উত্তরের জীবনযুদ্ধ, হাতি ও নূরুল ইসলামের মৃত্যু

এখনো মানুষের অবিমৃশ্যকারিতায় কিংবা প্রকৃতির রুদ্ররোষে এভাবেই অসহায় নূরুল ইসলামদের করুণ জীবনাবসান ঘটছে।

গোলাম ফারুক খানগোলাম ফারুক খান
Published : 20 Nov 2022, 12:14 PM
Updated : 20 Nov 2022, 12:14 PM

ভরা হেমন্তের মাঠ এখন পাকা ফসলে ভরে উঠেছে। এই ফসল সারা বছর কৃষকদের স্ত্রী-সন্তানের মুখে অন্ন জোগায়। নতুন ফসলকে ঘিরে তাঁদের অনেক স্বপ্ন ও পরিকল্পনা থাকে। তা ছাড়া এখন ফসলের উৎপাদন-ব্যয়ও খুব বেড়ে গেছে। বহু টাকা খরচ করে ফসল ফলাতে হয়। তাই সারাক্ষণই কৃষকের মন পড়ে থাকে মাঠে। সেদিন সন্ধ্যার খানিক পরেই দুঃসংবাদটি এল: পাকা ধানের ক্ষেতে বুনো হাতির পাল হানা দিয়েছে। পাকা ফসলের মাঠে হাতি নামলে কৃষকের সর্বনাশ। হাতির মুখ থেকে বাঁচিয়ে ঘরে আনার মতো কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। বনপাহাড়ের এলাকায় এরকমটি ঘটে মাঝেমাঝেই।

খবর পেয়েই তরুণ কৃষক নূরুল ইসলাম অস্থির হয়ে উঠলেন। পাড়াপড়শিদের নিয়ে ছুটে গেলেন মাঠের দিকে। তাঁদের হাতে আগুনের শিখা। রাতের বেলায় হাতির পাল লোকালয়ে নেমে এলে আগুন দেখিয়ে, ক্যানেস্তারা পিটিয়ে আর চিৎকার করে তাদের তাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। সেদিন দলটি এগিয়ে যেতেই হাতির পালও ধেয়ে এল তাঁদের দিকে। মুখের গ্রাস ছেড়ে যেতে চাইছে না ক্ষুধার্ত হাতিগুলি। তাদের তাড়া খেয়ে ছুটে পালালেন ফসল বাঁচাতে আগুয়ান কৃষকেরা। কিন্তু কীভাবে যেন নূরুল ইসলাম দল থেকে পিছিয়ে পড়েছিলেন। ধাবমান এক হাতির সামনে পড়ে গেলেন তিনি। ব্যাস, আর কথা নেই। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে, কয়েকবার আছড়ে অনেক ওপর থেকে ছুড়ে ফেলল হাতিটি। মাথায় গুরুতর আঘাত পেলেন নূরুল ইসলাম। চিকিৎসার জন্য যতক্ষণে তাঁকে উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো, ততক্ষণে তিনি মৃত। সেদিন সন্ধ্যায়ও নূরুল ইসলাম বুঝতে পারেননি কী ভয়াবহ পরিণতি নেমে আসছে তাঁর জীবনে।

ঘটনাটি ঘটেছে গত ১৪ নভেম্বর। নেত্রকোনা জেলার উত্তরাঞ্চলে কলমাকান্দা উপজেলায়। সীমান্তবর্তী রংছাতি ইউনিয়নের সন্ন্যাসীপাড়া গ্রামে। গারোপাহাড়ের নিচেই গ্রামটির অবস্থান। এটি একসময় দুর্গম অরণ্য এলাকা ছিল। অভাবের তাড়নায় সমতল থেকে ভাগ্যসন্ধানী মানুষ গিয়ে বন পরিষ্কার করে, মাটি কেটে সেখানে বসতি স্থাপন করেছেন। মূলত নেত্রকোনা জেলার দক্ষিণাঞ্চল, কিশোরগঞ্জ এবং ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকা থেকে গেছেন ওইসব আবাদি মানুষ। বড় করুণ ছিল জীবিকার জন্য পূর্বপুরুষের ভিটা ছেড়ে সমতলের মানুষের এই 'উত্তরে যাওয়া।' মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মানদীর মাঝি' উপন্যাসের কুবের-রাশুদের ময়নাদ্বীপে যাওয়ার মতোই করুণ। প্রকৃতির সঙ্গে কঠিন সংগ্রামে অনেক মৃত্যু এবং ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁদের। অনেকে হাতির পায়ে পিষ্ট হয়েছেন, অনেকে বাঘ আর অজগরের পেটে গেছেন। উত্তরে যাওয়া নিয়ে বিস্তর কথা-কাহিনি-লোকশ্রুতি জন্ম নিয়েছে বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকায়। কিন্তু বাস্তুত্যাগ করে নতুন জায়গায় থিতু হওয়ার পরও এসব মানুষের জীবনসংগ্রামের যেন শেষ নেই। অনুমান করি, নিহত নূরুল ইসলাম এই অভিবাসীদেরই সন্তান। এখনো মানুষের অবিমৃশ্যকারিতায় কিংবা প্রকৃতির রুদ্ররোষে এভাবেই অসহায় নূরুল ইসলামদের করুণ জীবনাবসান ঘটছে। কিছুদিন আগে এ নিয়ে সামান্য কিছু কথা লিখেছিলাম। নিজের প্রচণ্ড কর্মব্যস্ততার মধ্যেও এই শোচনীয় মৃত্যুর ঘটনাটি আমাকে দারুণ এক নাড়া দিয়ে গেল।

এই হাতির পাল এসেছিল সীমান্তের ওপারে বেদগড়া থেকে। ওখানে অরণ্যের আশ্রয়ে তারা থাকে। তবে হাতিরা কোনো রাষ্ট্র চেনে না, সীমান্ত মানে না। খিদে পেলেই তারা যেখানে খাদ্য আছে সেখানে ছুটে যায়। খাদ্য পাওয়ার অধিকার মানুষের যেমন আছে, তেমনি অন্যান্য প্রাণীরও আছে। এই অধিকারেই হাতিরা এসেছিল। কিন্তু মাঝখানে ঘটে গেল একটি মর্মছেঁড়া অঘটন। তবে ক্ষুধার খাদ্য খুঁজতে গিয়ে আগে হাতিদেরও বিপন্ন হতে হয়েছে। আজও হয়। অতীতে মানুষের হাতে ধরা পড়ে তাদের দলছুট ও নিঃসঙ্গ হয়ে নানা দেশে রপ্তানি হতে হয়েছে। প্রাণও হারাতে হয়েছে। যে এলাকায় নূরুল ইসলাম নিহত হয়েছেন সেখানে এবং তার আশেপাশেই এসব ঘটনা ঘটেছে। আজ থেকে শ দুয়েক বছর আগে।

একসময় নেত্রকোনার উত্তরাঞ্চল ছিল সুসং পরগনার অন্তর্গত। ষোল শতকের মধ্যভাগে সোমেশ্বর সিং (পাঠক) নামে ঈশা খাঁর এক সৈনিক এখানে সুসং রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। আসলে তিনি যুদ্ধ করে স্থানীয় গারো সর্দারদের কাছ থেকে এই ভূমি ও অরণ্য কেড়ে নিয়েছিলেন। আদিবাসীদের রাজ্যগ্রাসের কাজে তিনি গারোদের বিরুদ্ধে সাহসী হাজংদের ব্যবহার করেন। পরে তাঁর বংশধররা এই হাজং এবং গারোদের কাজে লাগিয়ে এক অদ্ভুত ব্যবসা ফেঁদে বসেন। হাতি ধরার ব্যবসা। বাঙালি কৃষকদেরও এ কাজে জড়িত করা হয়। গভীর অরণ্যের মধ্যে এক বিশাল এলাকা গজারি গাছের খুঁটি দিয়ে ঘিরে তার ভেতরে কলাগাছ আর ধানের চাষ করা হতো। এটি ছিল 'খেদা' বা হাতির ফাঁদ। কলাগাছ আর ধানের লোভে এই ফাঁদে ঢুকলেই ক্ষুধার্ত হাতির দল আটকা পড়ত। তারপর বন্দি হাতিগুলিকে শিকল পরিয়ে 'কুনকি' নামের পোষা হাতির সাহায্যে বাইরে নিয়ে আসা হতো। এইসব হাতি চালান দেওয়া হতো ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, দিল্লি এবং ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশে। সম্ভবত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে বাংলার এই হাতিব্যবসা একটি বৈশ্বিক রূপ লাভ করে।

হাতিখেদার কাজে হাজং চাষিদের বাধ্যতামূলক বেগার খাটানো হতো। এই বিপজ্জনক কাজ করতে গিয়ে অসংখ্য হাজং চাষি হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা যান এবং পঙ্গু হন। আরো নানারকম উৎপীড়ন চলত তাঁদের ওপর। অবশেষে এই অমানবিক ব্যবসার দাপটে জর্জরিত হাজংরা সুসঙের জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। উনিশ শতকের প্রথম দিকে শুরু হয়ে এই বিদ্রোহ পাঁচ বছর চলে। ক্রমে ক্রমে পুরো সুসং পরগনায় বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে গারো এবং বাঙালি চাষিরাও বিদ্রোহে যোগ দেন। জমিদাররা হাজং সর্দার মনাকে বন্দি করে বুনো হাতির পায়ের তলে নিক্ষেপ করেন। এই ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডের পর জমিদারদের হাতিগুলির হাজং মাহুতরাও বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। তাঁরা নিজেদের হাতিদের ক্ষেপিয়ে দেন এবং ক্ষিপ্ত হাতির দল জমিদারবাহিনীর অনেককে পিষে মারে। আত্মরক্ষার জন্য জমিদাররা সপরিবার নেত্রকোনা শহরে আশ্রয় নেন। বিদ্রোহীরা ফারাংপাড়া, বিজয়পুর, চেংনি, ধেনকি, আড়াপাড়া, ভরতপুর ইত্যাদি জায়গায় বড় বড় হাতিখেদাগুলি গুঁড়িয়ে দেন। এই বিদ্রোহের পর জমিদারদের নৃশংস হাতিব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এ নিয়ে অনেক কথা-উপকথার রেশ এখনো জনস্মৃতিতে জেগে আছে। ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় 'ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম' বইয়ে ময়মনসিংহের হাতিখেদা বিদ্রোহের সংক্ষিপ্ত অথচ তথ্যবহুল বর্ণনা দিয়েছেন।

আমরা জানি, একসময়ে ইওরোপের উপনিবেশগুলিতে হাতির, বিশেষ করে হাতির দাঁতের ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠেছিল। এই ব্যবসাকে কেন্দ্র করে পৃথিবীতে নিষ্ঠুরতার বন্যা বয়ে গেছে। বিখ্যাত ইওরোপীয় কথাসাহিত্যিক জোসেফ কনরাড তাঁর 'হার্ট অব ডার্কনেস' নামের উপন্যাসিকায় এই ঔপনিবেশিক ব্যবসার এক ভয়াবহ রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন। একটি বেলজিয়ান কোম্পানির প্রতিনিধি কার্টস কঙ্গোর গভীর অরণ্যে হাতির দাঁত আহরণ করতে গিয়ে এক অশুভ, অন্ধকার সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। নানা ধূর্ত ও নৃশংস উপায়ে হাতির দাঁত সংগ্রহ করতে করতে শেষ পর্যন্ত সে রীতিমতো এক দানবে পরিণত হয়। এই বীভৎস ব্যবসা তার মানবিক অন্তঃসারকে নিঃশেষ করে দেয়।

ঔপনিবেশিকতার সেই পাপ আজ তার আগের রূপে নেই, কিন্তু হাতিদের সংকট কি পৃথিবী থেকে দূর হয়েছে? তাদের খাদ্য এবং অনুকূল প্রতিবেশ কি নিশ্চিত হয়েছে? বরং দেশে দেশে অরণ্য নিঃশেষ করে তাদের খাদ্য এবং আবাসভূমি ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। এজন্যই তো ক্ষুধার্ত, অসহায় হাতির পাল ভারতের বেদগড়া থেকে বাংলাদেশের রংছাতি ইউনিয়নে নেমে এসেছিল। অবশ্য এ এলাকাও একসময়ে হাতি এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণীর বাসস্থান ছিল। সে বাসস্থান এখন তাদের হাতছাড়া। ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে দেখলাম, দু-দিন আগে কলমাকান্দায় একটি হাতি রহস্যজনকভাবে নিহত হয়েছে। জনশ্রুতি এই যে, খাদ্যসন্ধানী হাতিটিকে হত্যা করা হয়েছে।

কয়েক বছর আগে এরকম একটি হাতি জামালপুরের পাহাড়ি এলাকায় নেমে এলে বনবিভাগের লোকেরাই অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ দিয়ে তাকে হত্যা করেছিল। তখন সেই নিহত হাতির শোকে গ্রামের নারীদের কাঁদতে দেখেছি। হাতির জন্য মানুষের এই কান্না কী গভীর মানবিকতায় দীপ্ত! আমরা সবাই যদি এই মানবিক বোধে উজ্জীবিত হতে পারতাম!

নূরুল ইসলামের মতো পাহাড়ি ও অরণ্য অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষদের যেমন বাঁচার অধিকার আছে, তেমনি হাতির মতো বন্যপ্রাণীদেরও বাঁচার অধিকার আছে। মানুষ এবং হাতি কাউকেই যেন এভাবে মরতে না হয়। পৃথিবীতে সবার বাঁচার অধিকার নিশ্চিত হোক। ধম্মপদের সেই পুরোনো কথাটিই স্মরণ করি: সব্বে সত্তা সুখীতা ভবন্তু (বিশ্বের সকল জীব সুখী হোক)।