সমস্ত লেখকই অসার, স্বার্থপর এবং অলস। তাদের উদ্দেশ্যসমূহের একেবারে তলদেশে একটি রহস্য লুকিয়ে থাকে।
Published : 21 Jan 2024, 07:49 PM
অনুবাদকের ভূমিকা
ইংরেজ ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক এবং সমালোচক এরিক আর্থার ব্লেয়ার যিনি আজ জর্জ অরওয়েল নামেই অধিকতর পরিচিত। তিনি ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জুন তারিখে ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রদেশের মতিহারীতে জন্মগ্রহণ করেন। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের সমর্থক জর্জ অরওয়েলের রচনায় সুস্পষ্ট সামাজিক সমালোচনা এবং কর্তৃত্ববাদের বিরোধিতা স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। অরওয়েলের সাহিত্য সমালোচনা, কবিতা, কথাসাহিত্য এবং সাংবাদিকতা প্রবল আলোড়ন ও বিতর্ক তৈরি করেছে। তিনি তার রূপক উপন্যাস এনিম্যাল ফার্ম (১৯৪৫) এবং ডাইস্টোপিয়ান উপন্যাস নাইনটিন এইটি-ফোর (১৯৪৯) এর জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত ও বিখ্যাত। তার রচিত নন-ফিকশন রচনাসমূহের মধ্যে রয়েছে ইংল্যান্ডের উত্তরের শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক শ্রেণীর জীবনের ওপর তার নিজ অভিজ্ঞতার বয়ান “দ্য রোড টু উইগান পিয়ার” (১৯৩৭) এবং স্পেনের প্রজাতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতার বিবরণ “হোমেজ টু কাতালোনিয়া” (১৯৩৮)। রাজনীতি, সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি এবং স্পেনের গৃহযুদ্ধ (১৯৩৬-৩৯) বিষয়ক তার প্রবন্ধগুলোর মতোই তিনি বিতর্কিতভাবে সম্মানিত।
বার্মায় ইমপেরিয়াল পুলিশের সুপারিনটেনডেন্ট পদ থেকে অব্যাহতি নিয়ে চলে আসা জর্জ অরওয়েল মাঝে মাঝে সাংবাদিকতা পেশা থেকে অর্জিত অর্থে জীবন ধারণ করেছেন। লন্ডনে থাকাকালীন তিনি একজন শিক্ষক বা বই বিক্রেতা হিসাবেও কাজ করেছেন। ১৯২০ এর দশকের শেষ থেকে ১৯৩০ এর দশকের গোড়ার দিকে লেখক হিসাবে তাঁর সাফল্য বাড়তে থাকে এবং তাঁর প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তিনি স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধে গলায় বুলেটবিদ্ধ হয়ে আহত হন, জটিল চিকিৎসার পর অসুস্থতা নিয়েই ইংল্যান্ডে ফিরে যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন এবং ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সাল অব্দি ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের (বিবিসি) জন্য কাজ করেন। ১৯৪৫ সালে অ্যানিমেল ফার্ম উপন্যাসের প্রকাশনা তার জীবদ্দশায় আকাশচুম্বী খ্যাতি এনে দেয়। তার জীবনের শেষ বছরগুলোতে তিনি নাইনটিন এইটি ফোর উপন্যাস রচনায় মনোনিবেশ করেন এবং স্কটল্যান্ডের নির্জন জুরা দ্বীপে চলে যান। তার মৃত্যুর এক বছরেরও কিছু কম সময় আগে ১৯৪৯ সালের জুন মাসে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। ১৯৫০ সালের ২১ জানুয়ারী যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত অরওয়েল ফুসফুসে রক্তক্ষরণের কারণে লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ হাসপাতালে মাত্র ছেচল্লিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরন করেন।
অরওয়েলের রচনাসমূহ জনপ্রিয় সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার করে আছে। সর্বগ্রাসী এবং কর্তৃত্ববাদী সামাজিক অনুশীলনসমূহকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি অরওয়েলের লেখায় অনেক পুরাতন শব্দের নূতনভাবে প্রয়োগ ইংরেজি ভাষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে, যেমন ‘বিগ ব্রাদার’, ‘থট পুলিশ’, ‘রুম নম্বর ১০১’, ‘নিউজস্পিক’, ‘মেমরি হোল’, ‘ডাবলথিঙ্ক’ এবং ‘থট ক্রাইম’। ২০০৮ সালে দ্য টাইমস সাময়িকী জর্জ অরওয়েলকে "১৯৪৫ সালের পর থেকে আজ অব্দি ৫০ জন সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রিটিশ লেখক" -এর মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে উল্লেখ করে।
মূল : জর্জ অরওয়েল
অনুবাদ : মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী
খুব ছোটবেলা থেকেই, সম্ভবত পাঁচ বা ছয় বছর বয়সে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে বড় হয়ে আমাকে একজন লেখক হতে হবে। প্রায় সতেরো থেকে চব্বিশ বছর বয়সের মধ্যে আমি এই ধারণাটি ত্যাগ করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমি সচেতনভাবে বুঝতে পেরেছিলাম যে আমি আমার আসল স্বভাবের বিরুদ্ধাচরণ করছি এবং অচিরেই বা পরে আমাকে স্থির হয়ে বই লিখতে হবে।
আমি ছিলাম তিন ভাই-বোনের মধ্যে মধ্যম সন্তান। বড় বোন এবং ছোট বোনের সাথে আমার বয়সের দূরত্ব ছিল পাঁচ বছরের। আর আমার আট বছর বয়সের আগ অব্দি আমি বাবাকে খুব কমই দেখেছি। এই কারণসহ অন্যান্য আরো কিছু কারণে আমি কিছুটা নিঃসঙ্গ ছিলাম এবং আমি শীঘ্রই অপ্রীতিকর আচরণ করতে শুরু করলাম। এর ফলে আমার স্কুলের দিনগুলোতে আমি অনেকের কাছে অপ্রিয় হয়ে উঠেছিলাম। নিঃসঙ্গ শিশুদের মতো আমার বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলা এবং কাল্পনিক ব্যক্তিদের সাথে কথোপকথনের মতো অস্বাভাবিক অভ্যাস ছিল। আমি মনে করি শুরু থেকেই নিজেকে অন্যদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং অবমূল্যায়িত হওয়ার অনুভূতির সাথে আমার সাহিত্যিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলি মিশে গিয়ে গড়ে উঠেছে।
আমি জানতাম যে আমার কাছে রয়েছে শব্দের ভাণ্ডার আর, রয়েছে অপ্রীতিকর ঘটনাসমূহের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষমতাও। পাশাপাশি আমি অনুভব করেছি যে এর ফলে আমার এক ধরণের নিজস্ব জগত তৈরি হয়েছে যেখানে আমি দৈনন্দিন জীবনে আমার ব্যর্থতায় নিজেকে ফিরে দেখতে পারি। তবুও আমি আমার শৈশব ও কৈশোর জুড়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যে যেসব লেখা লিখেছিলাম তা ছয় পৃষ্ঠার বেশি হবে না।
আমার চার বা পাঁচ বছর বয়সে আমি প্রথম কবিতা লিখেছিলাম, আমার মা শুনে শুনে সেটি লিখে দিয়েছিলেন। এখন কবিতাটি সম্পর্কে আমার কিছুই মনে নেই, শুধু মনে আছে সেটি একটি বাঘ বিষয়ে ছিল। সেই কবিতায় উল্লেখযোগ্য একটি বাক্যাংশ ছিল- "বাঘের ছিল চেয়ারের মতো দাঁত"। তবে আমি মনে করি কবিতাটি ব্লেকের ‘টাইগার টাইগার’ এর অনুকরণ করে লেখা হয়েছিল। এগারো বছর বয়সে, যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮) শুরু হয় তখন আমি একটি দেশাত্মবোধক কবিতা লিখেছিলাম যা স্থানীয় সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। এর দুই বছর পর, কিচেনারের মৃত্যুতেও আমার লেখা কবিতা ছাপা হয়। সময়ের সাথে সাথে আমি যখন একটু বড় হয়ে উঠছিলাম তখন আমি জর্জিয়ান স্টাইলে দুর্বল এবং সাধারণত অসমাপ্ত 'প্রকৃতিবিষয়ক কবিতাগুচ্ছ' লিখেছি। এছাড়াও আমি প্রায় দুইবার একটি ছোট গল্প লেখার চেষ্টা করেছি। এই চেষ্টাগুলোও একরকম বাজে ধরনের ব্যর্থতা ছিল। মোটামুটি এগুলোই ছিল আমার উল্লেখযোগ্য রচনা যা আমি আসলে সেই সমস্ত বছরগুলিতে কাগজে লিখেছি।
যাইহোক, এই সময় জুড়ে আমি এক অর্থে সাহিত্য কর্মকান্ডে নিয়োজিত ছিলাম। শুরুর দিনগুলোতে নিজের সন্তুষ্টির বাইরে আমি তড়িঘড়ি এবং সহজে কিছু ফরমায়েশি লেখা লিখেছি। স্কুলের কাজ ছাড়াও, আমি বিভিন্ন অনুষ্ঠানভিত্তিক ছড়া কবিতা, আংশিকভাবে কমিক কবিতা লিখেছি যা এখন আমার কাছে আশ্চর্যজনক গতিময় লেখা বলে মনে হয়। চৌদ্দ বছর বয়সে আমি প্রায় এক সপ্তাহ সময়ের মধ্যে অ্যারিস্টোফেনেসের অনুকরণে একটি পুরো কাব্যনাটক লিখেছিলাম। এছাড়াও মুদ্রিত এবং পাণ্ডুলিপি আকারে স্কুল সাময়িকী সম্পাদনায় হাত লাগিয়েছি। বুঝতেই পারছেন যে এই সাময়িকীগুলো ছিল সবচেয়ে জঘন্য ব্যঙ্গাত্মক অনুকরণ। এবং আমাকে বলতেই হয় যে আমি এখনকার সস্তা সাংবাদিকতার তুলনায় সেইসব লেখালেখি বিষয়ে অনেক কম ঝামেলা পোহায়েছি। কিন্তু এই সবের পাশাপাশি পনেরো বছর বা তারও বেশি সময় ধরে আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের একটি সাহিত্য অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছিলাম:
এটি ছিল নিজের সম্পর্কে কোনো অবিচ্ছিন্ন ‘গল্প’ তৈরি করা, কেবল নিজ মনের মধ্যে বিদ্যমান এক ধরণের ডায়েরি। এটি শিশু এবং কিশোরদের একটি সাধারণ অভ্যাস বলেই আমি মনে করি। একজন ছোট শিশু হিসাবে নিজেকে আমি রবিন হুড বলে কল্পনা করতাম এবং রোমাঞ্চকর দুঃসাহসিক বীর হিসাবে চিত্রিত করতাম। কিন্তু খুব শীঘ্রই আমার আত্মরতিমূলক ‘গল্প’ কোনো চতুরতার আশ্রয় ছাড়াই আরও স্পষ্টভাবে আমার যাপিত জীবনের বর্ণনা হয়ে ওঠে। কয়েক মিনিটের জন্য এই ধরণের ভাবনা আমার মাথার ভিতরে চলত : “তিনি দরজাটি ঠেলে ঘরে প্রবেশ করলেন। সূর্যালোকের একটি হলুদ রশ্মি মসলিনের পর্দা দিয়ে ভিতর দিয়ে টেবিলের পড়েছে তির্যকভাবে, সেখানে একটি দেয়াশলাই বাক্স আধখোলা হয়ে কালির দোয়াতের পাশে পড়ে আছে। ডান হাত পকেটে রেখে সে জানালা ভেদ করে চলে গেল। কচ্ছপের পিঠের ন্যায় দেখতে একটি বিড়াল রাস্তায় একটি ঝরা পাতার পিছনে তাড়া করে এগিযে যাচ্ছে” ইত্যাদি ইত্যাদি। এই অভ্যাসটা আমার প্রায় পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত অব্যাহত ছিল, ঠিক আমার অ-সাহিত্যিক জীবনের বছরগুলোতে। যদিও সঠিক শব্দ খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হতাম এবং মনে হতো বাহ্যিক কোনো কারণে বাধ্য হয়ে একদম আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই বর্ণনামূলক প্রচেষ্টাটি করছি। আমি মনে করি, সেই 'গল্পে' অবশ্যই বিভিন্ন বয়সে আমার প্রিয় লেখকদের শৈলী প্রতিফলিত হয়েছে তবে যতদূর আমি মনে পড়ে সেগুলোতে সবসময়েই সূক্ষ্ম বর্ণনামূলক গুণ ছিল।
প্রায় ষোল বছর বয়সের সময় হঠাৎ করেই আমার কাছে অবিমিশ্র শব্দের আনন্দ, অর্থাৎ শব্দের ধ্বনি ও অনুষঙ্গ উন্মোচিত হতে শুরু করে। মিল্টনের প্যারাডাইস লস্টের পংক্তিগুলো-
“অনেক কষ্ট ও শ্রম দিয়ে সে
এগিয়ে গেছে : কষ্ট ও শ্রম দিয়ে”
যা এখন আমার কাছে খুব চমৎকার বলে মনে না হলেও তখন আমার শিরদাড়া কাঁপিয়ে দিয়েছিল এবং 'হি' (সে) বানানে ব্যবহৃত দুটো ই বর্ণমালা ব্যবহারের ফলে একটু অতিরিক্ত আনন্দই পেতাম। কোনো বিষয়কে বর্ণনা করার প্রয়োজনে আমি ইতিমধ্যে সেগুলো সম্পর্কে সবকিছুই জেনেছি। সুতরাং পরিস্কারভাবেই জানতাম আমি কী ধরনের বই লিখতে চাই। আমি বিশদ বিবরণে, মনোযোগ আকর্ষণীয় উপমাপূর্ণ এবং মাত্রাতিরিক্তভাবে অলঙ্কারপূর্ণ বেদনাদায়ক সমাপ্তিসূচক বিশাল পরিসরের প্রকৃতিবাদী উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলাম, যেখানে শব্দগুলি আংশিকভাবে তাদের ধ্বনির খাতিরেই ব্যবহৃত হয়েছে। এবং প্রকৃতপক্ষে আমার প্রথম সমাপ্ত উপন্যাস বার্মিজ ডেজ বরং এই ধরনের একটি গ্রন্থ। গ্রন্থটি আমি লিখেছি আমার ত্রিশ বছর বয়সে কিন্তু অনেক আগেই এর পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
আমি মনে করি যে কোনো লেখকের প্রাথমিক বিকাশ সম্পর্কে কিছু না জেনে তার উদ্দেশ্যসমূহ মূল্যায়ন করা সম্ভব না, তাই আমি এই সমস্ত পটভূমির অবতারনা করছি। লেখক যে যুগে বসবাস করছেন তা দ্বারা তার লেখার বিষয়-বস্তু নির্ধারণ হবে। এটি অন্তত আমাদের নিজেদের যুগের মতো অশান্ত, বিপ্লবী যুগে সত্য। তবে লেখক লিখতে শুরু করার আগে এমন এক আবেগপূর্ণ মনোভাব অর্জন করবেন যেখান থেকে তিনি কখনই সম্পূর্ণরূপে সরে যেতে পারবেন না। নিঃসন্দেহে, তার কাজ হলো নিজের মেজাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং কোনও অপরিপক্ক পর্যায়ে বা কোনও বিকৃত মেজাজে আটকে যাওয়া এড়ানো। তবে যদি তিনি তার প্রথম দিকের প্রভাব থেকে পুরোপুরি সরে যান তবে তিনি তার লেখক সত্তাকে হত্যা করবেন। জীবিকা অর্জনের প্রয়োজনকে একপাশে রেখে দিয়ে আমি মনে করি যে কোনো মাপের গদ্য লেখার ক্ষেত্রে লেখালেখির চারটি মহান উদ্দেশ্য রয়েছে। এগুলো প্রত্যেক লেখকের মধ্যে বিভিন্ন মাত্রায় বিদ্যমান। সময়ে সময়ে যে কোনও একজন লেখকের অনুপাতের তারতম্য হতে পারে, সেটি নির্ভর করে তিনি কোন পরিবেশে বাস করছেন তার ওপর। উদ্দেশ্যগুলো হল:
ক. নিছক অহংবোধ। বুদ্ধিমান বলে বিবেচিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, আলোচিত হওয়া, মৃত্যুর পরে মানুষের স্মৃতিতে থাকা, ছোটবেলায় যারা তিরস্কার করেছিল প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে তাদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। এটাই একমাত্র অভিপ্রায় নয় এবং জোরালো কিছু নয় এমন ভান করা। বিজ্ঞানী, শিল্পী, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, সৈনিক, সফল ব্যবসায়ীদের মতো - সংক্ষেপে বলতে গেলে পুরো মনুষ্যজাতির শীর্ষস্থানীয়দের বৈশিষ্ট্যকে ধারন করেন লেখকরা। মানুষের বিশাল জনগোষ্ঠী প্রচণ্ড স্বার্থপর নয়। প্রায় ত্রিশ বছর বয়সের পর তারা ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করে - অনেক ক্ষেত্রে, প্রকৃতপক্ষে তারা অনেকাংশে স্বতন্ত্র সত্তাকে বিসর্জন দেয় এবং মুলত অন্যদের জন্য বেঁচে থাকে অথবা গোলামির ঘানি টেনে মরে। কিন্তু প্রতিভাশালী মানুষদের সংখ্যালঘু একটি দলও রয়েছে যারা শেষ পর্যন্ত নিজের জীবনকে যাপন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকে, লেখকরা সেই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। আমার বলা উচিত যে গুরুতর লেখকরা সবদিক থেকে সাংবাদিকদের চেয়ে বেশি দাম্ভিক এবং আত্মকেন্দ্রিক, যদিও অর্থের প্রতি তাদের আগ্রহ কম।
খ. নন্দনতাত্ত্বিক কৌতুহল। অপরপক্ষে বাহ্যিক জগতের সৌন্দর্য সম্পর্কে চৈতন্য এবং তাদের সঠিক বিন্যাস। ভালো গদ্যের দৃঢ়তায় বা ভালো গল্পের উত্থান-পতনে একটি শব্দের উপর অন্য শব্দের প্রভাবে আনন্দ দান। এমন একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করার ইচ্ছা যা অন্যরা মূল্যবান মনে করবে এবং জানতে পিছপা হবে না। অনেক লেখকের মধ্যে নান্দনিক উদ্দেশ্য খুবই ক্ষীণ, কিন্তু একজন পুস্তিকা লেখক বা গ্রন্থ রচয়িতার কাছেও সযত্নে লালিত শব্দ এবং বাক্যাংশ থাকতে হবে যা অনুপযোগী কারণেও তার আবেদন তৈরি করবে। অথবা তিনি টাইপোগ্রাফি, মার্জিনের প্রস্থ ইত্যাদি সম্পর্কে প্রবলভাবে অনুভব করতে সক্ষম হবেন। রেলওয়ে গাইডের স্তরের উপরে কোন গ্রন্থই নান্দনিক বিবেচনা থেকে পুরোপুরি স্বাধীন নয়।
গ. ঐতিহাসিক স্পন্দন। বিষয়সমূহকে হুবহু দেখার, সত্য ঘটনাগুলি খুঁজে বের করার এবং পরবর্তী প্রজন্মের ব্যবহারের জন্য সেগুলি সংরক্ষণ করার আকাঙ্ক্ষা।
ঘ. রাজনৈতিক উদ্দেশ্য - সম্ভাব্য বিস্তৃত অর্থে 'রাজনৈতিক' শব্দটিকে ব্যবহার করা। বিশ্বকে কোনো সুনিশ্চিত অভিমুখে ধাবিত করার আকাঙ্ক্ষা, কাঙ্ক্ষিত সমাজের ধরন সম্পর্কে অন্য জনসাধারণের ধারণা পরিবর্তনে সচেষ্ট থাকা। আবারও বলছি, কোনো গ্রন্থ প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক পক্ষপাত থেকে মুক্ত নয়। রাজনীতির সাথে শিল্পের কোনো সম্পর্ক থাকা উচিত নয় – এই অভিমত স্বয়ং নিজেই একটি রাজনৈতিক মনোভাব
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই বিভিন্ন আবেগ কিভাবে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে বাধ্য হয় আর কিভাবে সেগুলো ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে এবং সময় থেকে সময়ে ওঠানামা করতে বাধ্য হয়। যখন আপনি প্রথম প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছিলেন স্বাভাবিক ভাবেই আপনার ‘স্বভাব’কে আপনি তখনকার হালেই গ্রহণ করেছেন– আমি এমন একজন ব্যক্তি যার স্বভাবের মধ্যে প্রথম তিনটি উদ্দেশ্য চতুর্থটির চেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছে। শান্তিপূর্ণ কোনো যুগে জন্ম হলে আমি হয়তো মাত্রাতিরিক্তভাবে অলঙ্কৃত বা নিছক বর্ণনামূলক বই লিখতাম, এর ফলে আমার রাজনৈতিক আনুগত্য সম্পর্কে একটুও জানতে পারতাম না। যেমনটা আমাকে এক ধরণের প্যামফ্লেটিয়ার হয়ে উঠতে বাধ্য করা হয়েছে। প্রথমে আমি একটি অনুপযুক্ত পেশায় (বার্মায় ভারতীয় ইম্পেরিয়াল পুলিশের চাকুরিতে) পাঁচ বছর কাটিয়েছি, তারপরে আমি চরম দারিদ্র্য এবং দেউলিয়া অবস্থার অনুভূতির মধ্য দিয়ে সময় পার করেছি। এর ফলে শাসকদের প্রতি আমার স্বভাবগত ঘৃণা বেড়ে উঠেছে এবং আমাকে প্রথমবারের মতো শ্রমিক শ্রেণীর অস্তিত্ব সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন করে তুলেছে। বার্মায় চাকরি করার ফলে আমি সাম্রাজ্যবাদের স্বভাব সম্পর্কে কিছুটা বুঝতে পেরেছি, কিন্তু সঠিক রাজনৈতিক প্রবণতা জানতে এই অভিজ্ঞতাগুলি আমার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তারপরে আসে হিটলার, আসে স্পেনের গৃহযুদ্ধ ইত্যাদি ইত্যাদি। ১৯৩৫ সালের শেষের দিকেও আমি একটি দৃঢ় সিদ্ধান্তে উপনীত হতে অপারগ ছিলাম। আমার ত্রিশঙ্কু অবস্থা প্রকাশে সেই সময়ে লেখা আমার একটি ছোট কবিতা মনে পড়ছে :
সুখী বিশপের প্রতিনিধি হতে পারতাম
দুশো বছর আগে জন্ম নিলে,
শাশ্বত ভাগ্যলিপি করতাম প্রচার
আর দেখতাম আমার আখরোটের বেড়ে ওঠা।
কিন্তু, হায়! আমি জন্মেছি অশুভ সময়ে
এবং হারিয়েছি সে মনোরম স্বর্গ,
কারন আমার উপরের ঠোঁটে গোঁফ গজিয়েছে
এবং আজকের যাজকেরা সবাই দাড়ি গোঁফ কামানো।
এর পরেও সময় ভাল ছিল খুব,
পরিতৃপ্তি আমাদের আসতো সহজেই,
উপদ্রুত ভাবনাকে আমরা তাড়িয়েছি ঘুমের দেশে
বৃক্ষের বুকের মাঝেই।
সকল অজ্ঞানতা দখলে ছিলাম সাহসী
এখন করছি শুধুই আমোদের ভান;
আপেল বৃক্ষশাখে হলদে-সবুজ পাখি
আমার শত্রুদের করে তোলে কম্পমান।
কিন্তু মেয়েদের পেট আর খুবানি ফল,
ছায়াময় নদীর কালবোস,
ঘোড়া আর প্রভাতের উড়ে যাওয়া বালিহাঁস,
এগুলো অলীক কল্পনা সবই।
আবার স্বপ্ন দেখা হয়েছে হারাম;
আমরা লুকিয়ে রাখি আমাদের আনন্দকে বিচ্ছেদ করে;
ঘোড়াগুলি তৈরি ক্রোমিয়াম ইস্পাতে
আর সামান্য মোটা লোকেরা তাদের পিঠে চড়ে।
সেই শুঁয়োপোকা আমি হইনি প্রজাপতি,
খোজা এক যার নেইকো হারেম;
যাজক ও প্রতিনিধির মাঝামাঝি
হাঁটছি আমি যেন ইউজিন আরেম;
আর প্রতিনিধি বাতলেছে আমার ভাগ্যলিখন
রেডিও বেজেই চলে,
কিন্তু পুরোহিত বলেছেন দিতে একটি অস্টিন সেভেন,
ডুগির বদলে সর্বদা পরিশোধ করে।
স্বপ্নে দেখি আমি শ্বেতপাথরের মহলে বাস করি,
জেগে দেখলাম স্বপ্নই হলো সত্যি;
জন্ম নেইনি আমি এমন যুগের তরে ;
স্মিথ ছিল? জোন্স ছিল? তুমি ছিলে ?
১৯৩৬-৩৭ সালে স্পেনের যুদ্ধ এবং অন্যান্য ঘটনাসমুহ মোড় ঘুরিয়ে দেয়, এর পর থেকে আমি জানতাম আমি কোথায় দাঁড়িয়ে আছি। ১৯৩৬ সাল থেকে আমার জানামতে আমি যে গুরুতর রচনার প্রতিটি লাইন লিখেছি তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে এবং গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পক্ষে লেখা হয়েছে, আমি সেরকমই মনে করি। আমাদের নিজেদের এই যুগে এই ধরনের বিষয়ের লেখা এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি আমার কাছে অর্থহীন আচরণ বলে মনে হয়। প্রত্যেকেই তাদের সম্পর্কে কোনো বিশেষ উপায়ে বা ছদ্মাবরণে লেখে। কে কোন পক্ষ নেয় এবং কোন পদ্ধতি অনুসরণ করে লেখে সেটি কেবল একটি প্রশ্ন মাত্র। কারো রাজনৈতিক পক্ষপাত সম্পর্কে সচেতনতা যত বেশি থাকে নান্দনিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিশুদ্ধতাকে বিসর্জন না দিয়ে রাজনৈতিকভাবে আচরণ করার সুযোগ তার তত বেশি।
গত দশ বছরে আমি সবচেয়ে বেশি যা করতে চেয়েছি তা হল রাজনৈতিক লেখাকে একটি শিল্পে পরিণত করা। সবসময় আমার সূচনা বিন্দুটি হয়ে থাকে এক প্রকার পক্ষপাতের অনুভূতি ও এক প্রকার বিচারহীনতার বোধ থেকে। আমি যখন লিখতে বসি, তখন আমি নিজেকে কখনো বলি না, “আমি একটি শিল্পকর্ম তৈরি করতে যাচ্ছি”। আমি এটি লিখছি কারণ কিছু মিথ্যা আছে যা আমি প্রকাশ করে যেতে চাই। কিছু সত্য আছে যার প্রতি আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। পাশাপাশি আমার প্রাথমিক উদ্দেশ্য থাকে শ্রুতিতে নিয়ে আসা। যদি এটি একটি নান্দনিক অভিজ্ঞতাই না হতো তাহলে আমি একটি বই তো দূরে থাক সাময়িকপত্রে একটি দীর্ঘ নিবন্ধও লিখতে পারতাম না।
যারা আমার রচনাকে পরীক্ষা করতে আগ্রহী তারা দেখতে পাবেন যে সরাসরি প্রচারের সময়ও এটিতে এমন অনেক কিছু রয়েছে যা দেখে একজন পূর্ণকালীন রাজনীতিবিদ অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করতে পারেন। আমি শৈশবে বিশ্ব সম্পর্কে যেরকম দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করেছি তা পুরোপুরি বর্জন করতে সক্ষম নই এবং ইচ্ছুক নই। যতদিন আমি বেঁচে থাকব এবং সুস্থ থাকব ততদিন গদ্যশৈলী সম্পর্কে দৃঢ় অনুভূতি অব্যাহত থাকবে। পৃথিবী ও প্রকৃতিকে ভালবাসতে পারব। কঠিন বিষয় ও অপ্রয়োজনীয় তথ্যের ভগ্নাংশসমূহ থেকে আনন্দ নিতে পারব। নিজের সেই দিকটা চাপা দিয়ে কোনো লাভ নেই। নিজের অন্তর্নিহিত পছন্দ এবং অপছন্দকে মূলত সর্বজনীন ও অ-ব্যক্তিগত ক্রিয়াকলাপের সাথে সমন্বয় করাই আমার কাজ। এই যুগ আমাদের সকলকে সেটি করতে বাধ্য করে।
এটা সহজ নয় কারণ এটি নির্মাণের এবং ভাষার সমস্যা তুলে ধরে এবং এটি সত্যবাদিতার সমস্যাকে নতুনভাবে মেলে ধরে। যেরকম কঠিন ধরনের উদ্ভূত অসুবিধায় আমি পড়েছি তার একটি উদাহরণ দিই। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ সম্পর্কে আমার রচিত গ্রন্থ হোমেজ টু কাতালোনিয়া অবশ্যই একটি খোলামেলা বর্ণনার রাজনৈতিক গ্রন্থ। তবে মূলত একটি নির্দিষ্ট বিচ্ছিন্নতা এবং ফর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে গ্রন্থটি লেখা হয়েছে। আমি এখানে আমার সাহিত্যিক প্রবৃত্তি বজায় রেখে সম্পূর্ণ সত্য বলতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। তবে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি গ্রন্থটিতে সংবাদপত্রের উদ্ধৃতির মতো লেখায় ভরা একটি দীর্ঘ অধ্যায় রয়েছে, যা ফ্রাঙ্কোর সাথে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে অভিযুক্ত ট্রটস্কিবাদীদের রক্ষা করে। স্পষ্টতই এমন একটি অধ্যায় যা এক বা দুই বছর পরে যে কোনও সাধারণ পাঠক আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে এবং গ্রন্থটি একদম ছুড়ে ফেলে দেবে।
একজন সমালোচক যাকে আমি সম্মান করি তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা করে আমাকে তিরস্কার করেন। তিনি বলেন, 'কেন আপনি এত সব বিষয়বস্তু ঢোকালেন? যা একটি ভালো বই হতে পারতো সেটিকে আপনি সাংবাদিকতায় পরিণত করেছেন।’ তিনি যা বলেছেন তা সত্য তবে আমি এর অন্যথা করতে পারতাম না। নিরপরাধ জনগণকে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করার বিষয়টি আমি জেনে গিয়েছিলাম, ইংল্যান্ডের খুব কম লোকই তা জানার সুযোগ পেয়েছিল। আমি যদি সেই বিষয়ে উত্তেজিত না হতাম তাহলে আমার দ্বারা কখনই গ্রন্থটি লেখা সম্ভব হতো না।
কোনো না কোনো প্রকারে এই সমস্যা আবার আসে। ভাষার সমস্যা সূক্ষ্ম এবং আলোচনা করতে খুব বেশি সময় প্রয়োজন। আমি শুধু বলব যে শেষের বছরগুলিতে আমি কম চিত্রকল্পময় এবং আরও সঠিকভাবে লেখার চেষ্টা করেছি। যাই হোক না কেন আমি বুঝতে পেরেছি যে লেখার যে কোনও শৈলী সম্পূর্ণ করার সাথেই লেখক সর্বদা সেটিকে অতিক্রম করে গেছেন। এনিম্যাল ফার্ম ছিল প্রথম গ্রন্থ যেখানে আমি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং শৈল্পিক উদ্দেশ্যকে একত্রিত করার জন্য সম্পূর্ণ সচেতনতার সাথে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। আমি সাত বছর ধরে একটি উপন্যাস লিখিনি, তবে আমি আশা করি খুব শীঘ্রই যুক্তিসম্মতভাবে আরেকটি উপন্যাস লিখব। এটি একটি ব্যর্থতা হতে বাধ্য, প্রতিটি গ্রন্থই এক ধরনের ব্যর্থতা কিন্তু আমি কিছুটা স্পষ্টতার সাথে জানি কি ধরনের বই আমি লিখতে চাই।
শেষের দিকের দু-এক পৃষ্ঠায় ফিরে তাকালে আমি দেখতে পাই যে আমি এটিকে এমনভাবে বলতে চেযেছি যেন আমার লেখার উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণভাবে সামাজিক সচেতন। আমি এটিকে চূড়ান্ত ছাপ হিসাবে ছেড়ে যেতে চাই না। সমস্ত লেখকই অসার, স্বার্থপর এবং অলস। তাদের উদ্দেশ্যসমূহের একেবারে তলদেশে একটি রহস্য লুকিয়ে থাকে। কতিপয় বেদনাদায়ক রোগের দীর্ঘ অসুস্থতার মতোই গ্রন্থ রচনা হলো এক ভয়ঙ্কর ক্লান্তিকর সংগ্রামের সমতুল্য। প্রতিরোধ বা অনুধাবনাতীত কোনো অশরীরী দ্বারা চালিত না হলে কেউ কখনও এমন কাজ করবে না। সকলেই জানেন যে মনোযোগ আকর্ষণের উদ্দেশ্যে একটি শিশু যেমন তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে, এই অশরীরীর প্রবৃত্তিও তেমনই। তবু এটাও সত্য যে নিজের ব্যক্তিত্বকে নিশ্চিহ্ন করার ক্রমাগত সংগ্রাম না করলে কোনো লেখকই পঠনযোগ্য কিছু রচনা করতে পারে না। ভালো গদ্য হলো জানালার মত। আমার উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে কোনটি সবচেয়ে শক্তিশালী তা আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না, তবে সেগুলোর মধ্যে অনুসরণযোগ্য বিষয়গুলো সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল। আমার রচনার দিকে ফিরে তাকালে আমি দেখতে পাই যে সচরাচর যখন আমার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যহীনতা ছিল তখন আমি প্রাণহীন গ্রন্থ লিখেছি। আর সাজানো গোছানো ফুলেল ভাষা, অর্থহীন বাক্য, আলংকারিক বিশেষণ এবং সাধারণভাবে ধাপ্পাবাজীর মাধ্যমে সত্যকে গোপন করেছি।
( রচনাটি ১৯৪৬ সালের গ্রীষ্মকালে ‘গ্যাংরেল’ সাময়িকীর চতুর্থ সংখ্যায় প্রকাশিত হয। গ্যাংরেল ছিল যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকে প্রকাশিত একটি স্বল্পস্থায়ী ত্রৈমাসিক সাহিত্য সাময়িকী। জে বি পিক এবং চার্লস নেইল কর্তৃক সম্পাদিত স্বল্পায়ু গ্যাংরেলের প্রথম সংখ্যা ১৯৪৫ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত হয়। অরওয়েলের বিখ্যাত প্রবন্ধ "আমি কেন লিখি" প্রকাশিত হয়েছিল শেষ সংখ্যায়। সাময়িকীর নামটি একটি স্কটিশ শব্দ থেকে নেওয়া, যার অর্থ ভবঘুরে। সাময়িকীটিতে সাহিত্য, কবিতা, সঙ্গীত এবং দর্শনের উপর প্রবন্ধ ছাপা হতো।)