যের অনেক লেখকই আমাদের অতীতে বা ভবিষ্যতের পৃথিবীতে নিয়ে গেছেন। এগুলোর মধ্যে গেল শতাব্দীর ‘ব্যাক টু দ্যা ফিউচার’নামের ইংরেজি সিনেমাটির উদাহরণ টানা যেতে পারে। এসব গল্পের কোনোটি কিছুটা পুরোপুরি কাল্পনিক আবার কোনোটি কিছুটা বিজ্ঞাননির্ভর।
পৃথিবীর নিজস্ব গতিকে বর্তমান ধরলে অতীত বা ভবিষ্যৎ ভ্রমণের জন্য যে যানটির প্রয়োজন হবে তার গতি পৃথিবীর গতি থেকে অবশ্যই বেশি হতে হবে। ছয় হাজার বছর পূর্বের আদম-হাওয়ার যুগে ফিরে যেতে রোকেয়া যদি পৃথিবীর গতি থেকে অনেক অনেক বেশি, ষাট হাজার মাইল গতিবেগের বায়ুযানের চিন্তা করে থাকেন তবে তাকে অঙ্ক বা বিজ্ঞান-নির্ভর বলেই ধরে নিতে হবে। আমার মতে গল্পটির বিজ্ঞানভিত্তিক সার্থকতা বাড়তো যদি গল্পটিতে উল্লেখ থাকতো যে বিমানটি পৃথিবীর গতির উলটো, অর্থাৎ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘুরছিল। তবে এই হিসাবের প্রধান দুর্বলতাটি হচ্ছে পৃথিবীর বার্ষিক গতি ৬৭,০০০ (সাতষট্টি হাজার) মাইল। আমরা এও জানি যে অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় রোকেয়া অংকে কাঁচা ছিলেন। মৃত্যুর পাঁচ বছর পরে প্রকাশিত রোকেয়া-জীবনী থেকে আমরা জানতে পারি ‘গণিত লইয়াই তাঁহার মুশকিল হইত সবচেয়ে বেশি’ ৫। সেই অভাব পূরণ করতে কলকাতায় শাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠার পর সেটি পরিচালনা করার সময় তিনি এক অংকের শিক্ষকের নিকট পাঠ গ্রহণ করতেন।
গল্পটির বিশেষত্ব এই যে, একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলনকে সামাজিক বাস্তবতার আলোকে ব্যাঙ্গ বা সমালোচনা করা হয়েছে। আর তা করা হয়েছে রূপকের আশ্রয়ে, কাল্পনিক বিজ্ঞানের মাধ্যমে সুখপাঠ্য এক হাস্যরসের সৃষ্টি করে।
বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কল্পকাহিনীতে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করা হয়েছে অনেক মাত্রা বা ডাইমেনসনে৬, বিজ্ঞানের উপকারকে কাজে লাগিয়ে। অপরপক্ষে ‘উন্নতির পথে’ কল্পকাহিনীতে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করা হয়েছে সীমিতভাবে, এক সম্ভাব্য অপকারিতাকে সামনে রেখে।
তথ্যপঞ্জী
১। উন্নতির পথে, আবদুল কাদির সম্পাদিত রোকেয়া-রচনাবলী, দ্বিতীয় সংস্করণ দ্বিতীয় মুদ্রণ, ২০১৫, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, বাংলাদেশ Rokeya Rachanabali : Kadir, Abdul Ed. : Free Download, Borrow, and Streaming : Internet Archive পৃ ২৩৬ ও ৫৫৭, পিডিএফ পৃ ২৫৮ ও ৫৭৯)। ২০২১ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে সর্বশেষ পঠিত বা নামান (ডাউনলোড)।
২। বেগম রোকেয়া: সময় ও সাহিত্য, পৃ ৮৮, মোরশেদ শফিউল হাসান, ১৯৮২ মওলা ব্রাদার্স, ঢাকা।
৩। বেগম তরজীর সাথে সাক্ষাৎ, আবদুল কাদির সম্পাদিত রোকেয়া-রচনাবলী, দ্বিতীয় সংস্করণ দ্বিতীয় মুদ্রণ, ২০১৫, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, বাংলাদেশ Rokeya Rachanabali : Kadir, Abdul Ed. : Free Download, Borrow, and Streaming : Internet Archive পৃ ২৩৮, পিডিএফ পৃ ২৬০)। ২০২১ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে সর্বশেষ পঠিত বা নামান (ডাউনলোড)।
৪। লেখকের সাথে অধ্যাপক দীপেন ভট্টাচার্যের ব্যক্তিগত পত্রালাপ, ১১ই ডিসেম্বর, ২০২১
৫। রোকেয়া-জীবনী, পৃ ৪৫, শামসুন নাহার (১৯৩৭), বুলবুল পাবলিশিং হাউজ, কলিকাতা
৬। বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ একটি আদর্শ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, আশরাফ আহমেদ (২০২২), বিডিনিউজ২৪ডটকম এর আর্টস বিভাগ ১১ই জানুয়ারি, ২০২২ https://bangla.bdnews24.com/arts/archives/35478