রবীন্দ্রনাথকে গান শোনানোর সৌভাগ্য যাঁদের হয়েছে তাঁদের মধ্যে তিনি অন্যতমা। তিরিশের দশকের বিশিষ্ট কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত'র সহধর্মিণী।
Published : 04 Feb 2024, 07:45 PM
আবু সয়ীদ আইয়ুব ( ১৯০৬-১৯৮২ )। তাঁর গভীর পাণ্ডিত্য ও প্রজ্ঞা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। এবং, তাঁর উচ্চাঙ্গের মননশীলতাও প্রশ্নাতীত। তিনি ছিলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের যশস্বী অধ্যাপক। অবশ্য এই পরিচয় ছাপিয়ে যা বিশেষভাবে উল্লেখ্য তা হ'ল, তাঁর অসামান্য বাংলা গদ্যে লেখা উচ্চস্তরের মননশীল বইগুলি, যা বাংলা ভাষার অবিস্মরণীয় সম্পদ। তাঁর মাতৃভাষা ছিল উর্দু। উর্দুতে রবীন্দ্রনাথের 'গীতাঞ্জলি' পড়ে মুগ্ধ, অভিভূত হয়ে পরবর্তীকালে তিনি বাংলা ভাষা শেখেন এবং কালক্রমে হয়ে ওঠেন প্রখ্যাত রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ। আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ, পথের শেষ কোথায়, পান্থজনের সখা, ব্যক্তিগত ও নৈর্ব্যক্তিক ইত্যাদি তাঁর লেখা একগুচ্ছ দীপ্তিময় বই। তাঁর ধ্রুপদী 'বাংলা গদ্য'র কাছে অনেক বাঙালি লেখক নিতান্ত শিশু! সাহিত্য একাডেমি, রবীন্দ্র পুরস্কার, দেশিকোত্তম ইত্যাদিতে সম্মানিত এই মনস্বী ভাবুককে কি আমরা 'বাঙালি' বলতে দ্বিধাগ্রস্ত হব? মোটেই নয়।
যদিও জন্মসূত্রে মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও অনেককেই 'বাঙালি' বলতে আমাদের মন সায় দেবে না। তার সঙ্গত কারণও নিশ্চয় আছে। বস্তুত, ভাষার মাসে 'বাংলা' ও 'বাঙালি' নিয়ে দৃশ্যপটে যা যা দেখা যায় সেসব 'প্রেম' নয়, বিশুদ্ধ 'হুজুগ' মাত্র! তা না হলে বাংলায় দুটো বাক্য বলতে গিয়ে বাঙালি আজ দশটা ইংরেজি শব্দ বলে কীভাবে? আবার, অনেক 'উচ্চশিক্ষিত' বাঙালি বাংলা লিখতে গিয়ে অজস্র ভুলই বা করে কীভাবে? অথচ, ইংরেজি লিখতে গিয়ে তো ভুল হয় না! ইংরেজি মাধ্যমে সন্তানকে পড়তে পাঠানো কিংবা বাংলা সাহিত্য পড়ায় ক্রমশ বাঙালির অস্তাচলগামিতা না হয় না-ই বলা গেল! অতএব, অনন্ত স্ববিরোধিতা প্রকট!
'মাতৃভাষা' হচ্ছে গাছের মতো! গাছের যেমন নিয়মিত পরিচর্যা করতে হয়, যত্ন করে রোজ গাছে জল দিতে হয়, গাছের পাতায় মরমী হস্তস্পর্শ বুলিয়ে দিতে হয়, তার স্নিগ্ধ ছায়ায় এসে বসতে হয়, 'মাতৃভাষা'ও একেবারে ঠিক তেমনই! গাছের উদাহরণ তো আছেই, 'মায়ের' প্রতি সন্তানের কর্তব্যের কথাও যদি বলা যায় তাহলে তার ব্যঞ্জনা কী হতে পারে? আমাদের গাঢ় প্রাত্যহিক জীবনচর্যা বলে দেয় যে, 'মাতৃভাষা' থেকে আমরা 'মাতৃ'-কে বাদ দিয়েছি, তাই 'ভাষা'রও আজ দীনদুখিনি অবস্থা! আদতে 'মাতৃভাষা'র প্রতি গভীর ভালবাসা, মমত্ববোধ যখন থাকবে তখন ওই 'ভুলগুলি' ফুল হয়ে ফুটবে না, বরং 'কাঁটা' হয়ে নিজেকেই বিঁধবে!
রাজেশ্বরী দত্ত ( ১৯১৮--১৯৭৬ )---স্বর্ণযুগের মরমী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। রবীন্দ্রনাথকে গান শোনানোর সৌভাগ্য যাঁদের হয়েছে তাঁদের মধ্যে তিনি অন্যতমা। তিরিশের দশকের বিশিষ্ট কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত'র সহধর্মিণী। তাঁরও মাতৃভাষা বাংলা না হলেও বাংলা শিখে পরবর্তীকালে তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের একজন বিখ্যাত শিল্পী হয়ে ওঠেন। তাঁর কণ্ঠে ছিল মধুরতম বিষাদের ছায়া; যা কবির গানের গহন আর্তিকে মূর্ত করে তোলে! যেমন, 'ওগো আমার চির অচেনা পরদেশী' গানটির মধ্যে যে প্রগাঢ় হাহাকার, তা তাঁর অসামান্য নিবেদনে শ্রোতার হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করে তোলে! তাঁর গাওয়া যেসব গান বারবার শুনতে হয় সেগুলি হ'ল---বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল, যে কেহ মোরে দিয়েছ সুখ, যে রাতে মোর দুয়ারগুলি, ফুল বলে ধন্য আমি, মম দুঃখের সাধন, প্রভু তোমা লাগি আঁখি জাগে, চিরসখা হে, এ কি করুণা করুণাময়, কখন যে বসন্ত গেল, এরা পরকে আপন করে, তুমি যেও না এখনই, কোথা যে উধাও হ'ল, মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, আজি যে রজনী যায়, ধীরে ধীরে ধীরে বও ওগো উতল হাওয়া ইত্যাদি। তাঁর আদি নাম ছিল রাজেশ্বরী বাসুদেব। জন্মসূত্রে ছিলেন পাঞ্জাবি। রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগের বিশিষ্ট কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার পর তাঁর পদবী হয় 'দত্ত'। তারপর তিনি বাংলা শেখেন। কণ্ঠে আগে থেকেই গানের সুরের পরশ ছিল। পরবর্তীকালে তিনি হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রখ্যাত শিল্পী। তাঁর নামটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বর্ণযুগের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে আছে। সুচিত্রা মিত্রকে একবার তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি অবলীলায় বলেছিলেন, ''উনি তো রবীন্দ্রসঙ্গীতের রাজ-রাজেশ্বরী!'' রাজেশ্বরী দত্তকে কি আমরা 'বাঙালি' বলব না? নিশ্চয় বলব।
ফাদার দ্যতিয়েন ( ১৯২৪--২০১৬ )। মাতৃভাষা ফরাসি। তাঁর বাংলা গদ্যের সঙ্গে সম্ভবত খুব কম বাঙালিরই পরিচয় আছে, যা বাঙালির দুর্ভাগ্যের সঙ্গে অন্বিত! এই বিশিষ্ট ভাবুকের উল্লেখযোগ্য রচনা হ'ল: আটপৌরে দিনপঞ্জি, ডায়েরির ছেঁড়া পাতা ইত্যাদি। আটপৌরে দিনপঞ্জি কিংবা ডায়েরির ছেঁড়া পাতা যারা পড়েছেন তারা জানেন যে, লেখার প্রসাদগুণে 'ব্যক্তিগত গদ্য' কতটা সুষমাময় ও কতটা লাবণ্যদীপিত হয়ে উঠতে পারে! 'আত্মনির্মিত বাঙালি' এই ভদ্রলোকটিরও আগে বিভূতিভূষণ ও বনফুলের লেখায় আমরা দেখেছি, 'ব্যক্তিগত গদ্য' যে নিছক 'ব্যক্তিগত' নয়, কিংবা 'ব্যক্তিগত' হয়েও তা বড় 'সামাজিক', বৃহৎ জনারণ্যের সঙ্গে যার গভীর অন্বয় রচিত হওয়ার ফলে সেসব শুধু 'পাঠযোগ্য' নয়, সমৃদ্ধ ও আলোকিত হতে 'অবশ্যপাঠ্য'।
পরিশেষে উদাহরণ দেওয়া যাক এমন দুজনের, যাঁরা বাংলা ভাষায় লেখেননি, কিন্তু বাংলা ভাষায় লিখিত একগুচ্ছ সাহিত্যসম্পদকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বের দরবারে। এখানে বলে রাখা ভাল যে, প্রত্যেক ভাষারই একটা নিজস্ব রূপ-রঙ আছে। এবং, অতি অবশ্যই একটা নিজস্ব 'গন্ধ'ও আছে; ইংরেজিতে যাকে বলা যায়--'এসেন্স'। একজন অনুবাদককে শুধু ভাষা ও তার রূপের ছটা সম্পর্কে জানলেই হয় না। 'গন্ধ'টাও জানতে হয়, বুঝতে হয়। দুটো ভাষারই। এবং, যে সাহিত্যকীর্তিটি অনূদিত হচ্ছে কেবল সেটাই ভালভাবে আত্মস্থ করা যথেষ্ট নয়, বরং সেই নির্দিষ্ট ভাষিক সাহিত্যটি যে ভূখণ্ড থেকে উঠে আসছে তার সামগ্রিক জীবনপ্রবাহ ও সাহিত্যে তার প্রসারিত প্রতিবিম্ব সম্পর্কেও অবগত থাকতে হয়। অন্য ক্ষেত্র থেকে একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা বোঝানো যাক। রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে হলে নিছক গানের কথা, সুর ও স্বরলিপি জানলেই কি চলে? এসব তো জানতেই হবে। কিন্তু, এর সঙ্গে সঙ্গে জরুরি হ'ল, গানের কথার ভেতরে ঢোকা, তার মর্ম আত্মস্থ করা। সুচিত্রা মিত্র তো আরও একধাপ এগিয়ে বলেছিলেন যে, ''রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে হলে রবীন্দ্রনাথকে জানতে হবে, তাঁর জীবনদর্শন ও জীবনবোধ জানতে হবে, বুঝতে হবে।'' অনুবাদও ঠিক তেমনই। এই মৌলিক বিষয়টির শূন্যতায় অনুবাদ নিছক আক্ষরিক ভাষান্তরে পর্যবসিত হতে বাধ্য, যা শেষপর্যন্ত হয়ে ওঠে কাষ্ঠল, প্রাণহীন। এই আবহে 'আত্মবিস্মৃত বাঙালি'-কে একালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি ভাবুক, ফরাসি অনুবাদক ও এলিয়ট-বিশেষজ্ঞ চিন্ময় গুহ প্রায় 'এককভাবে' চিনিয়ে চলেছেন ফ্রাঁস ভট্টাচার্য, জো উইন্টার প্রমুখ অবিস্মরণীয় সব বাংলা সাহিত্যের অনুবাদককে। জো সম্পর্কে তিনি একটি প্রবন্ধে লিখছেন : ''তাঁর অনুপুঙ্খময় অনুবাদগুলি মূলের মতো কল্পনায় আগুন ধরায়।" ( 'খেয়া পারাপার'/ দৈনিক সংবাদ প্রতিদিন, ১২ মার্চ ২০২৩ )। এই কথাটি অমোঘ। বস্তুত, কাল ও যুগ-উত্তীর্ণ শ্রেষ্ঠতম প্রতিভাগুলিকে কীভাবে 'আবিষ্কার' করলে তাঁদের প্রতি 'সুবিচার' হবে এই বোধটি সর্বাগ্রে স্বচ্ছ হওয়া দরকার ; জো যা আপন প্রজ্ঞায় 'অর্জন' করেছিলেন।
ফ্রাঁস ভট্টাচার্য ( ১৯৩৩-- )। অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি অনুবাদক ও লেখক লোকনাথ ভট্টাচার্যের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন এই ফরাসি মেধাবী, বিদুষী মহিলা। অতঃপর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসায় আর অসীম মমতায় অক্লান্তভাবে বাংলার চিরন্তন সাহিত্যসম্ভারগুলি তিনি অনুবাদ করে গেছেন দিনের পর দিন! নিরবচ্ছিন্ন অনুবাদকর্মপ্রবাহের জন্য তিনি ২০২২ সালে পেয়েছেন 'রবীন্দ্র পুরস্কার'। বাংলা ভাষাপ্রেমী, নিভৃতচারী এই অনুবাদককে অবলীলায় আমরা 'বাঙালি'ই তো বলব!
তাঁর 'রবীন্দ্র পুরস্কার' প্রাপ্তির পর চিন্ময় গুহ আবেগমথিত ভাষায় যা লিখেছিলেন সেটি উল্লেখ করা যাক :"In the midst of this gloom, one elevating news. France Bhattacharya, the French scholar, Emeritus Professor of the Universities of Paris, has won the Rabindra Puroshkar.
Since her marriage to Loknath Bhattacharya in the 1950s, this beautiful French woman devoted her whole life to Bengali literature. She began with the finest French translation of Pather Panchali (Gallimard), and went on to try a structuralist analysis of Thakumar Jhuli. Then she rendered into French Kapalkundala, Anandamath, Jogajog, Nastonir, Aranyak (which won the highest honours in France) , wrote books on the Bengal Renaissance in French published by Collège de France, and Vidyasagar (English translation published by Asiatic Society). She has also worked day and night to translate and publish Annada Mangal on the request of Sheldon Pollock. France di is now working on Chandimangal. On Satyajit Ray's request, she wrote the subtitles of some of his classic films. She also translated Tagore and Jibanananda's poems, and Tarashankar's short stories into French!
As the VC of Rabindra Bharati, i had honoured her (along with Gayatri Spivak and Shiv Kumar Sharma) with D.Litt Honoris Causa in 2012.
She deserves Deshikottam and Bharat Ratna. No one cares.
At least this Rabindra Puroshkar is some compensation for this incomparable 89 year old French scholar in the midst of a desert.
I am happy. She too is."
অর্থাৎ, "এই ঘনঘোর অন্ধকারের মধ্যে একটি গভীর আনন্দসংবাদ পাওয়া গেল। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক, বিশিষ্ট ফরাসি চিন্তক ফ্রাঁস ভট্টাচার্য রবীন্দ্র পুরস্কার পেলেন।
১৯৫০ সালে লোকনাথ ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর থেকেই এই সুন্দরতমা ফরাসি নারী বাংলা সাহিত্যের জন্য তাঁর জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। শুরু করেছিলেন ফরাসিতে পথের পাঁচালীর নান্দনিক অনুবাদ দিয়ে, যা গালিমার থেকে প্রকাশিত হয়। তারপর ঠাকুমার ঝুলির গঠনশৈলীগত বিশ্লেষণ করেন। এক এক করে ফরাসিতে অনবদ্য অনুবাদ করতে থাকেন কপালকুণ্ডলা, আনন্দমঠ, যোগাযোগ, নষ্টনীড়, আরণ্যক ( এটা তো ফ্রান্সে বিপুলভাবে সমাদৃত, নন্দিত হয় )। বই লেখেন ফরাসি ভাষায় বাংলার রেনেসাঁস যা Collège de France প্রকাশিত হয়েছিল এবং লিখেছেন বিদ্যাসাগরকে নিয়ে, যার ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশ করেছে এশিয়াটিক সোসাইটি । শেলডন পোলক-এর অনুরোধে তিনি দিনরাত এক করে বিপুল শ্রমে ফরাসিতে অনুবাদ ও প্রকাশ করেন অন্নদামঙ্গল । ফ্রাঁসদি এখন কাজ করছেন চণ্ডীমঙ্গল নিয়ে। সত্যজিৎ রায়ের অনুরোধে তাঁর কিছু ক্ল্যাসিক ছবির ফরাসি সাবটাইটেল লিখেছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের কবিতা এবং তারাশঙ্করের কিছু ছোটগল্পেরও অনুবাদ করেছেন ফরাসিতে।
আমি ২০১২ সালে রবীন্দ্রভারতীতে উপাচার্য থাকার সময় গায়ত্রী স্পিভাক ও শিব কুমার শর্মার সঙ্গে তাঁকেও ডি লিট সম্মানে ভূষিত করতে পেরে পরিতৃপ্ত হয়েছিলাম!
তিনি 'দেশিকোত্তম' ও 'ভারতরত্ন' পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু কারই বা এ নিয়ে মাথাব্যাথা আছে!
এই মরুভূমির মধ্যেও ৮৯ বছর বয়সী এই অতুলনীয়া ফরাসি ভাবুক যে অন্তত 'রবীন্দ্র পুরস্কার' পেলেন সেটাই সান্ত্বনা!
আমি সুখী। তিনিও।"