পাখিদের বিচরণের শেষ স্থানগুলো নির্বিচার দখলে বিরত থাকতে হবে

প্রখ্যাত পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হকের একান্ত সাক্ষাৎকার

হাসান হাফিজহাসান হাফিজ
Published : 17 Sept 2022, 02:49 PM
Updated : 17 Sept 2022, 02:49 PM

হাসান হাফিজ:  বার্ড ওয়াচিং ক্লাব এখন দেশে কতগুলো? এসবের প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও কর্মকাণ্ড, প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে কিছু বলুন।

ইনাম আল হক:   পাখির প্রতি আকর্ষণ ও কৌতূহল বাড়ছে দেশের মানুষের। খুব দ্রুত বাড়ছে পাখির আলোকচিত্র তোলায় আগ্রহী মানুষের সংখ্যা। পশুপাখিতে আগ্রহী তরুণদের ছোট ছোট সংগঠনও গড়ে উঠছে। এখনই সময় ক্রমবর্ধমান এই সামাজিক শক্তিকে প্রকৃতি সংরক্ষণের কাজে লাগানোর। 

হাসান হাফিজ:  বাংলাদেশের হেন কোনো পাখি নেই, যেটির সম্বন্ধে আপনি লেখেননি ও তার ছবি তোলেননি। ছবি তুলতে গিয়ে অনেক সময় দীর্ঘ প্রতীক্ষা করতে হয়, ঝুঁকি নিতে হয়। বিপদও ঘটে। এরকম কোনো ভয়াবহ বিপজ্জনক অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অনুগ্রহ করে বলুন। 

ইনাম আল হক:   পাখি দেখতে গিয়ে জীবনে যা ঘটেছে, তার মধ্যে সব চেয়ে স্মরণীয় হলো একটি বাঘের সামনে দাঁড়ানোর ঘটনা। ইন্ডিয়ার করবেট জাতীয় উদ্যানে তা ঘটেছিল ২০১৩ সালে। বনের এক পাশ থেকে বেরিয়ে একটা বাঘ আমাদের সামনেই পথ পার হয়ে অন্য পাশে গেল। দু’টি কারণে ঘটনাটি স্মরণীয়। এক মানুষ-খেকো বলে খ্যাত বাঘকে তার নিজ আবাসে দেখলাম। দুই, যাওয়ার সময় মুখ খিঁচিয়ে আমাদের ভয় দেখালেও বাঘটি একদল নিরস্ত্র মানুষ দেখে যে কত ভয় পেয়েছে, তা বুঝতে পারলাম।  

হাসান হাফিজ:  বাংলাদেশের কোন্ কোন্ জেলায় পাখির সংখ্যা ও প্রজাতি সবচেয়ে বেশি এবং কম?  ইনাম আল হক:   পাখি আছে যেখানে পাখির আবাস আছে। সুন্দরবন আছে বলে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় পাখির সংখ্যা ও প্রজাতি-বৈচিত্র্য বেশি। হাওড়-বিল আছে বলে সিলেট বিভাগের কয়েকটি জেলায় কিছু পাখি আছে। যৎসামান্য পাহাড়ি-বন আছে বলে পার্বত্য-জেলাগুলো আজও পাখিসমৃদ্ধ। নদীর মোহনা ও উপকূলীয় কাদাচর আছে বলে বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কয়েকটি জেলায় পাখি টিকে রয়েছে। পদ্মা ও যমুনা নদীর বিরান চর আছে বলে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগেও কিছু পাখি পাবেন।      

হাসান হাফিজ: পাখির প্রতি কীভাবে কখন আকৃষ্ট হলেন?     

ইনাম আল হক: বিস্মৃত বাল্যকালে পাখির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম; বলতে পারিনে কী করে। একটি চড়ুইছানা নিয়ে সারাদিন বসে রয়েছি - এটাই আমার আদিতম বাল্যস্মৃতি। মা বলেছেন, এক প্রতিবেশী দিয়েছিলেন সেই চড়ুইছানা, যখন আমার বয়েস চার বছর। গ্রামের স্কুলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় ঘুঘু, ডাহুক, বক, পানকৌড়ি, চিল, শকুন, ঈগল, শিকরে, মাছরাঙা, কাঠঠোকরা ও টিয়া পাখি চিনতে শিখেছিলাম। তৃতীয় শ্রেণি থেকে শহরের স্কুলে লেখাপড়া করলেও গ্রামের বাড়িতে আমার যাতায়াত ছিল। গ্রামের অনেকেই চিনতেন হরিয়াল, কোকিল, প্যাঁচা, হুদহুদ, বেনেবউ, ফিঙে, শাবুলবুলি, হাঁড়িচাচা, শালিক, বুলবুল, দোয়েল ও বাবুই পাখি। ছোট্ট ছেলেরা চিনত আরও বেশি--  সুইচোরা, বসন্ত, ফটিকজল, টুনটুনি, হরবোলা, মৌটুসি, ফুলঝুরি, মুনিয়া, খঞ্জন ও তুলিকার মতো বড়দের উপেক্ষিত অনেক পাখি। গাঁয়ের কিশোরদের কাছে আমি পাখি চেনার অনেক তালিকা পেয়েছি।        

হাসান হাফিজ:  বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে পাখির জন্য দরদ, মমতা কী বাড়ছে? উত্তর যদি ইতিবাচক হয়, তবে সেটা কতটা সন্তোষজনক?    

ইনাম আল হক:  পাখির প্রতি আকর্ষণ ও দরদ অনেক বেড়েছে আমাদের। দেশের অধিকাংশ লোক বুনোপাখিকে এখন পরিবেশের অনুষঙ্গ হিসেবে দেখেন, খাদ্য হিসেবে নয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শিক্ষা সম্প্রসারণের সাথে এর একটা সম্পর্ক আছে; মিডিয়াও খুব বড় ভুমিকা রেখেছে।        

হাসান হাফিজ:  বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে বিপন্ন প্রজাতির পাখি কোনগুলো?         

ইনাম আল হক:  এদেশের অনেক পাখি এখন বিপন্ন। বন বিভাগ ও আই.ইউ.সি.এন ২০১৫-১৬ সালে পাখির সমীক্ষা ও মূল্যায়ন করেছে। এই সমীক্ষায় বলেছে, দেশে বিপদাপন্ন পাখি প্রজাতির সংখ্যা ৬৮। দশ প্রজাতির পাখি মহাবিপন্ন হয়ে গেছে। এর মধ্যে সবার চেনা মহাবিপন্ন পাখি  হলো শকুন। পঞ্চাশ বছর আগে এদেশে লক্ষ লক্ষ বাংলা-শকুন ছিল; এখন আছে আড়াই শত। বন বিভাগ, আই.ইউ.সি.এন ও আন্তর্জাতিক নজরদারি না থাকলে এই সংখ্যা শূন্য হয়ে যাবে।   

হাসান হাফিজ:  এগুলোকে রক্ষা করার জন্য সরকার ও জনগণের কী কী করণীয় রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

ইনাম আল হক:  বাংলাদেশে পাখির অবস্থা শোচনীয়। পাখির বিচরণভূমি সবই আমরা দখল করে ফেলছি। কাক, চিল ও শালিকের মতো কয়েক প্রজাতির বর্জ্যভুক পাখি ছাড়া আর সব পাখির সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে। পাখি রক্ষার জন্য সরকারকে শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ পাখি অঞ্চল (আই.বি.এ) হিসেবে তালিকাভুক্ত যে সব এলাকা আজও অরক্ষিত ফেলে রাখা হয়েছে, তা সংরক্ষণ করতে হবে। পাখির পক্ষে সুশীল সমাজ ও মিডিয়ার জোরালো সমর্থন আছে। কিন্তু কাজগুলো সরকারি আমলাদেরই করতে হবে।

হাসান হাফিজ:  বিপদাপন্ন পাখিদের সংরক্ষণ করার ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা ও উদ্যোগ কী যথেষ্ট? জনসাধারণের ভূমিকাই বা কী হওয়া বাঞ্ছনীয়?   

ইনাম আল হক:   জনসাধারণ ও সরকার উভয়েরই যা করতে হবে, তা হলো দেশে পাখির শেষ বিচরণস্থানগুলো নির্বিচারে দখল করা থেকে বিরত থাকা। বন, বাদা, বিল, পাহাড়, ঘাসের প্রান্তর, নদীর চর, এই সব হলো পাখির এলাকা। ও সব স্থানে আগে আমরা সম্পদ আহরণের জন্য সাময়িকভাবে গেলেও স্থায়ীভাবে দখল করিনি। এখন আমরা সবই দখল করছি, ওগুলোর চেহারা বদলে ফেলছি অথবা ভয়ঙ্করভাবে দূষিত করছি। সেই আবাসহারা পাখিরাই তো বিপদাপন্ন।    

হাসান হাফিজ:  বার্ড ওয়াচিং ক্লাব এখন দেশে কতগুলো? এসবের প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও কর্মকাণ্ড, প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে কিছু বলুন।

ইনাম আল হক:   পাখির প্রতি আকর্ষণ ও কৌতূহল বাড়ছে দেশের মানুষের। খুব দ্রুত বাড়ছে পাখির আলোকচিত্র তোলায় আগ্রহী মানুষের সংখ্যা। পশুপাখিতে আগ্রহী তরুণদের ছোট ছোট সংগঠনও গড়ে উঠছে। এখনই সময় ক্রমবর্ধমান এই সামাজিক শক্তিকে প্রকৃতি সংরক্ষণের কাজে লাগানোর। 

হাসান হাফিজ:  বাংলাদেশের হেন কোনো পাখি নেই, যেটির সম্বন্ধে আপনি লেখেননি ও তার ছবি তোলেননি। ছবি তুলতে গিয়ে অনেক সময় দীর্ঘ প্রতীক্ষা করতে হয়, ঝুঁকি নিতে হয়। বিপদও ঘটে। এরকম কোনো ভয়াবহ বিপজ্জনক অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অনুগ্রহ করে বলুন। 

ইনাম আল হক:   পাখি দেখতে গিয়ে জীবনে যা ঘটেছে, তার মধ্যে সব চেয়ে স্মরণীয় হলো একটি বাঘের সামনে দাঁড়ানোর ঘটনা। ইন্ডিয়ার করবেট জাতীয় উদ্যানে তা ঘটেছিল ২০১৩ সালে। বনের এক পাশ থেকে বেরিয়ে একটা বাঘ আমাদের সামনেই পথ পার হয়ে অন্য পাশে গেল। দু’টি কারণে ঘটনাটি স্মরণীয়। এক মানুষ-খেকো বলে খ্যাত বাঘকে তার নিজ আবাসে দেখলাম। দুই, যাওয়ার সময় মুখ খিঁচিয়ে আমাদের ভয় দেখালেও বাঘটি একদল নিরস্ত্র মানুষ দেখে যে কত ভয় পেয়েছে, তা বুঝতে পারলাম।  

হাসান হাফিজ:  আপনার লেখা পাখিবিষয়ক বইগুলোর বিষয়ে জানতে চাই।       

ইনাম আল হক:   সাধারণ পাঠকের জন্য দু’টি বই আছে। একটি বাংলা-- ‘পাখিদেরও আছে নাকি মন’। অন্যটি ইংরেজি - ‘ফেদার্ড স্প্লেন্ডর্স বার্ডস অব বাংলাদেশ’। দেশের পাখি-দর্শকরা একটি বই প্রায়ই ব্যবহার করেন - ‘বাংলাদেশের পাখির ফিল্ডগাইড’। কিশোরপাঠ্য কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে: ‘রূপসী বাংলার পাখি’, ‘বেঙ্গমা-বেঙ্গমীর মতো কত পাখি’, ‘পাখিদের সুখদুখের কথা’ ইত্যাদি। 

হাসান হাফিজ:  আপনি বলে থাকেন যে, বাংলাদেশে কিছু স্পেশাল পাখি আছে, যা অন্য কোনো দেশে নেই। সেগুলো সম্পর্কে পাঠকদের যদি মোটামুটি একটু ধারণা দেন।      

ইনাম আল হক:   বাংলাদেশের বিশিষ্ট পাখি হলো কালামুখ-প্যারাপাখি, দেশি-গাঙচষা, পালাসি-কুরাঈগল, চামচঠুঁটো-বাটান, প্যারা-শুমচা, শতদাগি-ঘাসপাখি, লালগলা-ফিদ্দা, বাংলা-শকুন, বড়-মেটেকুড়ালি, বাংলা-রাঙাচ্যাগা ইত্যাদি। এই পাখিগুলো খুব অল্প কয়েকটি দেশে টিকে আছে। তবে অধিকাংশ দেশে, বিশেষ করে শ্রীলঙ্কা, তাইওয়ান, ম্যাদাগাস্কার ইত্যাদি দ্বীপে সে-দেশের অনেক অনেক এনডেমিক বা বিশিষ্ট পাখি আছে।

হাসান হাফিজ:  ঢাকার মিরপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানায় পাখি সংরক্ষণ, প্রদর্শনের ব্যাপারে আপনার পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন কি?

ইনাম আল হক:   মানুষের বিনোদনের জন্য বন্যপ্রাণী খাঁচায় রাখা এখন আর গ্রহণযোগ্য নয়। বিনোদন নয়, বন্যপ্রাণী সম্পর্কিত শিক্ষা, গবেষণা, প্রজনন ও চিকিৎসার জন্য এখন চিড়িয়াখানা ব্যবহৃত হয়। আমাদের জাতীয় ও অন্যান্য চিড়িয়াখানা ও সাফারিপার্ককে সেই লক্ষ্য সামনে রেখে এগোতে হবে। 

হাসান হাফিজ:  বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত জ্ঞানকোষ-এর পাখি বিষয়ক খণ্ড রচনা ও সম্পাদনায় আপনি যুক্ত ছিলেন। সে অভিজ্ঞতার কথা জানতে কৌতূহল হয়।

ইনাম আল হক:   পাখির কয়েকটি বিশাল বইয়ের কাজে সম্পৃক্ত থাকার সুযোগ পেয়েছি বলে আমি কৃতার্থ। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত তিনটি বই: ‘বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ (খণ্ড ২৬)’; ‘এনসাইক্লোপেডিয়া অভ ফ্লোরা অ্যান্ড ফনা অভ বাংলাদেশ (ভ্লুম ২৬)’  ও ‘এনভারনমেণ্ট অভ ক্যাপিটাল ঢাকা’ ইত্যাদি। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল বন বিভাগ ও  আই.ইউ.সি.এন প্রকাশিত একটি বই: ‘রেড লিস্ট অভ বাংলাদেশ - ভল্যুম ৩’। বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান কাজ। 

হাসান হাফিজ:  এই উপমহাদেশের আপনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি দুর্গম এ্যান্টার্কটিকায় গেছেন। সেখানকার প্রচুর ছবি তুলেছেন। সেগুলোর প্রদর্শনীও আমরা দেখেছি সত্তরের দশকে, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে। সে সম্পর্কে পাঠকদের  কিছু বলুন।

ইনাম আল হক:   অ্যান্টার্কটিকা, উত্তর-মেরু, হিমালয়-পর্বত, ম্যাডাগাস্কার ইত্যাদি অসাধারণ কিছু স্থান দেখার ভাগ্য হয়েছে। নানা স্থানে চিত্র-প্রদর্শনীও করেছি। সেসব কথা না বলে আপনার পাঠকদেরকে অমন অনন্য স্থানে ভ্রমণের সংকল্প করতে বলছি। 

হাসান হাফিজ:  দোয়েল কেন বাংলাদেশের জাতীয় পাখি হিসেবে নির্বাচিত হলো? এর পেছনে কী কী কারণ ও যৌক্তিকতা ছিল বলে আপনার মনে হয়?

ইনাম আল হক:   দোয়েল, শালিক, বুলবুল, টিয়া ইত্যাদি অনেক পাখিই বাংলাদেশের জাতীয় পাখি হতে পারত। সুন্দর, সুরেলা, সর্বোতগামী ও জনপ্রিয় পাখি হিসেবে দোয়েলের নির্বাচন ভালোই হয়েছে। তবে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই জাতীয় পাখি বলে কিছু নেই; এবং কোনো জাতীয় পাখিই সবার কাছে সমানভাবে প্রিয় নয়। 

হাসান হাফিজ:  পাখি বিষয়ক বড় ধরনের কাজের কোনো পরিকল্পনা আপনার রয়েছে কি? থেকে থাকলে সে ব্যাপারে বিস্তারিত বলবেন।

ইনাম আল হক:   আমার ইচ্ছে বাংলাদেশের ৭০০ প্রজাতির পাখির চামড়ার একটি জাতীয় সংগ্রহশালা হোক, যেমনটা অনেক দেশেই আছে। গবেষণার কাজেই এ সংগ্রহশালাটি প্রয়োজন। প্রাচীন কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও জাদুঘরে বিক্ষিপ্তভাবে পাখির কিছু চামড়া আছে। কিন্ত বাংলাদেশে পাখির ৭০০ প্রজাতি ও ততোধিক উপপ্রজাতির চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের কোনো উদ্যোগ নেই। আগের দিনে পাখি মেরে চামড়া সংগ্রহ করা হতো বলে কাজটা সহজ ছিল। এখন তা করা যায় না। এখন মৃত পাখি সংগ্রহ করে চামড়া সংরক্ষণ করতে হয়। এতে সময় ও অর্থ বেশি লাগে। তা হোক; কাজটা আমাদের শুরু করতে হবে।

হাসান হাফিজ:  বর্তমান বাংলাদেশ পাখির জন্য কতটা নিরাপদ?       

ইনাম আল হক:   এই ছোট্ট দেশে আমরা অনেক মানুষ বাস করি; পাখির বসবাসের জায়গা নেই। ঘুঘু, বক, পানকৌড়ি, শামখোল, চিল, বাতাসি, বসন্ত,  লাটোরা, সুইচোরা, টিয়া, কাক, শালিক, দোয়েল, চড়ুই ও মৌটুসির মতো মাত্র ১০০ প্রজাতির পাখি এখনও এদেশে ভালোই আছে। লোকালয়ে বাঁচতে জানে বলেই এরা টিকে আছে। বাকি ৬০০ প্রজাতির পাখি লোকালয় এড়িয়ে চলে। এদের অবস্থা খারাপ। সুন্দরবন ছাড়া প্রায় পুরো দেশই তো একটা বিশাল জনপদ। সুন্দরবন এখন ৩০০ প্রজাতির পাখির শেষ আশ্রয়স্থল। আমাদের শালবন, পাহাড়ি-বন, হাওড় আর উপকূলীয় চরাঞ্চলে মানুষের বসতি, চাষবাস ও ব্যবসাবাণিজ্য সম্প্রসারিত হচ্ছে। ওখানে পাখির ভবিষ্যৎ অন্ধকার।   

হাসান হাফিজ:  পাখি বাঁচানো ও শিকারিদের নিবৃত্ত রাখার ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন ও তার প্রয়োগ পরিস্থিতিটা আসলে কেমন? পাখি বিশারদ হিসেবে ব্যাপারটি আপনি কীভাবে দেখেন?

ইনাম আল হক:   বাংলাদেশে পাখি শিকার খুবই কম হয়; এবং তা আরও কমছে। শিকারের শখটা ইউরোপ-আমেরিকার মতো এদেশে প্রসার লাভ করেনি। অধিকাংশ বাঙালি পাখি-শিকার পছন্দ করে না। শিকারের বিরুদ্ধে দেশের আইনও অত্যন্ত কঠোর। শিকার নয়; পাখির বিচরণ ও প্রজননের স্থানাভাবটাই বড় সমস্যা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি জমির ওপর চাপ বেড়ে যাওয়াটাই পাখি উৎখাত হওয়ার প্রধান কারণ। যে সব বন, বাদা, বিল, চর আর ঘাসের প্রান্তরে পাখি বাস করত, তা সবই আমরা দখল করছি। এভাবেই আমরা পাখি শেষ করছি; শিকার করে নয়।  

হাসান হাফিজ:  শিশুদের মধ্যে পাখির জন্য ভালোবাসা, দরদ, মায়া-মমতার বোধ সৃষ্টি করা  ও তা লালনের জন্য কী কী করা বাঞ্ছনীয়?       

ইনাম আল হক:   পাখির জন্য ভালোবাসা শিশুদের সহজাত। কৈশোরে ও যৌবনে গিয়ে সেটা অনেকের জীবনে চাপা পড়ে যায়। তখন অনেকে বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে নির্দয়তার পাঠ গ্রহণ করে। কালক্রমে তাদের কেউ কেউ শিকারের উত্তেজনা ও বাহাদুরিতে আনন্দ খুঁজে পায়। শৈশবের পাখিপ্রেমের ওই বিকৃত রূপই তখন তাদের আকর্ষণ করে বিপুল শক্তি দিয়ে। ভালোবাসতে গেলে পাখিকে ঘরে কিংবা আঙিনায় আনতে হবে বলে মনে করে কেউ কেউ। পাখির প্রতি ভালোবাসার সাথে নিজেকে জাহির করার স্বাভাবিক আগ্রহ মিশে গিয়ে তাদের মধ্যে গজিয়ে ওঠে দামী-পাখি পোষার শখ। শৈশব ও কৈশোরে প্রকৃতির মাঝে গিয়ে মুক্ত পশুপাখি দেখে উপভোগ, শিক্ষালাভ ও বড়াই করার সুযোগ থাকলে এসব বিকৃতি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। পিতামাতা ও শিক্ষকদের কাছে এই সব কথা প্রচারের দায়টা আমাদেরই।  

হাসান হাফিজ:  বাংলাদেশী তরুণ-তরুণীদের পর্বতারোহণে অনুপ্রাণিত করার ক্ষেত্রে আপনি অনেকদিন ধরে ব্যাপক ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন। এ ব্যাপারে জড়িত হওয়ার কারণ ও অভিজ্ঞতাটা কেমন?

ইনাম আল হক:   সামরিক বাহিনীতে প্রশিক্ষণকালে হিমালয়ের বরফআবৃত পর্বতে চলার প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার। তারপর পাখি দেখতে গিয়ে বাংলাদেশের পাহাড়ে চলার অনেক সুযোগ হলো। অনেক তরুণ-তরুণী আমাদের সাথে যোগ দিলেন। হিমালয় অভিযানে যাব বলে সংকল্প করলাম এবং সাত জনের একটি দল নিয়ে এভারেস্ট বেইসক্যাম্পে গেলাম ২০০৪ সালে। সেই দলের কেউ কেউ পরে এভারেস্ট চূড়া আরোহণ করলেন। একটা ছোট উদ্যোগ থেকে আট বছরের মধ্যে অত বড় সাফল্য ছিল আশাতীত।  

হাসান হাফিজ:  আপনি বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর উচ্চ পদে (উইং কমান্ডার) কাজ করেছেন। বিমান উড্ডয়ন ও  প্রকৌশল বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় ব্যাপৃত আছেন। এগুলো আপনার পাখিচর্চা করার ক্ষেত্রে কতটা সহায়ক হয়েছে?  

ইনাম আল হক:   বাল্যকাল থেকে পাখির প্রতি আকৃষ্ট ছিলাম বলে বিমানবাহিনীতে গিয়েছিলাম; নইলে সেনাবাহিনীতে যেতাম। বিমানবাহিনী থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছি। ইতোমধ্যে সেনা কল্যাণ সংস্থার পরিচালক ছিলাম পাঁচ বছর। বাহিনী থেকে অবসর নিয়ে ব্র্যাক-এর মতো জনহিতকর প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি দেড় বছর। তারপর আট বছর একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক ছিলাম। কোথাও আমার পাখিচর্চায় কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়নি।   

হাসান হাফিজ:  বলা হয়, বাংলাদেশে আজকাল অতিথি পাখি খুব কম আসে। এই অভিযোগ সত্যি হয়ে থাকলে এর কারণ কী? এ সমস্যা সমাধানের উপায় কী কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

ইনাম আল হক:   বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখি যে কম আসছে, তার প্রধান কারণ হলো এশিয়া মহাদেশেই পরিযায়ী পাখি কমে গেছে। গত চার দশকে চীনসহ এশিয়ার অনেক দেশ দ্রুত-উন্নয়নের যূপকাষ্ঠে পাখির-আলয় বলি দিয়ে অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। সুন্দরবন ছাড়া বাংলাদেশেও পরিযায়ী পাখির বিচরণভূমি বিনষ্ট হয়েছে; সামনে আরও হবে। উন্নয়ন ও সংরক্ষণের মধ্যে সমন্বয় সাধন করার কাজে আমরা ন্যূনতম দক্ষতা অর্জন করার আগেই এদেশের বনভূমি, হাওর, উপকূল ও বন্যপ্রাণীর ভয়ংকর ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।  

হাসান হাফিজ:  বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলে পাখির সংখ্যা, বাসস্থান, বংশবৃদ্ধি ও তাদের নিরাপত্তার পরিবেশটা এখন কেমন?

ইনাম আল হক:   হাওর অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের ব্যাপারে আমাদের উদ্যোগ নগণ্য এবং সফলতা শূন্য বললেও চলে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ, মাছ আহরণ ও ধান উৎপাদন ছাড়া হাওরের কোনো বিষয়ে আমাদের আলোচনা, পরিকল্পনা কিংবা উদ্যোগ নেই। দেশি-মেটেহাঁস ও ধলা-বালিহাঁসের মতো যে সব পাখি হাজার বছর ধরে আমাদের হাওরে স্থায়ীভাবে বসবাস করত, তারা উৎখাত হয়ে যাচ্ছে; আমরা কিছুই করছিনে।  

হাসান হাফিজ:  বাংলাদেশের পাখি বিষয়ে যা গবেষণা হয়েছে বা হচ্ছে, তাকে কি পর্যাপ্ত বা সন্তোষজনক বলা যাবে?

ইনাম আল হক:   গবেষণা কেবল শুরু হয়েছে। পাখি-গবেষণায় অনেক তরুণের আগ্রহ রয়েছে। তাদের কাজে আমাদের সহায়ক হতে হবে।

ইনাম আল হক সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

জন্ম কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার জানিপুর গ্রামে, ১৯৪৫ সালে।

শিক্ষা: এমবিএ  - আইবিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭৯,) কমিউনিকেশন্স-ইলেকট্রনিক্স এঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমা (১৯৮৫) 

শিক্ষকতা  (চলমান): বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়,কম্যান্ড অ্যান্ড স্টাফ ট্রেনিং ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী, ফ্লাইট সেইফটি ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী

অন্যান্য দায়িত্ব (চলমান):  পরিচালক, আরণ্যক ফাউন্ডেশন, চেয়ারম্যান, ওয়াইল্ড টীম, জাতীয় সমন্বয়কারী, বাংলাদেশের জলচর পাখি শুমারি কর্মকাণ্ড। 

প্রকাশিত বাংলা বই: রূপসী বাংলার পাখি  (২০২১), বেঙ্গমা-বেঙ্গমীর মতো কত পাখি (২০১৮),পাখিদের সুখদুখের কথা (২০১৫),বাংলাদেশের পাখির ফিল্ডগাইড (২০১৫),পাখিদেরও আছে নাকি মন (২০১৩), বাংলাদেশ  উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ (খণ্ড ২৬) পাখি (২০০৯),নিষ্পাপ বাংলাদেশ (২০০৪)।

প্রকাশিত ইংরেজি বই: এনসাইক্লোপেডিয়া অভ ফ্লোরা অ্যান্ড ফনা অভ বাংলাদেশ (২৬ খণ্ড), বার্ডস: (২০০৮),ফেদার্ড স্প্লেন্ডর্স, বার্ডস  অব বাংলাদেশ (২০১৪), রেড লিস্ট অভ বাংলাদেশ : বার্ডস (২০১৫)

নিয়মিত লেখা (চলমান):  সাপ্তাহিক কলাম ‘হকস আই ভিউ’ দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (জানুয়ারি ২০২১ থেকে চলমান),সাপ্তাহিক কলাম ‘ওয়াইল্ড টীম’ ঢাকা ক্যুরিয়ার (জুলাই ২০২১ থেকে চলমান)

প্রাপ্ত সম্মাননা: জাতীয় পরিবেশ পদক ২০২১,বাংলা একাডেমি  বিজ্ঞানসাহিত্য পুরস্কার, ২০২১, দ্বিজেন শর্মা নিসর্গ পদক ২০২১,বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড, ২০১৮, বাংলাদেশ জুওলজিক্যাল সোসাইটির অনারারী ফেলো,২০১৬, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের প্রকৃতি সংরক্ষণ অ্যাওয়ার্ড, ২০১৩